নিষ্প্রভ প্রণয় শেষ পর্ব

নিষ্প্রভ প্রণয় শেষ পর্ব
একান্তিকা নাথ

রঙ্গনের মুখচোখে রাগের আভাস।বুকে হাত গুঁজে নীরুর পেঁছনেই স্থির দাঁড়িয়ে রইল।নীরু অবশ্য তা টের পেল না।সেতুকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতেই ব্যস্ত সে।রঙ্গন বেশ কিছুক্ষন তা নিশ্চুপে দেখে গেল।অবশেষে গম্ভীর স্বরে বলে উঠল,
“কতক্ষন যাবৎ এমন কান্না করছিস? কেনই বা কান্না করছিস? আশ্চর্য!”

নীরু মুহুর্তেই ঘাড় ঘুরিয়ে রঙ্গনের দিকে চাইল।পরিচিত মুখ চোখে পড়তেই দ্রুত কান্না থামানোর চেষ্টা করল।দুই হাতের তালুতে ব্যস্ত হয়ে চোখের পানি মুঁছে ত্যাড়া কন্ঠে জবাব দিল,
” মন চাইছে তাই কান্না করছি।”

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

রঙ্গন সরু চাহনীতে নীরুর দিকে চাইল এবার।কান্না করার কারণে চোখ লাল হয়ে আছে, নাকের অগ্রভাগ ও বেশ লালচে দেখাচ্ছে।অগোছাল চুল আরো অগোছাল বোধ হলো।কন্ঠে চাপা রাগ সমেতই রঙ্গন বলল,
” মন চাইছে নাকি নিজের কান্নার ব্যবস্থা নিজেই করেছিস?”
” মানে?”
রঙ্গন থমথমে গলায় উত্তর দিল,

” মানে একদম ভালো হয়েছে।আরো কিছুক্ষন কান্না কর।কান্না থামানোর চেষ্টা করছিস কেন?আমি খুশি হবো তুই কান্না করলে।শুধু কান্না না, কান্না করে করে মহাসাগর বানিয়ে ফেল!”
নীরু কান্না থামাল। চোখজোড়া দিয়ে রঙ্গনের দিকে স্পষ্ট চাহনি রেখে বলল,
” আমি জানি, আমার কান্নায় তুমি খুশি হও।যায় হোক,শুভকামনা তোমাদের ভবিষ্যৎ এর জন্য।”

কথাগুলো বলে আর দাঁড়াল না নীরু। দ্রুত পা বাড়াল নিজঘরের উদ্দেশ্যে। কেন জানি না আজ তার কান্না থামছে না।আরো বেশি কান্না করতে হবে তাকে।কেঁদেকেঁটে চোখমুখ ফুলিয়ে বসে থাকতে হবে।তবুও বোধ হয় এই যন্ত্রনার অবসান ঘটবে না।নীরু পা বাড়িয়ে নিজের ঘর অব্দি পৌঁছাতে পারল না।তার আগেই বলিষ্ঠ হাত চেপে ধরল তার হাত।এত জোরে চেপে ধরল যে হাতে কিঞ্চিৎ ব্যাথা ও অনুভব হলো।হতবিহ্বল নয়নে পেছনের মানুষটার দিকে তাকাতেই চোখে পড়ল রঙ্গনের রাগ।দাঁতে দাঁতে চেপে রঙ্গন শুধাল,

” দেখ নীরু, এসব ইমোশনাল ড্রামা ট্রামা আমি পছন্দ করি না।ভালো লাগে না আমার এসব।”
নীরু ভ্রু কুঁচকে শুধাল,
” কিসের ইমোশনাল ড্রামা করেছি?”
” এতক্ষন যে দুঃখের সাগরে ভেসে ভেসে কান্না করছিলি।”
” কি আশ্চর্য!কান্না করা না করা আমার ব্যাপার৷ তোমার জন্য কি কান্নাও করতে পারব না?”
রঙ্গনের স্পষ্ট উত্তর,

” না, পারবি না।আমার ভালো লাগে না।”
” তোমার ভালো লাগলেও কি হবে না লাগলেও কি হবে?”
রঙ্গন ত্যাড়া কন্ঠে জবাব দিল,
” অনেক কিছুই হবে।তোকে বলতে হবে সেসব?”
” না, বলতে হবে না।হাত ছাড়ো।”
রঙ্গন হাত ছাড়ল না।নীরুর কথাকে বিশেষ গুরুত্ব না দিয়ে বলে উঠল,

” ছাড়ব না।”
নীরু কপাল কুঁচকাল।কিছু না বলে ফোঁসফাঁস করে শ্বাস ছেড়ে রঙ্গনের দিক চাইল।হাত মুঁছড়িয়ে ছাড়ানোর চেষ্টা করতে করতেই গলা উঁচিয়ে বলল,
” অ্যাঁ! ছাড়বে না।তুমি ছাড়বে না বললেই হবে নাকি?হাতটা তো আমার।আমার কথাই আগে ফলবে।”
রঙ্গন বিশেষ পাত্তা দিল না নীরুর কথাকে।ঠাঁই দাঁড়িয়ে থেকে নীরু হাত ছাড়ানোর দৃশ্য পর্যবেক্ষন করল শুধু।কিয়ৎক্ষন পর নীরু থেমে গেল।হতাশ মুখে রঙ্গনের দিকে চাইল।রঙ্গন আড়াল করে হালকা হাসল। একইভাবেই শক্ত করে হাত চেপে ধরে থেকে বলল,

” কি হলো?ছাড়াতে পারলি না?জানতামই পারবি না।”
নীরু নিজের ব্যর্থতা স্বীকার করল না।ঠোঁটে ঠোঁট চেপে বলল,
” বিষয়টা তেমন নয়, ছাড়াতে চাইছি না তাই। ”
রঙ্গন ভ্রু কুঁচকে জিজ্ঞেস করল,
” কেন ছাড়াতে চাইছিস না?”
” মন চাইছে না তাই।”

” সত্যিই?নাকি আমি হাত ধরে থাকাতে ভালো লাগছে তোর?”
নীরু মিনমিনে চোখে চাইল।চঞ্চল গলায় বলল,
” মোটেই না।তুমি পরপুরুষ!পরপুরুষ হাত ধরে আছে বিষয়টা আমার কাছে ভালো লাগতে যাবে কেন?প্রচন্ড বিচ্ছিরি ফিলিংস হচ্ছে।হাত ছেড়ে দাও।”

” তুই না ছাড়াতে চাস না বললি?”
” এখন চাইছি, কারণ তুমি পরপুরুষ।”
” তো, তোর আপনপুরুষটা কে শুনি?”
” কেউ না।আমার জীবনে কোন পুরুষ নেই।যে ছিল সেও পরিত্যাক্ত। ”
” কে সে?”

নীরু এই প্রশ্নের উত্তর দিল না।রঙ্গনের দিকে তাকিয়ে গলার আওয়াজ উঁচু করে শুধাল,
“ঘরে যাব।”
রঙ্গন ভ্রু জোড়া কুঁচকে নিয়ে প্রশ্ন ছুড়ল,
” তো?আমি কি করব? ”
” হাত ছাড়ো। ”
” কাজ শেষ হলে ছেড়ে দিব।”
” কি কাজ তোমার?”

“তোকে কিছু বলার আছে। চুপচাপ দাঁড়াবি, শুনবি। তারপর আমি নিজেই হাত ছেড়ে দিব।হু?”
নীরু ছোট্ট শ্বাস ফেলল।বলল,
“বলো। ”
” দিয়ার সাথে আমার বিয়ে হলে কেমন হবে বল তো।”

নীরু যেন মনে মনে ভেবেইছিল রঙ্গন এমন কিছুই বলবে।চোখ টলমল করে উঠল তৎক্ষনাৎ।প্রিয় মানুষের মুখে তারই প্রিয়মানুষের কথা শুনে বুক ভার হয়ে আসল।এতগুলো দিনেও কি এইটুকু ভালোবাসা তার প্রাপ্য ছিল না?অন্তত একটু মায়া হলেও হতে পারত। সমস্ত অনুভূতি, সমস্ত দুর্বলতা জেনেও কি নিষ্ঠুর ভাবে রঙ্গন বলে দিল দিয়াকে বিয়ে করার কথা।এটা কি ইচ্ছে করেই তাকে কষ্ট দেওয়ার জন্য বলল?নীরু ভেতরে ভেতরে কষ্ট পেলেও সামলে নিল নিজেকে।মুখে হাসি টেনে চঞ্চল গলায় বলে উঠল,

” তুমি সুদর্শন পুরুষ, দিয়া দি ও সুন্দরী নারী।অবশ্যই তোমাদের দুইজনকে খুব ভালো মানাবে।আর বিয়ে হলেও বেশ ভালোই হবে।বিয়ের তো বেশ বয়স হয়েছে তোমার।বিয়েটা এবার করেই নাও বুঝলে।আমাকেও কিন্তু নিমন্ত্রন করবে।বেশ আয়েস করে খেয়ে আসব তোমার বিয়ের নিমন্ত্রন।”
” সত্যিই বিয়েটা করে নিব?আমিও তাই ভাবছিলাম। বিয়ের বয়স পেরিয়ে গেলে তো সমস্যা!”
” হু, করে নাও শীঘ্রই!”

রঙ্গন হাতের বাঁধন আলগা করল।হালকা ঝুঁকে নীরুর কানের কাছে ফিসফিসিয়ে শুধাল,
” আচ্ছা আরেকটা বিষয়, আমি যদি তোর আপন পুরুষ হই তবে কেমন হবে?”
নীরু স্থির দৃষ্টিতে কিয়ৎক্ষন তাকিয়ে রইল।তারপর মৃদু আওয়াজ তুলে বলে উঠল,
” তুমি আমার কাছে বরাবরই আপন পুরুষ। মনের পুরুষও বলতে পারো।এই বিষয়ে তো কোনকালেই কোন দ্বিধা ছিল না।আজও নেই।”

কথাগুলো বলেই নীরু হাত ছাড়িয়ে নিল।টলমলে চোখ নিয়ে মুহুর্তেই সেই স্থান ত্যাগ করল।রঙ্গন ক্লান্ত চাহনীতে তাকিয়ে রইল সেদিক পানে।আজও বলা হলো না কথাটা।নীরুকে বলতে চেয়েছিল এক কথা, বুঝে নিয়েছে অন্য কথা।ইচ্ছে ছিল আজ নীরুর সমস্ত কষ্টের অবসান ঘটিয়ে নতুন কিছুর সূচনা ঘটাবে। কিন্তু হলো না। বরাবরের মতোই এবারও নীরু একবুক কষ্ট নিয়ে মুখে হাসি টেনে চলে গেল।রঙ্গনের মন খারাপ হলো।হতাশায় চোখ ছোট ছোট করে শ্বাস ফেলল সে।দৃষ্টি ঘুরিয়ে এদিক ওদিক নিষাদকে খুঁজল।যেই নিষাদকে দেখতে পেল ওমনিই পা বাড়াল।একপ্রকার নিষাদকে টেনে এনেই বলে উঠল,

” আমায় হেল্প কর।তোর আর সেতুর প্রথম সাক্ষাৎয়ের সময় তো আমার থেকে বেশ পরামর্শ নিতি।আমিও পরামর্শ দিয়েছি। দিই নি?সাহায্য তো করেছি বল?”
নিষাদ ঠোঁট চেপে বলল,
” তো?এখন তুই কি রিটার্ন পরামর্শ চাইছিস?”
রঙ্গন মুখ কাঁচুমুচু করে উত্তর দিল,

” নীরুকে ভালোবেসে ফেলেছি।বিশ্বাস কর মিথ্যে বলছি না।”
নিষাদ একনজর তাকিয়ে বলল,
” দিয়া?দিয়ার প্রতি ভালোবাসা?”
রঙ্গন কিয়ৎক্ষন চুপ থেকে বলতে লাগল,

” আমি দিয়াকে ভালোবাসতাম।তারপর দিয়া যখন ছেড়ে চলে গিয়েছিল তখন আমি জানি কতটা কঠিন মুহুর্তের সম্মুখীন হয়েছিলাম।তুই জানিসই সব।তারপর থেকেই নীরুর পাগলামোর সম্মুখীন হই। কখনো হুটহাট দেখা করে জোরপূর্বক ফুচকা খেতে নিয়ে যাওয়া, কখনো মাঝরাতে কল করে বিরক্ত করা! আমি প্রথম প্রথম বিরক্ত হতাম।তারপর ধীরে ধীরে তা আমার অভ্যাসে পরিণত হলো।

তারপর একটা সময় পর যখন আমার বিয়ে ঠিক হলো তখনই বুঝলাম আমি কি রকম ফেঁসে গেছি এই অভ্যাসে।দিয়ার প্রতি আমার তখন শূণ্য অনুভূতি।তবে হ্যাঁ, প্রথম প্রেমের স্মৃতি রঙ্গিন হয়।আমার সেই স্মৃতি এখনো মনে আছে।তখনও মনে ছিল তবুও আমি দিয়ার প্রতি দ্বিতীয়বার দুর্বলতা অনুভব করতে পারলাম না তখন।নীরু তখন হুট করেই আমায় বিরক্ত করা ছেড়ে দিল।

আমার কেমন যেন অস্থির লাগছিল, নীরুর হাসিও সহ্য হচ্ছিল না তখন।আমি তখনও বুঝতে পারলাম না কি সাংঘাতিক মায়ায় আমি তলিয়ে যাচ্ছি।তারপর নীরুর জন্য বিয়ের প্রস্তাব পাঠানো হতে, দেশ ছেড়ে যাওয়া সব ঠিক ছিল।তারপর হঠাৎই বুঝলাম আমার জীবনে দুই নারীতে আমি দুইভাবে জড়িয়েছি।দিয়ার ক্ষেত্রে আমি প্রেমে পড়েছিলাম, আর নীরুর ক্ষেত্রে আমি মায়ায় পড়েছিলাম।দিয়া আমায় প্রেমে বেঁধেছিল, আর নীরু আমায় মায়ায় বেঁধেছে।আমি সত্যিই নীরুর প্রতি অনুভূতিপ্রবণ নিষাদ।বিশ্বাস কর।”

” এখন অনুভূতিপ্রবণ ঠিকাছে, কিন্তু তারপর একটা সময় পর যদি দিয়ার মতো নীরুর প্রতিও তোর অনুভূতি শূণ্য হয়ে যায়?ছুড়ে ফেলে দিবি নীরুকে?”
” ঐ যে বললাম, একজন আমায় প্রেমে বেঁধেছে অন্যজন মায়ায়।প্রেম বিষয়টা একটা সময় পর হয়তো ফ্যাকাসে হয়ে যায়, কিন্তু মায়া ফ্যাকাসে হয় না।এই মায়ার জন্যই বিনা রূপে, বিনা যৌবনে বৃদ্ধ বয়সে ও একটা মানুষ আরেকটা মানুষের পাশে থাকে।তবুও যদি কখনো এমন মুহুর্ত আসে যে নীরুর প্রতি আমার অনুভূতি শূণ্য হয়ে এসেছে তবে আমি নির্দ্বিধায় নিজেকে আড়াল করব।ছুড়ে ফেলার বদলে ছেড়ে যাব।কারণ তখন তুই আর নীরু কারোর সামনেই আমি দ্বিতীয়বার মুখ দেখানোর যোগ্য থাকব না।”

নিষাদ হালকা হাসল।বলল,
” আমার দুই বোনের সাথেই আমার বেশ মিল আছে রঙ্গন। আমি দিদির মতো রাগীও আবার নীরুর মতো হাসিখুশিও।এবার তুই যদি কখনো নীরুর হাসি মুঁছে দেওয়ার জন্য দায়ী হোস তবে তুই আড়ালে থাকলেও আমি তোর সম্মুখীন হবো।বুঝলি?”
রঙ্গন মুখ কালো করে বলল,

” তুই কেমন মেয়ের বাবাদের মতো জেরা করছিস।ভয় হচ্ছে আমার।”
এবার নিষাদ আওয়াজ তুলে হেসে উঠল।হাসি থামিয়ে নিষাদ বলল,
” কি হেল্প করতে হবে তোকে?”
“নীরুকে ধরেবেঁধে নিয়ে আসতে পারবি?জাস্ট পনেরো মিনিট হলেও চলবে।আমি শুধু ওর কাঙ্ক্ষিত কথাটা ওকে বলেই ছেড়ে দিব।প্রমিজ!”

” এতগুলো দিন কেঁটে গেল।জানাতে পারিসনি এখনো?
” তোর বোন সুযোগই দেয়নি।”
নিষাদ হেসে বলল,
” আচ্ছা। কাল হাত পা বেঁধে পার্সেল করে তোর কাছে নিয়ে যাব।তারপর বাকি দায়িত্ব তোর।”

সেতুর হাতে গুঁটিকয়েক কাগজ।সেই কাগজ গুলোর লেখায় চোখ বুলিয়েই চোখ বুঝল সেতু।ভালো লাগারা হৃদয় ছুঁয়ে যেতেই গালে গড়িয়ে পড়ল টসটসে নোনা জল।চোখ মেলে কাগজগুলো দ্রুত ড্রয়ারে রাখল।কয়েকদিন আগেও এই একই উত্তরই জানতে পেরেছিল সে প্র্যাগনেন্সি টেস্টে। আজকে সকালে আবারও রিপোর্টে একই বিষয় জেনে নিশ্চিত হলো সে।হালকা হেসে আলমারি বন্ধ করে ওয়াশরুমে গেল।চোখেমুখে পানির ঝাপটা দিয়ে আবারও রুমে আসতে চোখে পড়ল নিষাদকে।শার্টটা ঘামে ভিজে লেপ্টে আছে।চেহারা ক্লান্ত।সেতু ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখল রাত সাড়ে বারোটা।অনুষ্ঠানের কাজকর্ম, ব্যস্ততায় দুইজনই তখন ক্লান্ত। পা এগিয়ে হঠাৎ নিষাদের সামনে দাঁড়াল।নরম গলায় বলল,

“সারাদিন দৌড়াদৌড়ি করে ক্লান্ত হয়ে গিয়েছেন?”
নিষাদ ভ্রু কুঁচকাল।কন্ঠে এইটুকুও ক্লান্তির ছাপ না ফেলে প্রশ্ন ছুড়ল,
“দৌড়াদৌড়ি?আমি কি ছোট বাচ্চা?দৌড়াদৌড়ি কেন করব?”
সেতু মুখ কুঁচকে নিল।জবাবে বলল,
” উহ!শুধু শুধু কথা বাড়ান।বলতে চেয়েছি সারাদিনের ব্যস্ততায় ক্লান্ত নিশ্চয় আপনি?”
নিষাদ গমগমে স্বরে বলে উঠল,

” তোমার কি আমাকে ছোট বাচ্চা মনে হয় সেতু?এইটুকু বুঝব না আমি?”
” বুঝলে অবুঝের মতো কথা বলেন কেন?”
” প্রিয় মানুষদের সাথে কথা কম বললে মন খারাপ লাগে।জানো না?তাই প্রিয় মানুষদের সাথে কথা বাড়াতে ভালোবাসি।”
সেতু নিঃশব্দে হাসল।বলল,

” প্রিয় মানুষদের থেকে প্রিয় সংবাদ শুনতে ভালোবাসেন নিষাদ?আমার কাছে বোধ হয় আপনার জন্য খুব বড় একটা সংবাদ আছে, যা নিসন্দেহে আপনার কাছে প্রিয় সংবাদ হবে।শুধু প্রিয় নয়, চরম প্রিয় খবর!”
নিষাদ স্থির দৃষ্টিতে চাইল।প্রশ্ন ছুড়ে জিজ্ঞেস করল,
“প্রিয় সংবাদ?কি প্রিয় সংবাদ? ”
“প্রথমে ভেবেছিলাম আজই জানিয়ে দিব আপনাকে কিন্তু এখন মনে হচ্ছে দেরিতে জানানো উচিত।অপেক্ষার ফল মিষ্টি হয়।অপেক্ষা করুন।তবে একটু আগেও রুমে আসলে হয়তো জেনে যেতে পারতেন।”
নিষাদ ভ্র কুঁচকে বলল,

” রুমে দেরি করে আসার অপরাধ এটা?”
” ধরে নিন তেমন কিছুই।”
নিষাদের মুখ চুপসে গেল।প্রিয় সংবাদ জানার আগ্রহে উদ্গ্রীব হয়ে নরম গলায় বলল,
” মা অসুস্থ, মায়ের ঘরে গিয়েছিলাম।তাই দেরি হয়েছে।এবার বলো, কি প্রিয় সংবাদ।”

সেতুর মুখ হঠাৎই লালাভ হলো লজ্জ্বার ছোঁয়ায়।মিনমিনে চোখে একনজর নিষাদের দিকে চেয়ে বলে উঠল,
” প্রিয় সংবাদ পরে শুনলেও প্রিয়ই হয়।আমি জানি, আপনি তখন শুনলেও খুশি হবেন এখন শুনলেও খুশি হবেন। কিন্তু বিষয়টা হচ্ছে, আমি আপনাকে সেই সংবাদটা জানানোর জন্য প্রস্তুত হয়ে উঠিনি।কিভাবে জানাব তাও ভেবে পাচ্ছি না।ভেবে নিই?তারপর হুট করে আপনাকে সারপ্রাইজ দিয়ে বসব।হুহ?”
নিষাদ হতাশ হলো।সেতুর কাছাকাছি দাঁড়িয়েই ফিসফিসিয়ে বলল,

” অতো ভাবতে হবে না।আমার চোখের সামনেই প্রিয় মানুষ, প্রিয় সংবাদও তার কাছে।তবে আর দেরি কেন?তোমার মুখ দিয়ে বলে ফেলো জলদি।”
সেতু কিয়ৎক্ষন চুপ থাকল।একবার ভাবল বলে দিবে।পরক্ষনেই আবার লজ্জ্বায় আড়ষ্ট হলো।মৃদু গলায় বলল,
” ওটা তোলা রইল।খুব শীঘ্রই জানতে পারবেন নিষাদ।এখন ফ্রেশ হয়ে আসুন। আপনার শরীরে ঘামের গন্ধ।”
নিষাদ বাঁকা হাসল।সেতুর এক হাত টেনে কাছে টানল।মুহুর্তেই দুইজনের দূরত্বের পরিমাণ শূণ্য হলো।ঠোঁট বাঁকিয়ে বলল,

” আমার শরীরে ঘামের গন্ধ সেটা তুমি অতো দূরে দাঁড়িয়ে কি করে বুঝে নিলে ? এখন ভালো ভাবে যাচাই করো।আমার শরীরে ঘামের গন্ধ?”
” বিচ্ছিরি গন্ধ ।ছাড়ুন আমায়। ”
” বিচ্ছিরি গন্ধ হলেও তোমার বরের শরীররেই তো।এখন বিচ্ছিরি গন্ধ অনুভব করো। দেখবে প্রিয় মানুষের শরীরের বিচ্ছিরি গন্ধেও প্রেমে পড়ে যাবে।”

কথাটা বলেই নিষাদ চোখ টিপল।সেতু আহাম্মকের মতো তাকিয়ে থাকল কেবল।মুহুর্তেই কোমড়ে অনুভব করল নিষাদের হাত জোড়ার উষ্ণ ছোঁয়া৷ লোমকূপে শিহরন বইতেই বারকয়েক শ্বাস ফেলল সেতু।নরম গলায় বলল,
” এটা কি বিচ্ছিরি গন্ধের প্রেমে ফেলার জন্য ট্র্যাপ?”

নিষাদ এবার আওয়াজ তুলে হেসে উঠল। আর সেতু একদৃষ্টিতে সেই হাসির দিকে তাকিয়ে থাকল।কত সুন্দর এই হাসিটা!কতটা প্রাণবন্ত!নিষাদের এই হাসিটাই সবচেয় সুন্দর বোধহয়। কিয়ৎক্ষন অপলকভাবে সেই হাসির দিকে তাকিয়ে থাকার মাঝেই নিষাদের হাসি থেমে গেল।সেতুর দিকে তাকিয়ে হঠাৎই কন্ঠ গম্ভীর করে বলে উঠল,

” এই মেয়ে?এভাবে তাকিয়ে আছো কেন আমার দিকে?নজর লেগে যাবে। ”
” নজর লাগলে কি হয়?”
” নজর লাগলে আমার সৌন্দর্য কমে যাবে না?তখন কি কেউ আমার প্রেমে পড়বে?”
” কেউ বলতে?কে কে আপনার প্রেমে পড়ুক চান?”
নিষাদ এবার হেসে দিল।বলল,

” তুমি জ্বেলাস সেতু?”
” একদম নয়।”
” তবে?”
” এমনিই জানতে চেয়েছি।”
” তবে শোনো, আমি শুধু তোমার প্রেমই চেয়েছি এই জীবনে।আমি চাই,শুধু এবং শুধু তুমিই আমার প্রেমে পড়ো।আমার সর্বস্বই তোমার জন্য সেতু।”
সেতু ঠোঁট চওড়া করে বলল,

” তবে নজর লাগুক। ক্ষতি তো নেই?”।
” নজর লাগলে পরে আমার বউ যদি আমায় না ভালোবাসে?এমনভাবে ড্যাবড্যাব করে যদি না তাকিয়ে থাকে?”
” থাকবে, তখনও থাকবে।এখনও থাকবে।ভালোবাসায় সৌন্দর্য গুরুত্বপূর্ণ নয়।ভালোবাসায় মানুষটাই গুরুত্বপূর্ণ।ভালোবাসার মানুষের সবকিছুই সুন্দর হয়।আপনার সৌন্দর্য না থাকলেও আপনি আমার কাছে সুন্দর ঘোষিত হবেন। কেন জানেন?ভালোবাসার কারণে।”
নিষাদ বাঁকা হেসে শুধাল,

” তুমি কি আমায় ভালো টালো বাসো নাকি?সবকথায় ভালোবাসার সংজ্ঞা টানছো অথচ কোনদিন তো ভালোবাসি বললেনা।”
” ভালোবাসলেই ভালোবাসি বলে বলে তা প্রকাশ করতে হয় না।বুঝলেন?এবার গিয়ে ফ্রেশ হয়ে আসুন দয়া করে। ”
” না গেলে? ”
” না গেলে আপনার গায়ের বিচ্ছিরি গন্ধে অজ্ঞান….”

বাকিটা বলতে পারল না সেতু।তার আগেইই নিষাদের পুরু ঠোঁটজোড়া দখল করে নিল তার মিহি ঠোঁটজোড়া। উষ্ণ নিঃশ্বাস ছুঁয়ে গেল মুখচোখে।সেতুর নিঃশ্বাস ঘন হলো।হাত দিয়ে কেবল নিষাদের শার্টের একাংশ চেপে ধরল।কিয়ৎক্ষন পরই টের পেল নিষাদ কোমড় থেকে হাত ছাড়াল। আবদ্ধ ঠোঁটজোড়া মুক্তি পেল।নিষাদ ঠোঁট বাঁকিয়ে আবারও হাসল।মাথা চুলকে বলল,

“তখন বলেছিলাম না? ফিরতি ভালোবাসা পাওনা রইল?এখন সেই ফিরতি ভালোবাসা আদায় করে নিলাম।”
কথাটা বলে একদম দুই সেকেন্ডেই রূপ বদলে অন্যপাশে ফিরে চাইল।যেন সে কিছুই জানে না।একহাতে তোয়ালে নিয়ে সোজা হেঁটে ওয়াশরুমে গেল।আর সেতু চোপচাপ দাঁড়িয়ে কেবল সেসব দেখল।

আমাদের গল্পগুলো অল্প সময় ঘর বাঁধাল
তারপর পথ হারালো তোমায় আমায় নিয়ে
আগে যদি বুঝত তারা,
মনের নদীর কূল পাবে না
বেহায়া মুখ পোড়াতো অন্য কোথাও গিয়ে

নীরু গুনগুনিয়ে দুয়েকটা ভুল শব্দে হলেও ঠোঁট দিয়ে গানটা আওড়াল।মনে মনে কেবল বারবার রঙ্গনের একটা কথায় ভাবছে,” দিয়াকে বিয়ে করলে কেমন হবে?”নীরুর মন অস্থির হলো।এতগুলো দিনেও ভালোবাসা না পাওয়ার দুঃখে বিষাদ ছুঁয়ে গেল হৃদয়ে।চোখের সামনে মেনে নিবে কি করে প্রিয় মানুষকে অন্য কারো সাথে?কি যন্ত্রনার অনুভূতি।নীরুর চোখ টলমল করল।কান্না পেল ভীষণ করে। তবুও কাঁদল না।হঠাৎই কানে আসল নিষাদের কন্ঠ,

” এই নীরু? উঠ তাড়াতাড়ি।বাইরে বের হবো। ”
নীরু চোখ তুলে চাইল। বলল,
” কেন?”
” ভার্সিটি যাবি না?চল পৌঁছে দিয়ে আসি।”
নীরু মুহর্তেই নিষাদকে আশাহত করে বলে উঠল,
” আজ যাব না।”
নিষাদ হতাশ হলো।পরমুহুর্তেই একপ্রকার জোর করে টেনেটুনে নীরুকে বসা থেকে দাঁড় করাল। তাড়া দেখিয়ে বলল,
” তাড়াতাড়ি আমার পিছু পিছু আয়।একটা বিশেষ দরকার আছে।তোকে যেতেই হবে।জাস্ট কয়েক মিনিট পর আবার তোকে দিয়ে যাব বাসায়।এবার চল।”

” কোথায়? ”
” চুপচাপ চল না।গেলেই তো দেখবি।”
নীরু এবার মানল।চুপচাপ নিষাদের পিছু পিছু গেল। মাকে,দিদিকে, সেতুকে বলে ঘর ছেড়ে বেরও হলো।নিষাদ পকেট থেকে মোবাইলটা বের করে রঙ্গনকে কল দিল। কল রিসিভড হতেই হেসে বলল,

” নীরুকে নিয়ে আসছি। আজকেও যদি না জানাতে পারিস তো তোকে বোনের বর বানাব না।প্রমিজ।”
কথাটা বলেই কল কাঁটল নিষাদ।হালকা হেসে গাড়িতে উঠল।সাথে সাথে নীরুও গাড়িতে উঠে বসল।বলল,
” দাভাই?তোমার দরকারি কাজ রাখো।চলো আজ ঘুরে আসি কোথাও।আমার খুব মন খারাপ আজ।”
নীরুর মুখে গরুর বদলে দাভাই ডাক শুনে নিষাদ চমকাল না।অতি বেশি মন খারাপ থাকলে এমনই করে নীরু।নিষাদ হাসল।বলল,

” ঠিকাছে, আজ অনেক ঘুরব। যা চাস তাই হবে। কিন্তু তোর মন খারাপ কেন?”
” জানি না।”
” জানিস না?নাকি জানাতে চাস না?”

নীরু উত্তরে আর কিছু বলল না।নিশ্চুপ হয়ে বসে থেকে জানালা দিয়ে আকাশ দেখল কেবল।গাড়ি চলতে লাগল আপন গতিতে।কিন্তু বেশিক্ষন সে গতিতে চলতে পারল না।তার আগেই চোখে পড়ল কিছুটা দূরত্বর থাকা এক নিয়ন্ত্রনহীন ট্রাককে।নিষাদ প্রাণপন চেষ্টা চালাল বোনকে গাড়ির দরজা খুলে ঠেলে বের করতে। কিন্তু শেষ রক্ষা হলো না।তার আগেই ট্রাকটা এসে ধাক্কা দিল তাদের গাড়িটাকে।মুহুর্তেই ছিটকে গেল দুই ভাইবোনের শরীর।নিষাদ জ্ঞান হারিয়ে মুখ থুবরে রইল।কপালের দিকটায় কেঁটে রক্ত বইল দ্রুত।

ডান হাতটা কাঁচের টুকরোয় কেঁটে বিচ্ছিরি অবস্থা।সেদিক থেকে নিষাদের চেষ্টায় নীরুর তেমন কাঁটাছেড়া হলো না।তবুও তার নিঃশ্বাস নেওয়া কষ্টকর বোধ হলো। বারবার হা করে নিঃশ্বাস নেওয়ার চেষ্টা চালাল নীরু।কিন্তু খুব একটা সহজ বোধ হলো না। ছটফট করল দম বন্ধ হওয়ার সে পর্যায়ে। শরীর নেতিয়ে আসল।মুহুর্তেই টের পেল তার নাকের আর কানের ছিদ্রে ভেজা ভাব।হাত দিয়ে ছুঁতেই চোখে পড়ল রক্তের ধারা!

ঠোঁট, গলা বেয়ে সেই রক্তের ধারা এগিয়ে গেল।ভাইয়ের কথা মনে পড়তেই পাশ ফিরে নীভু নীভু চোখে চাইল নীরু।ঝাপসা চোখে কেবল নিষাদকে নেতিয়ে থাকতে দেখল। পরপরই চোখ বুঝে আসল নীরুর।জামার একাংশ খামচে ধরে প্রাণপনে চাইল নিঃশ্বাস নিতে।উহ!আগে তো কখনো এমন অক্সিজেনহীনতা অনুভব করেনি সে।বোধহয় মৃত্যু তার খুব কাছে।ভেতরে ভেতরে তখনও একরাশ মন খারাপ।

প্রিয় মানুষকে এই মুহুর্ত দেখার জন্য একরাশ তীব্র ইচ্ছে।একবার প্রিয় মানুষের মুখে ভালোবাসি শব্দটা শোনার আকাঙ্ক্ষা।আধো কি দেখা হবে?আধো কি শোনা হবে শব্দট?নাকি এত এত ইচ্ছে, এত এত আকাঙ্ক্ষা সব অপূর্ণই থাকবে?তাকে কি একরাশ অপূর্ণতা নিয়েই পৃথিবী ছাড়তে হবে?জানে না সে।এক বিষন্ন অনুভূতি নিয়েই চোখ বুঝল সে।হাত পা কেমন ঝুলে পড়ল মুহুর্তেই।

সেতু খবরটা শোনার পর থেকেই জমে গেল যেন।নিশ্চুপে বসে কেঁদে গেল কেবল।চোখগুলো ফুলে গেছে।নাকের অগ্রভাগ লাল টকটকে বর্ণ ধারণ করেছে।চুল গুলো এলোমেলো হয়ে মুখে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে।সিঁথির সিধুরটাও এবড়োথেবড়ো হয়ে কপালে লেগে আছে।শাড়িটাও ঠিকভাবে গোছানো নেই।চেহারায় একরাশ বিষাদই কেবল।কেমন যেন বিধ্বস্ত বেশ!কিছুক্ষনের মধ্যেই তার পুরো দুনিয়া ওলট পালট হয়ে গেল।এমনটা তো সে চায় নি।কখনোই চায়নি।বারবার তার সাথেই কেন এমনটা ঘটতে হবে?বুকের ভেতর কষ্টের ভারী পাথরটা নড়চড় করে উঠল বোধ হয়৷ সেতু ঠোঁট কাঁমড়ে কান্না আটকানোর চেষ্টা করল। তখন থেকে এক অক্ষর শব্দও নিজের ঠোঁট গলিয়ে বের করতে পারল না।

সবেমাত্রই হসপিটালে এডমিট করানো হলো নীরু আর নিষাদকে। সেতু হন্তদন্ত হয়ে এসেই হসপিটালের করিডোরে ঠাঁই মেরে বসে রইল। হাতটা গেল নিজের পেটের উপর।কান্নারা এবার দ্বিগুণ হলো।নিষাদকে কি তবে কালকেই মা হওয়ার বিষয়ে জানিয়ে দেওয়া উচিত ছিল?এই খবরটা শুনলে যে সবথেকে খুশি হতো, সে নীরু। তাকেও তো জানানো হলো না খবরটা।

মেয়েটা নিশ্চয় খবরটা শুনে হেসে খেলে নেচে দিত।আর আজ?কি থেকে কি হয়ে গেল।হাসিখুশি মেয়েটার পুরোমুখ রক্তে মাখামাখি।কোন কাঁটাছেড়া না হলেও মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণ হয়ে আশংকাজনক অবস্থা।ডক্টররা কোন আশা দিল না।সেতুর হাত পা কাঁপছে।দুইজন মানুষই তার ভীষণ প্রিয় মানুষ।দুইজন মানুষই তাকে সমুদ্র সমান ভালোবাসা উপহার দিয়েছে।এদের মধ্যে কারোর যদি কিছু হয়ে যায় , ভেবেই কলিজা কেঁপে উঠল সেতুর।আর একবার, অন্তত একবার হলেও নিষাদের পাগলামি, ভালোবাসার সম্মুখীন হতে চায় সে।আর একটা বার হলেও কপালে নিষাদের ঠোঁটের স্পর্শ চায়।

আর একটাবার হলেও নিষাদের মুখ ভালোবাসি শব্দটা শুনতে চায় সেতু।এভাবে কি আসলেই এত এত ভালোবাসা দিয়ে চলে যাওয়া যায়?একদৃষ্টিতে কথাগুলো ভাবতে ভাবতেই হাতে কারো স্পর্শ অনুভব হলো।হতবিহ্বল চোখে তাকাতেই চোখে পড়ল নীরের গোল গোল চোখের চাহনী।নীর আলতো গলায় বলল,
” মা? মামনি আল বাবা কি হয়েছে?”

সেতু উত্তরে কিছু বলতে পারল না। নীরকে ঝাপটে বুকে আগলে কেঁদে দিল হাউমাউ করে।এতটা দমবন্ধকর অবস্থা বোধ হয় এর আগে কোনদিন ও হয়নি তার।জীবনে এত এত কষ্টের সম্মুখীন হলেও এতটা কষ্ট বোধ হয় সে কোনদিনই উপলব্ধি করেনি।

রঙ্গন যখন হসপিটালে পৌঁছাল তখন নীরু আর পৃথিবীতে নেই।মস্তিষ্কে অতিরিক্ত রক্তক্ষরণ আর শ্বাসকষ্টের কারণে হসপিটালে আনার কিছু মুহুর্ত পরই নীরু দুনিয়া ছাড়ল।হেসে খেলে চলা প্রাণবন্ত মেয়েটা আর নেই।বারবার ভালোবাসার অনুভূতি প্রকাশ করা মেয়েটা ফিরতি ভালোবাসার কথা না জেনেই ছেড়ে গেল সবাইকে।মৃত্যুর আগ মুহুর্তেও বোধহয় মেয়েটা ভালোবাসার মানুষটার এইটুকু ভালোবাসা পাওয়ার জন্য ছটফট করেছে।হয়তো বারবার ভালোবাসার মানুষটাকেই মৃত্যুর আগ মুহুর্তে মনে করেছে।

রঙ্গন কি করবে বুঝে উঠল না।মস্তিষ্ক ফাঁকা ফাঁকা অনুভব হলো।আর তাকে কেউ বিরক্ত করবে না, ঘন্টার পর ঘন্টা কথা বলে মাথা খাবে না।গভীর রাতে হঠাৎই আর চেনা নাম্বারটা থেকে কল আসবে না।কেউ আর কথায় কথায় ঝগড়া করবে না।কেউ আর চঞ্চল গলায় ” গাধা” বলে সম্বোধন করবে না। রঙ্গন আর ভাবতে পারল না।এক দৃষ্টিতে নীরুর মুখের দিকে তাকিয়ে রইল শুধু।চোখজোড়া এতটাই লাল টকটকে দেখাল যেন চোখ ফেটে রক্ত বের হবে তার।নিঃশ্বাস নিতে প্রচুর কষ্ট অনুভব হলো ।বুকের ভেতর ভার হয়ে আসল মুহুর্তেই।পা জোড়া আর চলতে চাইল না।এক মুহুর্তের জন্যও এই ঘটনাটাকে বিশ্বাস করতে মন চাইল না তার।বারবার মনে মনে এটাই আওড়াল, “এটা স্বপ্ন। এটা স্বপ্ন রঙ্গন।”

কিন্তু না!এটাই সত্য!রঙ্গন মুখচোখ শক্ত করে ঠাঁই দাঁড়িয়ে রইল।অবশেষে সাহস করে নীরুর নিথর দেহের সামনে গেল।নীরুর শরীরটা ঝাঁকিয়েই বলল,
” নীরু?এক্ষুনি উঠে যা বলছি।এক চ’ড়ে সব দাঁত ফেলে দিব বললাম।প্রচুর রাগ লাগছে কিন্তু।”
নীরু উঠল না।বুঝে রাখা চোখের পাতা মেলে ধরল না।রঙ্গন এবার কেঁদে দিল।এতক্ষনকার লালাভ রক্তরাঙ্গা চক্ষু এবার জল গড়িয়ে দিল।নীরুর নিথর শরীরটাকে মুহুর্তেই বুকে আঁকড়ে নিয়ে বলে উঠল,

” তুই এতটা নিষ্ঠুর হতে পারিস না নীরু।এতটা কষ্ট আমি তোকে কখনোই দিইনি নীরু।তুই আমায় এতটা কষ্ট দিতে পারিন না।আমার এটা প্রাপ্য নয়।তুই আমার সাথে এটা করতে পারিস না নীরু।প্লিজ একবার!একবার নীরু।একটাবার সুযোগ দে।তুই আমাকে আমার অনুভূতিটা প্রকাশের সুযোগও দিলি না নীরু?এত বেশিই পাপ করেছি আমি?”

রঙ্গন কাঁদল। নীরু কতগুলো দিন কান্না করেছে এই রঙ্গনের জন্য।কতকাল এই রঙ্গনের জন্য চোখের জলে বালিশ ভিজিয়েছে।অথচ আজ রঙ্গন তার জন্য কান্না করছে।আর সে এই দৃশ্য দেখতেই পারল না।রঙ্গন দুই হাত দিয়ে আবারও ঝাকাল নীরুর শরীরকে। অস্ফুট স্বরে বলল,

” প্ প্লিজ নীরু।একবার চোখ মেলে তাকা। আমার ভালো লাগছে না এসব।”
রঙ্গন আবারও আশহত হলো।নীরুর কানের কাছে নিজের মুখটা নিয়েই কান্নাভেজা কন্ঠে বলে উঠল,
” আ্ আমি, আমি ও তোকে ভালোবাসি নীরু।একটাবার এই কথাটা জানানোর সুযোগ দে নীরু।শুধু একটাবার!ভালোবাসি।”

নীরু তাকে সুযোগ দিল না।শুধু ভালোবাসি বলার সযোগ নয়, একসাথে থাকার সুযোগ, আপন পুরুষ হওয়ার সুযোগ,একসাথে সংসার বাঁধার সুযোগ কোনটাই দিল না।বদলে তাকে নিকৃষ্টতম এক শাস্তি দিয়ে গেল।এই শাস্তি আজীবন বয়ে বেড়াবে কি করে সে?রঙ্গন আর ভাবতে পারল না।রক্তরাঙ্গা চোখে নীরুর দিকে একবার চেয়েই আবারও বুকে আঁকড়ে নিল নিজের সর্বস্ব শক্তি দিয়ে। বলল,

“তুই আমায় ছাড়তে পারিস না নীরু।সবসময় ভালোবাসি বলে বলে, যখন আমার ভালোবাসার সুযোগ আসল তখনই তুই আমায় ছেড়ে যেতে পারিস না।শুনলি?পারিস না নীরু।”
নীরু নিশ্চুপ। অন্যদিনের মতো আজ কোমড় বেঁধে ঝগড়া করল না।এক কথার বিপরীতে এতগুলো কথা শুনাল না।একটাবারও গাধা বলে ডাকল না।রঙ্গন শুধু শক্ত করে জড়িয়ে রাখল ওর প্রাণহীন দেহটাকে। মুহুর্তেই স্মরনে এল নীরুর বলা কথাটা,

“পাখি ফুরুৎ হয়ে গেলে তখন বুঝবে ভালোবাসা কাহাকে বলে।হতে পারে তুমি তখন দিনরাত আহাজারি করছো নীরুপাখির জন্য।দিনশেষে দেখবে পাখি ফুরুৎ!”

নিষাদকে দিন পনেরো পরই বাসায় আনা হলো।বিছানায় হেলান দিয়ে বসে অন্যমনস্ক হয় চেয়ে রইল সে।হাতে,মাথায় এখনো ব্যান্ডেজ করা।তবে এখন মোটামুটি সুস্থ।চোখ জোড়ার চাহনী ক্লান্ত।বোনের মৃত্যুর খবর এতগুলো দিন তার থেকে গোপণ রাখা হলেও দুইদিন আগেই জানতে পেরেছিল সে।তারপর থেকেই কেমন যেন থম মেরে আছে।বিনাপ্রয়োজনে কথা বলে না তেমন।নিষাদের মা দরজার সামনে দাঁড়িয়ে একপলক চাইল নিষাদের দিকে।পা বাড়িয়ে নিষাদের সামনে আসতেই নিষাদ হতবিহ্বল চাহনীতে তাকাল। মায়ের চোখেমুখের বিধ্বস্ত বেশ চোখে পড়তেই মাকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে দিল সে।অস্ফুট স্বরেই বলে উঠল,

“ম্ মা!আমি নীরুকে বাঁচাতে পারলাম না মা।আমি ব্যর্থ!আমি একটা অযোগ্য ভাই মা। পারলাম না ওকে বাঁচাতে।”
নিষাদের মাও কেঁদে ফেলল। ছেলের কথার বিনিময়ে কিছু বলতে না পেরেই আঁচল চেপে ধরল মুখে।ছেলেকে ছাড়িয়ে দ্রুত চলে গেল নিজের ঘরে।উনার ছেলেমেয়েদের মধ্যে সবচেয়ে চঞ্চল ছিল নীরু।আর সেই চঞ্চল নীরুই আজ মায়ের কোল খালি করে, এই পুরো ঘরকে শূণ্য করে চলে গেল।

নিষাদ মায়ের যাওয়ার দিকে তাকিয়ে একই ভাবে বিছানায় হেলান দিয়ে বসে রইল।ভেতরে ভেতরে সবটা। তীব্র কষ্টে দুমড়ে মুঁছড়ে শেষ হয়ে গেল।সেদিন হয়তো নীরুকে জোর করে না নিয়ে গেলে এমন কিছুই হতো না।কেন নিয়ে গেল সে?উহ!বুক ভার হয়ে আসছে তার।চোখের জল মুঁছে নিয়ে চোখ বুঝতেই হাতে অনুভব করল নরম হাতের স্পর্শ।মুহুর্তেই চোখ মেলে সেতুকে দেখতে পেল।সেতু পাশে বসল।নিষাদের হাতটা নিজের হাতে নিয়েই কেঁদে বলল,

” ন্ নিষাদ, আপনি জানেন?এই দিনগুলো কি ভীষণ দুর্বিষহ ছিল।আপনি আর দূরে যাওয়ার চেষ্টা করবেন না নিষাদ।আমার নিষ্প্রভ জীবনে প্রণয় রাঙ্গিয়ে আবারও নিষ্প্রভ করবেন না জীবনটা।এক মুহুর্তের জন্য মনে হয়েছিল আপনার আমার প্রণয় আবারও নিষ্প্রভ হতে চলেছে।এই কটা দিন প্রত্যেকটা মুহুর্তেই অজানা ভয়ে তটস্থ ছিলাম আমি।আপনারা ভাইবোন দুইজনই বেশ স্বার্থপর নিষাদ।এত এত ভালোবাসা দিয়ে পরমুহুর্তেই জীবনটাকে ফ্যাকাসে করে দিতে পারেন। ভালোবাসা কেড়ে নিতে পারেন।”

নিষাদ চুপ রইল।সেতু মাথাটা নিষাদের বুকে রাখল।মৃদু আওয়াজে বলল,
” নিষাদ? অনেকদিন হলো আপনি ভালোবাসি বলেন না।একবার বলবেন ভালোবাসি?”
নিষাদ কিয়ৎক্ষন চুপ থাকল।তারপর ঠোঁট নেড়ে বলল,
” ভালোবাসি সেতু।”
সেতু এক সাগর কষ্ট নিয়েও হাসল।বলল,

” আমার আপনাকে কিছু বলার আছে নিষাদ।এই কটা দিন এই কথাটা বলার জন্য ছটফট করেছি কেবল।নীরুকেও জানাতে পারিনি একটিবার।যদি আপনাকেও না বলতে পারি এই ভয়ে দিনরাত চোখের পাতা এক করতে পারিনি।”
নিষাদ ভরাট গলায় বলল,
” কি বলবে?”

সেতু কেঁদে দিল।চোখের জলে নিষাদের বুক ভিজিয়ে বলে উঠল,
” আপ্ আপনি বাবা হতে চলেছেন নিষাদ। আমি চেয়েছিলাম নীরের জম্মদিনের দিনই বলে দিব।কিন্তু কেন জানি না বলতে পারলাম না সেদিন।তারপর তো সবটা এলোমেলো হয়ে গেল নিষাদ।”
নিষাদের চোখজোড়া থমকে রইল।কথাটা দ্বিতীয়বার নিশ্চিত হওয়ার জন্যই অস্ফুট স্বরে বলল,

” সত্যি?”
” হ্যাঁ নিষাদ।সত্যিই!”
নিষাদ আলতো হাতে সেতুকে জড়িয়ে ধরল।এত কষ্টের মাঝেও হৃদয়ে প্রশান্তি অনুভব হলো।চোখজোড়া বুঝে নিয়েই তৃপ্তির শ্বাস ফেলল।মুহুর্তেই কানে আসল,
” বাবা?নীলু মামনি কোথায়?তোমার সাথে আসল না কেন?”

নিষাদ চোখ মেলে চাইল নীরের দিকে।আবার ও বুকের ভেতর কষ্টরা সতেজ হয়ে উঠল।অস্ফুট স্বরে বলল,
” তোমার নীলু মামনি ঘুমায় বাবা।”
নীর বোধ হয় বুঝল না। চোখজোড়া গোলগোল করে তাকিয়ে রইল কেবল।মনের ভেতর প্রশ্নরা খেলা করল।ঘুমালে তো বাড়িতেও ঘুমাতে পারত।ঘুমানোর জন্য কি বাড়ির বাইরে থাকতে হয়?

তখন বেশ রাত।রঙ্গন চুপচাপ শুঁয়ে রইল।ঘুম আসল না। আগের মতোই মাঝরাতে কল আসার অপেক্ষা করল। কিন্তু কল আসল না।উঠে বসে আলো জ্বালাল।এই কয়দিনেই চোখের নিচে কালচে দাগ বসেছে তার।দাঁড়িগুলো বেশ বেড়েছে।চুলগুলোও অগোছাল।কেমন যেন উদাসীন ভাব সবকিছুতে।রঙ্গন নীরুর ছবির দিকে তাকিয়ে রইল কিয়ৎক্ষন। শুধাল,

” তুই এমনটা ইচ্ছে করেই করলি নীরু,তাই না?আমি জানি,তুই ইচ্ছে করেই এই যন্ত্রনাটা আমায় দিয়ে গেলি।আমি সইতে পারছি না এই যন্ত্রনা!ছটফট করছি।তুই খুশি তো এখন নীরু?তোর আর আমার প্রণয়ের শুরুর আগেই সমাপ্তি ঘটল। আমার জীবনটা নিষ্প্রভ করে দিয়ে কি ফেলি?এত এত ভালোবাসা দেখিয়ে প্রণয়ের স্বপ্ন দেখিয়ে তুই কি সুন্দর ছেড়ে চলে গেলি আমায়।”
ক্ষানিক থেমেই আবারও বলল রঙ্গন,

” জানিস নীরু?এই পৃথিবী থেকে অপূর্ণতা নিয়ে চলে যাওয়া কতটা কষ্টকর জানি না, তবে পৃথিবীতে অপূর্ণতা নিয়ে বেঁচে থাকা বড্ড কঠিন।আমি তা এই কয়দিনে বেশ ভালো করে বুঝে গিয়েছি।আমার সারাজীবনের আপসোস থাকবে, আমি তোর কাছে অনুভূতি প্রকাশ করতে পারলাম না। তোকে বলতে পারলাম না, আমিও তোকে ভালোবাসি।তোকে একটিবারও জানাতে পারলাম না যে তুই আমাকে নীরু নামক মায়াতে কি সাংঘাতিক ভাবে আষ্ঠেপৃষ্ঠে জড়িয়ে নিয়েছিলি।এত বেশি স্বার্থপর হওয়ার কি খুব বেশি প্রয়োজন ছিল নীরু?”

কথাগুলো বলেই চুপ রইল রঙ্গন।ঘড়ির দিকে তাকিয়ে বুঝল বেশ রাত হয়েছে।দরজায় টোকা পড়তেই পা বাড়িয়ে দরজা খুলল।মাকে দেখেই ছোট ছোট চোখে চাইল একনজর।তারপর আবারও আগের জায়গায় এসে বসল।রঙ্গনের মা ছেলের মাথায় হাত বুলিয়ে বলল,
” এই কয়দিনে কি অবস্থা হয়েছে তোর। খেয়াল করেছিস?মেয়েটার সাথে তো তোর প্রেম ছিল না রঙ্গন।তবে এত কেন কষ্ট?”

নিষ্প্রভ প্রণয় পর্ব ২৭

রঙ্গন একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে শান্ত স্বরে বলল,
” ওর সাথে আমার প্রেম ছিল না মা, তবুও অনেককিছুই ছিল।”

সমাপ্ত