নীলপদ্ম গেঁথে রেখেছি তোর নামে পর্ব ১৩

নীলপদ্ম গেঁথে রেখেছি তোর নামে পর্ব ১৩
ইফা আমহৃদ

অপূর্ব লুসমি দিয়ে গরম পাতিল কলতলায় নিয়ে এলো। হিম পানির সাথে উষ্ণ পানির মিশ্রণ করে তাকাতেই দেখল তার ব্যবহারিত স্যাবলন সাবান নিখোঁজ। গম্ভীর হয়ে ভাবার সময় শ্রবণ হলো পানি ঝাপটানোর শব্দ। অগ্রসর হলো দিঘির দিকে। শীতকালে বৃষ্টিপাত হয়না বললেই চলে, যাতে পানি শুকিয়ে গেছে অনেকটাই।অন্যদিকে দিঘি পুনরায় খনন করতে হবে। চারপাশের মাটিতে পূর্ণ হয়ে এসেছে দিঘি। হাতে গোনা কিছু মাছ রয়েছে। তিনবোন গোসল করছে। একে অপরের দিকে পানির ছিটা দিচ্ছে। সাবানটা শানের উপর রাখা। বিরক্ত হয়ে বলে, “সাবানটা নিয়ে এসেছিস, বলবি না?”

সবাই অপূর্ব-র দিকে দৃষ্টি মেলাল। অতঃপর শেফালী বলে, “ভুলে গিয়েছিলাম, নিয়ে যান এখন।”
অপূর্ব তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে সাবান নিয়ে পুনরায় কলতলার দিকে অগ্রসর হওয়ার প্রচেষ্টা করতেই আরু বলে, “অপূর্ব ভাই, এখন শীত নেই। এদিকে আসুন একসাথে গোসল করি।”
“আমি সাঁতার জানি না।” অপূর্ব থেমে বলে।

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

“দিঘির জলে সবাই গোসল করতে পারেনা পূর্ব ভাই। আপনি তো কখনোই পারবেন না। একমাত্র ভালো মনের মানুষেরাই দিঘিতে এভাবে ভেসে থাকতে পারে, আপনার মনে তো কাঁদা।” আরু পানি ছুড়ে ব্যঙ্গ করে বলে। অপূর্ব থেমে গেল। ধীর পায়ে হেঁটে দিঘিতে নামল। খেজুর গাছের উপর‌ হাঁটু সমান পানিতে দাঁড়িয়ে রইল কিছুক্ষণ। অতঃপর আরও কিছুটা নামতেই সে অনুভব করল, এই দিঘি তাকে ডোবাতে পারবে না।

আরুর মস্তিস্কে হানা দিল দুষ্টু বুদ্ধি। ডুব দিয়ে অপূর্ব-র খুব নিকটে ভাসমান হলো, পশ্চাৎ। নিজের পিঠে পাওয়া আঁচড়ের বদলা নিতে অপূর্ব-র পিঠে চেপে বসল। মাথাটা চেপে দিঘির জলে দিল চুব। বিশ সেকেন্ড পার হওয়ার পর একুশ সেকেন্ডের মাথায় আরু অনেক দূরে। অপূর্ব ঘনঘন শ্বাস ফেলে। নি/র্দয় পরিস্থিতি অনুভব করে শেফালীর হাতটা চেপে তুর বলে, “এখানে দাঁড়িয়ে নিজের পিন্ডি চটকানোর চেয়ে চল ভাগি। এখানে আমাদের রাজত্ব চললেও স্থলে ভাইয়ের রাজত্ব। তাছাড়া শুনলেও মা মা/রবে।”

শেফালী টু শব্দ উচ্চারণ না করে গন্তব্যের দিকে অগ্রসর হলো। দুই বোন যখন স্থলে উঠে গেছে তখন ধ্যান ভাঙল আরুর। তার হাতে অপূর্ব-র লুঙ্গি। চাইলেও ওঠা অসম্ভব। স্থলের দিকে যাত্রা শুরু করে স্তব্ধ হলো অপূর্ব। আশেপাশে দৃষ্টি নিবদ্ধ করে আরুর দিকে নজরবন্দি করে তার লুঙ্গির হদিস পেল। চ্যাঁচিয়ে বলে, “আরু আমার লুঙ্গি দে বলছি। এটা কোন ধরনের অসভ্যতামি?”

“এটা আরুর শাস্তি। আপনার সাহস হয় কীভাবে ‘পূর্ব-পশ্চিম’ ভাই, আমার পিঠে আঁচড় কাটার? আপনাকে জাস্ট একটু ট্রেইলর দেখালাম।” আরুর দৃঢ় কণ্ঠ। অপূর্ব কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে রইল। কুলকিনারা না পেয়ে অন্য বুদ্ধি প্রয়োগ করে, “তুই আমার লুঙ্গি কেড়ে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছিস। কারণ তুই আমাকে এই অবস্থায় দেখতে চাস, তাই তো? শুধু শুধু পানির ভেতরে না দাঁড় করিয়ে বলতি, সরাসরি দেখাতাম। নিজের প্রতিটি অঙ্গ তো শতবার দেখি, একবার না-হয় তুই দেখলি।”

বলতে বলতে বুক সমান পানি দেয়া কোমর সমান পানি এলো। অতি প্রিয় ভাঁজ কা/টা ও জিম করা দেহের দিকে এক নজর অপলক চেয়ে রইল। গতিরোধ করল না অপূর্ব। এগিয়ে চলেছে ক্রমশ। পরিস্থিতি অনুভব করে পল্লব বন্ধ করে পশ্চাৎ ঘুড়ে আরু। দেয় ভুবন ভোলানো চিৎকার, “নাহহ! আমি দেখব না। আর একটুও এগোবেন না আপনি।”
অপূর্ব স্মিত হাসে। বলে, “আমি থামব না, শুধু এগিয়ে যাবো। যতক্ষণ আমার লুঙ্গি আমার হাতে না-আসে, ততক্ষণ এভাবে থাকব।”

পশ্চাৎ দিকে মুখ করে থাকে আরু আর সমুখে তাকায় না। লুঙ্গি ছুড়ে দেয় অপূর্ব-র দিকে। পরিধান করে লুঙ্গি। অতঃপর অপূর্ব এগোয় ক্রমশ। জলধারা অপসারিত হয়ে দুইজন মানব অদূরে এলো। সম্পূর্ণ জলাধারাকে অপসারিত করতে পেছন থেকে কোমর জড়িয়ে অঙ্গে অঙ্গে মিলিত করল দুটি দেহ। আরু থরথর করে কাঁপছে। এত জলের মাঝেও সে পিয়াসু। ওষ্ঠদ্বয় কানের লতিতে মিশিয়ে বলে, “দিলি কেন লুঙ্গি, চেয়েছি আমি? তুই তো দেখতে চেয়েছিস।”

স্পর্শগুলো আরও গাঢ় হয়ে এলো, বিচরণ করল নগ্ন কোমরে। অথচ আজ তার দেহে তুরের ব্লাউজ রয়েছে। কম্পিত আরু না-বোধক জবাব দেয়, “না, আমি দেখব না।”

অপূর্ব-র সেখানে বুক পর্যন্ত পানি, আরুর সেখানে গলা পর্যন্ত পানি। অপূর্ব পানিতে ডুব দিয়ে পাঁজাকোলা করে নিল আরুকে। আরু সাঁতার জানে বিধেয় অপূর্ব গলায় আড়কে ধরল না। ডাগর ডাগর চোখে শুধু চেয়ে রইল। নাকের সাথে নাকের ডগায় সুড়সুড়ি দিয়ে আলতো করে চুমু খেল ললাটে। আরু কেঁপে উঠল। নেত্রপল্লব গ্ৰথন করে রাখল। অপূর্ব ফিসফিস করে বলে, “এটা দিঘি নয়, নদী। প্রেমনদী। প্রেমতরঙ্গ। প্রেমতরঙ্গে বহমান প্রেমের জোয়ারে ভাসাতে অপূর্ব প্রস্তুত।”

অতঃপর অপূর্ব ঠেলে ভাসিয়ে দিল আরু-কে। আরু উলটা সাঁতারের দিল। কাতল মাছ আরুর পায়ের করতল স্পর্শ করে। সাঁতারের ফলে ঢেউয়ের সৃষ্টি হলো।
প্রেমেরও জোয়ারে, ভাসাবে দোঁহারে
বাঁধন খুলে দাও, দাও! দাও! দাও!
ভুলিব ভাবনা, পেছনে চাবো না
পাল তুলে দাও, দাও! দাও! দাও!

আরুর জ্বর নেমে এসেছে স্বাভাবিক মাত্রায়। মামাবাড়িতে থেকে পড়াশোনা দিব্যি চলছে আরুর। শীতকালে দিনের তুলনাত্মক রাত দীর্ঘ হয়। স্কুল ছুটির পর থাকে অপরাহ্ণ। আরু ও শেফালী নদীর ধানে অপেক্ষারত তুরের জন্য। ঝোপঝাড়ের মাঝে প্রয়াসের সে কিছু বলছে, তাও দীর্ঘক্ষণ। মাগরিবের আযান ঘনিয়ে আসছে। ব্যাকুল হয়ে আরু শুধাল, “কতক্ষণ লাগবে তুর? তাড়াতাড়ি আয়-না। চিন্তা করছে সবাই।”

“কেউ চিন্তা করছে না। আমি রোজ দেরি করে যাই।” ঝোপঝাড় থেকে তুর বলে উঠে। রাস্তার মাঝে পদচারণ করছে উৎসুক হয়ে উঠল আরু। শেফালী ললাটে উগ্র ভাঁজ ফেলে বলে, “ওর জন্য রোজ রোজ বাড়িতে যেতে দেরি হয়। মনে চায় আমিও একটা প্রেম করি।”

“করবি?” আগ্রহ নিয়ে মাটির রাস্তায় বসেছে আরু। সঙ্গ দিতে শেফালীও বসেছে। কিঞ্চিৎ পর তন্বীকে দেখা গেল এই অভিমুখো হতে। সংশয় নিয়ে বলে, “তোরা দুটোয় এখানে বসে কী করছিস? তুর কোথায়?”
“জানে কে? গিয়ে দেখ, নদীর পানিতে পা ডুবিয়ে বসে আছে দুটোতে। কতবার লুকিয়ে লুকিয়ে গেলাম দেখতে।” বিরক্ত প্রকাশ পেল শেফালীর গলায়। আরুর অগোচরে শেফালী, তুর ও তন্বী ফন্দি এঁটেছে কিছুর। অতঃপর অস্ফুট স্বরে বলে, “পরানের দোকানে ঐ ক্যাসেট টা এনেছে শুনলাম। তুর যতক্ষণে ফিরে আসবে ততক্ষণে আমরা দুজনে নিয়ে আসি।”

“কী ক্যাসেট?” আরুর সাদামাটা প্রশ্ন। কেউ উত্তর দিল না। আরুকে প্রহরীর দায়িত্ব দিয়ে ছুটে গেল দুজনে, একা দোটানা নিয়ে বসে রইল সেখানে। পেরিয়ে গেল ক্ষণ। লাল রঙের জ্ঞাত স্লিপার দৃষ্টিগোচর হতেই ঊর্ধ্বভাগে দৃষ্টি নিবদ্ধ করল আরু। অপূর্ব-কে সমুখে দেখে নোনা জল সঞ্চয় হলো ললাটে। আশেপাশে তাকিয়ে দুইবোনের সন্ধান করতে করতে হুংকার দিল অপূর্ব, “ভর সন্ধ্যায় এখানে বসে বসে কী করছিস? সঙ্গি দুটোয় কোথায়?”

অপূর্ব-র হুংকারে কেঁপে উঠে আরু। দুই বোনকে গালমন্দ করছে নিরবে আরু। অপূর্ব আজ সকালে শহরে গেছে। অফার করা চাকরিটা কনফার্ম করতে। বাড়ি ফিরে তিনবোনকে না দেখে এদিকে এসেছে।
ততক্ষণে শেফালী ও তন্বী ফিরত এসেছে। আরুর তার হাত দুটো ঢেউখেলানোর ন্যায় উপর থেকে নিচে নামিয়ে ইশারা করছে দুজনকে। পুনরাবৃত্তি করছে হিস, হিস। অপূর্ব হতভম্ব হয়ে বলে, “এমন করছিস কেন?”

রাস্তার ধানে ইঁদুর গর্ত করে রেখেছে। দুইপাশে বিভিন্ন আকৃতির মাটি জমানো। আরু ইতস্তত করে বলে, “অপূর্ব ভাই, আপনি তো‌ ইঁদুর ভয় পান। তাই ইঁদুর লড়াচ্ছি।”

নীলপদ্ম গেঁথে রেখেছি তোর নামে পর্ব ১২

“তাহলে পেছনের দিকে তাকিয়ে কেন.. বলতে বলতে পশ্চাৎ ফেরার প্রয়াস করে অপূর্ব। সেই বাক্যকে মাঝপথে দাঁড়ি টেনে হুট করে অপূর্ব-র হৃদমাঝারে ঝাঁপিয়ে পড়ে আরু। হিতাহিত ঘটনায় অপূর্ব নির্বাক। হুট করে সাজানো মিথ্যা কথাগুলো অপূর্ব-র হৃৎপিণ্ডের ধুকপুকানির কাছে হেরে গেল। দ্বি মুহূর্ত এভাবে অতিবাহিত হলো। অপূর্ব ছাড়িয়ে নিল নিজেকে। ধমক দেয়, “মাঝরাস্তায় কী হচ্ছে এইসব আরু? তুই তো এমন বেপরোয়া ছিলি না।”

নীলপদ্ম গেঁথে রেখেছি তোর নামে পর্ব ১৩ শেষ অংশ