নীলপদ্ম গেঁথে রেখেছি তোর নামে পর্ব ৪৭

নীলপদ্ম গেঁথে রেখেছি তোর নামে পর্ব ৪৭
ইফা আমহৃদ

“ধুর পা/গ/লি, অন্য নারীকে কেন আমার বুকে জায়গা দেব? আমার বুকে জায়গা হবে শিশুর। যে তোর আমার অংশ দিয়ে তৈরি।” আরুর মাথায় হাত বুলিয়ে আশ্বাস দিল অপূর্ব। মুখ তুলে চাইল অপূর্বর পানে। বিস্মিত আরুর নেত্রপল্লব। অপূর্ব উচ্চতা শুন্যতায় নামাতে হাঁটু গেড়ে মাটির ওপর বসল। কাপড় সরিয়ে মাথা রাখল আরুর ফরসা উদরে। দফায় দফায় কেঁপে উঠল। এই অবস্থা থেকে পরিত্রাণ পেতে পিছিয়ে গেল। তবে রক্ষা হলো না। শক্তপোক্ত কাঠের খুঁটির সাথে বেধে গেল। বামহাতটা অপূর্বর চুলের মাঝে রেখে থেমে থেমে বলে, “কী করছেন? ছাড়ুন। কেউ চলে আসবে।”

অপূর্ব থামল না, না ছাড়ল। বিনিময়ে বন্ধন দৃঢ় করে ধরে ওষ্ঠদ্বয় ছোঁয়াল আরুর উদরে। চকিতে হাতটা নিচে নামিয়ে তুলে নিল উঁচুতে। মাটি থেকে আরুর পায়ের দূরত্ব তখন অনেকটা। ভারসাম্য বজায় রাখতে আঁকড়ে ধরল অপূর্বর কাঁধ। অপূর্ব ললাটে ললাট ঠেকাতে ভরাট গলায় আরু বলে, “কী করছেন? আজ এমন কেন করছেন? একটু আগে বললেন আরেকজনকে বুকে নিয়ে ঘুমাবেন, এখন আদর করছেন!”

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

অপূর্ব জবাব না দিয়ে হাসে। তার চঞ্চল বউ আজ বোকা হলো কীভাবে? ঘুরতে ঘুরতে বলে, “আমি বাবা হচ্ছি, বউ আমাকে উপহার দিচ্ছে। সেই হিসেবে এইটুকু আদর তার প্রাপ্য।”
বাক হারিয়ে ফেলল। বাঘ থেকে বিড়াল ছানার মতো চুপসে গেল। বিড়াল ছাড়া মিউ বলতে পারলেও আরু বলতে পারছে না। শত প্রচেষ্টার পর বলে, “তবে তো আমি মা হব। কিন্তু আপনাকে কে বলেছে? যাকে বুকে নিয়ে ঘুমাতে চেয়েছেন, সে কি অন্তঃসত্ত্বা?”

“আমার বউ কি পাঁচটা? একটা‌। অবশ্যই সেই বউ অন্তঃসত্ত্বা। এতদিন তোর উগ্র আচরণে হতবাক হয়েছি, ডাক্তার হয়েও অনুভব করতে পারিনি আমি বাবা হব। একটু আগে বাবার কথায় রেগে আমি তোর সাথে ওমন ব্যবহার করেছি। ঘুণাক্ষরেও যদি অনুভব করতাম তুই নতুন অতিথি আনার বাহক। তবে এমন কাজ করতাম না।”
অপূর্ব এখনো উৎফুল্লিত হয়ে আরুকে ঘুরাচ্ছে। আরুর মাথা ঘুরছে। ঝাপসা দৃষ্টিতে অপূর্বকে দৃশ্যমান হচ্ছে না। ঘনঘন পলক ফেলে বলে, “মাথা ঘুরছে, নামান আমাকে। বমি পাচ্ছে।”

অপূর্ব হিতাহিতজ্ঞানশূন্য হয়ে নামাল আরুকে। পৃথিবীর গতির সাথে টক্কর দিতে না পেরে আরু হেলেদুলে বাইরের দিকে অগ্রসর হচ্ছে। পেছন দরজার কাছে যেতেই মুখ ভরে এলো বমিতে। মাথাটা একটু বাঁকিয়ে গড়গড় করে শূন্য করল পেট। অতঃপর দরজার সাথে ঠেসে বসে পড়ল মাটিতে। অপূর্ব ধ্যান থেকে বের হয়ে আরুকে ধরল। বাইরে থেকে মেয়ের এরূপ অবস্থা থেকে পারুল সবজি ফেলে ছুটে এলেন ঘরে। সরিষার তেল মাথার তালুতে দিয়ে ম্যাসাজ করতে করতে বলেন, “এই মাত্র তোকে সুস্থ দেখে গেলাম। এরমধ্যে আবার…। একটু আমের আচার দেই? খেলে ভালো লাগবে।”

“না। চালতার আচার দাও।” অপূর্বর গায়ে মাথা ঠেকিয়ে আরু বলে। অনিতা পানি দিয়ে আরুকে কুলি করিয়ে মুখ ধোয়ালেন। চালতার আচার বাটিতে দিয়ে অপূর্বকে বলেন, “তুই তো ডাক্তার, আরু হঠাৎ এমন করা তোর ডিকশনারিতে কী বলে।”

“আপনার ঘরে নতুন অতিথি আসার লক্ষণ। অয়ন মামা হতে চলেছে। বুবু আর তোমাকে ভালোবাসবে না।”
পারুল হাসলেন। সবজি তোলার সময় নয়না এসে এই আভাস দিয়েছিলেন।অয়নের মন ভার হলো। বিষাদের সুর তুলে বলে, “তাতে কী? আমি তো মামা হব। সবাইকে বলে আসি।”
বলেই অয়ন ছুটল সবাইকে জানাতে। অপূর্ব আরুকে কোলে তুলে ঘরে নিয়ে শোয়াল। মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বলে, “আরু বাবুর আগমনের কথা শুনে বাবুর বাবাও বাবু হয়ে গিয়েছিল। তাই তোকে ঘুরিয়েছে। আমার জন্য তোর ক্লান্ত লাগছে।”

আরু চালতার আচার খেতে খেতে বলে, “এটা তো রোজকার অভ্যাস। আপনার কোনো দোষ নেই। আচার খাবেন?”
“না! তুই খা! খেয়ে ঘুমা।”
অপূর্বর আদেশ মেনে আরু চালতা খেয়ে ঘুমানোর চেষ্টা করল। ক্লান্ত শরীর ব্যস্ত হলো তন্দ্রায়। তন্দ্রা ব্যাঘাত ঘটল হট্টগোলে। আহসান বাড়ির চাঁদের হাট তখন বসেছে মৃধা বাড়িতে। বিভিন্ন ধরনের কণ্ঠ আরুর কর্ণপথে যেতেই ছুটি নিল তন্দ্রা। ঘুমের কারণে দেহটা বেশ লাগছে আরুর। মাথায় ঘোমটা টেনে উপস্থিত হলো বৈঠকখানায়। ততক্ষণে আরুর গোপন তথ্য ফাঁস করেছে অপূর্ব। আরুকে দেখে চার জা গোল করে ধরল। অনিতা জড়িয়ে নিয়ে বলে, “তোর অসুস্থতার কথা আমাদের কেন বললি না মেয়ে? আমরা বুঝতে না পেরে তোর সাথে কেমন ব্যবহার করলাম।”
“আমি কিছু মনে করিনি।”

উত্তরে জাহানারা বলেন, “রাগ করে বাপের বাড়িতে চলে এসেছে। আবার বলে কিছু মনে করেনি।”
মোতাহার আহসান এগিয়ে এসে আরুর মাথায় হাত রেখে বলেন, “তোর মায়ের কাছে ক্ষমা চেয়েছি কিন্তু। এবার বাড়িতে ফিরে তৈরি হয়ে নে।”
“কোথায় যাবো?”

“অপূর্ব আমাকে বলেছে তোর কথা‌। আমি দাদু হতে চলেছি। এই বয়সে সবাই নাতি নাতনি কাঁধে নিয়ে ঘুরে। অবশেষে আমার সময় আসছে। কী যে ভালো লাগছে।” মোতাহার আহসানের কথায় আরু লজ্জানত হলো। চোখমুখে ফুটে উঠল লাজুক ভাব। তবুও তিনি বলেন, “তোর শরীরের কথা চিন্তা করে একটা সিদ্ধান্ত নিয়েছি। সব ভাই-বোন মিলে বেয়ানকে নিয়ে ঘুরতে যাবি।

বেয়ানের চিকিৎসার জন্য এই গ্ৰামে ভালো কোনো চিকিৎসক নেই। তাই ডাক্তার দেখানোর পাশাপাশি তোর মাইন্ড ফ্রেশ হবে। ইতোমধ্যে ব্যাগপত্র গোছাতে সুজন ও তিস্তা চলে গেছে।”
“অয়নকে নিয়ে যাই?” আরুর প্রশ্নের জবাবে পারুল বলেন, “দরকার নেই। আমাদের নায়র নিতে এসেছেন। তোরা ফেরার আগ পর্যন্ত আমরা সেখানে থাকব।”
আরু ও অপূর্ব অগ্রসর হলো আহসান বাড়ির দিকে। পেছনে আসছে তাঁরা।

ট্রাভেলিং ব্যাগগুলো সারিবদ্ধভাবে রাখা‌। সোয়েটার জড়িয়ে আড়ষ্ট হয়ে বসে আছে আরু। ব্যাগপত্র অপূর্ব গুছিয়েছে। সবাই অপেক্ষারত দুপুরের খাবারের। লঞ্চে নিয়ে যাত্রা শুরু করবে। গাড়ি এসে থেমেছে আহসান বাড়ির দোরগোড়ায়। চালক বাইরে থেকে হাঁক দিতেই তিয়াস বিরক্ত হয়ে বলে, “কতক্ষণ লাগবে মা?”
“হয়ে গেছে।” টিফিন ক্যারিয়ার এনে বিছানার ওপর রাখল জাহানারা। সুমি ক্যারিয়ানটা চালকের হাতে দিয়ে বলে, “এগুলো নেওয়ার কোনো দরকার আছে মা? ঘুরতে যাচ্ছি। নদী দেখতে দেখতে ইলিশ মাছ ভাজা দিয়ে গরম গরম ভাত খেতাম। ওখানেই পাওয়া যায়।”

“খবরদার কেউ বাইরের খাবার খাবি না। তোরা খেলে আরুও খেতে চাইবে। আরুর জন্য এখন বাইরের খাবার ঠিক না।” কড়া গলায় বলেন মণি। বিনিময়ে রঙ্গ করে সুমি বলে, “জা, কে তোমাকে এখন এই পকেট নিতে বলেছে। এই পকেটের জন্য বাইরের খাবার খেতে পারব না।”
পেটের ওপর হাত রেখে ভাব নিয়ে আরু বলে, “এই পকেটের জন্য যেতে পারছ ভাবী, এটা কম কিসে? চলো, দেরি হয়ে যাচ্ছে।”

আরু সবাইকে তাড়া দিয়ে অনিতার কাছে গেল। পা ছোঁয়ার চেষ্টা করতেই অনিতা বাধা দিল, “এই সময়ে ঝুঁকতে নেই। সাবধানে যাক। নিজের যত্ন নিস।”
“আচ্ছা।”

সবার থেকে বিদায় নিয়ে আরু উঠল গাড়িতে। একে একে উঠল বাকিরা। তিস্তা সুজন পূর্বেই বসা ছিল। আরুকে দেখে বেশ রঙ্গ করে সুজন বলে, “ভাবী, সুখবরের সাথে মিষ্টি পেলাম না। মিষ্টি পাবো কবে?”
“বিয়েটা আগে আপনারা করেছেন, অথচ সবাইকে সুখবর আগে আমি শুনিয়েছি। মিষ্টি তাহলে কার বিলানো উচিত? সুজন মাঝি, তৈরি হন।” বলতে বলতে অপূর্বর কাঁধে মাথা রাখল আরু। গতিশীল গাড়ি থামল ব্রিজের কাছে। সেখান থেকে গাড়িতে উঠল তিনজন। আরেকদফা অপূর্ব আরুর কাছে মিষ্টি চাইল। এক ফাঁকে তুরকে ঠ্যালে আরু বলে, “মিতুর সাথে ওখানে দাঁড়িয়ে কী করছিলি?”

নীলপদ্ম গেঁথে রেখেছি তোর নামে পর্ব ৪৬

“প্রয়াসকে চিঠি পাঠিয়েছি। সে ইতোমধ্যে ঘাটে পৌঁছে গেছে। আমরা কোন লঞ্চে যাবো তা-তো জানে না, সেটা লিখে পাঠিয়েছে।”
আরু মাথায় হাত দিল। এমনিতেই মাথা ঘুরছে তার।

নীলপদ্ম গেঁথে রেখেছি তোর নামে পর্ব ৪৭ (২)