নীলপদ্ম গেঁথে রেখেছি তোর নামে পর্ব ২০

নীলপদ্ম গেঁথে রেখেছি তোর নামে পর্ব ২০
ইফা আমহৃদ

বিছানায় আধশোয়া হয়ে নিদ্রায় মগ্ন অপূর্ব। দ্রুত গতিতে উড়ে আসা বাজপাখিটা অপূর্ব-র ঘরের টিনের উপর গতি রোধ করে। সেই অপত্যাশিত শব্দে অপূর্ব-র ঘুম হরতাল পালন করে। অপূর্ব ধরফরিয়ে উঠে বসে।

অবিরাম ধারায় আঁচড়ে চলেছে টিনের চালে। দীর্ঘক্ষণ এমন চলতে থাকলে ছিদ্র হয়ে কখনো সূর্য, তো কখনো আকাশের চাঁদ ঘরে বসেই উপভোগ করা যাবে। জুতা জোড়া পায়ে দিয়ে ঘর থেকে বের হয় অপূর্ব। অগনিত ঢিল মা/রতেই পাখিটা উড়ে গেল। অপূর্ব ঘরে ফেরত এলো। মাঝপথে শুনতে পেলাম তিন চাচি ও মায়ের গলা। ‘আরু’ নামটা শ্রবণ হতেই অপূর্ব পায়ের গতিরোধ করে থামল। মল্লিকা বললেন, “ভাবী, অপূর্ব তো আরুকে বিয়ে করবে। কিন্তু আরু তো কাজ জানে না। ছেলের বিয়ের আগে নাহয় আমরা রান্না করতাম। এখন কি বিয়ের পরেও আমরা রান্না করব?”

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

অনিতার চোখ মুখে ঘুম ঘুম ভাব। হাই তুলে নিজের ঘরের দিকে যেতে যেতে বলে, “মল্লিকা, তুমি যখন এই বাড়িতে এসেছিলে। তখন রান্না জানতে না। এখন জানলেও সবদিক আমাকেই সামলাতে হয়। আরুও নাহয় তোমাদের মতো আমার কাতারে পড়ুক।”

মল্লিকা ফের প্রশ্ন ছুড়ে, “তবুও। রান্না জানে না, সারাদিন টইটই করে। বিয়ের পরও কি উড়নচণ্ডী থাকবে?”
“তোমার শেফালী আরুর চেয়ে সুন্দর নয়। ওর মতো এত কাজ জানে না। তুমি বরং নিজের মেয়েকে রান্না শেখাও।” অনিতা ঘরের দিকে অগ্রসর হতেই অপূর্ব আড়ালে গেল। তপ্ত নিঃশ্বাস ফেলে ঘরের দিকে কদম ফেলে।

আজকের সকালটা ভীষণ আলাদা। খোলা জানালা দিয়ে মৃদু হাওয়ার পাশাপাশি বয়ে আসা কোকিলের কুহু কুহু ডাকে ঘুম পালায় আরুর। আধশোয়া হয়ে জানালা দিয়ে বাইরে গলিয়ে দিল হাত। শীতের সময়ের অভ্যাস এটা তার। শীতের কুয়াশা হাতে লাগলে কেঁপে কেঁপে উঠা। ভীষণ মনে পড়ছে শীতকে। তার পাশে তিন বোন তিন ভঙ্গিতে নিদ্রায় আসক্ত। শুক্রবার বলে আজ বাড়ির পরিবেশ অন্যদিনের চেয়ে ক্ষান্ত, সবাই ঘুমানো বলেই হয়তো। বালিশের পাশে থেকে ওড়না গলায় জড়িয়ে বেরিয়ে পড়ে আরু। সেদিনের ন্যায় বাড়ির সামনে থাকা বড়ো নিমগাছ থেকে ডাল ভেঙে দাঁত মাজতে মাজতে দিঘির দিকে অগ্রসর হলো। মল্লিকা সেখানে গরুর গোস্ত ধুচ্ছে।

আজ অপূর্ব-র হাসপাতালে ইমার্জেন্সি আছে। সকালে খেয়ে দুপুরের খাবার নিয়ে বের হবে এবং তাড়াতাড়ি ফিরে আসবে। আরু ঘাটলার উপর বসে বলে, “মামি এত সকাল সকাল কী রান্না করছ? আজকে না সবার ছুটি।”
“অপূর্ব-র কাজ আছে হাসপাতালে। ওর জন্যই রান্না করছি। সপ্তাহে একটি দিন সবার সাথে খাবে। আর পাঁচটা দিনের মতো তো দেওয়া যায় না। ভাবীর শরীরটা ভালো নেই, তাই আমি রাধছি।

কতবার অপূর্ব-কে বলা হলো বিয়ে করে নে। ও যদি বিয়ে করে নিতো আমার কি এখন রান্না করা লাগত?” হাতের কাজ করতে করতেই মল্লিকা বলে। অতঃপর নিজের কাজ শেষ করে উঠে এগোয়‌ রান্নাঘরের দিকে। অপূর্ব-র জন্য রান্না করার তীব্র বাসনা আরুর। অথচ সে রাঁধতে জানে না। হাত থেকে নিমের ডালটা ফেলে দিয়ে পানির কাছাকাছি নেমে স্পর্শ করে পানি। তিন-চারবার মুখমণ্ডলে ছিটিয়ে অস্ফুট স্বরে বলে, “মামি, আমি আসছি‌। আমি আজ তোমার থেকে রান্না শিখব।”

মল্লিকা গোস্তের তরকারি চাপিয়েছে উনুনে। আরু তাতে পাতা দিয়ে আগুন নিয়ন্ত্রণ করছে। প্রয়োজনীয় মশলা দিয়ে কষিয়ে পানি দিল। লবণ ও মশলার পরিমাণটা চেখে উল্লেখযোগ্য পরিমাণে এলো কি-না পর্যবেক্ষণ করে নিল। অতঃপর আরুকে নির্দিষ্ট একটা ইঙ্গিত দিতে বলে, “এই পর্যন্ত পানি শুকিয়ে গেলে নামিয়ে রাখিস। আর ধীরে ধীরে পাতা দিস। নাহলে শক্ত থেকে যাবে।”

আরু সায় দিয়ে নিজের কাজে ব্যস্ত হলো। আরুর চোখমুখে আনন্দের জোয়ার বইছে। আজ মামীর থেকে সবটা শিখে নিয়েছে, অন্য একদিন সে রান্না করে সবাইকে খাওয়াবে। মল্লিকা রুটি গোল করতে ব্যস্ত হয়ে গেলেন।
অনিতা টিফিন ক্যারিয়ারে খাবার গুছিয়ে টেবিলের উপর রাখার পাশাপাশি অপূর্ব জন্য থালা সাজাল। আটার রুটি, গরুর গোস্ত ও ডিম ভাজি। ভাই বোনেরা একত্রে খেতে বসেছে। অপূর্ব গোরুর গোস্তে কামড় দিয়ে হতভম্ব হলো।

প্রচণ্ড শক্ত যে দাঁত দিয়ে কেনো ছেঁড়া যাচ্ছে। টান দিতে গেলেই ঝোল ছিটে তার সাদা শার্টের লাগল। অপূর্ব-র চোখমুখ বিরাগী হয়ে উঠে। হাসপাতালের জন্য তৈরি হয়ে নেমেছে হে। অতঃপর চোখমুখ শক্ত করে বলে, “ভালোভাবে সিদ্ধ হয়নি ম।, দাঁত দিয়ে ছিঁড়তে গিয়ে কী অবস্থা হয়েছে? নিজের চোখে দেখ। মনে হচ্ছে গন্ডারের গোস্ত রান্না করেছ‌।”

অপূর্ব থালা সরিয়ে রাখতেই মল্লিকা-কে উদ্দেশ্য করে বলে অনিতা, “সিদ্ধ হয়েছে কি-না নামানোর আগে ভালোভাবে দেখে নিবি না। ছেলেটা এখন না খেয়ে যাবে না-কি আশ্চর্য। সবসময় তো আমিই দেখি, আজকে শুধু পারলি না।”
অদূরে আরু দাঁড়িয়ে মাথা নিচু করে রেখেছে লজ্জা ও ভয়ে। মল্লিকা আরুর দিকে চেয়ে করুন ইশারা করতেই অনিতা বলে, “পাঁচ মিনিট দাঁড়া তুই, আমি একটু তাপ দিয়ে আনি। শুধু একটু শক্ত হয়েছে, বাকি সব ঠিক আছে।”

“তখন যখন পারো নি, এখন আর দরকার নেই মা।”‌ অপূর্ব বলে টেবিল ছেড়ে উঠে নিলেই এগিয়ে আসে আরু। নতজানু হয়ে বলে, “আমার জন্য এমন হয়েছে। আজকে আমি মামির সাথে রান্না শিখছিলাম।”
“আজকেই কেন শিখতে হবে তোর? ফুফুকে বলে শিখতে পারতি। বিরক্তিকর। আর এখানে কী তোর?”টেবিলে আঘাত করে তীব্র গলায় বলে অপূর্ব। অপমানে পানসে হয়ে আসে আরুর মুখ। অনিতা সামাল দেওয়ার চেষ্টা করে, “থাম অপু, একটু তাপ দিলেই সিদ্ধ হয়ে যাবে। অহেতুক চ্যাঁচামেচি করিস না।”

“সেটা আমিও জানি, তবে এত সময় আমার কাছে নেই মা। আমাদের বাড়ির মেয়েরা তো টইটই করে না সারাদিন, ওর কেন টইটই করতে হবে? ফুফু ওকে শুধু শুধু মা/রে না, মা।” অপূর্ব রোষে আছে। গতকালের ব্যাপার নিয়ে চিন্তিত সে।
আরুর ডান চোখ এক ফোঁটা অশ্রু ঝরাল। বামচোখ পূর্ণ হয়ে আসার আগেই অনিতার দিকে না চেয়ে বলে, “আমি যাই মামি, মা আমার জন্য চিন্তা করছে।”

আরু স্থির না থেকে গতিশীল করল মা। কথায় আছে না পেটে টান পড়লে ভালোবাসা জানালা দিয়ে পালায়, ব্যাপারটা এমন। আরু চোখের আড়াল হতেই অনিতা বলেন, “তুই আসার আগে আরু সহজে এই বাড়িতে আসেনি অপু‌‌। আরু রাজহাঁস ভয় পেত। মামা বাড়িতে আসবে তাতেও টইটই হয়ে যাবে।”

“আমাদের বাড়িতেও তিনটা মেয়ে আছে মা, কই ওরা তো অকারণে বাইরে পা ফেলে না।” অপূর্ব বলে।
“কিন্তু আরুকে তুই ভালোবাসিস। কিছুদিন পর এই বাড়ির বউ হয়ে আসবে সে। ওর ক্ষেত্রে নিয়ম আলাদা।” বলতে বলতে উঠে গেলেন চম্পা। অপূর্ব ফের বাক্য করে, “তোমরা বাড়িতে বউ হয়ে আসার পরে দাদি রান্নাঘর থেকে ছুটি পেয়েছে। তেমনি আমি ও তিয়াস বিয়ে করলে তোমরা ছুটি পাবে। আরু যদি রান্না বান্না না জানে, আমি তো ওকে শোপিচ হিসেবে সাজিয়ে রাখব না। রূপ দিয়ে তো আমি ধুয়ে ধুয়ে পানি খাবো না, গুণেরও প্রয়োজন হবে।”

“আরু রান্না বাদে সব জানে অপু। ইমদাদ ভাই সারাবছর ঢাকায় পড়ে থাকে। আরুই তো ক্ষেতে কাজ করে, ছাগলের জন্য ঘাস কা/টে। শীতের সময় সবজি লাগায়, খেজুরের রস নামিয়ে বিক্রি করে। আবার পড়াশোনাও করে।” মণি বলে।
“বিয়ের পর মেয়েদের কাজ বাড়িতে। কোনো ভালো বাড়ির বউ নিশ্চয় ক্ষেতে কাজ করবে না।

সবসময় তো নিজের মনের কথা শুনে চললেই হবে না, মাঝেমাঝে মস্তিস্কের কথাও শুনতে.. অপূর্ব বাক্য শেষ না করে থামল। তাকাল দরজার পানে, সেখানে আরু দাঁড়িয়ে আছে। উপস্থিত সবাই চুপসে গেল আরু-কে দেখে। আরুও বাক্যটি করে না‌। তাকের উপর সাজিয়ে রাখা বাটিটা নিয়ে বলে, “বাটিটা ফেলে গিয়েছিলাম তাই নিতে এলাম। নাহলে বাটির জন্য মা আবার পাঠাত।”

আরু হন্তদন্ত হয়ে বেরিয়ে গেল বাড়ির দিকে। অপূর্ব টেবিলে আঘাত করল। এগুলো তো চাচিদের শোনাচ্ছিল, ও কখন এলো। ও তো চলে গিয়েছিল।
পদ্মাবতী তোমার মনের শ্রাবণে ভেসে আসা মেঘ সরিয়ে, আমি বসন্তের প্রেম নিয়ে আসব।

আরু সবসময় নদী সাঁতরে অপূর্বদের বাড়িতে আসা-যাওয়া করলেও আজ পুল দিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিল। উন্মাদের মতো শুধু ধাবিত হচ্ছে সামনে। পুলের আগে কালাচাঁনদের দেখা গেল আড্ডা দিতে সাঙ্গপাঙ্গদের নিয়ে। আরুকে দেখে আড্ডার ইতি টেনে এগিয়ে গেল আরুর নিকট। পাশ কাটিয়ে অগ্রসর হওয়ার প্রচেষ্টা করতেই পিছু ডাকল কালাচাঁন, “গোলাপী গতকালের ব্যবহারের জন্য রাগ করেছ? আসলে তুমি আমাকে বারবার ফিরত পাঠিয়ে দাও বলে আমি রেগেই অমন করেছি।”

নদীর ওপাশে প্রাথমিক বিদ্যালয় থাকলেও উচ্চ বিদ্যালয়ের জন্য আরুকে এপাড় আসছে হয় বরাবর। পঞ্চম শ্রেণির গন্ডি পেরিয়ে ষষ্ঠ শ্রেণিতে ভর্তি হতে যখন সে এপাড় এসেছিল তখন থেকেই কালাচাঁন তার পিছু নিয়েছে। আরু প্রত্যুত্তর না করে পুনরায় অগ্রসর হতেই কালাচাঁন হাত ধরল আরুর, “চোখমুখের এই অবস্থা কেন গোলাপী? কেঁদেছ কেন?”

অপূর্ব-র মতো সুদর্শন নয় বটে তবে তার ভালোবাসা খাঁটি, না-হলে এতদিনেও আরুর পেছনে পড়ে থাকে? আরুর কী হলো সে নিজেই ঠাওর করতে পারল না। হুট করে বলে ফেলে, “আমি তো রান্না করতে পারি না কালাচাঁন। এরপরেও কী তুমি আমাকে বিয়ে করবে?”

নীলপদ্ম গেঁথে রেখেছি তোর নামে পর্ব ১৯ শেষ অংশ 

আরুর মুখে আজ তুমি সম্বোধন, কণ্ঠটা বড্ড কাতর। সেই মায়াবী কণ্ঠ শুনলে বোধহয় অপূর্ব, আশেপাশে সেই কণ্ঠই কেবল শুনত। কালাচাঁন যেন আজ আকাশের চাঁদ হাতে পেয়েছে, “ঐ হাত দুটি শুধু আমার হাতে রাখো, আমি কাজের লোক লাগিয়ে রাখব গোলাপী।”

নীলপদ্ম গেঁথে রেখেছি তোর নামে পর্ব ২১