বিষাক্ত ভালোবাসা পর্ব ৫

বিষাক্ত ভালোবাসা পর্ব ৫
শারমিন আক্তার বর্ষা

সকাল থেকে এ পর্যন্ত দুইবার জ্ঞা’ন হারিয়ে ফেলছে ইয়ানা।
সকালে নাস্তা বানিয়ে রুহানির রুমে আসে ও’কে ডাকতে। রুমের মধ্যে রুহানিকে দেখতে না পেয়ে, রুহানির নাম্বারে কল দেওয়ার জন্যে সেলফোন হাতে নেয় সে তখন রুহানির মেসেজ গুলো দেখতে পায়। রুহানির মেসেজ গুলো পড়ে ফ্লোরে বসে কান্না জুড়ে দেয় ইয়ানা।

কিছুক্ষণ পর ফোনের লক খুলে তার খালার সাথে কথা বলে, রুহানি নেই খবর পেয়ে ইয়ানার খালা, খালাতো ভাই বোন ও তাদের সন্তান সবাই মিলে ইয়ানার ফ্ল্যাটে চলে আসে। সারাদিন ওনারা ইয়ানার পাশে থেকে বুঝাচ্ছে কিন্তু ইয়ানা কোনো কিছু তেই বুঝ মানছে না৷

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

রুহানির বাংলাদেশ সিম থেকে আসা মেসেজগুলো ইয়ানা দেখেছে কিছুক্ষণ আগে,মেসেজ চেক করে ওই নাম্বারে কল দিচ্ছে প্রতিবার’ই নাম্বার বন্ধ বলছে। চোখ দিয়ে অঝোরে অশ্রু গড়িয়ে পরছে। মেয়ের কোনো বিপদ হলো না তো? মাথার মধ্যে বাক্যটি ঘুরছে।

ভাবতে ভাবতে রুহানির বেডরুমে আসে। পুরো রুমে চোখ বুলাতে টেবিলে বইগুলোর মাঝে একটা ধূসর রঙের ডায়েরি দেখতে পেলো ইয়ানা, ডায়েরি টা হাতে নিয়ে প্রথম পৃষ্ঠা উল্টা তে থমথমে হয়ে গেলো সে। অশ্রুসিক্ত চোখে তাকিয়ে রইল ডায়েরির পাতার ওপরে।ইংরেজিতে রুহানির নিপুণ হাতে লিখা,
[ডিয়ার পাপা] -‘ প্রিয় বাবা!’

ডায়েরির প্রথম পাতায় বাবা নামক শব্দটি দেখে টেবিলের পাশে চেয়ারে ধপ করে বসে পরল ইয়ানা। বুকের মধ্যে ধুকপুক করছে, আলতো হাতে পরের পৃষ্ঠা উল্টালো সে। ডায়েরির সবগুলো পাতাতে রুহানি শুধু তার বাবাকে নিয়ে লিখেছে, শুঁকনো ঠোঁট জোড়া জিব দিয়ে খানিক ভিজিয়ে ইয়ানা পড়তে লাগে,

— বাবা, ও বাবা! তুমি কোথায়? তুমি কি জানো? তোমার মেয়ে তোমাকে ভীষণ মিস করে,এমন কোনো দিন যায় না যেদিন আমি তোমাকে মিস করি না। তুমি জানো, আমার সকল বন্ধু বান্ধবীদের সবার বাবা আছে, ওরা রোজ ওদের বাবাদের নিয়ে আমার সামনে গল্প করে। ওদের বাবা’রা ওদের কত ভালোবাসে। ওদের বার্থডে তে ওদের উইশ করে সারপ্রাইজ বার্থডে পার্টি দেয়।

ভার্সিটিতেও মাঝেমধ্যে ওদের বাবা’রা আসে। আমার দেখতে অনেক কষ্ট লাগে, শুধু মনে হয়,আমার বাবা কেনো নেই? আমার সব আছে, মা আমার কোনো কিছুর কমতি রাখেনি। তবুও আমার মনের মধ্যে শান্তি নেই। হাহাকার করে, প্রতিদিন আমি ছটফট করি,শুধু মাত্র আমার পাশে তুমি নেই বলে বাবা। তুমি কোথায় বাবা? আমার কথা কী তোমার একটুও মনে পরে না?

আমি মা’র কাছে তোমার কথা রোজ জিজ্ঞেস করতাম কিন্তু মা আমাকে বলতো না। আমিও চাই, আমার বাবা আমার কাছে আসুক, আমার বাবার ভালোবাসা আমার প্রাপ্য কিন্তু আমি সে ভালোবাসা স্নেহ থেকে বঞ্চিত। আমি তোমার কাছে আসবো বাবা,তোমাকে আমি খুঁজবো। আমি বাংলাদেশ আসবো বাবা। আমি তোমাকে খুঁজতে আসবো।

‘বাবা তোমার, রুহানি!’
ডায়েরি বুকের সাথে চেপে ধরে শব্দ করে কাঁদতে লাগল ইয়ানা। ওর কান্না শব্দ শুনে ড্রয়িং রুম থেকে বেডরুমে আসে ইয়ানার খালাতো বোন। ইয়ানার পাশে গিয়ে কাঁধে হাত রাখতে ইয়ানা তার বোনকে জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কাঁদতে লাগল। সে ইয়ানার কান্নার কারণ জিজ্ঞেস করায় ইয়ানা কান্না মিশ্রিত কণ্ঠে বলে,

— আমার এক আকাশ পরিমাণ ভালোবাসার পরও আমার মেয়ে বাবার অভাবে কান্না করে। বাবা নেই বলে কষ্ট পায়,আমার ভালোবাসায় কমতি ছিল,আমি পারিনি ওর বাবার জায়গা নিতে,রুহানি মনে মনে ওর কষ্ট দমিয়ে রাখতো। আমাকে বলেনি ও’ ওর বাবাকে চায়। ওর বাংলাদেশ যাওয়ার আসল কারণ হচ্ছে ওর বাবাকে খোঁজা।
ইয়ানার বোন সুজি শান্ত কণ্ঠে বলে,

— রুহানি তোকে বহুবার জিজ্ঞেস করেছিল, ওর বাবা কোথায়? কিন্তু তুই কিছু বলিসনি। প্রতিবার ওকে এড়িয়ে গেছিস। চলে গেছে ও বাংলাদেশ ওর বাবাকে খুঁজতে। কিন্তু আপু ভেবে দেখ, বাংলাদেশ ছোটো একটা শহর না, অনেক বড় একটা দেশ ওখানে ও কিছুই চিনে না। তাছাড়া ইয়াসির ভাইয়ার নাম ছাড়া রুহানি কিছু জানেও না, কখনো দেখেওনি। কিভাবে খুঁজবে রুহানি ওর বাবাকে? ইয়াসির নামে হাজারও মানুষ আছে বাংলার মাটিতে।

ইয়ানা,হাতের উল্টো পিঠ দিয়ে গাল মুছে নেয়,কর্কশকণ্ঠে বলে,
— আমি বাংলাদেশ যাবো। ২০বছর পর মেয়ের জন্য আমি ইয়ানা মেহফাজ বাংলাদেশ যাবো। আমার মন বলছে, আমার মেয়ে ভালো নেই। ও কোনো বিপদে আছে।

ফাঁকা রাস্তায় গাড়ি চলতে চলতে হুট করে থেমে গেলো,হঠাৎ ব্রেক কষায় পেছন থেকে খানিকটা সামনের দিকে ঝুঁকে পরলাম,ড্রাইভিং সিটটা আঁকড়ে ধরে,ড্রাইভারের উদ্দেশ্য বললাম,
— আশ্চর্য! এভাবে কেউ ব্রেক করে?
ড্রাইভার স্টিয়ারিংটা ডানে বামে ঘুরাতে ঘুরাতে বলে,

— গাড়ির ইঞ্জিনের প্রবলেম হইছে ম্যাডাম,গাড়ি আর সামনে যাবে না। গ্যারেজে নিতে হবে। এর থেকে আগে আপনাকে অন্য গাড়ি দিয়ে যেতে হবে।
ড্রাইভারের কথা আমার মাথার ওপর দিয়ে যাচ্ছে,কি বলছেন উনি,একে তো আমি পুরো একদিন ধরে জার্নি করতেছি আবার এ শহরে নতুন, কোনো কিছুই চিনি না। ঘন্টার পর ঘন্টা তার গাড়ি দিয়ে ঢাকা শহর ঘুরতেছি। আর উনি এখন বলছে গাড়ি সমস্যা, চলবে না।

অন্য গাড়ি দিয়ে চলে যান। মাথায় জেনো বাজ পরল, অভিমানে ঠোঁট জোড়া উল্টিয়ে কিয়ৎক্ষণ গাড়িতে বসে রইলাম। ড্রাইভারের আবারও ডাকে, ধ্যান ভাঙে আমার,ফ্যালফ্যাল দৃষ্টিতে তার দিকে তাকালাম। এদিকে সন্ধ্যে হয়ে আসছে। গাড়ির গ্লাস দিয়ে বাহিরে তাকাতে,চোখ ছলছল করে ওঠে। এখন এই মূহুর্তে আমি কোন দিকে যাবো? ভাবান্তর হয়ে ভাবতে লাগি। ড্রাইভার কম্পিতকণ্ঠে বলে,

— ম্যাডাম আপনি বললে,আমি অন্য একটা ট্যাক্সি দাঁড় করিয়ে দিচ্ছি।
এমনিতে রেগে আছি,তারওপরে উনার কথাশুনে কেনো জেনো গায়ে ফসকা পরল। তীক্ষ্ণ কণ্ঠে বললাম,
— লাগবে না আপনার কোনো সাহায্য। ভাড়া কত হয়েছে বলেন?

ভাড়া মিটিয়ে দিয়ে উনার গাড়ি থেকে নেমে পরলাম। রাস্তার পাশ দিয়ে হাঁটছি, এখানকার রাস্তায় যেমন ধুলোবালি তেমন ময়লা আবর্জনা,দেখেই বোঝা যাচ্ছে, যে যখন যেখানে খায়, তখন সে সেখানেই ময়লা ফেলে চলে যায়। বুঝলাম না,একটু কষ্ট করে ডাস্টবিনে ময়লা ফেললে তাদের কি হয়? লাগেজ টানতে টানতে হাঁটতে লাগলাম। রাস্তায় বেশ কয়েকজন আমার দিকে ঘুরে ঘুরে তাকাচ্ছে লক্ষ্য করছি। মনে হচ্ছে আমি চিড়িয়াখানার এক প্রাণী।

রাস্তার পাশে কয়েকজনকে শ্যামার বাড়ির এড্রেস দেখিয়ে জানতে চাইলাম,কোন দিকে যাবো। কেউ বলতে পারল না। নিরাশ হলাম হতাশাজনক দীর্ঘশ্বাস ফেলে হাঁটতে লাগলাম।কিছুদূর পথ আসতে আবারও কয়েকজনকে এড্রেস দেখিয়ে প্রশ্ন করতে একজন বলল,

— সোজা হাঁটতে থাকবেন,প্রায় মিনিট দশেক, তারপর একটা অটো নিয়ে বলবেন, সুরুজ ভিলা যাবো। অটো ওয়ালা আপনাকে নিয়ে যাবে। উনার কথা শুনে মনে হল,বেশ দূরে নয় খুব কাছেই। উনাকে ছোট্ট করে থ্যাঙ্কিউ বলে আগের ন্যায় হাঁটতে লাগলাম। দশ মিনিটের জায়গায় বিশ মিনিট ধরে হাঁটছি রাস্তা জেনো শেষ হচ্ছে না। এর ওপরে কয়েকজন লোক ইচ্ছে করে এসে ধাক্কা খাচ্ছে। মেজাজটা তিরতির করে বিগড়ে যাচ্ছে। কোনদিকে যাবো বুঝতে পারছি না। মাত্রাতিরিক্ত রাগে দাঁত চেপে রাস্তার পাশ দিয়ে হাঁটছি।

রাস্তার পাশে সাদা শার্ট ও কালো প্যান্ট পরে একটি মেয়ে দাঁড়িয়ে আছে। কানে ফোন কারো সাথে কথা বলছে। তার থেকে কিছুটা দূরত্বে কয়েকজন লোক গাড়ির সাথে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে মেয়েটার ওপরে নজর রাখছে। মেয়েটা বারবার এদিক ওদিকে তাকাচ্ছে একহাতে ফোন আর অন্য হাতে একটা লাগেজ, মনে হচ্ছে কোনো ট্যাক্সির জন্য অপেক্ষা করছে। কলে কাউকে বলছে,

— কিছুক্ষণের মধ্যে আমি এয়ারপোর্টে আসছি তোমরা ওখানেই চলে আসো। যতদ্রুত সম্ভব আমাদের বাংলাদেশ ছেড়ে যেতে হবে। কোনো ভাবেই A.S এর হাতে ধরা পরা যাবে না। তার হাতে ধরা পরা মানে হচ্ছে নিজের মৃ’ত্যু কে আমন্ত্রণ জানানো।
তীক্ষ্ণ চোখে মেয়ে টিকে পরক্ষ করা লোকটি গাড়ির ভেতরে বসা একজনকে বলে,

— বসকে ফোন লাগা।
লোকটার কথামতো একজন বস নামে সেভ করা নাম্বারে কল দেয়, কিছুক্ষণ কল বাজার পর কল রিসিভ করে। এপাশের লোকটি মেয়েটার দিকে একবার তাকিয়ে ফোনের ওপর পাশের লোকটার উদ্দেশ্য বলে,
— বস মেয়েটা আমাদের সামনেই দাঁড়িয়ে আছে।
ফোনের অপরপ্রান্তের লোকটি রাগী ও শক্ত গলায় বলল,

— যত দ্রুত সম্ভব ওকে A.S এর কাছে নিয়ে আসো।
লোকটি ‘ঠিক আছে’ বলে কল কেটে গাড়ির ভেতরে থাকা কয়েকজনকে উদ্দেশ্য করে বলে,
— বসের পারমিশন পেয়ে গেছি চল।
লোকগুলো নিজেদের মধ্যে কথা বলতে লাগে। এদিকে ওই মেয়েটি তার জায়গা থেকে সরে যায়। সে ফোনে কথা বলতে বলতে অন্য দিকে হেঁটে যাচ্ছে। পিছন থেকে রুহানি মেয়েটির জায়গায়,ঠিক যেখানে ওই মেয়েটি দাঁড়িয়ে ছিল, ওখানে এসে দাঁড়ালো।

রাস্তার চারপাশে চোখ বুলাতে লাগলাম। কোনো ট্যাক্সি বা রিক্সা দেখছি না। খানিক বিরক্ত হলাম,মনে হল এখন শ্যামাকে কল দিতেই হবে। ওকেই বলি ,এখানে এসে আমাকে নিয়ে যাবে। প্যান্টের পকেটে সবে মাত্র হাত দিলাম, ঠিক সেই মুহূর্তে পিছন থেকে কোনো এক পুরুষালী হাত আমার মুখের উপর রুমাল রেখে আমার মুখ শক্ত করে চেপে ধরলো।

দুইপাশ থেকে দু’জন পুরুষ আমার দুইহাত ধরে টানছে। চোখ জোড়া বড়সড় করে তাকালাম। শুনশান রাস্তা, তেমন কোনো মানুষ জন নজরে আসছে না। মুখ দিয়ে অস্ফুটস্বরে নানান আওয়াজ বেরিয়ে আসছে। নিজেকে ছাড়াবার আপ্রাণ চেষ্টা করলাম। তিনজন লোকের সাথে পেরে ওঠছি না। একটা সময় নিস্তেজ হয়ে ঠলে পরলাম। চোখ জোড়া বন্ধ হয়ে আসছে,হাজার চেষ্টা করেও মেলে রাখতে পারছি না।

— আর কত বাড়ির মধ্যে পায়চারি করবি শেফালি। এখন একটু বয়।
চাচীর কথা শুনে দাঁড়িয়ে পরল শ্যামা। বাড়িতে সবাই তাকে শেফালি বলে,কানাডায় যখন পড়তে গিয়েছিল তখন তার বন্ধুরা শ্যামা নাম টাকে ছোট করে শ্যাম বলে ডাকতো। শ্যামা খানিক বিরক্ত হল,গম্ভীর ও চিন্তিত কণ্ঠে বলে,

— চিন্তা হচ্ছে চাচী। রুহানি বাংলাদেশে প্রথমবার আসছে। আর সেটাও আমার জন্য, একবার ভেবে দেখো,এতক্ষণে ওর আমাদের বাড়িতে পৌঁছে যাওয়ার কথা কিন্তু ও এখনো আসেনি। তার চেয়ে বড় কথা এখন ওর ফোনটাও বন্ধ বলছে, জানি না কোথায় আছে? ওর কিছু হলে, আন্টি কে আমি কি জবাব দিবো তুমিই বলো?
শ্যামার বাবা, মেয়েকে উদ্দেশ্য করে নির্মূলকণ্ঠে বলল,

— চিন্তা করিস না। হয়তো ফোনে চার্জ নেই। আর জানিসই তো, ঢাকা শহরের জ্যাম। কিছুক্ষণের মধ্যে দেখিস চলে আসবে।

এক আলিশান বাড়ির সামনে এসে একটা গাড়ি থামলো। জ্ঞানহীন রুহানিকে ধরে,গাড়ি থেকে বের করে বাড়ির ভেতরে নিয়ে আসে। ড্রয়িংরুমে সোফার ওপরে রুহানিকে শুইয়ে দেয়। প্যান্টের পকেট থেকে ফোন বের করে বস নামক মানুষ টাকে কল দেয়। সে কল রিসিভ করে বলে,

— সবাই চোকান্না থাকো ও জেনো পালাতে না পারে।আধঘন্টার মধ্যে আমি পৌঁছে যাবো।
সন্ধ্যে ছয়টা বাজে, সাদা রঙের একটা গাড়ি এসে বাড়ির সামনে থামে,গাড়ির ড্রাইভার আগে বের হল। সে বের হয়ে এসে গাড়ির পিছনের ডোরটা খুলে দিতে কালো পোশাক পরিধান কারী একজন সুঠাম দেহের পুরুষ গাড়ি থেকে নামে। তীক্ষ্ণ চোখে ড্রাইভারের দিকে তাকিয়ে সে সামনে এগিয়ে যায়।

ড্রাইভার মাথা নিচু করে ওখানে দাঁড়িয়ে রয়। পরপর আরও একটি গাড়ি এসে থামে,সে গাড়ি থেকে চারজন ছেলে নেমে লোকটার পিছন পিছন হেঁটে যায়। কিয়দংশ পর, কলিংবেলটা বেজে ওঠে, বাড়ির মেড গিয়ে দরজাটা খুলে দেয়। একে একে পাঁচ জন বাড়ির ভেতরে আসে। ভ্রু কুঁচকে লোকটি শক্ত ও গম্ভীর কণ্ঠে শুধালো,

— মেয়েটি কোথায়?
মানুষটার সামনে উপস্থিত সকলে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে, একজন কম্পিত কণ্ঠে বলে ওঠে,
— বস মেয়েটি ড্রয়িংরুমে সোফার ওপরে শুয়ে আছে।
পিছনে চারজনের মধ্যে একজন এসে লোকটার শার্টের কলার চেপে ধরে শাসিত কণ্ঠে বলল,
— মেয়েটাকে নেওয়ার জন্য আর জায়গা পাওনি? A.S এর বাড়িতে নিয়ে আসছো কেন?
লোকটি থতমত খেয়ে যায়৷ আমতাআমতা করে বলে,

— বস বলেছিলেন মেয়েটার সাথে পার্সোনালি ডিল করবেন। তাই বাড়িতে নিয়ে আসতে।
সুঠাম সুন্দর পুরুষ গম্ভীর কণ্ঠে বলে,
— উমমম, প্রবীর ছাড় ওকে। আমিই বলেছি নেহাকে আমার বাড়িতে নিয়ে আসার জন্য, আমার সাথে চিট করার শাস্তি আমি ওকে আমার বাড়িতে দিবো।
প্রবীর লোকটার কলার ছেড়ে দেয়। পিছন থেকে আমান A.S এর সামনে এসে দাঁড়ালো আর বলল,

— কিন্তু A.S তুই কি ভুলে যাচ্ছিস বাড়িতে দাদীমা আছেন।
A.S নামের লোকটি দু-হাত প্যান্টের পকেটে ঢুকিয়ে চোয়াল শক্ত করে দাঁড়িয়ে বলে,
— তোর কি আমাকে ইস্টুপিট মনে হয়? দাদী বাড়িতে থাকলে কি তাকে বাড়িতে নিয়ে আসতে বলতাম নাকি?
দাদী নাই, আশ্রমে গেছেন, দু’দিন পর আসবেন।

কথাটি বলে, উনি ড্রয়িং রুমের দিকে অগ্রসর হল। তার পিছু পিছু বাকিরাও যেতে লাগে। A.S নামক লোকটি আয়েশি ভঙ্গিতে সোফার ওপর বসে। এদিকে নড়েচড়ে ওঠছে রুহানি। তাকে নড়তে দেখে একজন লোক তার দিকে এগিয়ে যেতে লাগে, A.S এক হাত তুলে বাঁধা দেয়। তার হাতের ইশারায় লোকটা জায়গাতে দাঁড়িয়ে পরে। রুহানির দু-হাত পিছনের দিকে নিয়ে রশি দিয়ে বেঁধে রাখছে। মুখমণ্ডলে একটা কালো কাপড় দিয়ে বাঁধা। জ্ঞান ফিরছে, কোনোমতে ওঠে বসল সে। A.S রাগান্বিত কণ্ঠে রুহানির উদ্দেশ্য প্রশ্ন ছুঁড়ছে। রুহানি কোনো উত্তর দিচ্ছে না, দেখে রাগে সে দাঁতে দাঁত চেপে কটমট করছে।

চেহারায় কাপড় বাঁধা,কিছুই দেখতে পারছি না। মুখমণ্ডলে রুমাল বাঁধা,কথা বলতে পারছি না। লোকটার প্রশ্নের উত্তর কিভাবে দিবো জানা নেই। তার থেকে বড় কথা হল,এরা কারা? আমাকে এখানে ধরে বেঁধে কেন নিয়ে আসছে? বোধগম্য হচ্ছে না কিছু। ভয়ে গলা শুঁকিয়ে আসছে। পাশ থেকে আরও একজন পুরুষের গলা পেলাম, সে বলল,
— ও কথা না বললে, সোজা গু’লি করে ওর খু’লি উড়িয়ে দে।
লোকটার কথায় আমি রীতিমতো হকচকিয়ে ওঠলাম, না পারছি নড়তে চড়তে, আর না পারছি কিছু বলতে। বুকের মধ্যে হার্টবিট জেনো তীব্র গতিতে ছুটছে।

অন্যদিকে রুহানিকে উত্তেজিত হতে দেখছে A.S ভ্রু যুগল কুঞ্চিত করে তীক্ষ্ণ চোখে রুহানির নড়াচড়া দেখে ঠোঁট জোড়া বাঁকা করে মৃদু হাসছে। ডান হাতের তর্জনী দিয়ে কপাল চুলকাচ্ছে, অষ্টদ্বয় জুড়ে আছে অমায়িক হাসি। ঠোঁট জোড়া চুকো করে থুতনিতে আঙুল রাখে,গম্ভীর কণ্ঠে বলে,
— আমার গোডাউন থেকে মা’ল সরিয়ে তুমি দেশ ছেড়ে পালিয়ে যাচ্ছিলে। কি ভাবছিলা A.S এর হাত থেকে বেঁচে যাবে? A.S হাত গুটিয়ে বসে বসে দেখবে? এতই সহজ?

ও কণ্ঠে গাম্ভীর্য শুনে, ভয় ও আতংকে ঘাবড়ে ওঠলাম। মনে হচ্ছে এখানে লোকটা একা নয়, আরও অনেকে আছে। এতগুলো মানুষের মাঝে আমি একা, তার ওপরে একজন বলছে,গু’লি করে মে’রে ফেলবে। মা’র কথা খুব মনে পরছে। চিৎকার করে কাঁদতে ইচ্ছে করছে। নিজের ওপর ভীষণ রাগ লাগছে। চোখের কার্নিশ বেয়ে অশ্রুকণা গড়িয়ে পরছে। মনে হচ্ছে, আমি আর আমার বাবাকে খুঁজতে পারবো না। আর আমার মা’র কাছেও ফিরে যেতে পারবো না।

A.S বসা থেকে ওঠে হেঁটে রুহানির সামনে এসে দাঁড়ায়। নিজ হাতে সে মেয়েটার মুখের কাপড়টা সরাবে। মেয়েটাকে ছটফট করতে দেখে ভীষণ আনন্দিত হচ্ছে সে। নিজ হাতে মা’র’বে। রুহানির একপাশে সোফার ওপরে পা তুলে রাখে A.S তাত্ক্ষণিক গলা খাঁকারি দিয়ে,হাত বাড়ালো।

— নিজের খুব কাছে পুরুষের এক অভয়ব ঠাহর পেলাম। ধর থেকে জেনো আ’ত্মা টা এখনই বেরিয়ে যাবে। অচেনা জায়গা, তারপর কিডনেপার’স। আমি নিতান্তই একজন সাহসী মেয়ে। কিন্তু কেনো জানি না, এখন আমার ভীষণ ভয় লাগছে। কি হবে আমার?

A.S হাত বাড়িয়ে রুহানির চেহারার ওপর থেকে কালো কাপড়টি খুলে ফেললো। কাপড়টি সরাতে মুখ বাঁধা অবস্থায় রুহানিকে দেখে A.S মোহিত চোখে তাকিয়ে রয়। ভীতু চোখে রুহানি লোকটির দিকে তাকিয়ে আছে। ভয়ে বেশ কয়েকবার চোখের পলক ফেলল সে।
নেহার জায়গায় রুহানিকে দেখে, ক্ষীপ্ত হল তাজ। সে তেড়ে গিয়ে একজন কিডনেপারের গালে ক’ষে চ’ড় মা’রল,আর তীক্ষ্ণ কণ্ঠে বলে,

— অ’ন্ধ হয়েছিস? ভুলভাল মেয়েকে তুলে নিয়ে আসছিস? এই মেয়েটা কে? আর নেহা কোথায়?
লোকটি গালে হাত রেখে বলে,
— স্যার আমরা তো নেহাকে ফলো করছিলাম। উনার জায়গায় এ মেয়ে কোথা থেকে আসছে কখন আসছে আমরা বলতে পারি না।
ওয়াসিফ কর্কশকণ্ঠে A.S এর উদ্দেশ্য বলে,

— এখন কি হবে A.S? এই মেয়ে তো আমাদের সবার চেহারা দেখে নিয়েছে। ওকে কি আমরা ছেড়ে দিবো নাকি মে’রে মাটি চাপা দিয়ে দিবো?
ওয়াসিফ লোকটার কথা কর্ণকুহরে আসতে বড়বড় চোখ করে লোকটার দিকে তাকালাম। তৎপর আবার আমার সামনে খানিকটা ঝুঁকে দাঁড়িয়ে থাকা লোকটার দিকে তাকালাম। এতক্ষণে আমি এটা খুব ভালো করে বুঝে গেছি যে, এখানে এই A.S নামের মানুষ টা হচ্ছে সবার মাথা। উনি যা বলে সবাই তাই করে। ভয়ে উনার দিকে তাকিয়ে ডানেবামে মাথা নাড়াতে লাগলাম। মানে হচ্ছে, আমাকে মার’বেন না।

লোকটা সরু চোখে আমার চোখের দিকে তাকিয়ে আছে। ঠোঁটের কোণে প্রস্ফুটিত এক চিলতে হাসি। সে মূহুর্তে তার বাম হাতের দিকে চোখ যেতে দেখলাম, উনার হাতে একটা পি’স্ত’ল। পি’স্ত’লের ওপর থেকে চোখ সরিয়ে লোকটার চোখে চোখ রাখলাম। তারপর আর কিছু মনে নেই, মাথা ঘুরিয়ে আসলো।

বিষাক্ত ভালোবাসা পর্ব ৪

রুহানি জ্ঞান হারিয়ে পরে যেতে নেয়। A.S দুইহাত দিয়ে রুহানিকে ধরে ফেলে। আচমকা পরে যাওয়ায় খোলা চুলগুলো এলোমেলো হয়ে চোখে মুখে এসে উপচে পরছে। A.S আলতো হাতে রুহানির মুখের ওপর থেকে চুলগুলো সরিয়ে দিচ্ছে। A.S পি’স্তলের মাথা নিজ কপালে ঠেকিয়ে, রুহানির মুখশ্রীর দিকে তাকিয়ে ঠোঁট জোড়া বাঁকা করে রহস্যময়ী হাসি হাসল। ও হাসি দেখে বোঝার উপায় নেই,কি চলছে তার ধুরতর মস্তিষ্কে।

বিষাক্ত ভালোবাসা পর্ব ৬