পথান্তরে প্রিয়দর্শিনী পর্ব ১৬

পথান্তরে প্রিয়দর্শিনী পর্ব ১৬
মম সাহা

রাতের আঁধারকে আরও বিভীষিকাময় আঁধারে রূপান্তরিত করেছে দর্শিনীদের আগুনে পুড়ে যাওয়া বাড়ির কালো ধোঁয়া। পুরো গ্রামে মানুষ হাতে হারিকেন,মশাল,চার্জার লাইট,ফোনের ফ্লাশলাইট ইত্যাদি নিয়ে ভীড় জমিয়েছে দর্শিনীদের বাড়ির সামনে। এখনো দাউ দাউ করে আগুন জ্বলছে। বিকট শব্দে ঘর গুলো ভেঙে পড়ছে। কিছুক্ষণের ব্যবধানে বাড়িটা ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে। প্রতাপ সাহা সাথে তার পুরো পরিবার ছুটে এসেছে মিনিট কয়েকের মাঝে। চোখের সামনে কষ্টে গড়ে তোলা বিরাট বাড়িটাকে জ্বলতে দেখে চিৎকার করে উঠে দর্শিনীর মা-সরলা।

নিধি, নিপা সহ সবাই হাউমাউ করে কেঁদে উঠে। পরিবেশ যেন মুহূর্তেই ভয়াবহ রূপ ধারণ করলো। প্রদীপ আর সুমন জ্বলন্ত ঘরটার দিকে জল ভর্তি বালতি, গামলা নিয়ে ছুট লাগালো। ইতিমধ্যে অবশ্য গ্রামের মানুষ জল মারা শুরু করে দিয়েছিলো। বাড়ির এমন বিধ্বস্ত অবস্থা দেখে কিয়দংশ সময়ের জন্য যেন সবাই ভুলে গেলো এ বাড়িতে দুটো মেয়ে এসেছিলো বিশ্রামের জন্য। তাদের কী অবস্থা, কী খবর এটা জানার যেন কারো আগ্রহ রইলো না। সবাই কেবল বিশাল বাড়িটাকে বাঁচানোর আপ্রাণ চেষ্টায় মগ্ন হয়ে রইলো। মেয়ের মায়া যেন এত বছরের বাড়ির চেয়েও বেশি হতে পারেনি এই মধ্যবিত্ত পরিবারের কাছে। তার উপর মেয়ে হলো স্বামীর সংসার ছাড়া। তার কতটুকুই বা মূল্য? এ বাড়ির থেকে তো আর বেশি হবে না, তাই না?
প্রতাপ সাহা মাথায় হাত দিয়ে যখন বিমূঢ় হয়ে চেয়ে রইলেন বাড়িটার দিকে তখনই মৃত্যুঞ্জয় আর দৃষ্টান্ত ছুটে এলো। হাত-পা তাদের অসম্ভব কাঁপছে। এত বিপদের মাঝে একমাত্র এই রক্তের সম্পর্ক ছাড়া ছেলে গুলো ঘরের ভেতর থাকা নারীদের কথা ভাবলো। উৎকণ্ঠা নিয়ে জিজ্ঞেস করলো,
“তৃণা আর প্রিয়দর্শিনী কোথায়,কাকা?”

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

চমকে উঠে প্রতাপ সাহা। সাথে সাথে চুপ হয়ে যায় পরিবেশ। এতদম গম্ভীর হয় প্রকৃতি। অবশেষে সবার মনে পরে মেয়ে গুলোর কথা। সত্যিই তো,মেয়ে গুলো কোথায় গেলো?
পুড়ে যাওয়া বাড়িটায় জল ছোড়াছুড়ির কারণে বাড়ির সামনের কিছু মাটি কাঁদায় পরিপূর্ণ হলো। প্রতাপ সাহা কাঁদার কথা চিন্তা করলেন না,ধ্যান দিলেন না সেদিকে। কেমন পাথরের মতন বসে গেলেন সেখানটায়। কাঠ কাঠ জবাবে বললেন,
“মেয়ে গুলো কী আর বেঁচে আছে? এই বিশাল বাড়িটারই এ অবস্থা। ছোট ছোট মেয়ে গুলোর তাহলে কতটা বীভৎস অবস্থা হয়েছে! অথচ আমি মেয়ে গুলোর কথা না ভেবে এতক্ষণ বাড়ির মায়ায় আচ্ছন্ন ছিলাম। কী পা’ষ’ন্ড মানুষ আমি! তাই না?”
এবার হৈচৈ, হা হুতাশে ভরে গেলো পরিবেশ। মানুষদের আহাজারিতে পরিপূর্ণ চরপাশ। আগুন ততক্ষণে ঝিমিয়ে গেছে। কেবল ছাইয়ের স্তূপে লাল রাঙা আভা হয়ে তার উপস্থিতি জানান দিচ্ছে। সকলের তখন বিধ্বস্ত অবস্থা। মৃত্যুঞ্জয় ছুটে গিয়েছে ঘরটার সামনে। কিন্তু ঘরের ভিতরে প্রবেশ করার কোনো সুযোগ নেই। খুবই ভয়াবহ ভাবে পুড়েছে সে ঘর। সে স্থির হয়ে চেয়ে থাকে সে ঘরের ভিতরে। প্রিয়দর্শিনীকে পাবে পাবে করেও কি সে হারিয়ে ফেললো? প্রনয়ের ফুল এভাবেই ফোঁটার আগে তবে মূর্ছা গেলো!

দর্শিনীর মা রীতিমতো জ্ঞান হারিয়েছে। যতই হোক বাড়ি আর মেয়ের শোক একসাথে সামাল দেওয়ার সক্ষমতা তার হয়ে উঠে নি।
প্রতাপ সাহা যেন মূর্তি হয়ে গেলো। নিপা নিজের কপাল চাপড়াতে চাপড়াতে আহাজারি করে উঠে বললো,
“মাথার উপরের আশ্রয়টা শেষ হয়ে গেলো? এত স্বাধের সংসার আমাদের,কী হাল হলো। দর্শিনী তৃণা কোথায় গেলো? কোথায় ওরা? মেয়ে গুলোর সাথে তখন কেনো এলাম না। মেয়ে গুলো কোথায় গেলো! এ জন্য আমি বার বার বলেছি দর্শিনীকে ঐ ন’র’পি’চা’শের সাথে ঝগড়া না করতে। আমার কথা শুনলে তো! আমি তো সবসময় খারাপই চায়। দেখলো তো এখন পরিণতি? আমি জানতাম,ঐ জা’নো’য়া’র লোক এমন কিছুই করবে। দেখো না গো তোমরা,আমার দর্শিনী কই। তৃণাটা কোথায়।”

নিপার আহাজারিতে পরিবেশ আরও ভয়ঙ্কর নিস্তব্ধতা ধারণ করলো। নিধি পুড়ে যাওয়া বাড়িটার দিকে টলমলে দৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে নিপাকে ধমক দিয়ে উঠলো। কড়া গলায় শাসনের স্বরে বললো,
“একদম হায় হায় করবি না, ছোট। দর্শিনী আর তৃণার কিচ্ছু হবে না। তুই চুপ কর। মায়ের মাথায় জল দে। কিছু হয় নি আমার তৃণার আর দর্শিনীর।”
নিপা চুপ হলো না বরং আরও ফ্যাচফ্যাচ করে কাঁদতে লাগলো।
মৃত্যুঞ্জয়ের শরীরে রক্ত আরও হীম হয়ে গেলো। সে আর দাঁড়ালো না। পুড়ে যাওয়া ঘরটার ভিতর ছুটে গেলো। বাড়িটা খুব অচল অবস্থায় টিকে আছে। একটু জোরে বাতাস হলেই মাথার উপর বড় দোচালা টিনটা ভেঙে পড়বে।
মৃত্যুঞ্জয়কে ছুটে যেতে দেখে দৃষ্টান্তও পিছে পিছে গেলো। সত্যি বলতে দৃষ্টান্তের পা নড়ছে না। নিজের প্রিয় মানুষের পুড়ে যাওয়া দেহখানা দেখার সহ্য শক্তি যে তার নেই। চিত্ত তার অশান্ত। এ জীবনে কী তার আর প্রিয়তমার সাথে ঘর করা হবে না? মিষ্টি সংসার করা স্বপ্নটা কী তার অপূর্ণই রয়ে যাবে! আর দর্শিনীর বাচ্চাটা? সেই বাচ্চাটা পৃথিবী না দেখতেই এমন বিভৎসতার স্বীকার হয়ে পৃথিবী ছাড়বে! সৃষ্টিকর্তা এটা কঠোর কেনো হলেন! এত এত মানুষের জিইয়ে রাখা স্বপ্ন গুলো আমরণ নির্বাসনে না পাঠালে কী খুব বড় ক্ষতি হয়ে যেতো?

প্রদীপ নিজের বাবাকে ধরে দাঁড়িয়ে আছেন। সুমনের চোখেও টলমল করছে জল। নিপা কাঁদছে,নিধি কাঁদছে। সরলা তখনও মাটিতে টান টান হয়ে মলিন ভাবে পড়ে আছে।
মৃত্যুঞ্জয় আর দৃষ্টান্ত যেমন হন্তদন্ত হয়ে ঘরে ছুটে গেলো, তেমন হন্তদন্ত হয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে এলো। দরদরিয়ে ঘামচে তাদের শরীর। শরীরের শিরদাঁড়া বেয়ে গড়িয়ে পড়ছে সে ঘাম। তাদের শরীরের শিরায় উপশিরায় তখন ছড়িয়ে পড়েছে আতঙ্ক। ভয়ার্ত তাদের মুখমন্ডল। মৃত্যুঞ্জয়ের ডান হাতের কব্জির দিকটা কালশিটে হয়ে আছে। বোধহয় আগুনের আঁচ লেগেছে সেথায়। কিন্তু ওরা ঘরের ভিতর কি এমন দেখেছে যে আতঙ্কিত হয়ে আছে ওদের মুখমন্ডল? পুড়ে যাওয়া নারী দেহ গুলো কী এতটাই বিভৎস ছিলো?
মৃত্যুঞ্জয়কে দেখে মূর্তির ন্যায় দাঁড়িয়ে থাকা প্রতাপ কথা বলে উঠলো। যান্ত্রিক মানবের মতন গুটি গুটি শব্দ উচ্চারণ করে বললো,
“মেয়ে গুলো আর নেই,তাই না?”
দৃষ্টান্ত আর মৃত্যুঞ্জয় নিজেদের দিকে মুখ চাওয়া চাওয়ি করলো। অতঃপর ফ্যাকাসে মুখ চোখ কুঁচকে বললো,
“ওরা তো ঘরে নেই। ঘরের কোথাও ওদের পাই নি। ওদের কোনো চিহ্নই নেই ঘরে।”
ওদের কথায় যেন নিরব বি’স্ফো’র’ণ ঘটলো। তিন চার ঘন্টা আগে মেয়ে দুটো বাড়িতে এসেছিলো অথচ ওরা বলছে মেয়ে দুটো ঘরে নেই! তবে,কোথায় গেলো ওরা? নাকি ওরা বাড়িতেই আসতে পারে নি? আরও বিভৎস কিছু কী তবে হয়েছে ওদের সাথে?
ভয়ে উপস্থিত সকলের কলিজা শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেলো। অনাকাঙ্খিত ভয়ে গুটিয়ে গেলো হৃদপিণ্ড। জলজ্যান্ত মেয়ে গুলো গেলো কোথায়?

বিহঙ্গিনী যাওয়ার পর নির্জীব হওয়া বাড়িটা আর জেগে উঠলো না। কিন্তু মোহনার হিংস্রতা দ্বিগুণ বাড়লো যেন। একটু আগের ঘটনা, সন্ধ্যা বেলা মায়া লুচি বেলছিল আর মোহনা ভাজছিলো সেটা ডুবন্ত তেলে। বিকেলের নাস্তা তৈরী করছিলো বউ – শাশুড়ি। মায়া তার হাতের শেষ লুচিটা কড়াইয়ের মাঝে ছাড়তে নিলেই মোহনা ইচ্ছাকৃত অনেকখানি গরম তেল মায়ার হাতে লাগিয়ে দেয় চামচ নাড়ার বাহানায়। ছিটকে উঠে মায়া, ভীষণ যন্ত্রণায় চিৎকার দিয়ে উঠে। মোহনা কিছু জানেনা ভাব ধরে রইলো।
মায়ার চিৎকারে বিপ্রতীপ ও তার শ্বশুর হাজির হয় তৎক্ষনাৎ। ছেলেকে দেখে মোহনা দ্রুত ফ্রিজের কাছে ছুটে গিয়ে বরফ এনে মায়ার হাতে লাগিয়ে দেয়। ভাব এমন যে, সে মায়ার ব্যাথায় ভীষণ ব্যাথিত হয়েছে।
মায়া কিছুটা শান্ত হতেই বিপ্রতীপ আর ওর বাবা রান্নাঘর থেকে প্রস্থান নেয়। মায়া তখনও তার হাতে নিবিড় ভাবে ফু দিয়ে যাচ্ছে। ইশ,গোলগাল হাতটা কেমন লাল হয়ে আছে!

পথান্তরে প্রিয়দর্শিনী পর্ব ১৫

মায়ার এমন বিধ্বস্ত রূপ দেখে প্রশান্তির হাসি হাসে। তার যেন ভীষণ তৃপ্তি লাগছে এ কাজটা করে।
মায়া তার হাতের দিকে তাকিয়েই বাঁকা হেসে বললো,
“আমি প্রিয়দর্শিনী বা সদ্য আবেগে পা দেওয়া কোনো ননীর কন্যা না। কী ভেবেছেন? এমন করলেই আমি চলে যাবো? কখনোই না। আগে আমি আপনার আরেক গুণধর ছেলের সন্ধান জানবো তারপর আপনাদের সমাপ্তি টেনে বিদায় নেবো।”

পথান্তরে প্রিয়দর্শিনী পর্ব ১৭