দোলনচাঁপার সুবাস পর্ব ৩৭

দোলনচাঁপার সুবাস পর্ব ৩৭
তাসফিয়া হাসান তুরফা

বাসায় পৌঁছে নিশীথ লম্বা একটা গোসল শেষে বসার ঘরে আসতে আসতে আধা ঘণ্টা খানেক লেগে গেলো। ততক্ষণে বাকি সবাই নাস্তা সেড়ে বিশ্রাম নিতে বসেছে! ইউনুস তালুকদার নাতিকে দেখে হাসিমুখে পাশে জায়গা করে দিয়ে বললেন,

—এখানে বস, দাদুভাই!
নিশীথ গিয়ে দাদুর পাশে বসলো চুপচাপ। ওকে বসতে দেখে আয়মান সাহেব গম্ভীর কণ্ঠে বললেন,
—খেয়ে নাও, নিশীথ। কিছু কথা আছে তোমার সাথে।
বাবার কথার বিপরীতে নিশীথ বললো,
—আমারও আপনার সাথে কিছু কথা আছে।
আয়মান সাহেব নড়েচড়ে বসলেন। যেন উনি কিছুটা আন্দাজ করতে পেরেছেন নিশীথ কিসের কথা বলতে চাইছে সেভাবেই বললেন,

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

—সব কথা পরে হবে। সারাদিন অফিসে ছিলে, আগে খেয়ে নাও। এরপর বসে ঠাণ্ডা মাথায় সব কথা হবে!
নিশীথ কিছুটা বুঝলো বাবার ইংগিত, তাইতো আর বেশি কথা না বাড়িয়ে চলে গেলো খেতে। খেতে খেতে আরও একবার ভেবে নিলো কীভাবে কথাবার্তায় এগোনো যায় বাবার সাথে। মনে মনে পরিকল্পনা শেষ হতে হতে খাওয়াও শেষ হয়ে গেলো। হাত ধুয়ে বসার ঘরে যাওয়ার আগে নিশীথ আসমা বেগমের উদ্দেশ্যে বল্লো,

—মা, আজকে তোমাদের সবার সাথে একটা জরুরি আলাপ আছে। বসার ঘরে এসো!
—বসার ঘরে তো তোর বাপ-চাচা দাদারা বসে কথা বলছে। আমি ওখানে যেয়ে কি করবো, নিশীথ?
—তোমায় আসতে হবে, মা। যে কথাটা বলতে যাচ্ছি আজ সেখানে আমার মা হিসেবে তোমার উপস্থিতিটাও অত্যন্ত প্রয়োজন। এসো আমার সাথে!

আসমা বেগমের হাত ধরে নিশীথ টেনে নিয়ে এলো তাকে বসার ঘরে। ওরা রুমে ঢুকতেই সকলে চোখ তুলে তাকালো সেদিকে। সবার মনোযোগ নিজের দিকে পেতেই নিশীথ ভাবলো আর দেরি করা উচিত নয়। তাই এবার রাখঢাক না করে ও সরাসরি বললো,
—আপনাদের সবার নিকট আমার একটি আবদার আছে! আমি আশা করছি বরাবরের মতো এবারো আপনারা আমার এই ইচ্ছে পূরণ করবেন।
নিশীথের কথায় আরেফিন সাহেব ভ্রু কুচকে বলেন,

—কি এমন আবদার আছে আমাদের নিশীথের যে এভাবে রিকোয়েস্ট করছিস সবাইকে, হু? তুই কবে থেকে এভাবে কথা বলা শুরু করলি? আগে তো যা মন চাইতো তা সরাসরিই চেয়ে নিতি!
নিশীথ ফোস করে দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললো,
—এ পর্যন্ত যত কিছু চেয়েছি নিজের জন্য তাতে তোমাদের অনুমতি এতটাও গুরুত্বপূর্ণ ছিলোনা, কারণ তোমরা আমার ওইসব আবদারের সাথে সরাসরি যুক্ত ছিলেনা। কিন্তু এবার যা চাচ্ছি, তাতে আমার সাথে তোমরাও ইনডাইরেক্টলি জড়িত।

—তোর কথা আমি কিছুই বুঝতে পারছিনা, নিশীথ। এত ঘুরে পেচিয়ে না বলে সরাসরি বললেই তো পারিস, বাপজান!
আসমা বেগম বিচলিত হয়ে বললেন। তার কথার বিপরীতে নিশীথ বলে,
—মা আমি চাইছিলাম…

—নিশীথ বিয়ে করতে চাইছে। ও চায় আমরা যেন ওর বিয়ের একটা ব্যবস্থা করি, তাইতো?
নিশীথ পুরো কথা বলতে যাবে এর আগেই ওর মুখের কথা ছিনিয়ে নিয়ে আয়মান সাহেব কথাটা বলে দিলেন। আসমা বেগম অবাক হয়ে একবার ছেলের দিকে তো একবার স্বামীর দিকে তাকালেন। নিশীথ মাথা নেড়ে বললো,
—আপনি ঠিক বলেছেন। আমি বিয়ে করতে চাইছি। আমি একজনকে ভালোবাসি। ওকে বিয়ে করে এনে আমাদের সম্পর্কটা পাকাপোক্ত করতে চাই। এজন্যই আপনাদের সাথে এসব কথা বলা।

আসমা বেগম বিস্ময়ের সাথে ছেলের মুখের দিক চাইলেন। তার ছেলের পছন্দের মেয়ে আছে অথচ একবারো তাকে জানালোও না? এটা কোনো কথা! কিন্তু এখানে সকলের সামনে নিশীথকে কিছু বললেন না তিনি। বরং, অভিমানি চোখে ছেলের দিক তাকিয়ে রইলেন শুধু। অন্যদিকে আয়মান সাহেব বেশ স্বাভাবিক ভাবেই বসে রয়েছেন যেন নিশীথ এমন কিছু বলবে এটা তিনি আগে থেকেই জানতেন, অর্থাৎ তিনি বিন্দুমাত্র অবাক অথবা বিচলিত হননি!

আরেফিন সাহেব আড়চোখে ভাইয়ের দিকে তাকালেন। আজকেই ভাইকে বলেছিলেন নিশীথের যদি পছন্দের মেয়ে থাকে তবে কি হবে আর সত্যি সত্যিই তার কথা ফলে গেলো! এরই মাঝে আয়মান সাহেব থমথমে মুখে বললেন,
—তো কে সেই মেয়ে যাকে বিয়ে করতে তুমি এত মরিয়া হয়ে উঠেছো? ডিটেইলস এ বলো শুনি। সবকিছু না জেনেশুনে তো আর বিয়ের মতো ব্যাপারে ফট করেই কিছু বলা যায়না, তাইনা?

আয়মান সাহেবের কথায় নিশীথ একটু অবাক হলো প্রথমে, উনি এত স্বাভাবিকভাবে ওর পছন্দের মেয়েকে দেখতে চাইছেন বিষয়টা পুরোটা হজম হলোনা। তবুও মনে মনে একটু খুশি হলো এই ভেবে যে, ওর বাবা হয়তো এ প্রথম ওর খুশির কথা ভেবে দোলাকে দেখতে চাইছে! তাই ও হাসিমুখে ফোন ঘেটে দোলার ছবি বের করে বাপ-চাচার দিকে মোবাইল তাক করে বললো,

—এই যে! ওর নাম দোলনচাঁপা। দাদু চিনে ওকে। দেখাও হয়েছে দাদুর সাথে এর আগে!
নিশীথ এর হাত থেকে ফোন নিয়ে আয়মান সাহেব চোখ সরু করে ফোনের দিকে তাকালেন। নিশীথের ওয়ালপেপারে হাস্যোজ্জ্বল দোলনচাঁপার সুশ্রী মুখ দেখে মনে মনে খানিকটা মুগ্ধ না হয়ে পারলেন না! আরেফিন সাহেব ভাইয়ের হাত থেকে ফোন নিয়ে ততক্ষণে দোলাকে দেখে ফেলেছে। উনার দোলাকে পছন্দ হয়েছে এমন ভংগিতে নিশীথের উদ্দেশ্যে বললেন,

—মেয়েটা তো ভীষণ মিষ্টি রে, নিশীথ। দেখলে ভাইজান? আমার ভাতিজার পছন্দ আছে বলতে হবে!
চাচুর কথায় নিশীথ গর্বের সহিত ইষত হাসলো। ছোট ছেলের কথায় সায় দিয়ে ইউনুস সাহেব বললেন,
—মেয়েটা যে শুধু দেখতেই মিষ্টি তা নয়, আরিফ। ওর কথাবার্তাও বেশ নম্র। এত ভদ্র একটা মেয়ে! ওকে দেখলেই আমার ভীষণ মায়া লাগে।
আরেফিন সাহেব হাসলেন বাবার কথায়। এদিকে আয়মান সাহেব এখনো থমথমে মুখে বসে থাকায় ইউনুস সাহেব বড়ছেলের উদ্দেশ্যে বললেন,

—তোর কি দোলনচাঁপাকে পছন্দ হয়নি, আয়মান? কিছু বলছিস না যে?
—আমার পছন্দ দিয়ে আর কি হবে, বাবা? তোমার নাতি তো নিজেই নিজের জন্য মেয়ে পছন্দ করে ফেলেছে। এখন আমাদের পছন্দ-অপছন্দে আবার কি যায় আসে?
নিশীথের চোখমুখ শক্ত হয়ে এলো বাবার কথা শুনে। কিছুক্ষণ চুপ থেকে হঠাৎ প্রশ্ন করে বসলো,

—কি কারণে দোলনচাঁপাকে আপনার পছন্দ হলোনা আমি কি জানতে পারি?
আয়মান সাহেব কিঞ্চিৎ হাসলেন। বসা থেকে উঠে দাঁড়ালেন। নিশীথের দিক এগিয়ে এসে বললেন,
—তোমার দোলনচাঁপা সম্পর্কে তো এখনো কিছুই জানলাম না যে পছন্দ হবে। ও কি করে, কোথায় পড়ে, কোথায় থাকে, ওর বাবা কি করে এসব না জেনেই কিভাবে পছন্দ করবো বলো?
নিশীথ কিছু একটা বলতে যাবে এর আগেই আয়মান সাহেব হঠাৎ বললেন,

—আর সবচেয়ে বড় কথা, মেয়েটা আমাদের স্ট্যাটাসের সাথে যাবে কিনা সেটাও দেখতে হবে। বিয়ের মতো সম্পর্ক তো হুট করেই আর করা যায়না তাইনা? তাহলে সবকিছু না জেনে আগেই আমার কেন ওকে পছন্দ করতে হবে?
নিশীথ এবার ক্ষেপে গেলো। বাবার ইংগিত বুঝতে পেরে ও বুঝলো তিনি কি বুঝাইতে চাইছেন! তাই হঠাৎ ও বললো,
—আপনার ছেলের দোলনচাঁপাকে পছন্দ এই একটা কারণই যথেষ্ট হওয়া উচিত ওকে পছন্দ করার জন্য! এটাই আমি মনে করি।

দোলনচাঁপার সুবাস পর্ব ৩৬

আয়মান সাহেব চমকে উঠলেন। অপরদিকে নাতির কথায় ইউনুস সাহেব হেসে উঠলেন। আরেফিন সাহেবও হাসলেন হালকা। এরা বাপ-ছেলে দুটোই সমান ত্যাড়া। কথায় এদের একেকজনের সাথে পেরে উঠা যাবেনা! এখন দেখা যাক বাপ-ছেলের বাকবিতন্ডার এ পাল্লায় এবার কে জিতে!

দোলনচাঁপার সুবাস পর্ব ৩৭ (২)