নেশাক্ত ভালোবাসা সিজন ২ শেষ পর্ব 

নেশাক্ত ভালোবাসা সিজন ২ শেষ পর্ব 
লেখিকাঃ Tamanna Islam

মাথার পেছনে একটা সাদা রঙের কুশনে আলতো ভাবে হেলান দিয়ে দোলনাতে বসে রয়েছে আইরাত। মাথার ওপরে খোলা আকাশ। আশেপাশে ছোট ছোট ফুলের গাছ। রোদের মিষ্টি কিরণ এসে মুখের ওপর পরতেই পিটপিট করে চোখে মেলে তাকায় সে। শূন্য নয়নে একবার নিজের চারিপাশে চোখ বুলায়। অতঃপর সবার আগেই হাত টা চলে যায় নিজের পেটের ওপর। এটা ভাবতেই শান্তি লাগে যে নিজের মাঝে একটা না বরং দু-দুটো প্রাণ নিয়ে বেঁচে আছে সে।

তার ভেতর আরো দুটো জীবন বেঁচে আছে। মুখের কোণে হাসির রেখা ফুটে ওঠে। বাতাসে চুলগুলো উড়ে উড়ে যাচ্ছে। স্নিগ্ধ এক পরিবেশ। তখনই টাফি-সফটি এসে দুজনে একে ওপরের পেছনে দৌড়াদৌড়ি করতে লাগে। তারা আগে থেকে কিছুটা বড়ো হয়েছে। ছুটোছুটি শেষে তাদের গাঢ় গোলাপি রঙের জিভ বের করে আইরাতের দিকে ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে থাকে। আইরাত তার পাশে থাকা একটা ছোট বাটি থেকে কিছু বিস্কিট নিয়ে তাদের দিকে এগিয়ে দেয়। দুজনে ছুটে এসে আইরাতের হাত থেকে বিস্কিট নিয়ে খেয়ে ফেলে।

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

আইরাত আবার হেলান দিয়ে পেটের ওপর এক হাত রেখে শুয়ে থাকে। ওপরে আইরাতের রুম থেকে অর্থাৎ করিডর থেকে নিচে বাগানের দিকটা পুরো দেখা যায়। সেখানে দিয়া, ইলা আর অনামিকার কন্ঠ শুনে আইরাত নিচে একটু উঁকি দেয়। সবাই কে নিচে দেখে আইরাতের নিচে যেতে মন চাইছে। এখানে একা একা বসে থাকতে আর ভালো লাগে না। নিজের গলা ছেড়ে ডাক দেয়।
আইরাত;; আব্রাহাম! আব্রাহাম!
আব্রাহাম;; এইতো এসে গেছি। কিছু লাগবে বেবিগার্ল?
আইরাত;; সবাই নিচে।
আব্রাহাম;; চলো তোমাকেও নিয়ে যাই।
আইরাত;; বাহ, বুঝে গেছেন।
আব্রাহাম;; হুম চলেন ম্যাডাম।

আইরাত আস্তে করে উঠে পরে। আব্রাহাম আইরাতের হাত ধরে ধরে নিয়ে যায়। আজকে ওপরের রুমে উঠেছে আইরাত জিদ করেই। আব্রাহামের কথা একটাও শুনে নি। এর জন্য তাকে সিড়ি বেয়ে নিচে নামতে হচ্ছে। আর তাদের পেছন পেছন টাফি-সফটিও লাফিয়ে লাফিয়ে আসছে।
আব্রাহাম;; আমার একটা কথা যদি শুনতে তুমি আইরাত! এইযে বললাম যে ওপরে সিড়ি বেয়ে উঠতে হবে না। কিন্তু নাহ তুমি তো নিজের মর্জির মালিক।
আব্রাহাম তাকিয়ে দেখে আইরাত সরু দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে আছে। নিশ্চিত রাগে ফুলছে।

আব্রাহাম;; আহা রাগ করছো কেনো? আচ্ছা রাগ করতে হবে না চলো।
আইরাত;; আমি যাবো না।
আব্রাহাম;; না না থাক রাগ করে না, রাগ করে না।
আইরাত;; না না আমি যাবো না, যাবো না। সরেন আপনি।
আইরাত নিজের হাত ঠাস করে ছাড়িয়ে নেয়।
আব্রাহাম;; কি এক জ্বালা। কথায় কথায় শুধু রাগ করে! বেইবি প্লিজ চলো। রাগ করে না সোনা।
আইরাত;; ওহ আচ্ছা আমি, আমি এখন জ্বালা হয়ে গেছি তাই না। থাক জ্বালা আর সহ্য করতে হবে না আপনার।
আব্রাহাম;; ?‍♂️
আইরাত;; যান যান।

আব্রাহাম;; জানপাখি প্লিজ চলো। আচ্ছা সরি সরি। এইযে কানে ধরেছ সরি।
আব্রাহাম সত্যি সত্যি আইরাতের সামনে এসে হালকা ভাবে নিজের কানে হাত দেয়। আইরাত তো দুহাত ভাজ করে গাল ফুলিয়ে টিমটিম হয়ে আছে। আব্রাহাম তার মাথা হালকা নিচু করে আইরাতের দিকে তাকায় দেখে আইরাত এখনো গাল ফুলিয়ে রেখেছে। তা দেখে আব্রাহাম তার আঙুল দিয়ে আইরাতের গালে বেলুন ফুটানোর মতো টুস করে টোকা দেয়। এতে আইরাত হেসেই দেয়।
আব্রাহাম;; চলো এখন।
আব্রাহাম তার হাত ধরে নিয়ে যেতে লাগে। ইদানীং এটাই হয়। হুটহাট করেই আইরাতের রেগে যাওয়া, প্রচুর জেদ করে বসা, এটা খাবে না সেটা খাবে না, এখানে যাবে না ওখানে যাবে না, মুড সুইং। তবে সবকিছুই আব্রাহাম সামলিয়ে নেয়। পারফেক্টলি। আইরাত যেমনই থাকুক না কেনো আব্রাহাম এসে আইরাতের পাশে বসে তাকে নিজের বুকের সাথে লাগিয়ে নিলেই যেনো জোয়ালামুখী শান্ত। নিচে নেমে এসে হলরুম পেরিয়ে বাগানের দিকে চলে যায়। কিন্তু সেখানে খানিক উঁচু ঢিভি ছিলো।

আব্রাহাম;; বেবিগার্ল, ওয়েট। তুমি এখানে দাড়াও।
আইরাত;; কি হয়েছে?
আব্রাহাম;; আসছি আমি।
আব্রাহাম গিয়ে বাগানে আগে একটা চেয়ার ভালোভাবে রেখে আসে। তারপর আবার আইরাতের কাছে আসে। তার দিকে নিজের এক হাত বাড়িয়ে দেয়।
আব্রাহাম;; Come my 3 in 1…
আব্রাহামের কথা শুনে আইরাত হেসে দেয়৷ আস্তে করে হাত টা আব্রাহামের হাতে রেখে নেমে পরে। তারপর এসে সবার সাথে বাগানে চেয়ারে বসে পরে।

আইরাত;; কি করো দাদি?
ইলা;; এইতো জুস বানাচ্ছিলাম তোর জন্যই। নে নে এটা খেয়ে ফেল আগে।
আইরাত;; না এটা তো জুস না।
ইলা;; আরে জুস-ই তো।
আইরাত;; এটা মিল্ক শেক।
ইলা;; বুঝে গেছে রে ?।
আইরাত;; হুম হুম চালাকি করো তাই না। ওটি হবে না। আমি খাবো না।
তখনই আইরাতের পাশে আব্রাহাম এসে দুহাত ভাজ করে দাঁড়ায়। গম্ভীর গলায় বলে ওঠে…
আব্রাহাম;; আইরাত খাও।
আইরাত;; বমি আসে আমার।
আব্রাহাম;; এখন আর আসবে না। দাদি মিল্ক শেক দাও দেখি।
ইলা;; এই নে।

আব্রাহাম মিল্ক শেকে এক গাদা চকোলেট ঢেলে দেয়। মিল্ক শেক থেকে হয়ে গেলো চকোলেট-মিল্ক শেক। সেটা আইরাতের দিকে এগিয়ে দিলে সে খেয়ে ফেলে। খাওয়ার পর আইরাতের ঠোঁটের ওপরে মুচ হয়ে যায়।
আব্রাহাম;; বাহহহ, আমার বউ এর মুচ।
আইরাত;; কৈ কৈ?
আব্রাহাম;; হাহাহা, এদিকে এসো।
আব্রাহাম আইরাতের ঠোঁটের ওপরে মুছে দেয়। সবকিছু ভালোই চলছিলো কিন্তু তখন কৌশল আসে।
কৌশল;; আব্রাহাম দাভাই!
আব্রাহাম;; হ্যাঁ
কৌশল;; একটু কথা ছিলো।
আব্রাহাম;; আসছি যা।
আব্রাহাম উঠে কৌশলের সাথে যায়।
আব্রাহাম;; কি হয়েছে?
কৌশল;; একটু অফিসে যেতে হতো তোমার।
আব্রাহাম;; কেনো?
কৌশল;; আসলে কয়েক লাক্ষ টাকা লস হয়েছে।
আব্রাহাম;; কেনো? কীভাবে?

কৌশল;; মানে জিনিস আমাদের কিন্তু তাতে নেমপ্লেট বা ক্রেডিট সম্পূর্ণ অন্যের দেওয়া। আর যেইসব জিনিসে আমাদের কোম্পানির নাম রয়েছে সেখানে জিনিসের গুনগত মান খুবই কম। যার ফলে নাম বদনাম হচ্ছে আমাদেরই। প্রোডাক্ট ভালো থাকলেও সেখানে উল্টা-পাল্টা সব করে রেখেছে অর্থাৎ ভেজাল যুক্ত। যার দরুন লক্ষ খানেক টাকা লস।
আব্রাহাম তার এক হাত কোমড়ে রেখে, আঙুল দিয়ে কপালের পাশে স্লাইড করে একবার পেছন ঘুরে তাকায়।

আব্রাহাম;; কে করেছে এইসব কিছু জানিস?
কৌশল;; খোঁজ লাগাচ্ছি তবে এখনো কিছুই জানা যায় নি। কিছু সময় লাগবে জেনে যাবো সবই।
আব্রাহাম;; আমি ভালো থাকতে চাইলে কি হবে ভালো আমাকে কেউ থাকতে দেয় না।
কৌশল;; হুমম। এখন কি করবে?
আব্রাহাম;; কাল আইরাত কে ডক্টরের কাছে নিয়ে যেতে হবে। তো কাল সময় পাবো না আমি। আচ্ছা দেখি আজ রাতেই অফিসে যেতে পারি কিনা।
কৌশল;; তাহলে এখন আমি ওদিকটা গিয়ে দেখি।
আব্রাহাম;; যা ভালো হয় কর। অয়ন কোথায় রে?
কৌশল;; রাশেদ, অয়ন সবাই তো অফিসে।
আইরাত;; কৌশল ভাইয়া! (কিছুটা চিল্লিয়ে)
কৌশল;; হ্যাঁ বউমনি।
আইরাত;; বাইরে যাচ্ছো?

কৌশল;; হ্যাঁ, কয়েক ঘন্টা পরই এসে পরবো আবার। তোমার কি চকোলেট-চিপ্স বা অন্যকিছু লাগবে?
কৌশলের কথায় আব্রাহাম তার দিকে চোখ ছোট ছোট করে তাকায়। ওইযে হাবিজাবি খাবারের নাম শুনে।
আইরাত;; হ্যাঁ হ্যাঁ তা তো বটেই। কিন্তু আসার সময় অবনি কেও সাথে নিয়ে এসো।
কৌশল;; আচ্ছা। দাভাই আমি গেলাম।
আব্রাহাম;; হুমম দেখে-শুনে যাস।

কৌশল চলে যায়। আব্রাহাম এমনি দাঁড়িয়ে থাকে আর ভাবতে লাগে যে এইসব কিছু আবার আশফাক করছে না তো। কারণ তার পুরো সন্দেহ এখন আশফাকের ওপরেই। তাকে আবার নিজের পার্টনার হিসেবে কাজে না নেওয়াতে আব্রাহামের ওপর বেশ জেদ রয়েছে তার। সে চাইলে এইসব কিছু উল্টো কাজ করতেই পারে। কিন্তু এইসব সে করলে আব্রাহাম তো তাকে আর এমনি এমনি ছেড়ে দিবে না।
আইরাত;; জামাইজান!
আব্রাহাম তাকিয়ে দেখে আইরাত তাকে হাত নাড়িয়ে নাড়িয়ে ডাকছে। আব্রাহাম তার কাছে যায়। সবার সাথে বসে পরে।
আইরাত;; জামাইজান!
আব্রাহাম;; হ্যাঁ।
আইরাত;; সবকিছু ঠিক আছে তো!
আব্রাহাম;; হ্যাঁ।

আইরাতের দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে কপালে চুমু এঁকে দেয়। তখনই দিয়া আর ইলা ঝেড়ে কাশে।
ইলা;; না মানে বলছিলাম কি যে আমরাও এখানে আছি আর কি!
আব্রাহাম;; তাই কি হয়েছে। তুমি আর দাদাভাইও তো লাভ ম্যারেজ করেছো। প্রথমে চুটিয়ে প্রেম করেছো তারপর পালিয়ে বিয়ে করেছো।
আইরাত;; হায় হায় তাই নাকি! দাদি সত্যিইইইই! আমি তো জানতামই না।
ইলা;; কি করবো আব্রাহামের দাদা সব দিক দিয়ে ঠিকই ছিলো তবুও মেনে নিচ্ছিলো না কেউই তাই পালিয়ে এলাম।
আইরাত;; আহা প্রেম রে।
আব্রাহাম;; হ্যাঁ দাদার গুণ টাই আমি পেয়েছি।
আইরাত;; কোথায় পেলেন! আমাকে নিয়ে তো ভাগেন নি আপনি!
আব্রাহাম;; কারণ তুমি নিজেই আমার কাছ থেকে দূরে দূরে পালিয়ে বেড়াতে। আমি আর তোমাকে নিয়ে পালাবো কখন। আর ওয়েট আমি কেনো পালাবো। আমি কি চোর না ডাকাত। সবার সামনে দিয়ে নিয়ে এসেছি। ভালোবেসেছি আমি খুন করিনি যে পালাবো।

আইরাত;; খুন করলেই বা কি!
আব্রাহাম;; কি বললে?
আইরাত;; “আমার জামাই টা কি ভালা গো” এটাই বললাম।
আব্রাহাম;; হুমম।
আইরাত;; আচ্ছা দাদি তোমার কয় বছর বয়সে বিয়ে হয়?
ইলা;; আমাদের যুগে তো মেয়েদের হাত-পা ফুটতে না ফুটতেই বিয়ে দিয়ে দেওয়া হতো রে। আমার যত টুকু মনে আছে পনেরো বছর বয়সে বিয়ে হয় আমার।
আইরাত;; এহ! বলো কি? এই পনেরো বছর বয়সে তুমি দাদার সাথে পালিয়ে এসেছো?
দিয়া;; জীবনে কি করলাম! ?
আইরাত;; ?

ইলা;; তোর দাদা আমার থেকে ৫-৬ বছর বড়ো ছিলো। স্কুলে আসার পথে দেখে পছন্দ করে। আস্তে আস্তে প্রেম, বাড়িতে বিয়ে ঠিক করলো কিন্তু তা কি আর হয়। পালিয়ে নিয়ে এলো আর আমিও এসে পরলাম।
আইরাত;; ভয় লাগে নি! যদি ধোকা দিতো?
ইলা মাথা তুলে তাকায়।
ইলা;; লেগেছে তো। অনেক ভয় লেগেছে যাবো কি যাবো না। বাড়ি ছেড়ে আসার সময় কতো পেছন ঘুরে ঘুরে ফিরে তাকিয়েছি। কিন্তু না করে দিতে পারি নি উনাকে। এইটুকু বুঝতে পেরেছিলাম যে বাবা যেখানে বিয়ে ঠিক করেছে সেখানে গেলে আমায় একটা সময় পঁচে মরতে হবে। তাই জীবনের মায়া ত্যাগ করে, সাহস জুগিয়ে ধরলাম তোর দাদাভাই এর হাত। জীবনে সুখ পেয়েছি অনেক। তবে যে সুখের মাধ্যম ছিলো সেই চলে গেলো।
আব্রাহাম;; কেনো আমি আছি না!

অনামিকা;; ?
ইলা;; ওরে হারামি। একটু ইমোশনাল হইছিলাম তাও হাসায় দেয়।
আইরাত;; তাহলে দাদি তোমার বয়স কতো?
আব্রাহাম;; দাদির বিয়ের বয়স কিছুদিন পর ৮০ তে পরবে। এবার হিসেব করে বের করো।
আইরাত;; চলছে ৭৯?
আব্রাহাম;; হুমম।
আইরাত;; বিয়ের বয়স ৭৯ চলছে। দাদির ১৫ বছরে বিয়ে হয়। তাহলে দাদির বয়স বর্তমানে ৯৪ ?।
দিয়া;; দাদি কে দেখে একদম বুঝাই যায় না।
আইরাত;; হায়াতের মালিক আল্লাহ।
অনামিকা;; মাশআল্লাহ।

আইরাত তার মাথা টা আব্রাহামের কাধে রেখে দেয়। আর আব্রাহাম আলতো করে তার মাথাও ঠেকিয়ে নেয়। সবাই এভাবেই বসে হাসি-তামাশা করতে লাগে।
রাতের বেলা বাসার দিকে সবকিছু ঠিকঠাক করে আব্রাহাম চলে যায় তার অফিসে। এই সময়ে আব্রাহাম কে অফিসে দেখে সবাই কিছুটা অবাক হয়। সবার সাথেই মোটামুটি কুশলাদি বিনিময় করে আব্রাহাম নিজের কেবিনে যায়। মেনেজার কে দিয়ে অফিসের সকল ক্যামেরা ফুটেজ গুলো নিয়ে আসতে বলে। সেগুলো এক এক করে সব চেক করতে লাগে। কিন্তু ফলাফল শূন্য। ফুটেজে তেমন কোন কিছুই খুঁজে পাওয়া যায় না।

গত এক সপ্তাহের মধ্যে যে সকল প্রোডাক্ট গুলো লঞ্চ হয়েছে সেগুলোর প্রত্যেকটার একটা একটা করে স্যাম্বল নিয়ে আসতে বলে। সবকিছু খুটিয়ে খুটিয়ে দেখার পরও কোন ঘাবলা পাওয়া যায় না। সবকিছুই ঠিক আছে। তার মানে পরিষ্কার যে কেউ ইচ্ছে করেই জিনিসগুলো তে ভেজাল মিশিয়ে সেগুলো চালান করা হচ্ছে। নয়তো একই প্রোডাক্ট সবই ঠিক শুধু ভেতরে এক রকম আর বাইরে আরেক রকম কেনো! অর্থাৎ অফিসের ভেতরে ঠিকঠাক কিন্তু বাইরে গেলেই সব ভেজালযুক্ত হয়ে যাচ্ছে। তার মানে দাঁড়ায় এই যে কেউ বাইরে থেকেই সবকিছু নষ্ট করে দিচ্ছে। যদি বাইরের মানুষ এইসব কিছু করে থাকে তাহলে অবশ্যই তাকে হেল্প করার জন্য বা তাকে সব ইনফরমেশন দেওয়ার জন্য ভেতরে কেউ না কেউ তো আছেই। এই সবকিছুই মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছিলো আব্রাহামের কিন্তু তখনই রাশেদ ডাক দেয়…

রাশেদ;; স্যার!
আব্রাহাম;; হুম
রাশেদ;; এখন তো আমারও মনে হয় যে সবকিছু আশফাকই করছে।
আব্রাহাম;; এতো প্যাচানো জিনিস ভালো লাগে না। সোজা মেইন পয়েন্টে আসি। এক কাজ করো বেশ কিছু গার্ড কে বলো পাতাল থেকে হলেও এই আশফাক কে ধরে নিয়ে আসতে।
রাশেদ;; স্যার এখন!
আব্রাহাম;; খুঁজতে বা ধরে আনতে তো সময় লাগবে। আজ খুঁজুক, পরে দেখি এই আশফাকের কি ব্যাবস্থা করা যায়।
আরো ঘন্টা খানিকের মতো থেকে আব্রাহাম নিজের বাসায় যাওয়ার জন্য পা বাড়ায়। বাইরে গিয়ে গাড়িতে উঠে বসে পরে। ব্লুটুথ কানে দিয়ে গান শুনতে শুনতে আসছে। কিন্তু কিছু সময় পর অনামিকা ফোন করে আব্রাহামের কাছে।

আব্রাহাম;; হ্যালো মা!
অনামিকা;; বাবা তাড়াতাড়ি আসো। আইরাতের অবস্থা ভালো না।
আব্রাহাম;; মানে কি! কি হয়েছে? (হাইপার হয়ে)
অনামিকা;; শুধু বমি করে যাচ্ছে। আর দম নাকি ভারি হয়ে আসছে।
আব্রাহাম;; ব্যাথা করছে নাকি পেটে?
অনামিকা;; ব্যাথা করছে না তবে ওর অবস্থা ভালো না।
আব্রাহাম;; আমি দশ মিনিটে আসছি মা তোমরা সবাই প্লিজ আইরাত কে দেখো। আমি আসছি। কেনো যে অফিসে আসতে গিয়েছিলাম আমি এখন।

এই বলেই আব্রাহাম ফোন কেটে দেয়। বুকটা কেমন ধুকপুক করছে। ইতোমধ্যে ঘেমেও গিয়েছে সে। এখন কোন রকমে শুধু বাড়ি পৌঁছে গেলেই হলো। আধা ঘন্টার রাস্তা দশ মিনিটে এসেছে সে। বাড়ির বাইরে গাড়ি থামিয়ে চাবি টা গার্ডের দিকে হালকা ঢিল দেয়। ও পার্ক করে দিবে। আর আব্রাহাম সোজা দৌড়। বাড়ি গিয়েই দেখে আইরাত একটা সিঙ্গেল সোফাতে বসে আছে। তার চারিপাশে সবাই তাকে নিয়েই ব্যাস্ত। আব্রাহাম ছুটে গিয়ে আইরাতের পাশে যায়। আইরাত কোন কথা না বলে শুধু ভারি ভারি দম ছাড়ছে আব্রাহাম কে দেখে তার কোমড় জড়িয়ে ধরে। সেও আইরাত কে জড়িয়ে ধরে মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে।

আব্রাহাম;; বেবিগার্ল! কি হয়েছে জান! ব্যাথা করছে পেটে। চলো হস্পিটালে যাবো।
আইরাত;; না না আমি কোথাও যাবো না। আমার এখন ভালো লাগছে না। আপনি আমার কাছে থাকেন তাহলেই আমি ঠিক থাকবো। আমার শুধু শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে।
আব্রাহাম আইরাতের মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে চুমু এঁকে দেয়।
আব্রাহাম;; ও কি খেয়েছে কিছু?
ইলা;; যা খাচ্ছে সবই তো উল্টিয়ে ফেলে দিচ্ছে।
আব্রাহাম;; আচ্ছা থাক। জানপাখি চলো।

আব্রাহাম আইরাত কে ধরে দাঁড় করায়। আস্তে আস্তে হেঁটে রুমে চলে যায়। তাকে বিছানার ওপর হেলান দিয়ে শুইয়ে দেয়। আব্রাহাম গিয়ে নিজের ওপর থেকে কোট টা খুলে শার্টের হাতা গুলো গুটিয়ে নেয়। বারবার চোখে-মুখে পানি দিতে দিতে আইরাতের জামার বুকের দিকটা আর হাতার দিকগুলো বেশ ভিজে গেছে। তাই আব্রাহাম তাকে চেঞ্জ করিয়ে দেয়। তারপর রেস্ট নিতে বলে। এভাবেই চলে যায় রাত টুকু।
পরেরদিন সকালে উঠেই আব্রাহাম আইরাত কে নিয়ে ডক্টরের কাছে যাওয়ার জন্য রওনা দেয়। ধরে ধরে নিয়ে গিয়ে গাড়িতে বসিয়ে দেয়। ড্রাইভার কে আস্তে ড্রাইভ করে যেতে বলে আর পেছন সীটে আইরাতের সাথে আব্রাহাম বসে আছে। ডক্টরের কেবিনে চলে যায়…

ডক্টর;; ম্যামের নয় মাসে তো পরে গেছে কিছুদিন আগেই। ডেলিভারির সময় হয়ে এলো বলে।
ডেলিভারির কথা শুনতেই আইরাত আব্রাহামের হাত খামছে ধরে। আব্রাহাম বুঝলো সে অনেক নারভাস তাই নিজের দুহাত দিয়ে আইরাতের এক হাত ভালো ভাবে জড়িয়ে ধরে।
আব্রাহাম;; হুমম।
ডক্টর;; এখন শুধু সবকিছু ভালোয় ভালোয় কেটে গেলেই হলো।
আইরাতের সাথে কেবিনে থাকা অবস্থায় আব্রাহামের কাছে ফোন আসে। রাশেদের ফোন দেখে আব্রাহাম উঠে কেবিনের বাইরে চলে যায়।
আব্রাহাম;; হ্যালো!

রাশেদ;; স্যার আশফাক কে তো পাই নি তবে তার জন্য কাজ করে এমন একজন কে পেয়েছি।
আব্রাহাম;; জমিয়ে খাতির-দারি করে আশফাক বর্তমানে কোথায় আছে তা বের করো।
রাশেদ একবার তার পেছন ফিরে তাকিয়ে আবার আব্রাহামের সাথে কথা বলে।
রাশেদ;; স্যার তাকে চেয়ারের সাথে বেঁধে রেখে

মারতে মারতে মুখ-নাক দিয়ে রক্ত বের করে ফেলেছি। কিন্তু তেমন কিছু একটা বলে না। কি করবো?
আব্রাহাম;; ঘি সোজা আঙুলে বের না হলে আঙুল বাঁকা করতে হয়। লিসেন যাকে তুলে এনেছো তার ফ্যামিলি তে কে কে আছে তা খোঁজ করো। এবং তাদের নিয়ে ব্লেকমেইল করো। ওকে বলো যে সে যদি মুখ থেকে কিছু না বের করে তাহলে তার পরিবারের লোকজন দের ক্ষতি করে দিবে। তবে এটা যেনো শুধু বলা অব্দিই সীমাবদ্ধ থাকে এর আগে না বাড়ে। ভূল করেও যেনো ওর পরিবারের লোকদের ওপর একটা টোকাও না পরে। কোন ক্ষতি যেনো ওর পরিবারের লোকজন দের না হয়। ওকে এটা বলো শুধু ওকে ভয় দেখানোর জন্য ব্যাস আর কিছুই না। আমি আবার বলছি বাকিদের কোন কিছু যেনো না হয় ওকে!

রাশেদ;; জ্বি স্যার।
আব্রাহাম ফোন কেটে দেয়। বাকি সব চেকাপ শেষে আইরাত কে নিয়ে বের হয়ে পরে। আইরাত আব্রাহামের কিছুটা রাগি মুখ দেখে বারবার জিজ্ঞেস করে যে সবকিছু ঠিক আছে কিনা! আব্রাহাম মুচকি হেসে হ্যাঁ বলে। বাসায় এসে পরে তারা। ডক্টর ৪ দিনের সময় দিয়েছে এরপরেই আইরাতের ডেলিভারির ডেট। এই কয়েকটা দিন আইরাত কে আরো বেশি কেয়ার ফুল থাকতে বলেছে ডক্টর। একদম বেড রেস্ট দিয়েছে।
রাতের বেলা আইরাত শুয়ে আছে আর আব্রাহাম তার জন্য জুস নিয়ে আসছে। আইরাতের হাতে জুস টা ধরিয়ে দেয় তখনই দরজাতে অয়ন আসে।

অয়ন;; দাভাই!
আব্রাহাম;; হুমম। অফিস থেকে কখন আসলি?
অয়ন;; আগে এদিকে এসো কথা আছে।
আব্রাহাম;; আইরাত সম্পূর্ণ জুস টুকু শেষ করা চাই ওকে!
আইরাত;; হুমমম।
আব্রাহাম অয়নের সাথে চলে যায়। অয়ন আব্রাহামের হাতে একটা ট্যাব ধরিয়ে দেয়। আর তাতে দেখা যাচ্ছে ওই লোকটাকে যে আশফাকের জন্যই কাজ করে। অর্থাৎ তাকে কি অবস্থায় রাখা হয়েছে তাই আব্রাহাম কে দেখাচ্ছে।
আব্রাহাম;; শালার ব্যাটা এতো মার খেয়েছে তবুও কিছু বলছে না!
অয়ন;; নাহ, অবশেষে বলেছে। আশফাক নাকি আজ ভোরের দিকেই শহরে এসেছে। মানে এই কদিন ও শহরের বাইরে ছিলো আজই এসেছে।

আব্রাহাম;; হুমম। আচ্ছা আমি দেখছি।
অয়ন;; ওহ আরেক কথা। হ্যাঁ আমাদের সন্দেহ-ই ঠিক ছিলো। এইসব কাজ আশফাকই করাচ্ছে।
আব্রাহাম;; ওই আধা মরা লোকটা বলেছে?
অয়ন;; হ্যাঁ। ও নাকি নিজেই সবকিছু তে উপস্থিত ছিলো।
আব্রাহাম;; হুমম।
অয়ন;; কাল…
আব্রাহাম;; অফিসে যাচ্ছি আমি।
অয়ন “হুমমম” বলে চলে যায়।

আইরাতের ঘুম থেকে ওঠার আগেই আব্রাহাম উঠে একদম রেডি। আব্রাহাম নিজের ওপরে এশ কালারের জেকেট জড়াচ্ছিলো তখনই আইরাত আস্তে আস্তে উঠতে ধরে বিছানা থেকে। আব্রাহাম তা আয়নাতে দেখে দ্রুত আইরাত কে এসে ধরে। তারপর ধরে তুলে বসিয়ে দেয়।
আইরাত;; সমস্যা নেই হাঁটাহাঁটি করতে পারি আমি বেশ ভালো করেই।
আব্রাহাম;; হুমম।
আইরাত;; অফিস?

আব্রাহাম;; বেবিগার্ল একদমই যেতে চাইছিলাম না কিন্তু একটু প্রব্লেম হয়েছে তাই যেতে হচ্ছে।
আইরাত;; আরে বুঝতে পেরেছি আমি। সমস্যা নেই আপনি যান।
আব্রাহাম;; ওঠো ফ্রেশ হও।
আইরাত গিয়ে ফ্রেশ হয়ে আসে। তারপর দুজন একসাথে রুমের বাইরে বের হয়ে আসে। আব্রাহাম সবার কাছে আইরাত কে ভালোভাবে রেখে বাইরে এসে চোখে গ্লাসে’স পরে নিজে দ্রুত অফিসে যাওয়ার জন্য ছুটে। আইরাত বাইরে এসেই দেখে সবাই বসে আছে। তবে দিয়া, ইলা রেডি হয়েছে হাতে কিছু ব্যাগ। এটা দেখেই তো আইরাতের মাথায় আগুন।

আইরাত;; এই এইই কোথায় যাও তোমরা?
দিয়া;; তুই আজ এতো তাড়াতাড়ি ঘুম থেকে উঠে পরলি যে।
আইরাত;; শুয়ে থাকতে থাকতে আর ভালো লাগে না। কোথায় যাচ্ছিস?
দিয়া;; একটু বাইরে।
আইরাত;; আমিও যাবো। বাসায় থেকে থেকে শেষ, কবে থেকে বাইরে যাই না আমি। আমাকেও নিয়ে যাও না।
অনামিকা;; না থাক, তুই বাড়িতে থাক।

আইরাত;; আরে আমি তো বাইরে গিয়ে আর হাঁটছি না। গাড়িতেই তো থাকবো। যাই যাই প্লিজ যাই।
আইরাতের আকুতি আর কেউ ফেলে দিতে পারে না। আর আসলেই তো কবে থেকে যে বাইরে যায় না সে। এই বাড়িতেই। সবাই যখন যাচ্ছে তাহলে তাকেও নিয়েই যাওয়া যায়। অবশেষে আইরাত কেও নিয়ে যাবে বলে ঠিক করে। অন্যদিকে আব্রাহাম অফিসে গিয়ে বড়ো কাচের ডেস্কের সাথে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। হাতে একটা গরম কফির মগ। সামনেই সব ফাইল এলোমেলো হয়ে আছে। যে লোকটাকে ধরে বেধে সব উগ্লিয়েছে তাকে ছেড়ে দিতে বলেছে। যদিও সে বর্তমানে হস্পিটালে এডমিট রয়েছে। ঘন্টা খানিক চলে যায় আব্রাহামও তার কাজে ডুবে আছে। হাজার করলেও আর কাজ শেষ হবে না। পাশে থাকা ফোন বেজে ওঠে, কাজের ব্যাস্ততায় নাম্বার না দেখেই ফোন রিসিভ করে কানে তুলে।
আব্রাহাম;; হ্যালো।

আশফাক;; হ্যালো স্যার। কেমন আছেন আপনি? বহুদিন পর আপনার এই ভরাট কন্ঠস্বর টা শোনার সৌভাগ্য হলো।
কন্ঠ চিনতে আর এক মুহুর্ত দেরি হলো না আব্রাহামের যে এই কে।
আব্রাহাম;; যাহহ,, যার জন্য ফাঁদ পাতলাম সে তো দেখি নিজের ইচ্ছে তেই ধরা পরেছে আমার কাছে।
আশফাক;; কিন্তু সেই ফাঁদে তো আমি পরবো না। পরবেন আপনি।
আব্রাহাম;; সোজাসাপটা কথা বল।
আশফাক;; আপনি কি ভেবেছেন নজর শুধু আপনি একাই রাখতে পারেন। আমি পারি না। আমিও রেখেছি।
আব্রাহাম;; মানে?

আশফাক;; এইযে আপনার দাদি, শালি আর প্রাণভোমরা অর্থাৎ বউ। আপনার অনাগত সন্তানের মা। তারা সকলে যে দেখি বাইরে। আমার নজরের সামনেই। কিন্তু আমি তাদের থেকে বেশ দূরে।
এটা শুনতেই আব্রাহামের কলিজা টা কেমন ছাত করে ওঠে। চেয়ারে হেলান দিয়ে বসে ছিলো সে, আশফাকের কথা শুনে সোজা হয়ে ওঠে বসে।
আব্রাহাম;; ওরা সবাই বাইরে কি করে? আর সাথে আইরাত! আইরাত কেনো? ও বাইরে এসেছে কেনো?
আশফাক;; এখন স্যার, একবার ভাবুন তো আমি যদি আইরাত ম্যাম কে কিডন্যাপ………..
আব্রাহাম;; আশফাক আমাকে চিনিস না তুই। একটা আচড় অব্দি এলেও তোকে আমি এমন মৃত্যু দিবো যে মৃত্যু নিজেও ভয় পেয়ে যাবে তোর অবস্থা দেখে।

আশফাক;; দেখা যায় কি হয়।
আব্রাহাম ফোনটা এক আছাড়ে ভেঙে খানখান করে ফেলে। মাথা ফেটে যাচ্ছে তার রাগে। সবকিছু ছেড়ে ছুড়ে আগে নিজের বাসায় যায় আব্রাহাম। বাড়ির ফোনে ফোন করে। এক সময় ফোন ধরে অনামিকা।
অনামিকা;; হ্যালো।
আব্রাহাম;; মা আইরাত আর দাদি, দিয়া সবাই কোথায় গিয়েছে? কেনো গিয়েছে?
অনামিকা;; তারা সবাই তো একটু বাইরে গিয়েছে। আইরাত কে রেখেই যেতে চাইছিলো কিন্তু তার নাকি বাসায় দম বন্ধ লাগছে। এমন ভাবে বললো যে মানা করতেই পারলো না। তাই নিয়ে গেলো। সমস্যা নেই আইরাত গাড়িতে রয়েছে তাকে নামতেও দিবে না।

আব্রাহাম;; কথা সেটা না মা। আচ্ছা ওরা কোথায় গিয়েছে?
অনামিকা;; সুপার শপে গিয়েছে।
আব্রাহাম;; আচ্ছা আমি রাখি। আর তুমি সাবধানে থেকো প্লিজ।
অনামিকা;; আচ্ছা।
আব্রাহাম এক হাত দিয়ে ড্রাইভ করছে আরেক হাত মুখের কাছে নিয়ে রেখেছে। হার্টবিট বেড়ে গিয়েছে তার চিন্তায় আর রাগে।

আব্রাহাম সোজা ঘোড়ার বেগে ছুটছে সুপার শপে যাওয়ার জন্য। কারণ ইলা, দিয়া আর আইরাত সবাই সেখানেই আছে। তবে ড্রাইভ করা অবস্থায় আব্রাহামের ফোনে ফোন আসে। সে না দেখেই রাগে ফোন কেটে দেয়। যখন তৃতীয় বারের মতো ফোন বেজে ওঠে তখন আব্রাহাম বিরক্তি হয়েই ফোন রিসিভ করে। কানে তার ব্লুটুথ ছিলো। হ্যালো বলতে যাবে কিন্তু তার আগেই ওপর পাশ থেকে দিয়া ঘাবড়িয়ে হাপাতে হাপাতে বলে ওঠে….
দিয়া;; হ হ্যা হ্যালো জিজু!

আব্রাহাম;; দিয়া আর ইউ ওকে? কি হয়েছে?
দিয়া;; জিজু অবস্থা খুব বেশি খারাপ।
আব্রাহাম;; হয়েছে কি আর আশেপাশে এতো চিল্লাপাল্লা কিসের?
দিয়া;; আইরাত নেই জিজু।
এক নিমিষেই আব্রাহাম তার গাড়ি থামিয়ে দেয়। হুট করেই এতো দ্রুত গাড়ির ব্রেক কষেছে যে অল্পের জন্য আব্রাহামের এক্সিডেন্ট হয়নি। চোখে মুখে ব্যাপক হয়রানির ছাপ নিয়ে আব্রাহাম আধো আধো গলায় বলে ওঠে…
আব্রাহাম;; নেই মানে! আইরাতের কি হয়েছে? কোথায় ও?

দিয়া;; জিজু আমি জানি না। আমরা সবাই শপের ভেতরেই ছিলাম। কেনাকাটা করে বাড়ি ফেরার জন্য গাড়িতে উঠতে ধরেছিলাম। কিন্তু তখনই খেয়াল করি যে গাড়ির এক পাশের টায়ার পাঞ্চার হয়ে গেছে। ড্রাইভার ঠিক করাচ্ছিলো ম্যাকানিক কে দিয়ে। এর মধ্যে আমরা সবাই কিছুটা দূর গিয়ে দাঁড়াই। কিন্তু এর মাঝে কি যে একটা হৈচৈ বেধে যায় যে আগুন লেগেছে। সাধারণত আমরা সবাই ভয় পেয়ে যাই। আইরাত কে নিয়ে আস্তে ধীরে আসছিলামই কিন্তু কোথা থেকে যেনো একটা গাড়ি এসে আইরাত কে তুলে নেয়।
আব্রাহাম;; তোম………

দিয়া;; না জোরজবরদস্তি করে নি। শুধু গান এনে আমাদের দিকে তাক করে ব্ল্যাকমেইল করে। আর আইরাত কে শুধু গাড়িতে উঠতে বলে। নইলে আমাদের সবাইকে গুলি করে দিবে এটা বলে। আইরাত আর অন্য কোন উপায় না পেয়ে উঠেই পরে গাড়িতে। আমাদের সবার সামনে আইরাত কে নিয়ে যায় জিজু কিন্ত আমরা কিছুই করতে পারিনা।
আব্রাহাম;; দাদি আর তুমি ঠিক আছো তো?
দিয়া;; না জিজু। আমি পরে গিয়ে মাথায় অনেক ব্যাথা পেয়েছি। আর দাদি ঠিকই আছে।
আব্রাহাম;; আসছি আমি।

আব্রাহাম ফোন টা নিয়ে পাশের সীটে ছুরে মারে রাগে। তার বুঝতে আর বাকি নেই যে কে এগুলো করিয়েছে। আশফাকের বলা কথাই তাহলে সত্যি হলো। মন চাইলে সব আগুন লাগিয়ে দিক। আইরত কে না জানি কোথায় নিয়ে গেছে! কি হালে আছে ও! ইশশশ অসহ্যকর আর ভাবা যায় না এইসব। আব্রাহামের রাগে সোজা কথা হাত-পা অবশ হয়ে গেছে। সে নিজেকে অনুভব করতেও পারছে না। মন চাইছে শুধু হাতে একটা চাকু বা ধারালো কোন অস্ত্র নিক আর তা দিয়ে শুধু মানুষ কে মেরে যাক। সে আবার হাওয়ার বেগে ছুটতে লাগে। সুপার শপে এসে পরলে দেখে দিয়া ইলা কে নিয়েই ব্যাস্ত। ইলা চিৎকার করে কাঁদছে। আব্রাহাম খেয়াল করে দেখে দিয়াও মাথায় কম ব্যাথা পায় নি। এমনকি তার মাথার পাশ দিয়ে রীতিমতো রক্ত ঝড়ছে। তাই নিজের ওরনা দিয়ে চেপে রেখেছে। আব্রাহাম কে দেখে দিয়া ছুটে যায়। গিয়েই হাউমাউ করে কেঁদে দেয়।

আব্রাহাম;; দিয়া, দিয়া কান্না করো না। প্লিজ ঠিক থাকো। আর তোমার অবস্থা তো ভালো না। হস্পিটালে চলো এভাবে থাকলে পরে ভয়াবহ রুপ ধারণ করবে। অয়ন! অয়ন কে ফোন করেছো?
দিয়া;; অয়ন, কৌশল ভাইয়া সবাই কেই বলেছি। তারা আসছে।
বলতে না বলতেই অয়ন আর কৌশল এসে হাজির হয়ে যায়। অয়ন তো দিয়ার অবস্থা দেখে পাগল প্রায়।
আব্রাহাম;; দেখ এখন ইমোশনাল হওয়ার টাইম নেই। অয়ন তুই দ্রুত দিয়াকে হস্পিটালে নে। আর কৌশল তুই দাদি কে নিয়ে জলদি বাড়ি যা। আর বাক…….

তার মাঝেই ফোন বেজে ওঠে। হাতে নিয়ে দেখে আননোন নাম্বার। রিসিভ করে। আর জানা মতেই ওপর পাশ থেকে আশফাকের অট্টহাসি। যা শুনেই পুরো মুখমণ্ডল লালচে বর্ণ ধারণ করে আব্রাহামের।
আশফাক;; আফসোস হচ্ছে?
আব্রাহাম;; অনেক বেশিই।
আশফাক;; নিজের ওপর তাই তো?
আব্রাহাম;; হুম
আশফাক;; আগেই বলেছিলাম আমি যে আমাকে নিজের বিজন্যাস পার্টনার বানিয়ে নিন। এতে তো আপনার আর লস হতো না তাই না।
আব্রাহাম;; আমার আফসোস হচ্ছে। প্রচন্ড রকমের আফসোস হচ্ছে। কিন্তু তা আমার ওপর না তোর ওপর, তোর কপালের ওপর।

আশফাক কিছু না বুঝে কপাল কুচকায়।
আব্রাহাম;; আমি জানি যে আমার আইরাত তোর কাছেই আছে। ওকে তুই-ই নিয়ে গেছিস নিজের সাথে।
আশফাক;; হ্যাঁ।
আব্রাহাম;; দেখ তোর শত্রুতা, তোর জেদ যা কিছুই আছে সবই আমার সাথে। আমার বউ বা পরিবারের কোন লোকদের সাথে না। যদি আসলেই মানুষ হয়ে থাকিস তাহলে তুই ওদের কিছুই করবি না আর যদি কাপুরুষ হয়ে থাকিস তাহলে ক্ষতি বাকিদেরই আগে করবি।

আশফাক;; এতোটাও ভীতু নই আমি। আমার টার্গেট কি তা তো আপনি এই সময়ে বুঝেই গেছেন তাই না। চিন্তা করবেন না আমি জানি যে এখন যদি আমি একজন কে মারি তাহলে একজনের সাথে সাথে আরো দুজন অর্থাৎ তিনজন মরবে। আর বাকিরা আধামরা। আমি তা করবো না। শুধু আপনাকে এখানে আনার চেষ্টা। আমার দূর্বল জায়গায় আঘাত করা।
আব্রাহাম তাকিয়ে দেখে কৌশল দাদি কে গাড়িতে বসাচ্ছে। আব্রাহাম দ্রুত ইশারাতে কৌশল কে ডাক দেয়।
আব্রাহাম;; জানিস তো দূর্বল জায়গাই যখন শক্ত হয়ে যায় তখন তার পরিণাম খারাপই হয়।
আশফাক;; হাহাহাহাহা,, আমি যখন ইচ্ছে তখনই আপনার এক বিরাট মাপের ক্ষতি করে দিতে পারি।
আব্রাহাম;; ব্যাটা, তুই এক কাজ কর। তুই না তোর হাতে চুড়ি পরে বসে থাক।

আব্রাহামের কথা শুনতেই ফোনের ওপর পাশ থেকে আশফাক চিল্লিয়ে ওঠে রাগে।
আব্রাহাম;; আস্তে আস্তে। চুড়ি পড়তে কেনো বলেছি জানিস কারণ তুই নিসন্দেহে একটা কাপুরুষ তাই তো মেয়েদের আশ্রয় নিস। তাদের ক্ষতি করার হুমকি দিস।
আশফাক;; হুমকি টা সত্যে পরিণত হলে কি হবে একবারও ভাবতে পারেন কি আপনি!
আব্রাহাম;; নিজের মরণ কে এভাবে নিজেই ডেকে আনিস না আশফাক।
আশফাক;; দেখা যাক কি হয়।

আব্রাহাম ফোন কেটে দেয়। কারণ এই আশফাকের কথা আর সহ্য হচ্ছে না তার। তবে এই কথা বলার মাঝেই আব্রাহাম একটা বুদ্ধিমানের কাজ করেছে তা হচ্ছে কৌশল কে ডাক দিয়ে এনে দ্রুত আশফাকের লোকেশন ট্রেক করে ফেলেছে। কেননা আব্রাহাম যখন আশফাকের সাথে ফোনে কথা বলছিলো তখন তো অবশ্যই তার ফোনের লোকেশন অন ছিলো। কথা বলার বাহানার ছলে আর উষ্কানি মূলক কথার জালে ফেলে তাকে। আর এই সুযোগেই তার লোকেশন ট্রেক করে নেয়। এখন আব্রাহাম অনায়াসেই জেনে যাবে যে এই ছুপা রুস্তাম কোথায় আছে বা কি করছে। এবার আব্রাহাম দ্রুত দিয়ার সাথে অয়ন কে হস্পিটালে দিয়ে আসতে বলে। আর ইলা কে বাড়ি। তারপর যে জায়গায় আব্রাহাম গিয়েছে সেখানে চলে আসতে বলে।

জেকেট টা নিজের ওপর থেকে ছুড়ে গাড়ির পেছন সীটে ফেলে শার্টের হাতা গুটাতে গুটাতে গিয়ে গাড়ির ড্রাইভিং সীটে বসে। মাথার ওপর যেনো কেউ জ্বলন্ত কয়লা রেখে দিয়েছে এমন ভাবে রাগ ধরে আছে আব্রাহামের। আজ আশফাক কে হাতের কাছে পেলে কি যে করবে সে আল্লাহ মালুম।

অন্যদিকে আইরাতের দম যেনো যায় যায় অবস্থা। অনেক অস্থিরতা কাজ করছে তার মাঝে। ঘেমে নেয়ে একাকার হয়ে গেছে। মাথার পাশ দিয়ে ঘামের বিন্দু বেয়ে বেয়ে পরছে। জোরে জোরে দম নিচ্ছে। আস্তে আস্তে চোখের পাতা খুলে ফেলে। নিজেকে আবিষ্কার করে একটা এলোমেলো ধুলোযুক্ত অন্ধকারাচ্ছন্ন রুমে। একটা চেয়ারের ওপর বসে আছে সে তবে তার হাত-পা বাধা না। সবকিছুই ঠিক আছে। শুধু বসে আছে সে। মাথার ঠিক ওপরেই একটা হলুদ রঙের বাতি আছে। সেটা জ্বলছে নিভু নিচু ভাবে। সেটাই পুরো ঘর কে আবছা আলোকিত করে রেখেছে। আইরাত সম্পূর্ণ পরিস্থিতি বুঝে ওঠে। তাকে নিশ্চিত অজ্ঞান করার মেডিসিন দিয়ে অজ্ঞান করে তারপর এখানে বসিয়ে রেখে গিয়েছে। সবার আগে আইরাতের হাতটা যায় নিজের পেটের ওপর। এক হাতের উল্টো পাশ দিয়ে কপালের ঘাম গুলো মুছে ফেলে আর ভার ভারি দম ছাড়ে। থেকে থেকেই কিছুটা কাশি দিয়ে ওঠছে। এক হাত পেটের নিচের অংশে ধরে চেয়ার থেকে আস্তে করে উঠে দাঁড়িয়ে পরে আইরাত। ধীর পায়ে হেঁটে হেঁটে গিয়ে রুমের দরজার কাছে চলে যায়। সেখানে গিয়ে দরজাতে আস্তে করে বার কয়েক বারি দেয়।

আইরাত;; এখানে কি কেউ আছেন? দরজা খুলুন প্লিজ। আমার, আমার দম বন্ধ হয়ে আসছে। প্লিজ কেউ দরজা খুলুন। কেউ কি আছেন?এখানে কি কেউ আছেন? প্লিজ একটা বার কেউ দরজা খুলে দিন।
বেশ কয়েক বার ডেকেও বাইরে থেকে কোন সাড়াশব্দ পায় না আইরাত। আব্রাহামের কথা খুব করে মনে পরছে। দাঁড়িয়ে থাকা তার পক্ষে আর সম্ভব না তাই সে গিয়ে আবার আগের চেয়ারে আস্তে করে বসে পরে। আশে পাশে কেমন অগোছালো প্রকৃতির সবকিছু। বেশ ভয়ও লাগতে শুরু করলো এবার আইরাতের। আইরাত আর না পেরে এক সময় হুহু করে কেঁদেই দেয়।

আশফাক আইরাত কে ধরে এনেছে তার নিজেরই এক বাড়িতে। তবে তা বেশ পুরনো। আশফাক নিজেই এই বাড়িতে এসেছে কমপক্ষে তিন-চার বছর পরে। নিজের ওই বাড়ির হলরুমে বসে বসে একের পর এক ঢকঢক করে মদ খেয়ে যাচ্ছে সে। আর আইরাত কে বন্ধ করে রেখেছে ওপরের এক রুমে। দীর্ঘদিন কেউ এই বাড়িতে না থাকার ফলে আর সেই সাথে পরিষ্কার না করার ফলে ধুলো-বালি সব জমে এক হয়ে গেছে।

আব্রাহাম এসে পরে আশফাকের বাড়ির সামনে। এসেই কপাল কুচকে তাকায়। এটাকে ভুতুড়ে বাড়ি বললেও কম হবে না। বাড়ির বাইরে বুলডগের মতো দু-দুটো কালো গার্ড দাঁড়িয়ে আছে। আব্রাহাম কিছু না বলেই আবার নিজের গাড়িতে উঠে পরে। গাড়ি বেশটুকু পিছিয়ে নেয়। পিছিয়ে নিয়েই আবার হাওয়ার বেগে গাড়ি স্টার্টআপ দিয়ে সামনের দিকে ছুটতে লাগে। গাড়ি এতোই জোরে সামনে এগিয়েছে যে এই দুজন গার্ডের আর কিছু করার সাহস বা গাড়ির সামনেই যাওয়ার দমে ধরেনি। তারা সোজা সামনে থেকে সরে এসে পরে। আর আব্রাহাম বাড়ির মেইন গেট একদম ভেঙে চৌচির করে ভেতরে ঢোকেছে। গেইট আর আস্তো নেই।

গগন কাপানো বিকট শব্দে বাড়ির ভেতরে আশফাকের হোস আসে। শব্দ টা এতোই জোরে হয়েছে যে তা আইরাতের কান অব্দিও পৌঁছে গেছে। তবে সে কিছু না বুঝে শুধু নিজের আশেপাশে তাকাতাকি করে। বাড়ির ভেতরে আরো আশফাকের কিছু চেলাটেলা ছিলো। তারা আব্রাহামের দিকে এগিয়ে গেলে আব্রাহাম রিভলবার বের করে সব কটা তাদের দেহে ঢুকিয়ে দেয়। আশেপাশে কোন দিকে তোয়াক্কা না করে একদম বাড়ির ভেতরে চলে যায়। হলরুমে এসে দেখে আশফাক মদ গিলতে ব্যাস্ত। তবে হলরুমে আসার আগে আব্রাহাম তার হাতে একটা লোহার লম্বাটে দন্ড নিয়ে আসে। যা মূলত বাড়ির গেইটেরই একটা অংশ ছিলো। আশফাক আব্রাহাম কে দেখে একটা শান্ত চাহনি দেয়।

আব্রাহাম;; আইরাত কোথায়?
আশফাক;; আরে আছে আছে। এতো হাইপার কেনো হচ্ছেন!
আব্রাহাম;; দেখ আমি নিজেকে খুব খুব খুব বেশি সংযত রেখেছি সেই জন্যই এখন অব্দি তুই নিঃশ্বাস নিতে পারছিস। আমি আমার আগের রুপ কে ফিরিয়ে আনতে চাই না। নয়তো তা মোটেও তোর জন্য সুবিধে জনক হবে না। এই বিজনেস পার্টনারশিপ নিয়ে যদি তোর সাথে আমার রেশারেশি হতো তাহলে তা মিটমাট করে নেওয়া যেতো কিন্তু এখন কথা আমার পরিবারের ওপর দিয়ে এসেছে। এনেছিস তুই। আমাকে বাধ্য করিস না আশফাক। সত্যি করে বল। আর শেষ বারের মতো জিজ্ঞেস করছি তোকে যে আমার আইরাত কোথায় আছে?

আশফাক;; আরে রিলেক্স মিস্টার আব্রাহাম চৌধুরী। আছে আপনার অনাগত সন্তান দের মা। কিছু হয়নি আপনার বউ এর। ঠিকই আছে এখনো মরে নি……………..
ব্যাস এইটুকু কথাই আশকাফের বলার সৌভাগ্য হয়। কেননা এইটা বলার সাথে সাথেই আব্রাহাম এক হিংস্র রকমের গর্জন দিয়ে তেড়ে এসে হাতে থাকা লোহার রড টা সোজা আশফাকের গলার শ্বাসনালি বরাবর ঢুকিয়ে দেয়। মূহুর্তেই পরিস্থিতি সব শান্ত আর আশফাক নিজেও। তার গলাতে লোহার দন্ড টা পুরো ঢুকিয়ে দিয়ে আব্রাহাম রাগে ফুসতে লাগে। তার কপালের রগগুলো কেমন ফুলে ওঠেছে। হাতের রগগুলোও জ্বলজ্বল করছে।

দাঁত গুলো কটমট করে আশফাকের দিকে তাকিয়ে আছে। আশফাক এখন শান্ত কেননা আব্রাহামের করা আঘাতে সাথে সাথেই সে মরে গেছে। আব্রাহাম তো এখন পুরো পুরি অন্ধ, রাগে অন্ধ হয়ে গেছে এখন। লোহার দন্ড টা আশফাকের গলা থেকে টেনে তুলে আবার আগের মতোই শ্বাসনালিতে আঘাত করে। এভাবে আব্রাহামের হাতে যতো কোলায় বারেবার আঘাত করেই গিয়েছে। একটা সময় আশফাকের গলা-ঘাড়ের মাংশ, হাড়, রগ সব ছিড়ে যায়। ঠিক যেনো দেহ থেকে মুন্ডু ছিড়ে নিচে পরে যাওয়ার মতো বাজে, বিভৎস দৃশ্য। আব্রাহাম রডটা তুলে নিচে ছুরে মারে। রাগ কমেছে তার। আর এখন তাকে কমাতেই হবে কেননা আইরাতের সামনে তার এই অবস্থায় যাওয়া যাবে না। এক তীক্ষ্ণ দৃষ্টি নিক্ষেপ করে আব্রাহাম আশফাকের দিকে।

আব্রাহাম;; এর জন্যই সবসময় নিজের অকাদ অনুযায়ী মানুষের সাথে টক্কর নিতে হয়।
এটা বলে আব্রাহাম এসেই পরতো কিন্তু তার চোখ যায় আশফাকের পকেটের দিকে। একটা চাবির মতো কিছু ঝুলছে। তা হাতে নিয়ে দেখে একটা ০৮ নাম্বার রুমের চাবি। আব্রাহাম বুঝলো যে এটাই আইরাত যে রুমে আটকে আছে সেই রুমের চাবি। সিড়ি বেয়ে দ্রুত ওপরের রুম গুলোর দিকে এগিয়ে যায়। ১ ২ ৩ সব রুমই আসে তবে ৮ আর আসে না। আব্রাহাম তো খুঁজতে খুঁজতে হয়রান। কিন্তু পায় না। আব্রাহাম ভাবে এখানে আইরাত নেই তাই আবার নিচে চলে যেতে ধরে। আর ওদিকে আইরাতও বুঝে যে হয়তো এখানে কেউ একজন এসেছে।

আইরাত তো আর এই বদ্ধ রুমে থাকতে পারছে না, দম যেনো এই গেলো চলে। তাই আইরাত বহু কষ্টে চিল্লিয়ে ওঠে “কেউ আছেন!” বলে। আব্রাহাম শুনতে পায় আইরাতের কন্ঠ। তা শুনেই যেনো অশান্ত বুকে একরাশ শান্তি এসে ভর করে। দ্রুত ছুটে যায়। দেখে ৬ নাম্বার রুমের শেষেই একটা মোড়ের মতো আসে আর তারপরেও ৭/৮ রুম আছে। ৮ নাম্বার রুম চাবি দিয়ে দিয়ে খুলে ফেলে। আর ভেতরে যেতেই দেখে আইরাত হাপিত্তেশ করছে। ঘেমে গেছে সে। জোরে দম ত্যাগ করছে শুধু। আব্রাহাম দ্রুত আইরাতের কাছে যায়। তার চুলগুলো হাত দিয়ে পেছনে সরিয়ে দিয়ে মুখে অজস্র চুমু খেতে থাকে। পরিবেশ ভালো না আর এই জায়গা আইরাতের জন্য সেইফও না তা বুঝতে পেরে আব্রাহাম আইরাত কে আস্তে করে দাঁড় করিয়ে নেয়। তারপর ওপর থেকে নিচের দিকে সিড়ি বেয়ে নামতে শুরু করে।

নেমে হলরুমে আসতেই আইরাতের চোখ কপালে উঠে যায়। কেননা হলরুমে শুধু রক্ত আর রক্ত। আইরাতের মাথা যেনো ঘুরে যাওয়ার মতো অবস্থা। আইরাত যেই না নিজের মাথা ঘুরিয়ে পেছনের দিকে তাকাতে যাবে তখনই আব্রাহাম নিজের একহাত দিয়ে তার চোখ গুলো ধরে আটকিয়ে দেয়। কারণ আইরাতের থেকে ঠিক কয়েক হাত পেছনেই আশফাকের ক্ষত-বিক্ষত নিথর দেহ টা চেয়ারের ওপর পরে রয়েছে। যা দেখা আইরাতের জন্য অবশ্যই মঙ্গল জনক হবে না। আইরাতকে নিয়ে হলরুম পেরিয়ে বাইরে এসে পরলে আব্রাহাম নিজের হাতটা তার চোখের ওপর থেকে সরিয়ে ফেলে। তবুও আইরাত খেয়াল করে দেখে কতোগুলো লোক মাটিতে পরে পরে ব্যাথায় কাতরাচ্ছে। আইরাত আব্রাহামের দিকে তাকায়। কিন্তু আব্রাহাম একটা ডোন্ট কেয়ার ওয়ালা ভাব নিয়ে বলে….

আব্রাহাম;; জাস্ট ইগনোর দ্যাম বেবিগার্ল।
আইরাত কে নিয়ে সোজা বাইরে এসে পরে। আর যেই গাড়ি দিয়ে আব্রাহাম এসেছে তা দিয়ে যাতায়াত করা এক প্রকার অসম্ভব। কারণ গাড়ির হুলিয়া আব্রাহাম গেইট ভেঙে পুরো পালটিয়ে দিয়েছে। তবুও আব্রাহাম ওই গাড়ির কাছে গিয়ে গাড়ির সামনের দরজা খুলে দেয়। সেখানে সীটের ওপর আইরাত কে বসিয়ে দেয়। তারপর একটা পানির বোতল বের করে আইরাতের চোখে-মুখে দিয়ে দেয়। এতোক্ষণে গিয়ে আইরাত যেনো একটু স্বস্থি পায়। তার মিনিট কয়েক পর অয়ন, কৌশল আর রাশেদ আসে গাড়ি নিয়ে। সাথে দিয়াও এসে পরে। দিয়ার মাথায় সাদা ব্যান্ডেজ করা।

আইরাত;; জামাইজান!
আব্রাহাম;; হ্যাঁ জানপাখি।
আইরাত;; আমি বাড়ি যাবো। আমি আর নিতে পারছি না এইসব কিছু। খুব বেশি খারাপ লাগছে আমার।
আব্রাহাম;; আচ্ছা কে বলেছিলো বাইরে আসতে। তুমি আমায় বলতে যে কি কি লাগবে আমি সেইসবের বন্যা ভাসিয়ে দিতাম। এই সময়ে কেউ বাইরে যায় বুঝো না তুমি জান!
আইরাত;; আমি কি জানতাম নাকি যে এমন কিছু একটা হবে।
আইরাতের ঝাড়ি ওয়ালা মুখ দেখে এতোকিছুর মাঝেও আব্রাহাম ফিক করে হেসে দেয়।
আব্রাহাম;; হ্যাঁ তাও ঠিক।

রাশেদের কাছ থেকে গাড়ির চাবি নিয়ে নেয় আব্রাহাম। আর তাদের এইসব আধো মরা মানুষ কে নিয়ে যেতে বলে। যারা বেঁচে আছে তাদের হস্পিটালে নিয়ে যেতে বলে আর যারা মরে গেছে তাদের কবরস্থানে। অয়ন কে ভেতরে আশফাকের লাশের ব্যাপারে সবকিছুই আব্রাহাম বলে এসে পরে। বাকি টুকু সামলানো অয়ন আর রাশেদের ব্যাপার। গাড়ি দিয়ে আব্রাহাম-আইরাত, কৌশল আর দিয়া এসে পরে। পেছনের সীটে আইরাতের দুপাশে আব্রাহাম আর দিয়া বসে আছে আর সামনে ড্রাইভ করছে কৌশল।

ভালোই ভালোই যাচ্ছিলো তারা সবাই কিন্তু এবার বাধে আরেক বিপত্তি। বেশ বড়ো বিপত্তি।
গাড়ি দিয়ে যাচ্ছিলো সবাই। তবে যেতে যেতেই হঠাৎ করে আইরাত দিতে ওঠে এক গগন বিদারি চিৎকার। সবাই বেশ অবাক। আইরাতের চিৎকারে কৌশল ভরকে গিয়ে দ্রুত গাড়ির ব্রেক কষে দাঁড়ায়। দিয়া চোখ বড়ো বড়ো করে তাকিয়ে আছে। আব্রাহামও হাইপার হয়ে পরে। কিন্তু এদিকে তো আইরাতের নাজেহাল অবস্থা। এক হাত কোমড়ের পাশে রেখে আরেক হাত পেটের নিচের অংশে ধরে ব্যাথায় কুকড়ে ওঠে।

দিয়া;; আইরু, আইরু কি হলো?
আব্রাহাম;; লেবার পেইন উঠেছে। কৌশল দ্রুত গাড়ি ড্রাইভ করে হস্পিটালের দিকে নে।
কৌশল কোন রকমে মাথা দু’বার দুলিয়ে দ্রুত গাড়ি আবার স্টার্ট দেয়। আইরাতের একহাত আব্রাহাম ধরে রেখেছে। তার বুকে আইরাত নিজের মাথা এলিয়ে দিয়েছে। দরদর করে ঘেমে যাচ্ছে। আর দিয়া কোন রকমে আইরাত কে বুঝিয়ে যাচ্ছে। আইরাতের বাম হাতের তালু বারবার ঢলে যাচ্ছে।

আব্রাহাম;; বেবিগার্ল প্লিজ একটু ধৈর্য ধরো। কিচ্ছু হবে না। সবকিছু ঠিক হয়ে যাবে। একটু সহ্য করো প্লিজ।
দিয়া;; কিন্তু জিজু ডেলিভারির ডেট তো আরো কয়েক দিন পর ছিলো তাই না!
আব্রাহাম;; অনেক সময় ডেলিভারি ডেটের আগে বা পরেও পেইন শুরু হয়।
আইরাত এবার আর না পেরে ঢুকরে কেঁদে দেয়। সব যেনো ছিড়ে যাচ্ছে ব্যাথায়। আরেক দফা চিল্লিয়ে ওঠে। আব্রাহামের এখন আর সহ্য হচ্ছে না এই পরিস্থিতি। যেখানে আইরাত সামান্য একটু ব্যাথা পেলেই আব্রাহাম তাকে বাচ্চার মতো কেয়ার করতো সেখানে এখন আইরাত ব্যাথায় কাতরাচ্ছে। আব্রাহাম শুধু কোন রকমে সামাল দিয়ে যাচ্ছে তাকে। মন যেনো আর শান্ত নেই। এক উত্থাল-পাতাল বয়ে যাচ্ছে।

আইরাত;; আব.. আ আব্রাহাম আম আমি আ আর পারছি নাহ। খুব কষ্ট হচ্ছে আমার।
আব্রাহাম;; জান আমার প্লিজ একটু সহ্য করো। এসে পরেছি আমরা। কিচ্ছু হবে না কারো। কৌশল জলদি যা।
কৌশলও কম জোরে গাড়ি ধাওয়া করছে না। কিন্তু তাড়াতাড়ি তে করা কাজই আসলে ভালো না। পথ যেনো আর ফুরাতেই চাচ্ছে না। তারও পনেরো কিংবা বিশ মিনিট পর গাড়ি এসে থামে হস্পিটালের সামনে। আব্রাহাম ফোন করে ডক্টর কে আগেই বলেছে যে লেবার পেইন শুরু হয়েছে আইরাতের। তাই ডক্টর সেই অনুযায়ীই সবকিছু ঠিক করে রেখেছে। গাড়ি থামলে আইরাত কে পেছন থেকে ধরে দিয়া। দিয়ার ওপর হালকা ভাবে হেলান দিয়ে চোখে বন্ধ করে এক প্রকার কাঁদছে আইরাত। আব্রাহাম দ্রুত গাড়ি থেকে নেমে পরে। গাড়ির দরজা খুলে আইরাতের উদ্দেশ্যে বলে…

আব্রাহাম;; বেবিগার্ল! হাত দাও আমার দিকে।
আইরাত;; ক ক কি কর করছেন কি আপনি?
আব্রাহাম;; হাত দাও। তুমি তো আর হাঁটতে পারবে না। হাত দাও।
আইরাত;; আব্রাহাম আম আমি য যেতে পারবো।
আব্রাহাম;; জানপাখি হাত দাও, এইটুকু তুমি হেঁটে যেতে পারবে না। হাত দাও আমায়। সময় কম।
আইরাত;; কিন্তু….

এই অসময়ে আইরাতের এমন না না আর শুনতে না পেরে আব্রাহাম তাকে দেয় এক ধমক। আইরাত কেঁপে ওঠে সাথে আরো কেঁদেও দেয়। একটা হাত আব্রাহামের হাতের ওপর রেখে আস্তে করে গাড়ি থেকে কিছুটা বাইরে বের হয়। তারপর আব্রাহাম ধীরে আইরাত কে কোলে তুলে নেয়। তবুও এতে আব্রাহামের মাঝে কোন ভাবান্তর দেখা যায় না, সে আগের মতোই থাকে। দিয়াও গাড়ি থেকে নেমে ছুটে তাদের পিছু পিছু যেতে লাগে। হস্পিটালের ভেতর আব্রাহাম কে দেখা মাত্রই নার্স আর ডক্টর এগিয়ে যায়। একটা বেড এনে তাতে আইরাত কে শুইয়ে দেয়। একটা রুমে আইরাত কে নিয়ে যায়। কিন্তু ততক্ষণে আইরাতের ওয়াটার ব্রেক করে ফেলে। ব্যাথা যেনো তীব্র থেকে তীব্রতর হতে থাকে।

আইরাতের গায়ের জামা টা কোন রকমে খুলে একটা ঢিলা জামা পরিয়ে দেওয়া হয়। চুলগুলো গুটিয়ে এক করে একটা ব্লু কালার হেয়ার ব্যাগের ভেতরে বেধে দেয়৷ তারপর আবার সেই রুম থেকে আইরাত কে বেডে শুইয়ে বের করে আরেক রুমে নিয়ে যাওয়া হয়। অর্থাৎ যেখানে মূলত ডেলিভারি হবে। যাওয়ার সময় আব্রাহাম সোজা আইরাতের বেডের কাছে এসে পরে। আইরাত তো শুধু ছটফট করে যাচ্ছে ব্যাথায়। তার হিতাহিত জ্ঞান নেই বললেই চলে। আব্রাহামের হাত সে এতো টাই শক্ত ভাবে ধরেছে যে ছাড়ার আর নামগন্ধ নেই। আব্রাহাম শুধু তাকে সাহস জোগানোর জন্য এটা ওটা বলে যাচ্ছে কিন্তু প্রকৃত পক্ষে আব্রাহাম নিজেও অনেকটাই বেশি নারভাস। OT তে আইরাত কে ঢোকাতে যাবে কিন্তু আইরাত কোন ক্রমেই যেনো আব্রাহামের হাত ছাড়ে না। সে আব্রাহাম কে ছাড়া যাবেই না। তখন ডক্টর বলে ওঠেন….

ডক্টর;; স্যার প্লিজ আপনিও কেবিনের ভেতরে আসুন নয়তো ম্যাম পারবে না। প্লিজ স্যার আসুন।
অতঃপর আব্রাহাম নিজেও আইরাতের সাথে কেবিনে ঢুকে পরে। আইরাত কে পজিসন মোতাবেগ শোয়ানো হয়। ওয়াটার যেহেতু তার ব্রেক করেছে তাই ব্যাথা টা ক্রমেই ধীরে ধীরে বাড়ছে। আব্রাহাম ভয় পাচ্ছিলো এটা নিয়ে যে যদি আইরাতের কাটাছেঁড়া করতে হয়। কিন্তু ডক্টর সবকিছু দেখে বুঝলো যে কাটাছেঁড়া করতে হবে না অর্থাৎ সিজার করতে হবে না। নরমাল ভাবেই ডেলিভারি করা সম্ভব। আইরাতের মাথার কাছে আব্রাহাম তার এক হাত ধরে দাঁড়িয়ে আছে। মনে-প্রাণে আল্লাহ কে ডেকে যাচ্ছে। দুপাশে দু-তিনজন নার্স এসে দাঁড়ায়। আর ডক্টর নিজের কাজ করতে লাগে। এদিকে আইরাত আব্রাহামের হাত ধরে কেঁদেই যাচ্ছে।

বাড়ির প্রত্যেকটা লোক এসে হস্পিটালে হাজির। সবার মাঝে বেকুলতার ছাপ স্পষ্ট। অধীর আগ্রহে হস্পিটালের বাইরে দাঁড়িয়ে বা বসে রয়েছে সবাই। যখন আর এক বিন্দুও শক্তি আইরাতের মাঝে বাকি নেই,, চোখ যেনো তার নিভু নিভু তখন আব্রাহাম আইরাতের মাথার সাথে নিজের মাথা ঠেকিয়ে রেখে দেয়। তখনই একদম শান্ত পরিবেশের মাঝে বাচ্চার কান্নার আওয়াজ পাওয়া যায়। পুরো হস্পিটাল কেঁদে কেঁদে মাথায় তুলে নিয়েছে। বাইরের সবাই শুধু কেবিনের দরজার দিকে তাকিয়ে আছে। একটা বাচ্চাকে নিয়ে টাওয়ালে মুড়িয়ে একজন নার্সের কাছে দিয়ে দেয়।

সে বাচ্চাকে নিয়ে চলে যায়। পরমূহুর্তেই আরেকটা বাচ্চা কে আরেকজন নার্সের কাছে দিয়ে দেয়। আইরাতের এখনো তেমন কোন হুস নেই। প্রচন্ড দ্রুত গতিতে শ্বাস নিচ্ছে সে। বেশ ভালোই ব্লিডিং হয়েছে। তবে এতে আইরাতের ইনশাআল্লাহ কোন ক্ষতি হবে না। সব ঠিকই আছে আর এইটুকু তো হওয়ারই ছিলো। ডক্টর আইরাত কে ঠিক ঠাক করে দেয় একদম নিট এন্ড ক্লিন। অতঃপর হাত থেকে গ্লাপস আর মুখ থেকে মাস্ক খুলতে খুলতে বলে ওঠেন….
ডক্টর;; সব বাচ্চাই সুন্দর। আল্লাহ’র দেওয়া বিশেষ উপহার হয়। কিন্তু সত্যি বলতে কি এত্তো সুন্দর বাচ্চা আমি আমার ডক্টর লাইফে কখনোই দেখি নি এর আগে। অনেক অনেক কংগ্রেচুলেশন স্যার & ম্যাম আপনাদের টুইন বেবি হয়েছে। একজন ছেলে আর একজন মেয়ে।

আইরাত মুচকি হাসে। হালকা করে মাথা তুলে দেখে আব্রাহাম আইরাতের হাতটা অনেক শক্ত করে ধরে মাথার কাছে তার মাথা নামিয়ে রেখেছে। এর মাঝেই একজন নার্স আসে। আইরাত খেয়াল করে দেখে নার্সের কোলেই দুজন বাচ্চা। তবে নার্স টা দুজন বেবি কে একসাথে নিতে গিয়ে কেমন হিমশিম খাচ্ছে। ডক্টর দ্রুত একজন কে নিজের কোলে নিয়ে নেয়। উঠে বসার মতো অবস্থায় আইরাত নেই। কিন্তু এখন কি আর সেই খেয়াল আছে তার। আইরাত উঠে বসতে ধরলে আব্রাহাম তাকে ধরে তুলে বসিয়ে দেয়। পিঠের পেছনে একটা বালিশ দিয়ে দেয়। ছেলে-মেয়ে উভয় কেই আইরাতের কোলে দেওয়া হয়। দুপাশে দুজন কে নিয়ে বসে আছে আইরাত। মনে হচ্ছে এর থেকে বেশি সুখময় শান্তিময় সময় আর নেই। এখন এই সময় টুকু তাদের একা থাকতে দেওয়াই ভালো তাই নার্স আর ডক্টর বাইরে বের হয়ে পরে। মিনিট কয়েক পর বাকি সবাই কে কেবিনের ভেতরে যেতে বলে। আইরাত তাকিয়ে দেখে আব্রাহাম ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে আছে।

আইরাত;; জামাইজান!
আব্রাহাম;; হুম।
আইরাত;; আপনি খুশি নন!?
এবার আব্রাহাম চোখ তুলে আইরাতের দিকে তাকায়। আইরাতের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতেই হঠাৎ তার চোখের কোণে পানি জড়ো হয়ে যায়। আইরাত অবাক হয়ে তাকায়। এবার আব্রাহাম আর ঠিক থাকতে পারে না। আব্রাহাম কেঁদে দেয়। আইরাত কে পাশ থেকে জড়িয়ে ধরে।

আব্রাহাম;; খুশি রে আমার জানপাখি। আমি অনেক খুশি। একেবারে বাধভাঙ্গা খুশি আজ আমি। আমার বিশ্বাস হয় না। আমার কি আদৌ এতো টা সুখ পাওনা। আমার বলার ভাষা নেই। পৃথিবীর সবথেকে ভাগ্যবান আমি আজ।
আইরাত আব্রাহামের দিকে তাকায়। আব্রাহামের চোখে অশ্রুবিন্দু মুক্তোর ন্যায় ছলছল করছে আর মুখে ঝুলছে বিশাল মাপের হাসির রেখা। এবার আব্রাহাম বেবিদের দিকে তাকায়। আসলেই নবজাতক সুন্দর। দুধে-আলতা গায়ের রঙ। এত্তো গোলুমোলু। তাদের থাই, হাত আর গালগুলো বেশি মোটাসোটা। ঠোঁট গুলো এত্তো ছোট্ট আর গাঢ় গোলাপি। চোখের পাপড়ি গুলো কি যে কিউট। ঠোঁটের ঠিক ওপরেই ছোট্ট একটা বুচো নাক। মেয়ের চুলগুলো কালো আর ছেলের চুলগুলো হালকা ব্রাউন কালারের। দুজন এতোটাই দেখতে এক রকম যে এদের চেনার উপায় নেই যে কোনটা ছেলে আর কোনটা মেয়ে। আইরাত মেয়ে কে আব্রাহামের দিকে এগিয়ে দেয়। আব্রাহাম আইরাতের দিকে তাকিয়ে থাকে।

আইরাত;; আরে কি হলো তাকিয়ে আছেন কেনো? ধরুন।
আব্রাহাম আমতা আমতা করে বলে..
আব্রাহাম;; আব… না মানে আমি নিবো মানে যদি ব্যাথা পায়।
আইরাত;; পাবে না আপনি ধরুন।
এর মাঝেই মেয়ে কেঁদে দেয়। তার কান্না দেখে আব্রাহাম তড়িঘড়ি করে কোলে নেয় তাকে আর সাথে সাথেই মেয়ের কান্না বন্ধ। আইরাত হেসে দেয়।
আইরাত;; হুমম আমার বুঝা শেষ, মেয়ে হবে বাপের পাগল।
নিজের কোলের দিকে তাকিয়ে দেখে ছেলে বৃদ্ধ আঙুল চুষছে।
আব্রাহাম;; আচ্ছা আমি না কিছু বুঝলাম না।
আইরাত;; কি?

আব্রাহাম;; বাচ্চা হওয়ার সাথে সাথেই খাওয়ার জন্য কান্না করে আর এই দুজন কিছুই না। একজন আঙুল চুষছে আর একজন চুপ।
ছেলে মেয়ে দুজন কে একসাথে নিয়ে বসলে দুজনেই একসাথে পিটপিট করে চোখ মেলে তাকায়। জ্বলজ্বল করছে তাদের চোখগুলো।
আব্রাহাম;; তোমার মতোই হয়েছে।
আইরাত আব্রাহামের দিকে তাকায়।
আব্রাহাম;; একদম গোলুমোলু।

ব্যাস এটা বলার সাথে সাথেই বাচ্চাদের কান্না শুরু। কানের পর্দা যেনো ফেটে গেলো। বুঝলো ক্ষিদে পেয়েছে। বাকিরা সবাই কেবিনে ঢুকে। এখন কমপক্ষে বাটিতে করেই দুখ নিয়ে খাওয়াতে হবে কেননা আইরাতের শরীর ভালো না আর সেই অবস্থায় সে নেই। সবাই তো বাচ্চাদের পেয়ে খুশিতে পাগল। এক্কেবারে দিশেহারা। আর আব্রাহাম ব্যাস্ত আইরাত কে নিয়ে। আইরাত এর টেক কেয়ার সে নিজেই করে। আজ না হলেও হয়তো আগামীকাল আইরাত কে হস্পিটাল থেকে রিলিজ দেওয়া হবে। আব্রাহাম-আইরাত বসে ছিলো। আইরাতের কোমড়ের এক সাইডে হাত রেখে দিয়েছে সে। সবাই কে বাচ্চাদের নিয়ে মাতামাতি করতে দেখে আব্রাহাম আইরাত তাদের মাথা একসাথে ঠেকিয়ে হাসিমুখে তাদের সবার দিকেই তাকিয়ে থাকে। এই গোটা পৃথিবীর সবথেকে বেশি সুখময় মূহুর্ত যেনো এটাই। শুরু হলো আজ থেকে আব্রাহাম-আইরাতের জীবনের আরেক নতুন ধাপ।

দেখতে দেখতেই কখন যে চোখের পলকেই ছয়-ছয়টি মাস পেরিয়ে গেছে টেরই পাওয়া গেলো না। আর এই ছয়টি মাসে পালটে গেছে অনেক কিছুই। চৌধুরী বাড়ি আর চৌধুরী পরিবার যেনো আগে থেকে বেশ অনেকটাই ভিন্ন কিসিমের হয়ে গেছে। সবকিছু তেই পরিবর্তন এসেছে। বাড়ির আনাচে-কানাচে তে খুশিরা সব এসে উঁকি দেয়। আব্রাহাম-আইরাতের জীবন আগে থেকে আরো বেশি সুখময় হয়ে গেছে। এই ছয়টি মাসে বাচ্চা রা অনেক টাই বড়ো হয়ে গেছে। আইরাত নিজেই দুই বাচ্চার নাম দিয়েছে। আব্রাহামের ভাষ্যমতে আইরাত যা ভালো মনে করে তাই। সে ছেলের নাম দিয়েছে আতিফ আহমেদ চৌধুরী আর মেয়ের নাম দিয়েছে সায়রা ইসলাম নূর। দুজনেই দেখতে মাশআল্লাহ অনেক বেশিই সুন্দর। অনেক নাদুসনুদুস, গোলুমোলু। আর হবেই না কেনো! আইরাত সারাদিন এটা ওটা বাচ্চাদের খাওয়াতেই থাকে।

এত্তো পরিমাণে তাদের দেখে শুনে রাখে যে বলার বাইরে। আব্রাহাম তো তাদের মা, আম্মু, মাম্মাম শেখাতে শেখাতে একদম মুখে ফেনা তুলে ফেলে। আর আইরাত বাপ, বেটা-বেটির এইসব কান্ড দেখে হেসে হেসে শেষ হয়। আব্রাহাম ঘুমিয়ে থাকলে আইরাত হয়তো নূর বা আতিফ কে সোজা আব্রাহামের ওপরে বসিয়ে দিয়ে আসে। আর তারাই আব্রাহামের ঘুম ভেঙে দেওয়ার জন্য উঠে পরে লাগে একেবারে। রীতিমতো নাকানিচুবানি খায় আইরাত এদের দামলাতে গিয়ে। আতিফ আর নূর কে একই রকমের ড্রেস পরিয়ে দিলে কেউই আর ধরতে পারবে না যে ছেলে কোনটা আর মেয়ে কোনটা। শুধু একমাত্র তাদের চুল দেখা বাদে। এই চুলের রঙ দিয়েই তারা বুঝে যে আতিফ কোনটা আর নূর কোনটা।

ছেলে হয়েছে মায়ের পাগল আর মেয়ে হয়েছে বাবার পাগল। আইরাত শুধু এদের গালগুলো টানে। এত্তো নরম আর মোটাসোটা যা বলার বাইরে। বাড়ির সবাই মাথায় করে রাখে দুই বাচ্চাকে। তারা ইদানীং হামাগুড়ি দিতে শিখেছে একটু আধটু। এই হামাগুড়ি দিয়েই সারা বাড়ি টইটই করে ঘুরে বেড়ায়। খানিক চোখের আড়াল হলেই এরা এক জায়গা থেকে আরেক জায়গাতে চলে যায়। তাই দুজন কে চোখে চোখেই রাখতে হয় আরো বেশি। তবে আতিফ আর নূর মাঝে মধ্যে নিজেদের ভেতরেই খাবলা খাবলি বাধিয়ে দেয়, পরে একজন দেয় কেঁদে। আইরাত বা আব্রাহাম তাকে এসে কোলে নিলে সাথে আরেকজনও দেখা দেখি কেঁদে দেয়। এখন কোনটা কে রেখে কোনটাকে কোলে নিবে।

কেননা দুজন কে একসাথে নেওয়া যায় না। তারা একসাথে বসে বসে খেলা করলে বা আঙুল চুষে চুষে ঘুমালে মনে হয় এক নজরে তাদের দিকে তাকিয়েই থাকি। এত্তো সুন্দর লাগে একসাথে। আব্রাহাম-আইরাত তাদের উভয়ের মাঝেও বেশ পরিবর্তন এসেছে বাবা-মা হবার পর থেকে। যেই আইরাত কিনা নিজেই একজন বাচ্চা ছিলো। বাচ্চামো তে ভরা ছিলো। সেই এখন নিজের দু বাচ্চা সহ পুরো পরিবার কে সামাল দেয়। নিজের বাচ্চাকাচ্চা থেকে শুরু করে ঘরের প্রায় কাজগুলোই, দাদির মেডিসিন সহ বাকি সব সেই সামলায়। আবার আব্রাহামের দিকেও নজর রাখে, মাঝেমাঝে আব্রাহামের অফিসের কাজে হেল্প করে। তবে আগে থেকে চঞ্চলতা আর চটপটে স্বভাব টা কমে নি এক ফোটাও।

পুরো বাড়ি টা যেনো আইরাতের ছোঁয়ায় ঝলমল করে। বাড়ির লক্ষী বলা যায় তাকে। আগের মতোই রয়েছে দেখতেও। শুধু আব্রাহামের সাথে একটু জোরজবরদস্তি করে নিজের চুলের আগাল টুকু ছেটে নিয়েছে। আব্রাহামের কথা তো আর নাই বলি। তাকে দেখে বুঝাই যায় না যে এই বান্দা দুই বাচ্চার বাপ। হুবাহু আগের মতোই দেখতে রয়েছে। সেই আগের মর্জি-মেজাজ, বডি, চাপদাড়ি। নিজের বউ আর বাচ্চাদের নিয়ে যখন প্রেস/মিডিয়ার সামনে আসে তখন যেনো কারো নজরই সরে না তাদের ওপর থেকে। আগের মতোই হ্যান্ডসাম,, রাফ & টাফ আছে।

আর রইলো কথা তাদের দুজনের ভালোবাসার তো দেখে মনে হয় যে তারা নিউলি ম্যারেড কাপল। মানুষ বলে যে বাচ্চাকাচ্চার বাবা-মা হলে নাকি জামাই-বউ এর সম্পর্কে কিছুটা ভিন্নতা চলে আসে। আসলে এটা ভূল আর তা এই দুজন মানুষ কে দেখে বুঝা যায়। অনামিকা আর আইরাত আগে যেই বাড়িতে থাকতো সেটা আব্রাহাম রেখে দিয়েছে এমনি। সে চায় সবাই একই সাথে একই বাড়িতে এক পরিবারের মতো থাকুক। কি দরকার অযথা দূরে দূরে থাকার তাই এমনটা করা। অয়ন-দিয়া সহ অবনি-কৌশল আর রাশেদ-রোদেলাও এখন পার করছে বিবাহিত জীবন। ইলার যেনো নিজের নাতির বাচ্চাদের পেয়ে আর অন্য কিছুর দরকারই পরে না। মোট কথা একটা হ্যাপি ফ্যামিলি কাকে বলে তা এই পরিবার কে না দেখলে বুঝার কোন উপায়ই নেই।

বিছানার ওপর এক গাদা খেলনা নিয়ে আতিফ আর নূর কে বসিয়ে দিয়ে রেখেছে আইরাত। তারা তাদের মতো করে খেলছে আর থেকে থেকে হাসছে। আর আইরাত ঘরের সব কাজ করছে। প্রথমে নিজের চুল বেঁধে নেয়। তারপর এক নজর ঘড়ির দিকে তাকিয়ে ফিডারে করে দুধ নিয়ে আসে বাচ্চাদের জন্য। তাদের সামনে ফিডার রাখলে তারা নিজে থেকেই হাতে তুলে নেয়। একজন শুয়ে শুয়ে ফিডার খাচ্ছে তো আরেকজন উলটে উলটে। পেছনের দিকে তাকিয়ে দেখে একটা সিংগেল সোফার ওপরে এক গাদা বাচ্চাদের কাপড় রয়েছে তা দেখে আইরাত সেদিকে এগিয়ে যায়। গিয়ে সেগুলো ভাজ করতে লাগে তখন আব্রাহাম রুমে আসে। আব্রাহাম কে দেখেই বাচ্চারা খুশিতে গদগদ হয়ে যায়। ধীর পায়ে এগিয়ে গিয়ে আব্রাহাম আইরাতের পেছনে দাঁড়িয়ে পরে। তাকে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরে আর আচমকাই এমন হওয়াতে আইরাত বেশ চমকে যায়।

আইরাত;; আপনি এই সময়ে অফিস থেকে বাড়ি এলেন যে! কিছু দরকার?
আব্রাহাম আইরাতের চুলে নিজের নাক ডুবিয়ে দিয়ে বলে…
আব্রাহাম;; তোমাকে।
আইরাত;; এহ! এটা আবার কেমন কথা? হুট করেই আবার কি হলো আপনার?
আব্রাহাম;; প্রেম রোগে আক্রান্ত আমি।
আইরাত মুখটা উল্টিয়ে দিয়ে আব্রাহামের দিকে তাকায়। কোমড়ে দুহাত রেখে বলে…
আইরাত;; ভীমরতিতে ধরেছে আপনাকে?
আব্রাহাম;; না না তা তো বুড়ো বয়সে ধরে। আর আমি এখনো বুড়ো হয়নি বুঝলে। মেয়েরা মরে এখনো আমার ওপর জানো!

আইরাত;; আসলেই মরবে তারা। মরণ কাছিয়ে এসেছে তাদের তো তাই।
আব্রাহাম;; ক্ষেপেছে।
আইরাত;; হ্যাঁ ক্ষেপেছি তো! খুশি হয়েছেন!
আব্রাহাম আসলে চেতানোর জন্যই এইসব বলে আইরাতকে। সে মুচকি এক হাসি দিয়ে আইরাতের দিকে এগিয়ে যায়। তারপর নিজের হাতটা আইরাতের সামনে রাখে। আইরাত তাকিয়ে দেখে আব্রাহামের হাতে একটা বেলীফুলের মালা রয়েছে। এটা দেখেই তো আইরাত খুশিতে গদগদ হয়ে যায়।
আইরাত;; থাংকু জামাইজান।

আব্রাহাম যেই না আইরাত কে একটা চুমু দিতে যাবে তখনই তাকিয়ে দেখে যে বাচ্চারা ফিডার হাতে নিয়ে তাদের দিকেই ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে আছে। এগুলো যেনো তাদের চোখ না এক একটা বড়ো সাইজের মার্বেল। পিটপিট করছে।
আব্রাহাম;; আহাম…আহাম। আন্ডাবাচ্চা চোখ বন্ধ করো জলদি বাবাই এখন মাম্মাম কে কিসসি দিবে৷
এতো ছোট ছোট বাচ্চাগুলোও কি যে বুঝলো এতে তা একমাত্র তারাই জানে। কেননা আব্রাহামের বলার সাথে সাথেই তারা সোজা তাদের পুচ্চু পুচ্চু হাত দিয়ে চোখ গুলো ঢেকে ফেলে। তা দেখে আব্রাহাম-আইরাত দুজনেই হেসে একাকার। আর আব্রাহাম আইরাতের গালে কষে একটা চুমু এঁকে দেয়।

দুবেলা হাঁটতে নিয়ে যেতে হয় আইরাত আর বাচ্চাদের। সকালে আর বিকেলে। বুকের সামনে বেবি ব্যাগ ঝুলিয়ে তাতে করে নূর কে কোলে নেয় আব্রাহাম আর আতিফ কে কোলে নেয় আইরাত। এভাবেই সকালে আর বিকেলে নিয়ম করে হাঁটে। এটা যেনো এখন অভ্যাসে পরিণত হয়েছে তাদের। বিকেল বেলা হাঁটাহাঁটি শেষে তারা বাসায় এসে পরে। বাসায় এসেই দেখে সবাই বাগানে বসে বসে আড্ডা দিচ্ছে। আব্রাহাম-আইরাত কে দেখেই দিয়া আর অবনি ছুটে এগিয়ে যায়। তারপর তাদের কাছ থেকে বাচ্চাদের নিয়ে আসে। এবার আইরাত একটু বুক ভরে দম নেয়। এতোক্ষণ বাচ্চাকে নিয়ে থাকতে থাকতে এখন হয়রান লাগছে তার। বাচ্চাদের কে দিয়া, অবনি, কৌশল, অয়ন, তারা সবাই নিয়ে ব্যাস্ত হয়ে পরে।

এদিকে আইরাত আর আব্রাহাম গিয়ে কিছুটা ফ্রেশ হয়ে আসে। তারপর জমিয়ে আড্ডা দিতে লাগে। সবাই হাসছে আর বাচ্চাদের নিয়েই খেলা করছে। তবে আতিফ অয়নের কাছে গিয়েই তার চুল ধরে টানাটানি শুরু করে দেয়। আর তাদের এইসব কর্মকান্ড দেখছে আব্রাহাম-আইরাত। এর মাঝেই হুট করে রাশেদের মাথায় বুদ্ধি আসে ট্রুথ আর ডেয়ার খেলার। একে একে সবাই জেনে তাদের মত ঠিক করে নেয়। আব্রাহাম-আইরাত কেও টেনে এই খেলা তে নিয়ে আসা হয়। সবার ভাগ্যেই এক এক করে পরছে আর সবাই নিজেদের কৃতকর্ম খোলাসা করছে। তবে দেখতে দেখতেই পালা আসে আব্রাহামের। আব্রাহাম ডেয়ার নেয় যার ফল সরুপ তাকে সবাই ঝেঁকে ধরে গান গাওয়ার জন্য। আব্রাহামও রাজি হয়ে যায়। সে আইরাত কে ইঙ্গিত করে গিটারে টুংটাং আওয়াজ তুলে।

“তুমি আকাশের বুকে বিশালতার উপমা~
তুমি আমার চোখেতে সরলতার প্রতিমা ❤️?~
হোক না সে অনেক দিন বা বছর। আব্রাহামের করা প্রত্যেকটা কাজ আইরাত কে বারবার আগের ন্যায়-ই মুগ্ধ করে তোলে। আর আব্রাহাম তো নিজেই আইরাতে মুগ্ধ। এভাবেই সময় টুকু যেতে লাগে।
এখন রাতের সময় সবাই যার যার রুমে ঘুমাচ্ছে। কিন্তু আইরাত-আব্রাহাম সজাগ। আতিফ আর নূর ঘুমিয়ে পরেছে অনেক আগেই। আব্রাহাম অফিসের কাজ করছিলো করিডরে বসে বসে। বেশকিছু ইম্পর্ট্যান্ট মিটিং আছে, সেগুলোরই ফাইল সব। আইরাত এতোক্ষণ বাচ্চাদের পাশেই শুয়ে ছিলো। খেয়াল করে দেখে তারা ঘুমিয়ে পরেছে৷ দুজনের মাথাতেই আলতো করে চুমু এঁকে দিয়ে আইরাত আস্তে করে উঠে পরে তাদের পাশ থেকে।

তাকিয়ে দেখে আব্রাহাম তার চোখে মোটা ফ্রেমের চশমা পরে ল্যাপটপে গভীর ভাবে তাকিয়ে আছে। পরণে তার হাফ হাতা ওয়ালা একটা সাদা টি-শার্ট। এক নজর তার দিকে তাকিয়ে আইরাত দু কাপ কফি বানিয়ে আনে। ল্যাপটপ থেকে মাথা তুলে ঘাড়ের পেছনে এক হাত রেখে কিছুটা ক্লান্ত ভঙ্গিতে ঘাড় টা একটু পেছনের দিকে নিয়ে নেয় আব্রাহাম। তখনই এক কাপ কফি নিয়ে আব্রাহামের সামনে ধরে আইরাত। তার হাত থেকে কফি টা নিয়ে নিজের পাশে রেখে দেয়। তারপর আইরাতের হাত ধরে এক টান দিয়ে নিজের সামনে বসিয়ে দেয়। আব্রাহাম আইরাত কে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরে। আইরাতও তার মাথা টা একটু এলিয়ে দেয় আব্রাহামের কাধের ওপর।

নেশাক্ত ভালোবাসা সিজন ২ পর্ব ৫৬+৫৭+৫৮+৫৯+৬০

আব্রাহাম;; অনেক অনেক ধন্যবাদ বেবিগার্ল।
আইরাত;; কেনো বলুন তো!
আব্রাহাম;; আমার জীবনে আসার জন্য, আমার অন্ধকার ময় জীবন টাকে নিজের ভালোবাসা দিয়ে এতোটা আলোকিত করে তোলার জন্য, আমাকে ভালোবাসা শেখানোর জন্য, ভালোবাসা কাকে বলে তা বুঝানোর জন্য, এত্তো এত্তো পরিমাণে কিউট দু-দুটো বাচ্চা গিফট করার জন্য, এত্তো সুন্দর একটা হ্যাপি ফ্যামিলি দেওয়ার জন্য, এতো গুলো খুশি একসাথে আমাকে দেওয়ার জন্য অনেক অনেক ধন্যবাদ জানপাখি আমার।

আইরাত তার ঘাড় ঘুড়িয়ে আব্রাহামের গালে চুমু দিয়ে দেয়। আর আব্রাহাম আইরাতের ঠোঁটে। তাকে যেনো আব্রাহাম আরো বেশি করে জড়িয়ে ধরে। আর তাদের এই রাত্রিবিলাশ কে আরো গাঢ়ভাবে ফুটিয়ে তুলেছে ওপরে আকাশে থাকা ওই চাঁদের মুগ্ধকর জোৎসা রাতের আলো। যার আলোতে তাদের প্রতিবিম্ব বেশ দারুন ভাবে ফুটে ওঠেছে। বেশ সময় এভাবেই বসে থাকার পর তারা ভেতরে চলে আসে। বাচ্চারা একপাশে থাকে। আইরাত মাঝে আর তার ঠিক পরেই আব্রাহাম। আইরাত বাচ্চাদের জড়িয়ে ধরে আর আব্রাহাম আইরাত কে। যেনো সবকিছু সামলানোর দায়িত্ব আইরাতের আর এই পুরো আইরাত টাকে সামলানোর একান্ত দায়িত্ব আব্রাহামের।

আইরাত;; ভালোবাসি জামাইজান।
আব্রাহাম;; ভালোবাসি অনেক বেশি।
এই বলেই আব্রাহাম আইরাতের মাথায় এক চুমু এঁকে দেয়। তারা দুজন হয়ে রইলো একে ওপরের জন্ম জন্মান্তরের চিরসাথী হয়ে। আরেক দফা পরিপূর্ণতা পেলো আব্রাহাম-আইরাতের নেশাক্ত ভালোবাসা

( লেখাঃ Tamanna Islam ) এই লেখিকার আরও লেখা গল্প পড়তে চাইলে এখানে ক্লিক করুন এই গল্পের সিজন ১ পড়তে চাইলেও এখানে ক্লিক করুন

1 COMMENT

Comments are closed.