নিষ্প্রভ প্রণয় পর্ব ২৭

নিষ্প্রভ প্রণয় পর্ব ২৭
একান্তিকা নাথ

নীরের জম্মদিনের আয়োজন করা হলো বেশ সাধারণ ভাবে।আর পাঁচটা সাদামাটা বাঙ্গালি অনুষ্ঠানের মতোই।বাড়িতে গুঁটিকয়েক লোকজনও সেই উপলক্ষ্যে।সেতু তখন কাজে ব্যস্ত।শ্বাশুড়ি অসুস্থ।নীরুও রান্নায় সাহায্য করেছে। নিলিও হাত লাগিয়ে কাজ সামলাচ্ছে বেশ ।

এমন না যে নিলির সাথে সেতুর সম্পর্কে খুব একটা ভাব এসেছে। নিলির সাথে তার সম্পর্কটা বরাবরই একটা নির্দিষ্ট সীমা পর্যন্ত।তবে এইটুকু অন্তত সে জেনেছে যে, নিলি বাইরে বাইরে গম্ভীর রূপ দেখালেও ভেতরে ভেতরে এই পরিবারের বাদ বাকিদের মতোই নরম মনের। সেতু হাসল৷ ব্যস্ততার ভীড়ে নিলি এটা ওটা করে দিলেও তাদের দুইজনের খুব একটা কথা হলো না।

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

তবুও হাতের কাজ কত দক্ষভাবে সামলে নিচ্ছে নিলি।সেতু তাকিয়ে তাকিয়ে দেখল।নিষাদ এক দুইবার এসে দেখে গেল সবটা। শেষবার এসে যখন দেখল নিলি আর নীরু নেই সেইখানে তখনই সেতুর সামনে কোমড়ে হাত রেখে দাঁড়াল।পকেট থেকে রুমাল এগিয়ে হঠাৎ বলে উঠল,

” উহ!ঘেমে গিয়েছো তুমি।ঘাম মুঁছে নিয়ে ফ্রেশ হতে যাও।”
সেতু চোখ তুলে চাইল।রুমালটা না নিয়েই নিজের মতো কাজ করতে লাগল।নিষাদ ঠোঁটে ঠোঁট চাপল। দীর্ঘশ্বাস ফেলে শুধাল,

” কি বলেছি শুনলে না তুমি?”
সেতু এবারও উত্তর দিল না।নিষাদের এবার রাগ লাগল।দাঁতে দাঁত চেপে বলে উঠল,
” তুমি কি আমায় পাত্তা দিচ্ছো না সেতু?”
সেতু এবার ক্লান্ত চোখে তাকাল।মোটামুটি কাজ শেষ তার।দু পা বাড়িয়ে মৃদু আওয়াজ তুলে বলল,

” দিচ্ছি তো পাত্তা।”
” তবে কথা বলছো না কেন?তুমি কি কানে শুনতে পাও না?এতগুলো কথা বলছি অথচ উত্তর দিচ্ছো না।”
” আপনি কাজের মাঝে শুধু শুধু কথা বাড়ান তাই কথা বলছিলাম না।”
” আমি কথা বাড়াই?”
” তো এতক্ষন ধরে কথা বাড়াচ্ছে কে?আমি?”

সেতু কথাটা বলেই সেই স্থান ত্যাগ করার উদ্দেশ্যে পা বাড়াল।মুহুর্তেই পেছন থেকে চিকন হাতে টান অনুভব হলো।ফলস্বরূপ দুই পা বাড়িয়েই তাকে থামতে হলো।ঘাড় ঘুরিয়ে নিষাদের দিকে চাইতেই নিষাদ রুমাল এগিয়ে সেতুর কপালে ছোঁয়াল।ঘাম মুঁছে দিয়ে কপালে আসা ছোট চুলগুলো গুঁজে দিল কানের পেছনে।তারপর বলল,
” এইবার ঠিক আছে।যাও তৈরি হয়ে আসো।ছেলের জম্মদিন অথচ ছেলের জননীই হাজির নেই। ”
সেতু ক্ষীণ দৃষ্টিতে একবার তাকিয়ে বলল,

” হাত ধরেছেন কেন?বাড়িভর্তি মানুষ।হাত ছাড়ুন।”
” তুমিই তো চাইছিলে তোমার হাতটা ধরি, রুমাল দিয়ে মুখের ঘাম মুঁছে দিই।কি চাও নি?”
” কেন চাইব?”
নিষাদ গম্ভীর স্বরে বলল,

” না চাইলে তো বলামাত্রই কাজ করে ফেলার কথা।যেহেতু করোনি সেহেতু তুমি মনে মনে চেয়েছো এসব।”
সেতু ক্লান্ত গলায় শুধাল,
” হ্যাঁ চেয়েছি।হয়েছে?এবার হাত ছড়ুন দয়া করে।”
” না ছাড়লে?না ছাড়লে কি করবে তুমি?”

কথাটা বলেই নিষাদ হাত ছাড়ল।ঠোঁট চওড়া করে হেসে পা বাড়িয়ে মুহুর্তেই সেই স্থান ছেড়ে গেল।সেতু ক্লান্ত চাহনীতে তাকিয়ে রইল সেদিক পানে।এতক্ষন না হাসলেও এইবার নিঃশব্দে হেসে ফেলল সে।নিষাদ কিছুটা গিয়ে নিলির হাতে গ্লাস সমেত জল এগিয়ে দিয়ে বসাল।হেসে বলল,

” দিদি, কাজ তো অনেক করেছো।যাও এবার কিছুক্ষন বিশ্রাম নাও।বাকিসব হয়ে যাবে।”
” বিশ্রাম নিলে কে সামলাবে এসব?মাও অসুস্থ। ”
নিষাদ মৃদু হেসে বলল,
” সামলানো হয়ে যাবে।তুমি যাও, কিছুটা সময় রেস্ট নাও।”
নিলি একপলক চাইল।নিষাদ আবারও বলে উঠল,
” আমি আছি, সামলে নিব।হুহ?”
নিলি হাসল। নিষাদকে সেই ছোটবেলা থেকে দেখে এসেছে সে।কবে যে বড় হয়ে গেল খেয়ালই করা হয়নি যেন।

অনুষ্ঠানের তোড়জোড়ের মাঝেই নীরু বেশ উৎসাহ নিয়ে এদিক ওদিক তাকাল।রঙ্গন আসল না?হতাশ মুখে সামনে তাকাতে চোখে পড়ল দিয়াকে।কি ভীষণ সুন্দর দেখাচ্ছে কালো শাড়িতে।সাদা ধবধবে শরীরে বেশ মানিয়েছে শাড়িটা।নীরু হাসল।এগিয়ে গিয়ে দিয়াকে উদ্দেশ্য করে বলল,
” তোমায় কি ভীষণ মিষ্টি লাগছে দিয়া দি।”
দিয়া পাশ ফিরে তাকাল।মৃদু হেসে বলল,

” তোমায়ও নীরু।সাঁজলে না কেন?সাঁজলে আরো ভীষণ সুন্দর লাগত।”
নীরু আপসোসের সুরে বলল,
” আমি সাঁজলেও কেউ চোখ তুলে তাকায় না দিয়া দি।তাই কষ্ট করে সাঁজার থেকে না সাঁজা ভালো না?”
” চোখ তুলে তাকানোর জন্যই বুঝি সাঁজে মানুষ?”
নীরু দাঁত কেলিয়ে হেসে বলল,

” জানি না, যায় হোক তুমি কিন্তু থাকবে হু?আমি তোমাদের জন্য বিশেষ সুযোগ করে দিব ছাদে।আজই ভুল বুঝাবুঝি মিটিয়ে নিও।বেস্ট অফ লাক।”
দিয়া হালকা হেসে বলল,

“আমি নিজের দিক থেকে সর্বোচ্চ চেষ্টা করব ।বাকিটা রঙ্গনের কাছে নীরু।”
” উহ!উনিও তোমায় ভালোবাসে। মুখে বলতে পারছে না শুধু অভিমানের কারণে।”
কথাটা বলে নীরু আবারও এদিক ওদিক চাইল।রঙ্গন এখনও আসে নি। কি আশ্চর্য!এত দেরি হচ্ছে কেন?ভাবতে ভাবতেই হাতে টান পড়ল।নীর হাত ধরে টানছে।নীরু মুচকি হেসে নীরের সাথে পা বাড়াল।

সেতু মাত্রই চোখেমুখে জল দিয়ে বের হলো। পরনের শাড়িটা খুলে অন্য শাড়িটা হাতে নিতেই দরজায় টোকা পড়ল।সেতু ভ্রু কুঁচকাল।ওপাশ থেকে নিষাদ বলে উঠল,
” এই সেতু?দরজা আটকে বসে আছো কেন?দরজা খুলো।”
সেতু হতাশ হলো।সবসময় এই লোক কোথায় থেকে উদয় হয়?মৃদু আওয়াজে বলল,

” আমি একটু পর বের হচ্ছি। আপনি যান।”
” তুমি ভেতরে এতক্ষন কি করছো?নীর খুঁজছে তোমায়।”
” কাজ করছি আমি।”
” দরজা খুলো, আমি ডুকবো আর বের হবো।”
সেতু মৃদু গলায় বলল,
” আমি শাড়ি পরছি নিষাদ।আপনার কি খুব জরুরী কোন কাজ আছে?জরুরী না হলে দয়া করে কিছুক্ষন অপেক্ষা করুন।”

” এটা খুবই জরুরী কাজ।তুমি দরজা খুলতে এত সময় নিচ্ছো কেন?আশ্চর্য!”
ভেতরে দাঁড়িয়ে থাকা সেতু চোখ ছোট ছোট করল।হাতের শাড়ীটা কোনরকম শরীরে পেঁচিয়ে দরজা খুলল।ওপাশ থেকে নিষাদ হুড়মুড়িয়ে ঘরে ডুকল।দ্রুত পায়ে রুমে ডুকল নীর সহ। সেতু মিষ্টি হাসল।হাঁটু গেড়ে বসে নীরের দুই হাত ধরে বলল,

” শুভ জম্মদিন বাবা।অনেক অনেক বড় হও তুমি। মা সবসময় তোমায় ভালোবাসে।”
নীর হাসল।ছোট হাতজোড়া দিয়ে সেতুকে আলতোভাবে জড়িয়ে ধরল।কিছু সময় পর সরে গিয়ে সেতুর দিকে ভালোভাবে তাকাল।মুখ কুঁচকে বলে উঠল,
” মা,তুমি কোথায় ছিলে?এতসময় খুঁজছি আমি। লেডি হও নি কেন তুমি এখনো?”
সেতু হাসল ঠোঁট টেনে।নীরের গালে চুমু খেয়ে বলল,

” রেডি?রেডি হতেই তো ব্যস্ত ছিলাম, তোমরা তো সেই সুযোগ দিলে না।দরজা খোলার জন্য আন্দোলন শুরু করে দিলে।”
নীর বাধ্য ছেলের মতো বলল,

” আচ্ছা তুমি লেডি হয়ে নাও।আমি বাবা কি এনেছে তা দেখে চলে যাব।”
সেতু আর নিষাদ দুইজনই হাসল এবার।নিষাদ হাঁটু গেড়ে একটা বক্স এগিয়ে দিল। মুচকি হেসে বলল,
” এতে তোমার জন্য লাল টুকটুকে একটা বউ এনেছি।তোমার অতি আগ্রহ দেখে লাল টুকটুকে বউয়ের দায়িত্ব তোমার উপর এখনই দিয়ে দিলাম কেমন?সুখে সংসার করো বাবা।”
কথা গুলো বলেই নিষাদ হেসে উঠল।নীর ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে বলল,

” আমি তো বউ চাইনি।”
” চাও নি তো কি হয়েছে?এটা বাবা তোমায় উপহার দিয়েছে।বুঝলে?”
নীর মাথা ডানে বামে দুলিয়ে বলল,
” না, বুঝিনি।”

নিষাদ আবারও হাসল।পাশ থেকে আরো কয়েকটার খেলনার বক্স এগিয়ে দিয়ে বলল,
” কিন্তু আমি বুঝেছি তোমার কি চাই।এগুলো খুলে দেখে নাও তুমি যা চাও তা আছে কিনা।তবে বউও তোমায় নিতে হবে।ঠিকাছে?”

কথাগুলো বলে নিষাদ চোখ টিপল।দাঁত কেলিয়ে হেসে নীরের দিকে তাকাতেই দেখল নীর খুশি হলো।মুখে প্রাণবন্ত হাসি তার। নীর ওখান থেকে একটা বক্স নিয়েই দৌড়ে চলে গেল।নিষাদ সেদিক পানে তাকিয়ে আবারও হাসল৷ সেতুর দিকে তাকিয়ে ভ্রুঁ কুঁচকে বলল,
“একি! তুমি শাড়ি পরতে পারো না?”
সেতু অসহায় চোখে তাকাল।মৃদু গলায় উত্তর দিল,

” মানে?”
নিষাদ ত্যাড়া কন্ঠে বলে উঠল,
” শাড়ি পরতে পারলে কেউ এমনভাবে শাড়ি পরে?কি বিচ্ছিরি রকম শাড়ি পরেছো।”
সেতু নিজের দিকে একবার চাইল।তখন তাড়াতাড়ি করে কোনরকম শাড়ি পেঁচিয়েছিল কেবল।নিষাদ যে ইচ্ছে করেই কথা গুলো বলছে তা বুঝতে পেরেই চোখ সরু করল।বলল,

” বিচ্ছিরি হলে বিচ্ছিরি।আমার তো বিচ্ছিরে শাড়ি পরাতে কোন সমস্যা হচ্ছে না।”
” আমার সমস্যা হচ্ছে।সবাই বলবে নিষাদের বউ শাড়ি পরতে পারে না।”
সেতু নরম গলায বলল,

” ওহ।”
নিষাদ ভ্রু উঁচিয়ে বলল,
” ওহ কি?সুন্দর করে শাড়ি পরো। ”
” আপনি যান আগে।”
” না গেলে?না গেলে কি করবে তুমি?”
সেতু হতাশ কন্ঠে বলল,

” সুন্দর করে শাড়ি পরব না।এবার বলুন, যাবেন কি যাবেন না?”
” যাব না।”
কথাটা বলেই ঠোঁট গোল করে সেতুর মুখের উপর ফু ছাড়ল নিষাদ।দাঁত কেলিয়ে হেসে ফিসফিসি করে বলল,
” যাচ্ছি,তবে যাওয়ার বদলে ফিরতি ভালোবাসা পাওনা রইল।হুহ?”

রঙ্গনের পরনে কালো রংয়ের পাঞ্জাবি।লম্বা চওড়ায় সুদর্শন পুরুষটির শরীর কালো পাঞ্জাবীতে নজর কাড়া বোধ হলো নীরুর কাছে।ড্যাবড্যাব করে কিছুটা সময় তাকিয়ে থেকে বার কয়েক শ্বাস ফেলল।বুকের ভেতর কেমন জানি অনুভূতি হলো।সুপ্ত ভালো লাগায় ভরে উঠল হৃদয়। মুহুর্তেই আবার মন খারাপ হলো।দিয়া রঙ্গন দুইজনেরই পরনে কালো রংয়ের পোশাক।

দুইজনই সুন্দর।দুইজনকেই নজরকাড়া সুন্দর বোধ হচ্ছে।দুইজনের কত মিল!নীরু নিজের মাথায় নিজেই চাটি মারল।কিসব আজেবাজে ভাবনা।একই রংয়ের পোশাক পরলেও তার কি?মৃদু শ্বাস ফেলে দ্রুত পায়ে এগিয়ে রঙ্গনের সামনে দাঁড়াল। চঞ্চল গলায় শুধাল,
” কেমন আছো গাধা?”

রঙ্গন অন্যদিকে তাকিয়ে ছিল।পরিচিত কন্ঠ কানে যেতেই চোখ ফিরিয়ে তাকাল সেদিক পানে।মুহুর্তেই চোখের দৃষ্টি স্থির হলো।কতগুলো দিন, কতগুলো বছর পর এই মেয়েটাকে সামনাসামনি দেখা।ইচ্ছে হলো মুহুর্তেই নিজের মধ্যে জমিয়ে রাখা সকল কথা, সুপ্ত অনুভূতি সবটা প্রকাশ করতে। কিন্তু পারল না।চোখজোড়ার দৃষ্টি একই রেখেই তাকিয়ে থাকল ।অনুষ্ঠানের বাদ বাকিদের মতো অতোটা সাঁজ নেই সামনের মেয়েটাতে।পরনে ছাঁইরাঙ্গা একটা গোল জোমা।গলায় ওড়না পেঁছানো।চুলগুলো বেনুনি করা থাকলেও অগোছাল দেখাচ্ছে কেমন।মুহুর্তেই মনে পড়ল, আগের নীরুর চুলগুলো ছিল কাঁধ অব্ধি!রঙ্গন হেসে বলল,

” এমন পাগলের মতো হয়ে আছিস কেন? লোকজন কি বলবে?”
নীরু ভ্রু উঁচিয়ে চাইল।ঠোঁট চেপে বলল,
” পাগল?আমাকে পাগলের মতো লাগছে তোমার কাছে?”
” তো?তোকে কি অসম্ভব রূপবতী কিংবা মুভির নায়িকা টাইপ লাগবে? পাগলকে পাগলের মতোই লাগে সবসময়।”
রঙ্গন কথাটা মজা করে বললেও নীরুর মন খারাপ হলো মুহুর্তেই।বুকের ভেতর বিষাদ ছুঁয়ে গেল।আড়চোখে একবার বেশ কিছুটা দূরে দাঁড়ানো দিয়ার দিকে তাকাল।অসম্ভব সুন্দরী, রূপবতী, সাদা ধবধবে রমণী।সেদিক থেকে সে অতি নগন্য।মনে মনে গায়ের শ্যামলা রং নিয়ে বেশ আপসোস ও করল।নরম গলায় বলল,

” আমি সুন্দরী নই বলে এমনটা বললে?শোনো, আমি সুন্দরী নাই হতে পারি। তবে আমি নিজেকে রূপবতী কিংবা নায়িকাও দাবি করিনি কখনো।”
রঙ্গন অবাক হয়ে বলল,
” ওমাহ!তুই হঠাৎ এমন নরম হয়ে গেলি কেন?ঝগড়া না করে মেনে নিচ্ছিস সবটা?”
” যেটা সত্যি সেটা মেনে নিতে আমার কোনকালেই সমস্যা হয় নি।যায় হোক, তোমার সারপ্রাইজ?মনে আছে সারপ্রাইজের কথা?”

রঙ্গন হাসল। নীরুর দিকে তাকিয়ে হালকা ঝুঁকল।কানের কাছে ফিসফিসিয়ে বলে উঠল,
” তোর জন্য রিটার্ন সারপ্রাইজ অপেক্ষা করছে নীরু। ”
নীরু উৎসাহ নিয়ে প্রশ্ন ছুড়ল,
” কি সারপ্রাইজ?”
” বলে দিব?বলে দিলে সারপ্রাইজ থাকে নাকি পাগল?”
“আমি সারপ্রাইজ পেতে পেতে একদম সারপ্রাইজের চূড়ায় পৌঁছে যাই। বুঝলে?তাই আগে থেকে জেনে নিলে ভালো না?”

রঙ্গন হাসল।বাঁকা হেসে উত্তর,
” এবারের সারপ্রাইজে তুই সত্যি সত্যিই সারপ্রাইজের চূড়ায় পৌঁছে যাবি নীরু।”
নীরু ঠোঁট বাঁকিয়ে বলল,
” বাহ!”

রঙ্গন দৃষ্টি সরু করল।নীরুর কপালে আসা অগোছাল চুল গুলোতে ফু লাগিয়ে বলল,
” চল সারপ্রাইজটা দিয়ে ফেলি।হু?ছাদে চল।”
নীরুর বাঁধা দিল।চঞ্চল গলায় বলে উঠল,
” এ্যাঁ, একদম না।ছাদে আমি সারপ্রাইজ দিব ভেবে রেখেছি।আগে আমার সারপ্রাইজ, তারপর তোমার সারপ্রাইজ।”
রঙ্গন মেনে নিল। বলল,

” ঠিকাছে,আগে তোর সারপ্রাইজ।একটু তাড়াতাড়ি কর তাহলে।”
নীরু ফোঁড়ন কেঁটে বলল,
” কি ব্যাপার বলোতো? আমি কি সারপ্রাইজ দিব তা আগে থেকেই কি জেনে নিয়েছো নাকি?নয়তো এত তাড়া কেন?”

” সারপ্রাইজ পাওয়ার থেকেও সারপ্রাইজ দেওয়ার জন্য আমি বেশি উদ্গ্রীব হয়ে আছি। অনেকদিনের প্ল্যান এই সারপ্রাইজটা দেওয়ার, কিন্তু পেরে উঠিনি।আজ সুযোগ মিলেছে বুঝলি?তাই দেরি করতে চাইছি না।”
নীরু হালকা হাসল।আলতো হাতে রঙ্গনের হাতটা টেনেই সামনে এগিয়ে গেল।দিয়ার সামনে এনেই খিলখিলিয়ে হেসে বলে উঠল,

” অবশেষে তোমাদের দুইজনকে একই স্থানে, একই সাথে দেখার ইচ্ছেটা আমার পূর্ণ হলো।দুইজন একসাথে দাঁড়াও প্লিজ।একটা ছবি তুলে নিই?প্লিজ।”
রঙ্গন একবার তাকাল।মুহুর্তেই এতক্ষনের খুশি থাকা মুখটা কঠিন হলো।চোয়াল শক্ত হলো।নীরুর হাত থেকে হাতটা ছাড়িয়ে নিয়েই চোখ রাঙ্গিয়ে চাইল নীরুর দিকে।নীরুর অবশ্য পাত্তা দিল না।জোর করেই দিয়া আর রঙ্গনকে একসাথে দাঁড় করিয়ে ছবি তুলতে লেগে গেল।দাঁত কেলিয়ে বলল,

” কি সুন্দর জুটি তোমরা। দিয়া-রঙ্গন!একদম পার্ফেক্ট!আমি কিন্তু খুব শীঘ্রই তোমাদের বিয়ে খেতে চাই। বুঝলে?”
কথাগুলো বলতে বলতেই একটা ছবি তুলল।তাও রঙ্গনকে স্থির দেখাল না সেই ছবিতে। নীরু মাথা উঁচিয়ে মোবাইল থেকে চোখ ফিরিয়ে রঙ্গনের দিকে তাকাতেই দেখল রঙ্গন সরে গিয়েছে সেখান থেকে। নীরু হতাশ হলো।ভ্রু উঁচিয়ে বলল,

” কি হলো?সরে গেলে কেন তুমি?”
রঙ্গন রাগল। দাঁতে দাঁত চেপে নীরুর দিকে এগিয়ে নীরুর হাতটা চেপে ধরেই বলল,
” তোর সাথে কথা আছে আমার। একটু চল আমার সাথে।”
নীরু চোখ ছোট ছোট করে তাকিয়ে বলল,

” তুমি কিন্তু আগে আমার সারপ্রাইজ বলেছো।সুতারাং আগে আমার সারপ্রাইজ।হুহ?”
রঙ্গন এবার নিজের রাগকে নিয়ন্ত্রন করার চেষ্টা করল।শক্ত গলায় বলল,
” ঠিকাছে, পাঁচ মিনিট।পাঁচ মিনিটের মধ্যেই তোর সারপ্রাইজের সমাপ্তি ঘটাতে হবে।”
নীরু মাথা নাড়িয়ে বলল,

” ঠিকাছে, তুমি তাড়াতাড়ি ছাদে যাও।সারপ্রাইজ অপেক্ষা করছে তোমার জন্য।”
রঙ্গন মুখচোখ কঠিন রেখে পা বাড়াল ছাদের দিকে।নীরু মলিন হেসে দিয়ার দিকে ইশারা ছুড়ল। জোরজবরদস্তি করে রঙ্গনের পিঁছু পিঁছু পাঠাল দিয়াকেও।

পাঁচ মিনিটের জায়গায় বিশ মিনিট হলো।নীরু এপাশ ওপাশ চাইল।রঙ্গন আর দিয়া কেউই এখনোও নামেনি।হঠাৎ সিঁড়ির দিকে নিলিকে যেতে দেখেই হুড়মুড়িয়ে গিয়ে বলল,
” তুমি ছাদে যাচ্ছো কেন?ছাদে কি কোন কাজ আছে? আমায় বলো। আমি যাচ্ছি।”
নিলি বলল,

” উহ!ছাদে মা আচার শুঁকোতে দিয়েছিল।বিকাল গেল, সন্ধ্যা গেল, এখন রাত হলো। তাও আনা হয় নি।”
নীরু তৎক্ষনাৎ বলল,
” ঠিকাছে, আমি আনছি?”
” তাড়াতাড়ি যা।”

নীরু অনিচ্ছা স্বত্ত্বেও পা বাড়াল। সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠতে উঠতে সংকোচ বোধ করল।তবুও উঠল। ছাদের দরজায় উঁকি দিয়ে তাকাতেই সর্বপ্রথম চোখে পড়ল দিয়া রঙ্গনকে জড়িয়ে আছে।খুব দ্রুত কিছু বলেও চলছে রঙ্গনকে।নীরু আর দাঁড়াতে পারল না।বুকের ভেতর মুহুর্তেই কম্পন উঠল।এই দুইজন মানুষকে মিলিয়ে দেওয়ার সম্পূর্ণ ইচ্ছা থাকলেও এই দুইজন মানুষকে একসাথে সহ্য করা তার কাছে মৃত্যুসম বোধ হলো।হয়তো ভালোবাসার মানুষকে অন্য যে কারোর সাথে দেখাই মৃত্যুযন্ত্রনার সম যন্ত্রনা অনুভব করায়।নীরুর চোখ টলমল করল।ঠোঁট কাঁমড়ে কান্না আটকানোর চেষ্টা চালিয়েই দ্রুত নামল সিঁড়ি বেয়ে।কানের কাছে কেউ বলল,

নিষ্প্রভ প্রণয় পর্ব ২৬

” কি হলো নীরু? কান্না পাচ্ছে তোমার?”
নীরু পাশ ফিরে সেতুকে দেখল। এবার আর কান্না আটকে রাখতে পারল না।সেতুকে জড়িয়ে ধরেই কেঁদে দিল নিঃশব্দে।উহ!কি কষ্ট!চোখের সামনে ভালোবাসার মানুষকে অন্য একটা মানুষের সাথে সহ্য করা এতটা কষ্টের?আগে তো এতটা তীব্র কষ্ট অনুভব করে নি সে।হয়তো চোখের সামনে এমন পরিস্থিতি দেখতে হয়নি বলেই আগে এতটা কষ্ট হয়নি।

নিষ্প্রভ প্রণয় শেষ পর্ব