নীলপদ্ম গেঁথে রেখেছি তোর নামে পর্ব ৫২

নীলপদ্ম গেঁথে রেখেছি তোর নামে পর্ব ৫২
ইফা আমহৃদ

আনন্দ নগরের বড়ো বটগাছের নিচে শেষ দিনের বাইজি নাচ বসেছে‌। প্রধান বাইজি ছাড়াও সেখানে রয়েছে আরও চার জন। গ্ৰামবাসীদের সাথে যোগ দিয়েছে ওরাও। আরু উদাসীন হয়ে নিভৃতে ভেবে চলেছে তুরের কথা। দুই সখীর কেউ মনোযোগী নয় এই নাচে। তুর বাধ্য হয়ে এসেছে, আরু একা ঘরে ভয় পাবে বিধায় এসেছে। শেফালী দুই সখীর মাঝে এসে বলল, “আরু মুখ ভার করে রেখেছিস কেন? তুরের সাথে ঝামেলা হয়েছে? সেও মুখ ভার করে রেখেছে। কতবার জিজ্ঞেস করলাম, কী হয়েছে? জবাব পেলাম না।”

“শেফু, আমি একটা অন্যায় করে ফেলেছি। তুর ও প্রয়াস ভাইয়ের কথা আমি ওনাকে জানিয়ে দিয়েছি। এজন্য তিনি তুরের ওপর ক্ষ্যাপে আছেন। তুরও আমার ওপর রেগে আছে। আমি ভালোর জন্য বলেছিলাম, এতে বিপরীত হয়ে যাবে বুঝতে পারিনি।”

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

“আমি প্রয়াস ভাইকে দেখেই ঘাবড়ে গিয়েছিলাম। অপূর্ব ভাইয়ের এমন ব্যবহার অস্বাভাবিক নয়। একটা পরপুরুষকে এভাবে নাটকের মতো সাজিয়ে রাখা ন্যায় নয়, অন্যায়। আবার তুরের কষ্ট আমি অনুভব করতে পারছি।”
বলতে গিয়ে শেফালীর চোখ হলো টলমল। না! আর তিয়াসের কথা সে ভাববে না। তার জন্য চারটা জীবন অনিশ্চয় হয়ে পড়তে পারে।

এবার সে এক পা এগোবে কাঁলাচানের দিকে। বিনিময়ে কাঁলাচান যদি এক পা এগোয়। তবে শেফালী আবার দুই পা এগোবে। তাদের সম্পর্কটা অনিশ্চিত করবে না। আরুকে আশ্বাস দিয়ে বলল, “এইসব নিয়ে তুই প্যানিক করিস না। সম্পর্কের মাঝে একটু বাধা না আসলে ভালোবাসার গভীরতা অনুভব করা যায় না।”
অপূর্ব ভ্রু কুঁচকে তাকাল উভয়ের দিকে। সময় ক্রমাগত পেরিয়ে যাচ্ছে। শীত গ্রাস করছে রাতকে। অপূর্ব সবাইকে পেরিয়ে পেছনে যেতেই শেফালী সামনে ফিরে এলো। আরুর পাশে বসে বাকিদের উদ্দেশ্য করে বলল, “তোদের দেখা হলে বলিস। ফিরে যাব।”

কাঁধে হাত রেখে আরুকে নিজের বুকে জড়িয়ে নিল। আরু কেবল ক্লান্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে কাতর গলায় বলল, “ভালোবাসার সংজ্ঞা জেনেও আপনি বারবার কেন এমন করেন? কেন ওর কাছে আমাকে অপরাধী করে দিলেন? প্রথমবার প্রাণের প্রিয় বোনের গায়ে হাত তুলতে আপনার বাঁধল না? নাকি ওর ভালোবাসার মূল্য আপনার কাছে নেই?”

“তোকে এই প্রশ্নের উত্তর আমি দেব না। বোনকে মাথায় তুলে নেচে বাঁদর তৈরি করার চেয়ে শাসন করে মানুষ তৈরি করা আমার ভালো। তুই ঘুমা।” অপূর্বর ত্যাড়া কথায় আরু মাথা তুলল। চোখমুখে কঠোর ভাব এনে উঠে দাঁড়াল। মির্জা বাড়ির অতিথি হওয়ার কারণে ওদের আসন সবার সম্মুখে। আরু প্রথম সারিতে গিয়ে তিস্তাকে বলল, “তোমার সাথে বসব।”

চেয়ারের কাছে রোগাপটকা দেহ তিস্তার। এক পাশে সেঁটে আরুকে বসার জায়গা করে দিয়ে মনোযোগী হলো নাচ দেখায়। আরু কেবল রাগের কারণে এখানে এসেছে, ঘুমে পল্লব ঢাকতে মিনিট তিন লাগল না। তিস্তার কাঁধে মাথা রেখে পা তুলে বসে ঘুমিয়ে গেল।

নাচ সমাপ্ত হওয়ার শেষ মুহুর্ত পর্যন্ত সবাই উপভোগ করল সেই নাচ। দর্শকেরা টাকা উড়িয়ে দিয়েছে বাইজিদের দেহে। অপূর্ব তা করল না। ইস্কান্দার মির্জার পুতি হওয়ার দৌলতে বাইজিদের সম্মানি দিল হাতে তুলে। রেশমী নামের মহিলা অপূর্বর দিকে অবাক দৃষ্টিতে তাকাল। বয়সের কারণে তেজ কমে গেলেও সাজসজ্জার ত্রুটি নেই। কৌতূহল নিয়ে বলল, “কে তুই? আগে তো কখনো তোকে এখানে দেখিনি।”

“আমি অপূর্ব আহসান। ইস্কান্দার মির্জার একমাত্র মেয়ে চম্পাকে চেনেন? আমি তার বড়ো ছেলে মোতাহার আহসানের ছেলে অপূর্ব আহসান।”
“তুই চম্পার নাতি? চম্পা কেমন আছে? চম্পাকে বলিস, রেশমী সালাম পাঠিয়েছে। আগে আমার মা নাচ করত। মায়ের সাথে এখানে আসতাম।

চম্পা আমাকে কত ভালোবাসত।” রেশমীর চোখে ফোটল অতীতের আসরের দৃশ্য। নিজেকে ধাতস্থ করে টাকাগুলো নিয়ে অপূর্বর মাথায় হাত রাখল। তখন এগিয়ে এলো আরু ছাড়া সকলে। মেতে উঠল রেশমীর সাথে। রেশমাকে ‌বিদায় দিয়ে অপূর্ব লক্ষ করল, একটি ফাঁকা চেয়ারে জড়সড়ো হয়ে শুয়ে আছে আরু। পরিচিত বলতে ইলিয়াস আলী ছাড়া কেউ নেই আশেপাশে। অভিমানী আরুকে পাঁজাকোলা করে তুলে নিয়ে বাড়ির দিকে এগোল অপূর্ব। বাকিরা হাঁটছে তার পিছুপিছু।

মির্জা বাড়ি ঘুমে বিভোর। তবে এক নবদম্পতি শুতেই পারেনি বিছানায়। শেফালী হাঁসফাঁস করছে চাপা কথা স্ফুট করতে। কালাচাঁন তার শার্ট খুলে কেবল সেন্ডো গেঞ্জি পরে লেপের তলায় ঢুকল। নোকিয়া মোবাইলে সাপ গেমস খেলতে খেলতে আড়চোখে শেফালীর দিকে এক পলক ফেলে। যার দরুন সাপের লেজে মুখ লেগে গেমস ওভার। চার্জে লাগানোর সুবিধা নেই এখানে। কালাচাঁন ফোনটা বালিশের কিনারে রেখে বলল, “ওখানে দাঁড়িয়ে কী করছ? কাল সকাল সকাল বের হব গ্ৰামের উদ্দেশ্য।”

শেফালী চট করে বিছানায় উঠে বলল, “আপনার সাথে আমার একটা কথা আছে। জরুরি কথা। শুনবেন?”
“কেন শুনব না? সব কথার চেয়ে তোমার কথাখানা আমার কাছে গুরুত্বপূর্ণ। বলো।” কালাচাঁন আগ্রহ নিয়ে বলে। তবে শেফালী স্বাভাবিক হয়ে বলতে পারছেনা। শেফালীর কাজে বিরাগী হয়ে কালাচাঁন চোখ বন্ধ করল। ফের শেফালী বলব, “শুনবেন না, আমার কথা?”

“তুমি মুখে অনশন পালন করছ। অনশন পালন করলে খেতে পারেনা। কিন্তু তোমার ক্ষেত্রে ব্যতিক্রম। তুমি কথাও বলতে পারোনা। অনশন ভাঙা অবধি আমার পক্ষে অপেক্ষা করা সম্ভব নয়। অনশন ভেঙে আমাকে ডেকো।” কালাচাঁন চোখ বন্ধ রেখেই বলল। ভাবাবেগ দেখা গেল না কালাচাঁনের মাঝে। তবে কালাচাঁনের চোখ বন্ধ থাকার কারণে শেফালীর জড়তা কা/ট/তে শুরু হয়েছে। জিভ দিয়ে ঠোঁট ভিজিয়ে বলল, “আমরা কি আর পাঁচটা স্বামী-স্ত্রীর মতো বৈবাহিক সম্পর্কে জড়াতে পারিনা?”

চট করে চোখ মেলল কালাচাঁন, দৃষ্টি নামিয়ে ফেলেছে শেফালী। কানে সমস্যা হয়েছে ভেবে কনিষ্ঠা আঙুল দিয়ে পরিষ্কার করে নিল এক দফা। শেফালীর মুখ বলে দিচ্ছে সে মিথ্যা শোনে নি। চাঁদশূন্য আকাশ। ঘুটঘুটে অন্ধকার বিরাজ করছে সেই কামরাতেও। শেফালীর থুতনি তুলে চোখে চোখ রেখে কালাচাঁন বলে, “আমি কি ভুল শুনলাম? আমার চোখের দিকে তাকিয়ে বলবে আর একবার?”

“অতীত ভোলা যায়না, আবার অতীত আঁকড়ে বাঁচা যায়না। তবে আমি বর্তমান নিয়ে বাঁচতে চাই। আমার মনের দহনের কথা আপনি জানেন, আপনার দহন আমি অনুভব করতে পারি।” এর জবাবে কিছু বলল না কালাচাঁন। মাথাটা আলতোভাবে ঠেকাল শেফালীর ললাটে। ঘনঘন শ্বাস নিল শেফালী। পৌঁছেছে প্রেম বার্তা, বেড়ে গেল উষ্ণতা। পৌষের শীতও হার মানে তাতে। কালাচাঁন যদি গড়ে নিতে পারে, নিক-না গড়ে। সমস্যা নেই। শুধু একটু আদরে সাজিয়ে নিক।

সময় ও স্রোত কখনো কি কারো জন্য অপেক্ষা করেছে? তাঁরা তো বহমান। নিজের মতো ধাবিত হওয়াই এদের কাজ। আরুর ছোটো পেট অনেকটা প্রশস্ত। এক মাস, দুই মাস, তিন মাস… পেরিয়ে গেছে নয়টি মাস। পেট না ধরে চলাফেরা করতে পারেনা আরু। কোনো কাজ আজকাল তাকে করতে হয়না। বংশে প্রথম সন্তান আসছে বলে কথা।
আরু রোয়াকে বসে আমের আচার খাচ্ছিল। বেশ স্বাদের সেই আচার? প্রথমদিকে বমি দূর করতে খেলেও আজকাল অভ্যাসের কারণে খায়। আরুর জন্য গাছের ছাল নামক মশলা থাকে না। খেয়ে শেষ করে ফেলে। মল্লিকা কলতলা থেকে পানি এনে উঠানে রেখে বলল, “তুই এখনো বসে আছিস কেন? দুলাভাই না একটু পর তোকে নিতে আসবে? জামাকাপড় গুছিয়েছিস?

নীলপদ্ম গেঁথে রেখেছি তোর নামে পর্ব ৫১

“বাবাইয়ের তো কোনো খবর নেই। কখন আসবে কে জানে। তাছাড়া আমার যা জামাকাপড় আছে, ওগুলো টাইট হয়ে গেছে অনেক। তাই নেব না। মায়ের শাড়ি পরব।” আচার খেতে খেতে বলে আরু। তখনই বাড়িতে মিষ্টি, পান, সুপারি হাতে প্রবেশ করল ইমদাদ হোসেন ও অয়ন। আরুকে দেখেই ছুটে এসে জড়িয়ে ধরল। উত্তেজিত হয়ে বলল, “বুবু কেমন আছিস তুই? পুঁচকে কেমন আছে?”

নীলপদ্ম গেঁথে রেখেছি তোর নামে পর্ব ৫৩