নীলপদ্ম গেঁথে রেখেছি তোর নামে পর্ব ৫৩

নীলপদ্ম গেঁথে রেখেছি তোর নামে পর্ব ৫৩
ইফা আমহৃদ

“বুবু তুই কেমন আছিস, পুঁচকে কেমন আছে?” অয়নের কথায় এক গাল হাসে আরু। নয় মাসের পেটের কারণে আরুকে আয়ত্ব করতে পারেনি অয়ন। তাই চোখমুখ বেশ মলিন। অয়নকে সরিয়ে ইমদাদুলের হাত থেকে প্যাকেটটা নিয়ে বলল, “বাবা, কালকে আসবে বলেও কেন এলে না?”

“রাগ করিস না মা। ট্রেন মিস করে ফেলেছিলাম। আসতে আসতে দেরি হয়ে গেছে। তাই রাত করে এলাম না। এমনিতেই আমাদের গ্ৰাম ভালো নয়।” ইমদাদুল হোসেন বাইরেই শানের ওপর বসল। ‘বাড়ির একমাত্র দুলাভাই ও বেয়াইয়ের কণ্ঠ শুনে ফিরে এলেন অনিতা। প্রসন্ন হয়ে বললেন, “এখানে বসলে কেন ইমদাদুল? ভেতরে এসো।” পরপর বিরতি দিয়ে বললেন, “তুমি সবসময় দুই হাত ভরে খাবার নিয়ে আসো। তোমাকে কতদিন বলেছি, খালি হাতে আসতে?”

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

“নিজের শ্বশুর বাড়ি আবার মেয়ের শ্বশুরবাড়ি। খালি হাতে আসা শোভা পায়না। আমি এমনই আসব। যদি এগুলো আনতে বারণ করো, তবে আর আসব না ভাবী।” ইমদাদুলের কথায় অনিতা কান টেনে ধরল‌। বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক তাদের মাঝে বিরাজমান।

“হয়েছে আর ভাষণ দিতে হবেনা। চুপ করে ভেতরে এসে বসো। সুমি, ইমদাদুল ভাই আর অয়নকে শরবত দাও।”
“আমাকে নিয়ে এত ব্যস্ত হতে হবেনা। আমি আরু আর অপু নিয়ে এখনই চলে যাব। ভেলিভারির সময় মেয়ে তার মায়ের কাছে থাকলে জোর পায়। তাই পারুল আমাকে পাঠিয়েছে। কড়া হুকুম, ওকে নিয়েই যেতে হবে।”

বলতে বলতে সবাই বৈঠকখানায় গিয়ে বসল। সুমি ততক্ষণে নাস্তা এনে টেবিল সাজিয়ে ফেলেছে। আরু আর আগের মতো কাঠের সিঁড়ি ভেঙে ওপরে ওঠেনা। এই অবস্থায় অপূর্ব তাদের মালামাল নিচে নামিয়েছে। আরু ঘর থেকে জামাকাপড়ের ব্যাগ নিয়ে বৈঠকখানায় আসতে অনিতা বলল, “বিকালে গেলে হবেনা? অপু তো এখনো এলো না। দুপুরের খাবার খেয়ে বিশ্রাম নিতে নিতে অপু চলে আসবে।”

“পারুল আরুর জন্য অপেক্ষা করছে। আমি আরুকে নিয়ে যাই, অপূর্ব বিকালে এসে চলে যাবে।” ইমদাদুলের কথায় বাধ্য হয়েই সায় দিল অনিতা। নাস্তা খেয়ে রওনা হলো বাড়ির দিকে। আসার সময় রিকশা নিয়ে এসেছিল বলে তেমন সমস্যা হলো না। অনেকদিন পর আরু এলো মৃধা বাড়িতে, সাথে এলো ময়না পাখিরা। পারুল আরুকে দেখে প্রসন্ন হয়ে জড়িয়ে ধরলেন রিকশায় থাকতেই। অতঃপর হাত ধরে ধীরে ধীরে নামালেন। জড়িয়ে ধরে অয়নকে আদেশ দিল, “তাড়াতাড়ি তোর চাচিকে ডেকে নিয়ে আয়। আরু আসলেই তাকে খবর দিতে বলেছে।”

অয়ন ছুটে গেল। চোখমুখে প্রকাশ পেয়েছে উত্তেজনা। নয়না দিঘিতে কালির পাতিল ধুচ্ছিল। অয়ন দিঘির পাড়ে দাঁড়িয়ে বলে, “চাচি বুবু এসেছে, মা আপনাকে ডাকছে।”
“তুই যা, আমি হাতের কাজ শেষ করে আসছি।” মাজতে মাজতে বলে নয়না। অয়ন শুনল না বোধ হয়, কিংবা ইচ্ছা করেই নয়নার আঁচল ধরে টানতে টানতে বাড়ির দিকে এগিয়ে গেল। নয়না আঁচল ছাড়াতে ছাড়াতে বলল, “ছাড়, অয়ন। আঁচল ছাড়। কেউ চলে আসবে। আমার হাতের মা/র খাবি কিন্তু। অয়ন! তোর মাকে বি/চার দিব। ছাড়।”

“আপনাকে বুবুর কাছে নিয়েই তবে ছাড়ব।” বলতে বলতে উঠানে নিয়ে গেল নয়নাকে। আঁচল ছাড়তেই নয়না পারুলকে উদ্দেশ্য করে বলল, “অয়ন দিনদিন বেয়াদব হয়ে যাচ্ছে। আমার আঁচল ধরে টেনে নিয়ে এসেছে।”
ইমদাদুল তীক্ষ্ণ দৃষ্টি নিক্ষেপ করতে অয়ন কাঁচুমাচু মুখে করে ফেলে। ভীত অয়ন ছুটে যায় সাবিতের কাছে। অতঃপর আরুকে নিয়ে পিঁড়ি পেতে বসায় রোয়াকে। মাথায় হাত বুলিয়ে বলল, “কেমন আছিস আরু?”

“ভালো আছি চাচি। তোমরা কেমন আছো?”
“ভালো আছি। অপু আসেনি?”
“উনি রাতে আসবে। সাথী, সিঁথি ওরা কোথায়? কতদিন হয়েছে ওদের সাথে কথা হয়না। ডাক দাও, কথা বলি।” পেটে হাত দিয়ে হাঁপাতে হাঁপাতে আরু বলে। রিকশায় ঝাঁকানিতে বেসামাল তার অবস্থা। আরুর তখনকার ছাগল ছানা মিঠু এই নিয়ে চারবার ছানা দিয়েছে। উঠানের একপাশে মিঠুকে বেঁধে রাখা হয়েছে ছানা নিয়ে। ছানা দুটো খেলা করছে। আরু দুহাত বাড়িয়ে আয় বলতেই ছানা দুটো ছুটে এলেও মিঠু এলো না। চোয়ালের নিচে হাত রাখতেই ছানা যুগল পল্লব বুজে অনুভব করতে থাকল সোহাগ। আরু কৌতূহল নিয়ে বলল, “মা, মিঠু ওভাবে বসে আছে কেন? কী হয়েছে ওর?”

“মিঠুকে বোধ হয় সাপে ছোবল দিয়েছে। সারা শরীর ঘাঁ হয়ে গেছে। কালকে পশু হাসপাতালে নিয়ে গিয়েছিলাম, ডাক্তার ইনজেকশন দিয়েছে। সারা শরীরে মাখার জন্য একটা মলম দিয়েছে। বলেছে, ছানা দুটো যাতে মায়ের থেকে দূরে রাখি। দুধ ছাড়া কী খাবে ছাগল দুটো?” প্রিয় ছাগলের এমন কথা শুনে আরু উঠে এগিয়ে গেল।

মাটিতে বসে কোলে তুলে আদর করতে থাকে। ছাগলের দেহের বিভিন্ন অংশ পচে দুর্গন্ধ ছড়াচ্ছে। বোধ হয় বেশিদিন বাঁচবে না। ফোঁস করে নিঃশ্বাস ফেলে দিঘিতে নজর রাখতেই মাছের বুটবুট দেখতে পেল। প্রসন্ন হয়ে বলল, “মা, মাছগুলো অনেক বড়ো হয়েছে তো। একটা মাছ ধরো না? আজ মাছ দিয়ে ভাত খাব।”

“আচ্ছা। তুই এখন ঘরে চল।” পরপর আশেপাশে তাকিয়ে মিলাতে পারল না অয়নের হদিস। অপারক হয়ে ইমদাদুল হোসেনকে বলল, “আপনি এখানে থাকুন।‌ ছানা দুটো যাতে মায়ের দুগ্ধ খেতে না পারে। আমি আরুকে ঘরে দিয়ে আসি।”

বলেই আরুকে ধরে ধরে ঘরে নিয়ে গেল। আরুর ঘরটিতে রেখে ফ্যান চালু করল। আরু মায়ের হাতটি ধরে বলল, “মা, তুমি একটু আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিবে? রাত হলেই পাখি পেটের ভেতরে নড়াচড়া করে। পায়ের দাগ স্পষ্ট দেখা যায়। ব্যথায় চোখ ঝাপসা হয়ে আসে। উনাকেও ঠিকমতো ঘুমাতে দেইনা, আমিও ঘুমাই না। চোখের নিচে কালি পড়ে গেছে। আমাকে একটু ঘুম পাড়িয়ে দেবে মা?”

“তুই থাক, আমি এক মিনিটের ভেতরে আসছি।” পারুল বিছানা ঝেড়ে আরুকে রেখে দিঘির দিকে গেলেন। দখিনের জানালা খুলতেই দমকা হাওয়া আরুকে ছুঁয়ে দিল। অনুভব করল পুরনো দিনের কথা। এই ঘরে কাটাল দৃশ্য ভেসে উঠল চোখের পাতায়। পেছনে তাকিয়ে দেখল, পারুল ওজু করে এসেছে। আরুকে নিজের কোলে‌ নিয়ে মধুর কণ্ঠে দোয়া পড়তে শুরু করল, করল জিকির। আরুর ছটফটে প্রাণ সেই কণ্ঠে শীতল হয়ে এলো। ওষ্ঠদ্বয় নাড়িয়ে নিজেও ব্যক্ত করল হরফ। নেত্রপল্লব ঝিমিয়ে নেমে এলো তন্দ্রার রাজত্ব।

ফোনের রিংটোর এক নাগাড়ে বেজে চলেছে। সময় ৫.১৫ টা। অপূর্ব ফোন রিসিভ না করে পা থেকে মোজা টেনে খুলছে। বাড়িতে প্রবেশ করে আরুর আসার কথা শুনেই চলে এসেছে এখানে। অপূর্ব ফোন রিসিভ করে কানের কাছে নিয়ে বলে, “হ্যালো মাহাদ, আমি আজ সাড়ে চারটার বের হয়েছি। তাই তোমার সাথে দেখা হয়নি। আশেপাশে খুঁজেও তোমাকে পাইনি।”

চিরচেনা কণ্ঠ শুনে আরু তাকাল। মুচকি হেসে মাথাটা অপূর্বর কোলে রেখে জড়িয়ে ধরল কোমর। অপূর্ব ওপাশের কথা আর শুনল না, কল বিচ্ছিন্ন করে আরুর মাথায় হাত চালিয়ে বলল, “লম্বা একটা ঘুম দিলি শুনলাম। তা ঘুমানোর আগে কিছু খেয়েছিস?”

“না। তবে অনেকদিন পর নিজেকে ফ্রেশ ফ্রেশ লাগছে। এতদিন ঘুমের কারণে মাথা ঝিম দিয়ে থাকত। আজ তেমন লাগছেনা। তবে খুব ভালো লাগছে। তা আপনি কখন এসেছেন?”
“এই এলাম। ফ্রেশ হয়ে একসাথে খাব।” বলতে বলতে অপূর্ব ব্যাগ থেকে নিজের সাধারণ পোশাক বের করে দিঘির দিকে রওনা হলো, মুখ ধুতে আরুও চলল পিছুপিছু।

নীলপদ্ম গেঁথে রেখেছি তোর নামে পর্ব ৫২

যাওয়ার সময় নিমের ডাল ভাঙতে ভুলে না। দিঘির পাড়ে বসে দাঁত মাজছে, অন্যদিকে অপূর্ব তখন সাবান দিয়ে দেহ পরিষ্কার করছে। গাছের সাথে হেলান দিয়ে পাখিকে উদ্দেশ্য করে আরু বলে, “এই পাখি, কবে তুই আমার কোলে আসবি। কবে মা বলে ডাকবি। না! না! তুই বিদেশিদের মতো মম ও ড্যাড বলে ডাকবি, ঠিক আছে?”

নীলপদ্ম গেঁথে রেখেছি তোর নামে পর্ব ৫৪