নীড়ের খোজে পর্ব ৩

নীড়ের খোজে পর্ব ৩
জান্নাতুল বিথী

মায়ের কোলে গুটিশুটি মেরে শুয়ে আছি আমি।একটু পর পর হেচঁকি তুলে কাঁদছি।মায়ের চোখেও পানি।হয়তো এতো বছর পরে সন্তানকে কাছে পেয়ে আ*বেগে গা ভাসিয়ে দিচ্ছেন রেখা বেগম।আমি একের পর এক বিচার দিতে থাকি মায়ের কাছে।আর মা চুপচাপ শুনে যাচ্ছে আমার এতো দিনের জমানো অভিযোগ।এক মুহূ*র্তেই যেনো আমার সব ক্লান্তি কর্পূরের ন্যায় উড়ে যায়।দু’চোখে নেমে আসে রাজ্যের ঘুম।

‘তুহাকে ডেকে দাও মেজোপা।মেয়েটা আসার পর থেকে সেভাবেই শুয়ে আছে।’
বড় জায়ের কথা শুনে চোখ তুলে তাকায় রেখা বেগম।মলিন হেসে বলে,
‘আরেকটু ঘুমাক না আপা।মেয়েটা কতো কাল শান্তিতে ঘুমায় না কে জানে?’
‘আমার পূত্র বধু আর তোমার মেয়ে এই বাড়িতেই তো থাকবে এখন থেকে মেজো।এতো চিন্তা করছো কেনো।কতো রাত হয়ে গেলো মেয়েটা এখনো না খেয়ে আছে।সবাই ওর জন্য না খেয়ে বসে আছে।তুমি ওকে তুলে দিয়ে নিজেও খেতে আসো।’

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

রেখা বেগম মেয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে দেখে মেয়েটা কতো শান্তি তে ঘুমাচ্ছে। ডাকতে ইচ্ছে করছেনা।তারপরো রেখা বেগম মেয়েকে ঘুম থেকে উঠানোর জন্য তুহা বলে দু-তিনবার ডাকতেই আমি হুড়মুড়িয়ে উঠে বসি।আমি এভাবে উঠায় মাও হয়তো কিছুটা ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেছে।তাই আমার গালে হাত রেখে বললো,
‘কি হলো মা ভয় পাচ্ছিস কেনো?’

মায়ের কথা শুনে পিটপিট করে তাকাই তার দিকে।প্রথমে বুঝে উঠতে পারিনা আমার বর্তমান অবস্থান কোথায়।মাথায় একটু চাপ প্রয়োগ করতেই সব কিছু মনে পড়ে।মা এখনো জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে আমার দিকে।তাই বললাম,
‘হঠাৎ ডাকায় ভয় পেয়ে গেছিলাম।স্যরি আম্মু।’
আমার কথা শুনে আম্মু হাসে।বিছানা থেকে নামতে নামতে বললো,

‘জলদি ফ্রেস হয়ে নিচে আয়।সবাই তোর জন্য না খেয়ে বসে আছে।’
ইশশ কি আদুরে ভাব আম্মুর কন্ঠে।সেকেন্ডের মাঝেই আমার চোখ ভিজে উঠে।ইতোমধ্যে বোঝা হয়ে গেছে আমার ওই বাড়িতে ঠিক যতোটুকু অত্যাচার সহ্য করেছি এই বাড়িতে তার চাইতেও বেশি ভালোবাসা পাবো।এখন থেকে আর সৎ মায়ের চড় খাপ্পড় খেয়ে বা চুলের মুঠি ধরে ঘুম থেকে উঠাতে হবেনা।

নিজের আপন মায়ের আদুরে গলার ডাক শুনেই ঘুম ভাঙ্গবে আমার।তখন আম্মু ডাকাতে এই কারনেই ভয় পেয়ে গেছিলাম।সৎ মা কখনো আমাকে ঘুম থেকে ডেকে উঠাতো না।নিজে থেকেই উঠতাম যদি কখনো উঠতে একটু দেরি হতো তখনই তার মুখ থেকে অক*থ্য ভাষায় গালা*গাল বের হতো আর তা শুনেই ঘুম ভাঙ্গতো আমার।

ফ্রেস হয়ে রুম থেকে বের হয়ে দেখি সবাই গভীর কোনো আলোচনায় মগ্ন।সিরিয়াস কিছু নিয়ে তারা আলোচনা করছে মনে হলো আমি তাই টেবিলের কাছে যেতে কিছুটা ইতস্ত বোধ করছি।এর মাঝেই হঠাৎ শৈবাল নিচু স্বরে চেঁচিয়ে উঠে বললো,

‘বিয়ে করতে বলছো বিয়ে করেছি বাবা কিন্তু সংসার করতে বলছো কেনো?ছিনি না জানিনা এমন একজনকে বিয়ে করেছি এখন হুট করে চাইলেই কি সংসার করা যায় নাকি?আমাকে অন্তত মানিয়ে নেওয়ার সময় টুকু দাও।এর মাঝে আমি আমার পড়া টাও কমপ্লিট করি?’
শৈবালের কথা শেষ হতেই পাশ থেকে একজন বললো,

‘হ্যা ভাইজান শৈবাল তো ঠিকই বলেছে।ছেলেটা এখনো পড়া-লেখা শেষ করে নাই।এর মাঝে বিয়ে।ওকেও একটু সময় দেওয়া উচিত তোমাদের।’
একজন ভদ্র মহিলা বললো,
‘তুহাও তো ছোট এখনো।ওকেও সময় দেওয়া উচিত।কিছুদিন পর মেয়েটার এইচএসসির রেজাল্ট বের হবে।তারপর নাহয় ওকেও ভার্সিটিতে ভর্তি করিয়ে দিলে তোমরা।’

আমি কিছু না বলে গুটিগুটি পায়ে এগিয়ে যাই টেবিলের কাছে।আমাকে দেখেই তারা আলোচনা মাঝ পথে বন্ধ করে দেয়।হঠাৎ আমাকে বারো-তেরো বছরের একটা ছেলে টেনে নিয়ে গিয়ে সবার সামনে দাড় করিয়ে বলে,
‘ওই যে ডানপাশের কর্নারে যে বসে আছে সে হলো তোমার শ্বশুড় ইউসুফ পাটওয়ারী।তার পাশের জন হলো তোমার আর আমার বাবা দুলাল পাটওয়ারী,আর সর্বশেষ উনি হলেন গিয়ে আমাদের ছোট চাচ্চু নুরুল পাটওয়ারী,

ওই যে শৈবাল ভাইয়ের পাশে দাড়িয়ে আছে উনি তোমার শ্বাশুড়ি সারা পাটওয়ারী,তার পাশের জন আমাদের মম রেখা পাটওয়ারী,ছোটমা তার বাপের বাড়ি আছে।আর ওইযে নীল টি-শার্ট পরা ছেলেটা দেখছো সে হলো তোমার দেবর সৈকত ভাই।এবার অনার্স থার্ড ইয়ারে।তার পাশের জন হলো তোমার স্বামী ফাহাদ পাটওয়ারী শৈবাল।এবার মাস্টার্স লাস্ট ইয়ারে।আরো দুজন পিচ্চি আছে ওরা বর্তমানে বাড়িতে নেই।’

দীর্ঘ বক্তব্যের পর থামলো ছেলেটা।আমি হা করে তাকিয়ে আছি।এতো পিচ্চি একটা ছেলে এতো কথা বলে কিভাবে আল্লাহ্।সবার দিকে তাকিয়ে দেখি সবাই মিটিমিটি হাসছে।শুধু শৈবাল বাদে।সে এক মনে বসে খাবার চিবুচ্ছে।যেনো এর চাইতেও গুরুত্বপূর্ণ কাজ আসে পাশে আর একটাও নেই।আমি অবাক চোখে মানুষটা কে পরখ করছি।গাড়িতে আমার সাথে কতো সুন্দর ব্যবহার করলো।এখন দেখো আসার পর থেকে একটা কথাও বলেনি আমার সাথে।শৈবালের দিক থেকে দৃষ্টি সরিয়ে ছেলেটার দিকে তাকিয়ে বলি,

‘সবার পরিচয়ই তো দিলে।তা নিজের টা বাদ রাখলে কেনো?’
আমার কথা শুনে সবাই ফিক করে হেসে দেয়।সৈকত ভাই হাসতে হাসতে বললো,
‘ওর নাম হলো ডি*স্টার্ব।যার কাজ হলো সবাইকে ডি*স্টার্ব করা।আর কাজের মাঝখানে ব্যাঘাত ঘটানো।তাইনা হিমেল?’
তার কথা শুনে ছেলেটা ফুসে উঠে বলে,

‘এটা কিন্তু ঠিক না ব্রো।আমি কখনো তোমাকে ডিস্টার্ব করিনা।’
এক কথার বিনিময়ে আরেক কথা এভাবে দুজনের খুনশুটি লেগেই থাকে।শ্বাশুড়ি মা আমাকে চোখ দিয়ে ইশারা করলেন যেনো আমি শৈবালের পাশের চেয়ারে বসি।আমিও তার কথায় দ্বিরুক্তি প্রকাশ না করে চুপচাপ তার পাশের চেয়ারে এসে বসে পড়ি।

আমার কাজে শৈবাল একবার আমার দিকে তাকিয়ে আবারো খাবারে মনোযোগ দেয়।আমাকে একজন একদিক থেকে একটা প্রশ্ন করছে আর আমি তার উত্তর দিচ্ছি।যার বেশির ভাগ প্রশ্নই সৎ মা আর বাবাকে নিয়ে।তারা আমার সাথে কতোটুকু খারাপ ব্যবহার করছে কেউ তাদের প্রতিবাদ করেছে কিনা এসব প্রশ্ন।কথা বলার মাঝে হঠাৎ তারা ভাইয়েরা ভাইয়েরা কথা বলায় ব্যস্ত হয়ে পড়ে।আমার দিকে কেউ তাকিয়ে নেই কারনে আমি নিচু স্বরে শৈবাল কে জিজ্ঞেস করি,
‘আপনি কি বিয়েটা মেনে নেননি?’

কথাটা শুনে শৈবাল ভ্রু কুচকে একবার আমার দিকে তাকিয়ে আবার খেতে মনোযোগ দেয়।তার কাছ থেকে জবাব না পেয়ে আমি হতাশ হই।মানুষটা কেরকম যেনো গিরগিটির ন্যায় পাল্টে গেলো হঠাৎ করে।
‘তুহাকে বড় মাছের পিস টা দাও রেখা।’

হঠাৎ দুলাল পাটওয়ারীর কথা শুনে আমি চমকে উঠে তার দিকে তাকাই।আরেকবার নিজের প্লেটে তাকাই।ইতোমধ্যেই পুরো প্লেট বিভিন্ন আইটেম দিয়ে ভরে গেছে।তাই তড়িৎ গতিতে তার দিকে তাকিয়ে দুইদিকে মাথা নেড়ে না না করতে করতে বলি,

‘না না আঙ্কেল আমি আর কিছু নিবো না।’
আমার কান্ডে সবাই হেসে দেয়।ছোট চাচ্চু বললো,
‘কি ব্যাপার বউমা নিজের শ্বশুড় কেও আঙ্কেল ডাকো নিজের বাবাকেও আঙ্কেল ডাকো এটা কি ঠিক?’
আমি কিছু না বলে নিচের দিকে তাকিয়ে থাকি।কিই বা বলবো তাকে।শ্বশুড় কে বাবা ডাকা বিষয়টা অন্য কিন্তু নিজের আপন মায়ের দ্বিতীয় স্বামীকে কি করে বাবা বলে ডাকবো?আর তাছাড়া সেই মানুষটাই বা কি ভাববে।আমার এতো ভাবনার মাঝে হিমেল বললো,

‘তুহাপু আমি আমার বাবাকে তোমার সাথে শেয়ার করলাম।তুমিও তাকে বাবা বলে ডাকতে পারো।আমি কিন্তু কখনো আমার জিনিস কারো সাথে শে*য়ার করিনা।তোমার সাথে করলাম।তোমাকে ভালোবাসি বলে।’
হিমেলের কথা শুনে আমি হেসে ফেলি।

‘আমার কোনো মেয়ে নেই কথাটা কখনো আমি মানিনি মা।কেউ আমাকে কয় সন্তানের পিতা জিজ্ঞেস করলেই বলতাম আমার এক মেয়ে এক ছেলে।আমি সব সময় মেনে এসেছি আমার একটা ছোট্ট সোনামনি আছে যাকে সময় হলেই নিজের কাছে তুলে নিয়ে আসবো।আর এখন দেখো সত্যি সত্যিই তুলে নিয়ে আসলাম তোমাকে।ওরা তোমাকে আমাদের সাথে দিতে অস্বীকার করার কারনেই তোমাকে বউ হিসেবে এনেছি।নয়তো আমরা কিন্তু তোমাকে মেয়ে হিসেবেই নিয়ে আসতে গেছিলাম।যাই হোক তাতে কি আমার মেয়ে আমার ঘরে ফিরে এলো তো।’

ইশশ মানুষটা কতো নির্ধিদ্বায় বলে দিলো “আমার মেয়ে” অথচ যার রক্ত আমার শরীরে বইছে সে মানুষটা এখনো অবধি একটি বার আমাকে “আমার মেয়ে” বলেনি।উনার কথা শুনে চোখে অশ্রুরা ভীড় জমায়।অতঃপর অশ্রু লুকানোর জন্য নিচের দিকে তাকিয়ে মনে মনে বেছে নেই নিজের পিতাকে।রক্তের সম্পর্ক দিয়ে কি হবে যদি আত্মার সম্পর্ক না থাকে?

খাওয়া শেষে হিমেল আমাকে টেনে নিয়ে আসে।সবার সামনে বলে আসে আমাকে আমার রুমে দেখাতে নিয়ে আসছে।ওর এসব কাজ দেখে আমার প্রচুর হাসি পাচ্ছে।অনেক কষ্টে নিজেকে কনট্রোল করছি।এদিকে তার যতো আজগুবি বকাবকির শেষ নেই।এর মধ্যে জেনেছি ছেলেটা ক্লাস নাইনে পড়ে।এখনো তার একটা গার্লফ্রেন্ডও নাই এজন্য কিছুক্ষণ দুঃখ প্রকাশ করলো।আমরা দুজন হাটতে হাটতে দোতলায় চলে এসেছি।একটা রুম ক্রস করার সময় হঠাৎ রুমের দরজা খুলে শৈবাল বেরিয়ে আসে।হিমেলের দিকে তাকিয়ে বলে,

‘যা গিয়ে পড়তে বস।এখানে কি তোর?’
শৈবালের ধ*মক শুনে হিমেল আমার দিকে কাচুমাচু করে তাকায়।শৈবাল আবারো ধ*মক দিয়ে বলে,
‘কি হলো এভাবে তাকাচ্ছিস কেনো ওর দিকে?যেতে বললাম তো।’
দ্বিতীয় বার ধ*মক শুনে ছুটে পালায় হিমেল।এতক্ষন কি হলো সব কিছুই আমার মাথার উপর দিয়ে যাচ্ছিল।যখন বোধগম্য হলো তখন আমি তার দিকে তাকিয়ে বলি,

‘এটা কি হলো?ওর সাথে এভাবে কথা বললেন কেনো?’
‘যাক বাবা তুমি এতো কথা বলতে জানো এই ই বা কম কি?’
এরপর আমার দিকে হালকা ঝু*কে বলে,
‘বিয়েটা আমি মেনে নেইনি ঠিক তবে কোনো ব্যাপার না।মানিয়ে নিবো একসময়।’

নীড়ের খোজে পর্ব ২

[জোড়া পদ্ম গল্পটা আমি পেইজ থেকে ডিলিট করে দিচ্ছি।এই গল্পটা শেষ হলে ইনশাআল্লাহ্ জোড়া পদ্ম শুরু করবো।দুইটা একসাথে লিখা আমার পক্ষে সম্ভব না।তুহা আর শৈবালের পক্ষ থেকে একটি করে বাক্য বলে যাবেন।তাদের কেমন লাগে?]

নীড়ের খোজে পর্ব ৪