নীড়ের খোজে গল্পের লিঙ্ক || জান্নাতুল বিথী

নীড়ের খোজে পর্ব ১
জান্নাতুল বিথী

‘তুহা জানিস শুনলাম তোর স্বামী নাকি বো*বা?’
চাচাতো বোন সুমাইয়া আপুর বলা কথাটা শুনেও আমার তেমন ভাবাবেগ হলো না।আমার ঠোটের কোণে তখনো সুক্ষ হাসি বিদ্যমান।এই মানুষটার হাত ধরে যখন আমি মু*ক্তির পথে পা বাড়াবো তখন তার দোষ ধরে আমার কি লাভ।সে আমাকে মুক্ত করবে এই ন*রক থেকে।অবশেষে সৎ মায়ের ক*বল থেকে রক্ষা পাবো কথাটা ভাবলে মনে অদ্ভুত একটা শান্তি মিলে।তাও কতূ*হল দমাতে না পেরে সুমাইয়া আপুকে বলি,

‘তুমি জানো কিভাবে আপু?’
‘আরে তোর জামাইকে যখন কবুল বলতে বলছে কবুল বলে নাই।এই বাড়িতে আসার পর তার মুখ থেকে একটা কথাও বের হয়নি।তোদের এখন কোর্ট ম্যারেজ হইছে।আইন-গত দিক থেকে তোরা স্বামী-স্ত্রী হলেও ইসলামিক দিক থেকে না।’
মুচকি হেসে কথাটা বলে সুমাইয়া আপু।

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

যেনো আমার স্বামী বোবা এই কথাটা শুনে সে খুব খুশি।অবশ্যই খুশি হলেও হতে পারে।এই দুনিয়ায় আমার ভালো যে কেউ দেখতে পারে না তা জানা আছে আমার।আপু এই কথাটা শুনে অবাক হইনি আমি।একটু হলেও ধারনা আছে যে মানুষটা আমাকে বিয়ে করবে সে কখনো নিজের ইচ্ছেয় বিয়েটা করবে না।তাই হয়তো ক*বুল বলার সময় কোনো কথা বলেনি সে।তাই সবাই হয়তো ভেবে নিলো সে মানুষটা বোবা।এসব এখন আর আমাকে ভাবায় না।আমি শুধু এখন একটা কথা ভাবতে থাকি সারাক্ষণ কখন মু*ক্তি পাবো এই বাড়ি থেকে?

দিনের প্রথম প্রহর।কাক ডাকা ভোরে ঘুম থেকে উঠে কাজে লেগে পড়ি আমি।ঘর-উঠান ঘাড়ু দিয়ে মাটির চু*লায় রান্না বসাই।একটু পরে উঠে সবাই নাস্তা করবে তার আয়োজন করছিলাম আমি।রান্না যখন শেষ পর্যায়ে তখন পাশের বাড়ির রিতুর আম্মা আসে।এসেই আমার পাশে বসে এক গাল হেসে বলে,

‘আম্মা জান চাচিরে এক বোতল সয়াবিন তেল দাও তোমার চাচা আইজ বিকালেই নিয়ে আসবে।তহন চাচি দিয়া যামু।’
চাচির কথা শুনে ভয়ে ভয়ে তাকাই তার দিকে।তেল দেওয়াটা কোনো ব্যাপার না কিন্তু যখন তেল দেওয়ার কথা সৎ মা শুনবে তখন আমার পিঠের ছা*ল তুলবে।তাই আমি আমতা আমতা করতে থাকি।চাচি হয়তো আমার মনের কথা কিছুটা আ*ন্দাজ করতে পেরেছে তাই বলে,

‘তুমি চিন্তা কইরো না আম্মা কেউ জানবে না।চাচি কাউরে জানাবো না।খুব দরকার যে আম্মা।’
মা তখনো ঘুমে বি*ভোর তাই আমি কিছু না ভেবে তাকে তেল দিয়ে দেই।রান্না শেষে টেবিলে সব কিছু গুছিয়ে রাখি।তার কয়েক ঘন্টা পর আব্বা নাস্তা করে দোকানে চলে যায়।তুলি-তুহান কে নিয়ে আম্মা স্কুলে যায়।তাই এর ফাঁ*কে সব কিছু ঘুছিয়ে নাস্তা করতে বসি আমি।

এক টুকরো রুটি ছিঁড়ে মুখে তুলবো তখনই হঠাৎ আম্মা আসি আমার চুলের মু*ঠি ধরে কয়েক ঘা লাগিয়ে দেয়।আমি অবাক চোখে তার দিকে তাকিয়ে আছি।কেনো মারছে সে আমাকে কথাটা একটু হলেও আন্দা*জ করতে পেরেছি ইতোমধ্যে।তাও কাঁদলেও এখন আর চোখ থেকে পানি পড়ে না।কাঁদতে কাঁদতে দু’চোখ ক্লান্ত আজ।আম্মু কয়েকটা গা*লি দিয়ে বলে,

‘সংসারে চাল-তেল কি তোর না*গর কিনে দেয়?তোর সাহস হয় কিভাবে বাহিরের মানুষরে তেল দেওয়ার?নিজেইতো বাপের ঘাড়ের উপর বসে খাচ্ছিন তাও পেট ভরে না।মানুষরে খাওয়াচ্ছিস কেনো?আ*পদ টা বিদেয়ও হয়না।ঘাড় থেকে নামবি কোন দিন তুই?’

বলেই আমাকে ধাক্কা দিয়ে ফে*লে দেয়।আমি কিছু না বলে নিচের দিকে তাকিয়ে আছি।ভাঙ্গা চেয়ারের কোণায় লেগে তখনো কপাল থেকে কয়েক ফোটা র*ক্ত গাল বেয়ে অবহেলায় নিচে পড়ে যায়।আম্মা গালা*গালি করতে করতে ঘর থেকে বের হয়ে যায়।কোনো মতে শরীরটা টেনে রুমে গিয়ে শুয়ে পড়ি আমি।এরপর আর কিছু মনে নেই।যখন চোখ মেরে তাকাই তখন চারদিক থেকে আম্মার বকা*বকির আওয়াজ কানে আসে।

একটু কান খাড়া করে শুনে দেখি আমাকেই বকছে।এখনো দুপুরের রান্না বসাইনি তাই এতো বকা*বকি।শুয়ে পড়ার পর কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছি নিজেও খেয়াল করিনি।তাড়াহুড়ো করে উঠে মুখে পানির ছিটে দিয়ে চুলায় রান্না বসাই।তাড়াহুড়ো করতে গিয়ে হাত পু*ড়িয়ে ফেলি।না চাইতেও মুখ থেকে মৃদু চিৎ*কার বের হয়।

দাঁদে দাঁত চেপে সে ব্যাথা হ*জম করে নেই হঠাৎ উঠান থেকে চিৎ*কার চেঁচামেচির আওয়াজ পেয়ে আমি হুড়*মুড়িয়ে রান্না ঘর থেকে বের হয়ে আসি।এসে দেখি দুইজন মধ্যবয়স্ক লোক আম্মার সাথে তর্কা*তর্কি করছে।ভালো করে পরখ করে দেখলাম না এদের কাউকে আমি কখনো দেখিনি।তাদের চাল-চলনে একটা শহুরে ভা*ব আছে।বাহিরে আসতেই একজনের ন*জর আমার দিকে পড়ে।লোকটা আমার কাছে এগিয়ে এসে আমার মাথায় হাত রেখে কোমল সুরে জিজ্ঞেস করে,

‘তুমি তুহা মামনি?’
ভদ্রলোকের কথা শুনি আমি পিট*পিট করে তার দিকে তাকিয়ে উপর নিচ মাথা নাড়িয়ে “হ্যা” বলি।ভদ্রলোক আমার কপালের শুকনো র*ক্তে আলতো হাত বুলিয়ে বলে,
‘এই মহিলাটা তোমার উপর অনেক অত্যা*চার করে তাই না মা?’

আমি অবাক দৃষ্টিতে লোকটার দিকে তাকাই।লোকটা কে ছিনতে পারছি না আমি।আম্মা যতই খারাপ হোক অপরিচিত কোনো লোকের সামনে আমি কখনো তা প্রকাশ করবো না।তাই লোকটাকে বলি,
‘জ্বী না আঙ্কেল আপনি হয়তো ভু*ল বুঝছেন।’

আমার কথা শুনে দ্বিতীয় ভদ্রলোক আমার কাছে এগিয়ে এসে বলে,
‘সেটা তো আমরা দেখতে পাচ্ছি মামনি।তোমাকে আর এখানে থাকতে হবে না।আমরা নিয়ে যে*তে এসেছি তোমাকে এখান থেকে।”

ভদ্রলোকের কথা শুনে আমি অনেক খুশি হই।এই বাড়ি থেকে বের হওয়ার জন্য আল্লাহ্ কাছে কতো প্রার্থনা করেছি তা কেবল আল্লাহই ভালো জানে।পরক্ষনেই মনে পরে এই দুইটা মানুষকে আমি ছিনি না।আম্মাও যেতে দিবেনা কখনো।আমার ভাবনার মাঝেই আম্মা চেঁচি*য়ে উঠে বলে,

‘এই এই কারা আপনারা?আপনাদের না চলে যেতে বলেছি?ল*জ্জা করেনা অ*পরিচিত মানুষ জনের বাড়ি বয়ে এসে এমন করতে?বেরিয়ে যান আমার বাড়ি থেকে।তুহা কোথাও যাবেনা।সম্পর্ক*হীন মানুষের সাথে তো একদমি না।’
আম্মার কথা শুনে দ্বিতীয় ভদ্রলোক মুচকি হেসে বলে,
‘তুহা মামনি তুমি একটু ঘরে যাও তোমার মায়ের সাথে একটু কথা আছে।’

লোকটার কথা শুনে আমি অদ্ভুত দৃষ্টিতে তার দিকে তাকাই।বুঝতে পারলাম এখানে সমস্যা*টা মূলত আমাকে নিয়ে।তাদের মাঝে তর্কা*তর্কিও আমাকে নিয়ে হচ্ছে।আমার মনে তখনো একটা কথাই চলতেছিলো আমি হয়তো মুক্তি পাবো এই ন*রক থেকে।মুক্তির স্ব*দ হয়তো আমিও নিতে পারবো।

ঘরে আসার পর কি হলো আমি কিছু জানিনা।একটু পর আম্মা এসে আমার হাতে একটা শাড়ি ধরিয়ে দিয়ে বলে পরে নিতে আজ নাকি আমার বিয়ে।আমি অবাক হয়ে আম্মাকে প্রশ্ন করতে যেতেই ধম*কে উঠেন আমাকে।তাই আর সাহ*স হয়নি কিছু বলার।তবুও আমি রাজি হতে চাইনি কারনে চ*ড়-থা*প্পড় খেতে হইছিলো কয়েকটা।আব্বাকে দোকান থেথেকে ডেকে আনার জন্য লোক পাঠানো হইছে।আব্বা আসার পর একদম সাদামাটা করে ঘরোয়া ভাবে বিয়ে সম্পুর্ন হয় আমাদের।

অদ্ভুত হলেও সত্য আমার বিদা*য়ের সময় একটু কান্নাও করিনি আমি।তুলি আমার হাত ধরে বাহিরে নিয়ে আসে।
‘দুলাভাই আমার আপারে আপনের হাতে তুইলা দিলাম।আপনে আপার যত্ন নিয়েন কেমন?’
বলে একজনের হাতে তুলে দেয় আমাকে।বলা বাহু*ল্য তখনো লোকটাকে দেখিনি আমি।

একটা মেয়েকে একজন স্বামীর হাতে তুলে দেয়ে তার মা কিংবা বাবা।আর আমার দায়িত্ব পালন করছে একটা দশ বছর বয়সী মেয়ে।কি অদ্ভত নিজের ভাগ্য ভেবেই তাচ্ছিল্যের হাসি দিয়ে লোকটার মুখের দিকে তাকাই।লোকটা ভ্রু কুচকে তাকিয়ে আছে আমার হাতের দিকে।তাও কোনো কথা বলেনি দেখে আমি ভেবে নিলাম লোকটা হয়তো সত্যিই কথা বলতে পারেনা।

‘শৈবাল বউমাকে নিয়ে গিয়ে গাড়িতে বসো যাও।’
শৈবাল নামটা দু’বার মনে মনে আওড়ে নিলাম আমি।দ্বিতীয় ভদ্রলোক কথাটা বলে আমার স্বামী নামক মানুষটাকে।কথাটা শুনে উনি কোনো দিকে না তাকিয়ে আমার হাত ধরে টেনে নিয়ে যায় গাড়ির কাছে।শেষ বারের মতো নিজের জন্ম-স্থানের দিকে তাকিয়ে বুক চি*রে একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে।আর হয়তো কখনো ফেরা হবেনা নিজ গ্রামে।আমাকে গাড়িতে বসিয়ে শৈবাল আমার পাশের সিটে বসে ভ্রু কুচকে বলে,

‘মেয়ে কাঁদচো না কেনো তুমি?’
শৈবালের কথা শুনে চোখ পিটপিট করে তাকাই তার দিকে।লোকটা তাহলে কথাও বলতে পারে?আর বাড়ির সবাই কি লোকটা কথা বলতে পারেনা কারনে পৈচাশিক আনন্দ পাচ্ছে ভেবেই মনে মনে কিছুক্ষণ হাসলাম।লোকটা এখনো আমার দিকে ভ্রু কুচকে তাকিয়ে আছে দেখে বলি,

‘কাঁদবো কেনো আমি?’
‘ওমা আজকে না তোমার বিয়ে?সেই হিসেবে তো তোমার কান্না করা উচিত।’
শৈবালের এই ধরনের কথায় এক মুহূর্তের জন্য আমার মাঝে চঞ্চলতা ফিরে আসে।উৎসুক দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে বলি,
‘আজকে তো আপনারও বিয়ে ছিলো তাহলে আপনি কান্না করছেন না কেনো?’

নীড়ের খোজে পর্ব ২