প্রিয়দর্শিনী পর্ব ২৯

প্রিয়দর্শিনী পর্ব ২৯
প্রজ্ঞা জামান তৃণ

অপরাহ্ণের সময় নীল আকাশে লালচে আভা। আবিদের ফুল দ্বারা সুসজ্জিত গাড়িটা চৌধুরী ভিলার উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করেছে। আবিদ দর্শিনী দুজনে একাকী গাড়িতে অবস্থান করছে। বিদায়ের মুহূর্ত থেকে এখন পযর্ন্ত দর্শিনী ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে। আবিদ দর্শিনীর দিকে সরু চোখে তাকিয়ে রয়েছে। দর্শিনী আবিদের দেওয়া টিস্যু দিয়ে নাক মুছে প্রশ্নবিদ্ধ চোখে তাকায়। শেষে আবিদকে লক্ষ‍্য করে বলে,

‘এখন কী আমি একটু কাঁদতে পারবো না? এভাবে তাকিয়ে আছেন কেনো?’
আবিদ গালে হাত দিয়ে অদ্ভুত মুখোভঙ্গিতে দর্শিনীর দিকে তাকিয়ে বলে,
‘না দেখতেছি কতো কাঁদতে পারো তুমি! আমার এখন মনে হচ্ছে আমি তোমাকে বিয়ে করে আনিনি, কিডন‍্যাপ করে এনেছি দর্শিনী।’

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

দর্শিনীর চোখ বেয়ে দু’ফোটা অশ্রু গড়িয়ে পড়ে। এসি নিয়ন্ত্রীত গাড়ি, কিন্তু সে হাঁসফাঁস অনুভব করছে। ভারী লেহেঙ্গা, জুয়েলারি, তারপর মাথায় লেহেঙ্গার ভারী ওড়নাটা ঘোমটার মতো করে দেওয়া। দর্শিনীর গরম লাগছে। আবিদ বুঝতে পেরে ড্রাইভারকে এসির পাওয়ার কমিয়ে ষোলোতে দিতে বলে। আবিদ দর্শিনীর মুখোমুখি বসে দুই হাত ধরে শান্ত হতে বলে। দর্শিনী আবিদের দিকে করুণ চোখে চেয়ে বলে,

‘আমার বাবা-মা, আপুকে মনে পড়ছে আবিদ শাহরিয়ার চৌধুরী।’
আবিদ দর্শিনীকে আহম্মকের মতো তাকিয়ে দেখছে। কিছুক্ষণ আগেই আবিদ শ্বশুর শাশুড়ির থেকে বিদায় নিয়ে আসল। দর্শিনীর এতো তাড়াতাড়ি তাদের মনে পড়ছে? সে দর্শিনীর দিকে ভ্রু কুঁচকে বলল,
‘আর ইউ শিয়র? এইমাত্র তাদের থেকে বিদায় নিয়ে আসলাম। আর এখনি বাবা মাকে মনে পড়ছে? আমরা আবার আসবো দর্শিনী। তাছাড়া তুমি যখন ইচ্ছে আসতে পারবে।’

দর্শিনীকে নিশ্চুপ দেখে আবিদ কপালে আঙ্গুল ঘষে জোরে নিশ্বাস নিলো। তারপর ড্রাইভারের উদ্দেশ্যে বলল,
‘গাড়ি ঘুরান আঙ্কেল! মুহতাসিম ভিলায় নিয়ে চলুন। দর্শিনী যেহেতু আমার সঙ্গে যেতে ইচ্ছুক নয়। তাকে তার বাড়িতেই রেখে আসবো। দর্শিনী সেখানে আনন্দে থাকবে; এদিকে বউ হীন কষ্ট পাবো আমি।’
আবিদ শেষের কথাটা ধীরে বলেছে ড্রাইভার শুনতে না পেলেও দর্শিনী ঠিকই শুনেছে। এদিকে ড্রাইভার আবিদের কথায় অলরেডী গাড়ি থামিয়ে দেয়। দর্শিনী আঁতকে উঠে! সহসা আবিদের হাত আঁকড়ে বলে,

‘আমি যেতে চাইনা বলেছি আপনাকে?’
আবিদ দর্শিনীর হাত ধরে বলে উঠে,
‘এইযে এতো কান্না করছো। আমার খারাপ লাগছে নিজেকে অপরাধী মনে হচ্ছে। এতে স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে তুমি যেতে চাওনা শ্বশুরবাড়ি।’

দর্শিনী আবিদের দিকে তাকিয়ে বলে,
‘সবাইকে ছেড়ে আসতে হলো বলে মন খারাপ। বাবা মাকে মনে পড়ছে ভিষণ। এর মানে এটা নয় আপনার সঙ্গে যেতে চাইনা। আপনি বেশি বুঝে ফেলেছেন।’
আবিদ তৎক্ষণাৎ দর্শিনীকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে বলে,
‘আমার বউ! মন খারাপ করার কিছু নেই। আমরা আবার আসবো, তাছাড়া বাবা মাও তোমাকে দেখতে আসবে। মন খারাপ করার কী আছে?’

সামনে ড্রাইভার আঙ্কেল অথচ আবিদ তাকে জড়িয়ে রয়েছে বলে দর্শিনী ছাড়াতে চায়। এদিকে আবিদ নির্বিকার! দর্শিনীকে ঐভাবে জড়িয়ে ড্রাইভারকে বলে,
‘গাড়ি স্টার্ট দেন আঙ্কেল। আমার বউ আমার কাছেই থাকবে।’

ড্রাইভার আঙ্কেল মৃদু হেসে গাড়ি ড্রাইভ করতে থাকে। আবিদ দর্শিনী, দুজনে সদ‍্য বিয়ে করেছে। তাদেরকে প্রাইভেসি দিতে তিনি ড্রাইভিংয়ের উপর মনোনিবেশ করেন। এদিকে দর্শিনী লজ্জায় চোখ বন্ধ করে নেয়। হঠাৎ আবিদের থেকে ছাড়া পাবার জন‍্য চেষ্টা করে। নিজের সর্বস্ব দিয়ে জোর খাটায় কিন্তু ব‍্যার্থ হয়। শেষে হাল ছেড়ে দিয়ে আবিদের বুকে মিশে থাকে। আবিদ মিষ্টিমধুর হাসে।

অন‍্যান‍্য সব গাড়ি চৌধুরী ভিলাতে আগেই পৌঁছে গেছে। চৌধুরী বাড়ির বাকি মেম্বারর্সরা বাড়িতে পৌঁছে আবিদ দর্শিনীকে ওয়েলকাম করার জন‍্য প্রস্তুতি নেয়। অবশেষে চৌধুরী বাড়ির গেটে আবিদের নেভিব্লু গাড়িটা প্রবেশ করে। সন্ধ্যা নেমে এসেছে প্রায়। চৌধুরী ভিলা বিভিন্ন আলোয় ঝলমল করছে। একে একে সবাই বেরিয়ে আসে।

আবিদ গাড়ি থেকে নেমে দর্শিনীর দিকে হাত বাড়িয়ে দেয়। দর্শিনী আবিদের হাত ধরে নেমে আসে। তারপরে দুজন একসঙ্গে দরজার সামনে দাঁড়ায়। আত্মীয়স্বজনরা মুগ্ধ হয়ে আবিদ দর্শিনীকে দেখতে থাকে। পুস্পিতা সহাস‍্যে মিষ্টির প্লেট এনে অনুসা বেগমকে দেয়। অনুসা বেগম দর্শিনী এবং আবিদকে মিষ্টি খাইয়ে দেন। তারপর ছেলে এবং নতুন বউমাকে সোফায় এনে বসায়। আত্মীয়স্বজনরা আবিদ দর্শিনীকে ঘিরে দাঁড়ায়।

কালকে আবিদ শাহরিয়ার চৌধুরীর বিয়ের বউভাত এজন্য আত্মীয় স্বজন কমেনি আরো বেড়েছে। আবিদ দর্শিনী সবার মাঝে বসেছিল। আত্মীয়রা আবিদ এবং দর্শিনীর প্রশংসা করছে। যেমন, দুজনকে খুব মানিয়েছে, একে অপরের জন‍্য তৈরি। আবিদ ভাগ‍্যবান আবিদের বউ ভিষণ সুন্দর, ইত্যাদি। একসময় শাহরিয়ার চৌধুরী এবং আরহান আবিদকে ডেকে নিয়ে যায়। কালকের বউভাত সম্পর্কে গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা করবে তারা।

তাছাড়া সবার মাঝে আসফি অনুপস্থিত ছিল; এখনো পযর্ন্ত বাড়িতে ফিরেনি সে। আসফি দর্শিনীকে চায়ত এটা তারা জানে। আবিদ দর্শিনীর যেহেতু বিয়ে হয়ে গেছে; তাই নিঃসন্দেহে আসফি আজ বাড়িতে ফিরবে না। তবুও বাবা হিসাবে শাহরিয়ার চৌধুরী আসফির জন‍্য দুশ্চিন্তা করছেন। ইতিমধ্যে বেশ কয়েকবার ফোনও দিয়েছেন। কিন্তু ফোন বন্ধ দেখাচ্ছে। শেষে বিষয়টি তিনি আবিদকে জানায়। আবিদ বাবাকে দুশ্চিন্তা করতে নিষেধ করে। কারণ আসফি যেখানে থাকুক তার লোকজন সর্বদা তাকে চোখে চোখে রাখবে। দর্শিনী অনেকক্ষণ সবার মাঝে বসেছিল। এজন্য অনুসা বেগম আদিবাকে বলে দর্শিনীকে আবিদের রুমে নিয়ে যেতে। আদিবা দর্শিনীকে নিয়ে আবিদের রুমে চলে যায়।

আবিদের রুমটা টকটকে গোলাপ, রজনীগন্ধা ফুল দিয়ে সাজানো হয়েছে। সারা রুম জুড়ে গোলাপ, রজনীগন্ধা ফুলের মিশ্র সুবাস। এতো সুন্দর সাজানো রুম দেখে দর্শিনী মুগ্ধ। আদিবা দর্শিনীকে বলে,
‘এখন বসে থেকে আমার ভাইয়ের জন‍্য অপেক্ষা করো ভাবিপু।’
আদিবা সশব্দে হেসে দেয়। দর্শিনীকে নিশ্চুপ দেখে আদিবা আবারো বলে,

‘একটু পরে সবাই ডিনার করবে তখন তোমাকে নিয়ে যাবো। আমরা সবাই চেন্জ করে নিয়েছি। তোমার ল‍াগেজ এখানে আনা হয়েছে। তুমিও চেন্জ করে নেও ভাবিপু।’
বলেই আদিবা চলে যায়। আদিবার মুখে ভাবিপু ডাকটা পছন্দ হয় দর্শিনীর। আদিবা চলে যেতেই, দর্শিনী বিছানায় বসতে চাইল কিন্তু পুরো বিছানা জুড়ে ফুলের সমাহার। দর্শিনী বিছানায় বসে বিছানা এলোমেলো করতে চায়না। এরচেয়ে ভালো সে শাওয়ার নিবে। দর্শিনী লাগেজ থেকে গাঢ় পার্পেল রঙের মসৃণ শাড়ি বের করল পড়ার জন‍্য। তৎক্ষণাৎ রুমে প্রবেশ করে আবিদ। দর্শিনীর হাতে শাড়ি দেখে বলল,

‘চেন্জ করবে?’
‘হ‍্যাঁ! ভাবছিলাম চেন্জ করে ফেলি। প্রচন্ড ভারী এগুলো! এখন কেমন অসস্থি হচ্ছে। শাওয়ার নেওয়ার প্রয়োজন।’
আবিদ দর্শিনীর উদ্দেশ্যে বলে,

‘ঠিক আছে তুমি আগে শাওয়ার নেও। পরবর্তীতে আমি নেবো।’ বলেই আবিদ কাবার্ড থেকে টিশার্ট টাউজার বের করে।
দর্শিনী হুম বলে ওয়াশরুমে চলে যায়। আবিদের ওয়াশরুমটা ছোট একটা রুমের সমান। টাইলস বসানো ঝকঝকে নিট এন্ড ক্লিন। এখানে গোসল করার জন‍্য বাথ ট‍্যাব রয়েছে। দর্শিনী আগে কখনো বাথ ট‍্যাবে গোসল করেনি। এজন্য ঝর্ণাতেই সাবান শ‍্যাম্পু সমেত গোসল সারলো।

ভেজা চুল, পার্পেল রঙের মসৃণ শাড়িতে আবৃত দর্শিনীকে, স্নিগ্ধ সুন্দর দেখাচ্ছে। আবিদ মুগ্ধতার সঙ্গে তাকিয়ে দেখছে তার বউকে। দর্শিনী টাওয়েল দিয়ে চুল মুছতে মুছতে ড্রেসিং টেবিলের সামনে দাঁড়ায়। আয়নায় আবিদকে তাকিয়ে থাকতে দেখে দর্শিনী কী বলে ইশারা করে। আবিদের চঞ্চল চিত্ত দর্শিনীকে নিজের বউ রূপে দেখে বেসামাল হয়ে পড়ছে। হঠাৎ তার গলা শুকিয়ে উঠেছে।

প্রিয়দর্শিনী পর্ব ২৮

আবিদ এতো তৃষ্ণার্ত অনুভব করছে কেনো? দর্শিনী আবিদের চাহনীতে মৃদু লজ্জা পায়। আবিদ মুহূর্তে নিজেকে কন্ট্রোল করে ওয়াশরুমে চলে যায়। মাথা খারাপ হয়ে যাচ্ছে তার। এখন শাওয়ার নিলে ঠিক লাগবে। আচ্ছা তার বউকে এতো সুন্দর হতে কে বলেছে? আসলেই সুদর্শিনী রমনী!

প্রিয়দর্শিনী পর্ব ৩০