বিষাক্ত ভালোবাসা পর্ব ৪

বিষাক্ত ভালোবাসা পর্ব ৪
শারমিন আক্তার বর্ষা

‘দুই মাসের গ’র্ভ’ব’তী ইয়ানা,চার দিনের মাথায় বাংলাদেশ থেকে ইতালি চলে আসে,তার বাবা মা’র কাছে। নিজের সাংসারিক ঘটনা ও বাচ্চার খবর তাদের জানালেন। ইয়ানার বাবা মেয়ের ওপর ভীষণ নারাজ,সেজন্য ইয়ানাকে নিজের কাছে রাখতে চাইলেন না। ইয়ানার বাবা গম্ভীর কণ্ঠে বলে,

— যেদিন তুমি আমার মান সম্মান ন’ষ্ট করে বাড়ি ছেড়ে চলে গেছো। সেদিন থেকেই তুমি আমার কাছে মৃ’ত। ইয়ানার বাবার কথার পিঠে তার মা কিছু বলতে পারেননি। শুধু শাড়ির আঁচলে মুখে চেপে ধরে নিশ্চুপে কান্না করেছেন। ইয়ানার ফিরে আসার খবর পেয়ে তার খালামনি তাকে কল দেয়। ইয়ানার খবর অবশ্য তাকে ইয়ানার মা জানিয়েছে,খালামনির সাথে কথা বলল ইয়ানা।

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

তিনি ইয়ানাকে নিজের কাছে কানাডা চলে আসতে বলেন। যা হওয়ার হয়ে গেছে ভেবে, অতীত পিছনে ফেলে কানাডা খালা মনির কাছে চলে আসে ইয়ানা। উচ্চ শিক্ষিত মেয়ে দেখতে স্মার্ট, লম্বা। এক মাসের মধ্যে ভালো একটা কোম্পানি তে জব পেয়ে যায়। নিজের দায়িত্ব নিজের কাঁধে তুলে নেয় ইয়ানা।
দিনের শেষে,তিন সন্ধ্যে বেলায় নিজের একাকীত্ব কে সঙ্গী করে নেয় সে।

অন্ধকারে আচ্ছন্ন ঘর,কোথাও কোনো আলোর চিহ্ন নেই। ঘরের মধ্যে খটখট একটা শব্দ হচ্ছে,ইজি চেয়ারে বসে দোল খাচ্ছে। কিয়ৎক্ষণ পর,ঘরটি আলোয় আলোকিত হয়ে ওঠে,২০বছরের একটি মেয়ে দরজা ঠেলে ঘরে ঢুকে লাইট জ্বালালো। তীক্ষ্ণ চোখে তাকিয়ে শাসিত কণ্ঠে বলে,

— মা! সেই ছোটো থেকে দেখছি,তুমি রোজ তিন সন্ধ্যে বেলা একটা রুমের মধ্যে একা বসে থাকো,তাও আবার ঘুটঘুটে অন্ধকার করে। রুমের লাইট পর্যন্ত অন করো না আর দরজা জানালা বন্ধ করে রাখো। রোজ রোজ এমনটা কেনো করো?
মেয়েটির কথা কর্ণকুহরে আসতে চেয়ার দুলানো বন্ধ করে,ঘাড় কাত করে পিছনে তাকায় ইয়ানা, কোলের ওপর থেকে চোখের চশমাটি হাতে নিয়ে তা চোখে পরিধান করেন। ঝাপ্সা চোখে বার কয়েক চোখের পলক ফেলে। অনেকটা সময় অন্ধকারে ছিল,ও হুট করে লাইটের আলোয় চোখ আবছায়া দেখছে। কিছুক্ষণ পর,লাইটের আলোর সাথে দৃষ্টি মিলে যেতে তিনি সরু কণ্ঠে বলে,

— তোমাকে কতবার বলেছি রুহানি। এই সময়টা আমার একান্তই ব্যক্তিগত, আর এই সময়টায় আমার আশেপাশে কারো উপস্থিতি আমি সহ্য করতে পারি না। তবুও কেন তুমি চলে আসো?
রুহানি ঠোঁট জোড়া উল্টিয়ে কিয়ৎক্ষণ তার মা’য়ের দিকে তাকিয়ে রইল,তৎপর তার মা’য়ের সামনে এসে পায়ের সামনে হাঁটু ভাজ করে বসে। করুণ কন্ঠে বলে,

— মা। আমি আজ তোমাকে বিরক্ত করতে আসিনি। একটা গুরুত্বপূর্ণ কথা বলতে আসছি।
— এখন যখন চলেই আসছো,তা বলেই ফেলো কি বলতে আসছো।
— মা তোমাকে বলেছিলাম না,আমার ফ্রেন্ড শ্যাম’র বিয়ের কথা?
রুহানির কথায় তার মা ভাবান্তর হয়ে শুধালো,

— হ্যাঁ ওই যে, ওই মেয়েটা, কি জেনো নাম তার?
— ওর পুরো নাম শেফালি শ্যামা। ওর বিয়ে মা আগামী সপ্তাহে ও আমাকে বাংলাদেশ থেকে রোজ দশবার করে কল দিচ্ছে এবং বলছে আমি যদি না যাই তাহলে ও বিয়ে করবে না।
ইয়ানা তীক্ষ্ণ চোখে মেয়ের দিকে তাকিয়ে শক্ত গলায় বলে,

— কোথায় কানাডা আর কোথায় বাংলাদেশ? তোমার কি মাথা খারাপ হয়ে গেছে রুহানি? তোমাকে আমি ছাড় দিয়েছি বলে,এতটাও ছাড় দেইনি যে তুমি একা একা বাংলাদেশ চলে যাবে। তোমার ওই ফ্রেন্ডকে বলে দাও,তুমি যেতে পারবে না।
তীক্ষ্ণ কণ্ঠে কথাটি বলে রুহানির সামনে থেকে তার মা ওঠে চলে যায়। অভিমানে,ঠোঁট জোড়া উল্টিয়ে ঠাই বসে রইল রুহানি। শুঁকনো ঢোক গিলে মনে মনে বলল,

— তুমি যেতে দিবে না। তাই তো মা? দেখো আমিও তোমার মেয়ে! আমি বাংলাদেশ যাবোই। সেটা যেভাবেই হোক এই রুহানি আয়রান বাংলাদেশ যাচ্ছে।
সূর্যের প্রথম কিরণ,পৃথিবীর বুকে উপচে পরছে। অন্য দিকে বিভোরে ঘুমাচ্ছে ইয়ানা। আজ মা’য়ের ঘুমিয়ে থাকার সুযোগ নিবে রুহানি। ছোট এক লাগেজে নিজের সাময়িক কিছু পোশাক নিয়ে নিজ রুম থেকে বের হয় রুহানি। মায়ের রুমের বাহির থেকে উঁকি দিয়ে একবার মা’কে দেখে তারপর বাড়ি থেকে বেরিয়ে পরে।

ঘন্টা খানেক পর,এয়ারপোর্টে চলে আসে। পিছনে তাকিয়ে ভারী নিঃশ্বাস ফেলে কানাডাকে বিদায় জানিয়ে ইমিগ্রেশন দিয়ে ভেতরে চলে যায়। কানাডা থেকে ঢাকা রুটে সরাসরি ফ্লাইট। জীবনের প্রথম ইতালি বাদে ভিন্ন দেশে ভ্রমণ করছে রুহানি তবুও একা। বুকের মধ্যে ধুকপুক করছে। ভারী নিঃশ্বাস ফেলে বিড়বিড় করে বলে,

— আমাকে ক্ষমা করে দাও মা। আমাকে যে করে হোক বাংলাদেশ যাওয়ার ছিল,ছোট নানীর থেকে শুনেছি বাংলাদেশে আমার বাবা আছে। আমার বিশ বছর বয়স পূর্ণ হতে আর মাত্র দুই সপ্তাহ বাকি আছে। এই পর্যন্ত আমি যতবার তোমাকে আমার বাবার কথা জিজ্ঞেস করেছি তুমি ততবার আমাকে এড়িয়ে গেছো। এবার আর নয়,আমি আমার বাবাকে খুঁজে বের করবো। তার আগে হচ্ছে বান্ধবীর বিয়ে।

দীর্ঘ ১৫ঘন্টা জার্নি করে ঢাকা এয়ারপোর্ট থেকে বের হলাম,পরদিন সকাল,দশটায়। বাংলার মাটিতে পা রাখতে মনে এক প্রশান্তি বয়ে গেলো। যা আমি উপলব্ধি করতে পারলাম। মৃদু হেসে বললাম,
— আপা ঠিক বলেছিল বাংলাদেশ মানেই এক বুক ভালোবাসা। সম্পূর্ণ অচেনা একটা শহর,একা একা চলে আসলাম। মা’কে বলেও আসিনি। মা’র নাম্বারে টেক্সট পাঠিয়ে ছিলাম।

তবুও এতক্ষণে মনে হয় মা পাগলের মত হয়ে গেছে। তাই বাংলাদেশের সিম টা ফোনে সেট করে আগে মা’র নাম্বারে ডায়াল করলাম। মা কল রিসিভ করল না বলে,কয়েকটা মেসেজ পাঠিয়ে দেই। আমি ঠিক আছি,আমার জন্য চিন্তা করো না,আমি বাংলাদেশে পৌঁছে গেছি।

ফোনটা প্যান্টের পকেটে রেখে একটা ট্যাক্সি ভাড়া করলাম। আমি আসবো তা শুধু মাত্র আমার বান্ধবী জানে,ও এয়ারপোর্টে আসবে বলেছিল,আমিই আসতে দেইনি শুধু বলেছিলাম তোর লোকেশন মেসেজে পাঠিয়ে দাও। এদিকে ট্যাক্সি ওয়ালা অর্ধেক বেলা আমাকে ঢাকার অলিগলি ঘুরাচ্ছে কিন্তু ঠিকানা পাচ্ছে না। অবশেষে বিরক্ত হয়ে বান্ধবীর নাম্বারে কল দিলাম। একবার রিং হতে সে কল রিসিভ করে,ফোনের এপারে আমার কণ্ঠ শুনে স্যরি বলতে লাগল। আমি জিজ্ঞেস করতে ও বলে,

— ভুল হয়ে গেছে রেএ। আমি এড্রেস খানিকটা ভুল লিখে ফেলছি। খেয়াল করিনি। স্যরি তুই বল এখন কোথায় আছিস? আমি আসছি এখনই।
ওর কথাশুনে রাগে দাঁত চেপে ধরলাম। ১৫ঘন্টা পর এখন ৯ঘন্টা পুরো একটা দিন আমি শুধু জার্নি করছি আর সে কি না আমাকে ভুল এড্রেস দিছে। রাগ লাগলেও ফোনে কিছু বললাম না। গাড়ির ড্রাইভারের সাথে ওর কথা বলিয়ে দিলাম। ড্রাইভার শ্যামার সাথে কথা বলে,ঠিকানা বুঝে নেয়। পাঁচ মিনিট কথা বলে, ড্রাইভার বলল,

— আচ্ছা ম্যাডাম! আমি একঘন্টার মধ্যে ম্যাডাম কে জায়গা মত নিয়ে আসছি।
ড্রাইভার কথা শেষ করে ফোনটা আমার দিকে এগিয়ে দেয়। ফোন কানে লাগিয়ে তীক্ষ্ণ কণ্ঠে বললাম,
— একবার বাড়ি আসতে দে তারপর তোর একদিন আর আমার যে কয়দিন লাগে।

মাত্রাতিরিক্ত রাগে কলটা ঠুসস করে কেটে দিলাম। কথা বলার মুড টাই নষ্ট করে দিছে। অন্যদিকে আমি কল্পনাও করিনি, ঢাকা শহরে এত জ্যাম পরে। নয় ঘন্টা ধরে জ্যামে বসে ছিলাম। গাড়িতে বসে থাকতে থাকতে কোমরটা জেনো ধরে আসছে। পিঠ টাও চিনচিন ব্যাথা করছে। নিজের ওপরে ভীষণ রাগ উঠতাছে।

বিষাক্ত ভালোবাসা পর্ব ৩

মনে হচ্ছে গাড়ি থেকে নেমে হাঁটা শুরু করি। এখন আবার আধাঘন্টা ধরে জ্যামে বসে আছি। বেশ কয়েকবার শ্যামা কল দিচ্ছে। বিরক্ত হয়ে ফোনটা সাইলেন্ট করে রাখলাম। সাইলেন্ট মুডেও ফোনটা বেশ বেজে চলেছে। শুনতেই পাইনি।
— বান্ধবীর বিয়ের জন্য বাংলাদেশ এসে, কি’ডনে’প হয়ে গেলাম। কথাটা হা’স্যক’র হলেও এটাই সত্য।

বিষাক্ত ভালোবাসা পর্ব ৫