নীড়ের খোজে পর্ব ২

নীড়ের খোজে পর্ব ২
জান্নাতুল বিথী

আমার অদ্ভুত প্রশ্ন শুনে শৈবাল ভ্রু কুচকে বিরক্তি প্রকাশ করে বলে,
‘অদ্ভুত তো আমার বিয়ে তো কি হইছে আমি তো আর বাবার বাড়ি থেকে চলে যাচ্ছি না।বরং বাবার বাড়ি যাচ্ছি।উল্টো দিকে তোমাকে দেখো?’

লোকটার কথা শুনে বুক চিরে একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে।কিছু না বলে জানালা দিয়ে বাহিরে তাকাই।বাবার বাড়িতে যাদের শৈশব ভালো কাটে,যাদের বাবা মা সন্তানদের আদর-ভালোবাসা দিয়ে ভরিয়ে রাখে তারাই আপনজন,আপন নীড় ছেড়ে চলে যাওয়ার সময় কান্না করে।অপরদিকে আমি?

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

মা হারা মেয়ে।আমার বয়স যখন চার বছর তখন বাবা তার প্রা*ক্তন প্রেমিকাকে বিয়ে করার জন্য ডিবোর্স দেয় মা কে।আমার দাদি নিজে পছন্দ করে বাবাকে কে বিয়ে করাইছিলো।ছেলের এমন কাজ দেখে মানুষটা অসুস্থ হয়ে পড়ে।কিন্তু ছেলে কে কোনো ভাবেই মানাতে পারেনি বুড়ো মানুষটা।

ডি*বোর্সের পর মা অনেক আকুতি-মিনতি করেছিলো আমাকে তার সাথে নেওয়ার জন্য,কিন্তু বাবা আমাকে মায়ের সাথে যেতে দেয়নি।বরং মা যখন চুরি করে আমার খোজ-খবর নিতো আমাকে কিছু কিনে দিতো তখন সৎ মায়ের অত্যাচার আমার উপর বেড়ে যেতো।এক পর্যায়ে দাদি মায়ের হাত ধরে কান্না করে বলেছিলো,

‘রেখা মা আমার নাতনি টাকে ওরা জ্যান্ত মেরে ফেলবে।তুই ওর সাথে আর দেখা করিস না মা।দেখবি আল্লাহ্ যদি কখনো চায় তাহলে তোর মেয়ে তোর কাছেই ফিরে যাবে।’
মা সেদিন কাঁদতে কাঁ*দতে বেরিয়ে গেছে।যাওয়ার সময় অবশ্যই বাবাকে হুমকি দিয়ে গেছিলো,

‘আমার মেয়ের যদি পড়া-লেখা বা কোনো কিছুতে ত্রু*টি হয় তাহলে আমি তোমাকে কখনো ছেড়ে দেবো না।আমি চাইলে এখনো তোমাকে জেলে ঢুকাতে পারি।তার অবশ্যই অনেক কারনও আছে।তাই যদি জেলে ঢুকতে না চাও তাহলে আমার মেয়ের পড়া-লেখায় যেনো কোনো ত্রুটি না হয়।’

বাবার বর্তমানে যে মুদি দোকানটা আছে তা সে সময় মায়ের টাকা দিয়েই কিনেছিলো।তাই মায়ের হুমকিতে ভয় পেয়ে বাবা কখনো আমার পড়া-লেখা বন্ধ করেনি।এছাড়া বাকী সব অত্যাচার আমার উপর করেছিলো।শেষ যে কোন দিন তাকে বাবা বলে ডেকেছিলাম তাও মনে নেই আমার।

এমনো দিন গেছে সারাদিন কাজ করে এক বেলা খেতে দিয়েছে আমাকে সৎ মা।রাত্রে যখন সবাই মিলে খেতে বসে তখন তাদের পাশে দাড়িয়ে কার কি লাগবে সব কিছু গুছিয়ে/এগিয়ে দিতে হয় তাদের।অথচ সেই মেয়েটাই কতো রাত যে না খেয়ে ঘুমিয়ে গেছে তার খোজ কখনো কেউ করেনি।সারাদিনের সব অভিযোগ মনে পুষিয়ে রেখে রাতে আকাশের ওই তারাদের দিকে তাকিয়ে মা কে খুজতাম আর সব অভি*যোগের কথা তাকে বলতাম।আচ্ছা মা কি দেখছে তার ছোট্ট তুহা কতো বড় হয়ে গেলো?আজ তার বিয়ে ছিলো?

‘এ্যাই মেয়ে কোথা হারিয়ে গেলে তুমি?কখন থেকে ডাকছি তোমায়?’
হঠাৎ পুরুষালী কারো কন্ঠে এমন কথা শুনে চম*কে উঠে ভাবনা থেকে বেরিয়ে আসি আমি।পাশ ফিরে তাকিয়ে দেখি শৈবাল আমার দিকে ভ্রু কুচকে তাকিয়ে আছে।তাকে এভাবে তাকিয়ে থাকতে দেখে আমি কিছুটা হকচকিয়ে যাই।লোকটা এভাবে তাকিয়ে আছে কেনো?
‘কি হলো কি বলছি তোমাকে?’
‘কি বলছেন?’

প্রশ্নের পিঠে প্রশ্ন করায় চোখ বন্ধ করে ফোস করে নি*শ্বাস চাড়ে সে।আমি অবাক চোখে তাকিয়ে আছি।আজব লোকটা বিরক্ত বোধ করছে কেনো?আমি তো তাকে জ্বালাইনি।তাহলে?
‘কিছু খাবে তুমি?না মানে বাবা বললো তুমি নাকি দুপুর থেকে কিছু খাওনি আর এখন তো সন্ধ্যা হয়ে আসছে।এখনো কিছু খাবেনা?’

আজব শেষ কোন দিন কেউ আমাকে এই কথা জিজ্ঞেস করছে মনে পড়ছেনা।গত পনেরো বছরে হয়তো কেউ জিজ্ঞেস ও করেনি।আর এই মানুষটা যার স*ঙ্গে কয়েক ঘন্টার ব্যবধানে একটা পবিত্র স*ম্পর্কে জড়িয়েছি সে এখন আমাকে কথাটা জিজ্ঞাস করছে।তাও কতো মোলা*য়েম কন্ঠে ভেবেই আমার চোখ ছল*ছল করে উঠে।মনে পড়ে গত রাত্রে শেষ খেয়েছিলাম।সকাল থেকে এখনো কিছুই খাওয়া হয়নি।এতো কিছুর ভীড়ে খাওয়ার কথা মাথাতেই আসেনি।আমি কিছু না বলে নিচের দিকে তাকিয়ে আছি।শৈবাল ড্রাইভার কে গাড়ি থামাতে বলে একটা হোটেলের সামনে।ইতোমধ্যে আমরা গ্রাম থেকে অনেক দূরে চলে এসেছি।অতঃপর আমার দিকে তাকিয়ে বলে,

‘বুঝলাম তুমি স্বল্প ভাষী তাই বলে যেখানে কথা বলা উচিত সেখানেও কথা বলবে না?’
কথাটা শুনে আমি অবাক চোখে তাকাই শৈবালের দিকে।মনে পড়ে যায় পনেরো বছর আগের কথা।যখন মা আমাকে এতো বেশি কথা বলার জন্য বাচাল বলতো।

তখন বাচাল,চঞ্চল ছিলাম।এখন সব কিছুই ধোয়াসায় ঘেরা অতীত।ভেবেই শৈবালের দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসি।লোকটা এখনো আমার দিকে তাকিয়ে আছে দেখে কিছুটা অস্বস্তি হয়।শে হয়তো আমার অস্বস্তি বুঝতে পেরেই তাড়াহুড়ো করে গাড়ি থেকে বের হয়ে যায়।দশ মিনিট পর ফিরে আসে একহাতে বিরিয়ানির প্যাকেট আর এক হাতে এক বোতল পানি।আমার দিকে বিরিয়ানির প্যাকেট টা বাড়িয়ে দিয়ে বলে,

‘নাও খেয়ে নাও তাড়াতাড়ি।’
প্রচুর খিদে পেয়েছে কারনে কোনো বাক্য ব্যয় না করে তার হাত থেকে প্যাকেটটা নিয়ে খেতে শুরু করি।আড় চোখে একবার শৈবালের দিকে তাকিয়ে দেখি সে নিউজফিডে স্ক্রল করতে ব্যস্ত।এদিকে তার হুশ নেই।খাওয়া শেষ করে সিটে শরীর এলিয়ে দেই।প্রচুর ক্লান্ত লাগছে।অন্য দিকে গা গুলিয়ে আসছে।আমি শৈবালের দিকে তাকিয়ে বলি,

‘আমরা কোথায় যাচ্ছি?’
শৈবাল আমার দিকে একবার আড়চোখে তাকিয়ে আবার ফোনে মনোযোগ দেয়।ছোট্ট করে বলে,
‘শহরে।’
‘কতক্ষণ লাগবে যেতে?’
‘চার ঘন্টা।’
চার ঘন্টা শুনে আমি আতঁকে উঠি।এতো ঘন্টা জার্নি করতে গেলে মরেই যাবো হয়তো।গ্রামের বাহিরে এতোদূরে কখনো যাইনি।কিভাবে সম্ভব?

সাড়ে চার ঘন্টার পরঅবশেষে গন্তব্যে পৌছালাম।এর মধ্যে আমার অবস্থা অনেক শৌচ*নীয়।তিনবার বমি করেছি।ক্লান্ত হয়ে সিটে হেলান দিয়ে কখন যে ঘুমিয়ে পড়ি টেরই পায়নি।হঠাৎ গাড়ি থেমে যাওয়া ঘুম ভে*ঙ্গে যায় আমার।সদ্য ঘুম থেকে উঠেই বুঝতে পারিনি আমার অবস্থান বর্তমানে কোথায়।অতঃপর চারপাশে তাকিয়ে দেখি আমার পাশেই শৈবাল বসে ছিলো যে ইতোমধ্যেই গাড়ি থেকে বের হয়ে গেছে।আমার পাশে এসে গাড়ির ডোর খুলো দেয় দ্বিতীয় ভদ্রলোক।যিনি আমার শ্বশুড়।আমার দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে জিজ্ঞেস করে,

‘বেশি খারাপ লাগছে মা?এসো বের হয়ে এসো।’
‘না আঙ্কেল।সারা রাস্তা তো ঘুমিয়েই এসেছি।’
আমার কথা শুনে শ্বশুড় মশাই মুচকি হাসে।আমার হাত ধরে বাইরে নিয়ে আসে।আমরা একটা দোতলা বাড়ির সামনে দাড়িয়ে আছি।ইতোমধ্যেই বাড়ি থেকে এক এক করে সবাই বের হয়ে আসে।অচেনা পরিবেশে অচেনা মানুষ জন দেখে আমি লজ্জা আর অ*স্বস্তিতে মাথা নুইয়ে ফেলি।

নীড়ের খোজে পর্ব ১

‘চলো মামুনি।’
শ্বশুড় মশাইয়ের কন্ঠ শুনে তার দিকে তাকাই আমি।মুচকি হেসে সামনে পা বাড়াতে যেতেই চেনা মুখ দেখে আমি থমকে যাই।এই মানুষটাকে ছিনতে আমার কখনো অসুবিধে হয় না।হওয়ার কথাও না।আমি অবাক দৃষ্টিতে সামনে তাকিয়ে আছি।অস্ফুট স্বরে গলা থেকে বেরিয়ে আসে একটি মাত্র শব্দ।
‘মা’

নীড়ের খোজে পর্ব ৩