অন্তর্হিত কালকূট বোনাস পর্ব 

অন্তর্হিত কালকূট বোনাস পর্ব 
লেখিকা: অনিমা কোতয়াল

আমের ভিলার হলরুমে আবছা অন্ধকার। সদর দরজা দিয়ে উঁকি দিয়ে চারপাশে ভালোভাবে একবার চোখ বুলিয়ে নিল উচ্ছ্বাস। কাউকে দেখতে পেলো না। সবাই ঘুমিয়ে পড়েছে ভেবে নিশ্চিন্ত হয়ে ফিরে এলো জিপের কাছে। নেশায় বুদ হয়ে সিটে হেলান দিয়ে পড়ে আছে রুদ্র। সময় ব্যয় করল না। কাঁধের ওপর রুদ্রর হাত নিয়ে ভারসাম্য বজায় রেখে নিয়ে এলো বাড়ির ভেতরে। রুদ্রর এই অবস্থা সম্পর্কে আমের ভিলার কেউই জানেনা। একমাত্র উচ্ছ্বাস ব্যতিত। নিজেকে নিয়ন্ত্রণের এক অদ্ভুত এক ক্ষমতা নিয়ে জন্মেছে ছেলেটা। সারাদিন রুদ্রকে দেখে কারো বোঝার ক্ষমতা নেই ওর ভেতরে কী চলছে। সকালে ঘুম থেকে ওঠা, ফাউন্ডেশন সামলানো, দলের কাজ দেখা সব ঠিক নিয়মমাফিক করে যাচ্ছে। স্বাভাবিকভাবে।

কিন্তু সব কাজ সেরে নেওয়ার পরেই মনের সাথে সাথে শরীরটাও ভেঙ্গে পরে রুদ্রর। মধ্যরাতে বারে বসে বোতলের পর বোতল শেষ করে ভেতরের যন্ত্রণাটা কমানোর ব্যর্থ চেষ্টা করতে থাকে। আর ওর অর্ধচেতন দেহটাকে বার থেকে তুলে আনার কাজটা করে উচ্ছ্বাস। সবার অলক্ষ্যে। কেউ জানেও না যে শক্ত হাতে একটা দল সামলানো ছেলেটা নিজেই ভেতরে ভেতরে নিঃশেষ হয়ে যাচ্ছে। জানতে দেয়নি কাউকে। আজ বারোদিন যাবত এভাবেই চলছে। উচ্ছ্বাস এ নিয়ে কয়েকবার বলেছে, ‘কথা বল রাশেদ বাবার সাথে। নিয়ে আয় প্রিয়তাকে। নিষেধ করবেন না উনি। কেনো নিজেকে কষ্ট দিচ্ছিস এভাবে?’
জবাব দিতোনা রুদ্র। একবার শুধু বলেছিল, ‘ একটা সরল, নিষ্পাপ মেয়ের জীবন নষ্ট করার কোন অধিকার নেই আমার। আমি ঠিক সামলে নেব।’

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

কিন্তু এই বারোদিনে সামলে নেওয়ার কোন লক্ষণই দেখতে পেলোনা উচ্ছ্বাস। সকলের সামনে শক্ত, দৃঢ় হয়ে থেকে ভেতরে ভেতরে গুড়িয়ে যাওয়াকে বুঝি সামলে নেওয়া বলে? আর কেউ না জানলেও উচ্ছ্বাস জানে কী ভয়ানক দহনে দগ্ধ হচ্ছে রুদ্র। তবে পাল্টা কিছু বলতেও পারতো না। কীকরে বলবে? এই একই কারণে ও নিজেও তো আজ অবধি নাজিফাকে বলেনি নিজের মনের কথা। সেচ্ছায় এক প্রাচীর তৈরি করে রেখেছে নিজেদের মধ্যে।
‘ কী হয়েছে ওর?’
থম মেরে দাঁড়িয়ে গেল উচ্ছ্বাস। বজ্র দৃঢ় কন্ঠস্বরটা যেন ফাঁকা হলরুমে বজ্রপাতের মতোই মনে হল ওর কাছে। ভয়ে ভয়ে ঘাড় ফিরিয়ে তাকালো কয়েক হাত পেছনে দাঁড়িয়ে থাকা রাশেদের দিকে। সবে রুদ্রকে নিয়ে সিঁড়ির দিকে পা বাড়াচ্ছিল ও। দেখে ফেলল রাশেদ বাবা! শুকনো এক ঢোক গিলে হাতে ধরে রাখা প্রায় অচেতন রুদ্রর দিকে তাকাল ও। ভাষাহীন হয়ে গেল কিছুক্ষণের জন্যে। রাশেদ গম্ভীর গলায় বলল, ‘কিছু জিজ্ঞেস করেছি আমি।’
উচ্ছ্বাস খানিক ইতস্তত করে বলল, ‘একটু বেশিই খেয়ে ফেলেছে আজ। বুঝতে পারেনি। আসলে_’
এইটুকু বলেই থেমে খেল উচ্ছ্বাস। কথা সম্পূর্ণ করার জন্যে চেষ্টা করেও আর একটাও শব্দও খুঁজে পেলোনা। দৃঢ় পদক্ষেপে কয়েক পা এগিয়ে এলো রাশেদ। গভীরভাবে কিছুক্ষণ পর্যবেক্ষণ করল রুদ্রকে। চোখ ফিরিয়ে তাকাল উচ্ছ্বাসের দিকে। বলল, ‘ এই বুঝতে না পারাটা বারো দিন যাবত চলছে বোধ হয়।’

চকিতে রাশেদের দিকে তাকাল উচ্ছ্বাস। সঙ্গেসঙ্গেই নামিয়ে নিল চোখজোড়া। বুঝল আর কিছু বলার নেই ওর। রাশেদ না জেনে আন্দাজে ঢিল ছোড়ার লোক নন। সব জানে সে। তাই নিশ্চুপ হয়ে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে রইল। আধ মিনিট কেউ কিছু বলল না। রাশেদ বলল, ‘যাও এখন। ওকে বলো কাল ঘুম থেকে উঠে আমার সাথে কথা বলতে।’
‘ জ্বি।’
মিনিমিনিয়ে শব্দটা উচ্চারণ করে রুদ্রকে নিয়ে ভেতরে চলে গেল উচ্ছ্বাস। পেছন তাকালে হয়তো দেখতে পেতো অসহায় এক পিতার ব্যথিত দৃষ্টি।
উচ্ছ্বাস রুদ্রকে নিয়ে করিডর পেরিয়ে যাওয়ার পর পিলারের আড়াল থেকে বেরিয়ে এলো জ্যোতি। বিষণ্ন দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল ওদের যাওয়ার দিকে। কয়েকদিন যাবত রুদ্রকে ঠিকভাবে দেখতেই পায়না ও। সকালে কফি দেওয়ার সময় কোনরকম দেখা সাক্ষাৎ হয়। চেষ্টা করেও আলাপ জমাতে পারেনা আজকাল। কী হয়েছে রুদ্রর? দলীয় কোন সমস্যা হয়েছে? না-কি সমস্যাটা ব্যক্তিগত? কথাটা ভাবতে ভাবতে ওদের পেছন পেছন এগিয়ে গেলো রুদ্রর ঘরের উদ্দেশ্যে।
রুদ্রকে বিছানায় শুইয়ে দিয়ে ওর ঘুমন্ত মুখের দিকে তাকাল উচ্ছ্বাস। মনোযোগ দিয়ে দেখল তেজস্বী এক রাজপুত্রের নিস্তেজ মুখ। চলে আসতে নিলেই রুদ্রর গলার স্বর শুনে থেমে গেল। বিড়বিড় করে বলছে, ‘সাদা রঙটাতে তোমাকে খুব সুন্দর লাগে প্রিয়। একদম স্নিগ্ধ পরীর মতো।’

ফোঁস করে একটা শ্বাস ফেলল উচ্ছ্বাস। কপাল কুঁচকে বলল, ‘শালা! প্রেম করবেনা, বিয়ে করবেনা বলে শুয়ে শুয়ে বাসরের স্বপ্ন দেখছে। ভয়ানক ব্রহ্মচারী! “সাদা রঙে তোমাকে খুব সুন্দর লাগে প্রিয়।” সিরিয়াসলি!’
কথাগুলো বলে রুদ্রকে আরেকবার ঠিকঠাক করে দিয়ে উঠে দাঁড়ালো। উচ্ছ্বাসকে ফিরে আসতে দেখে দরজার আড়াল থেকে দ্রুত সরে এলো জ্যোতি। রুদ্র ঠিকঠাকভাবে শুয়ে পড়েছে দেখে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল। কিন্তু মনে একটা খচখচানি বয়েই গেল। রুদ্রর কথা শুনতে না পেলেও উচ্ছ্বাসের সব কথাই শুনেছে ও। কথাগুলোর আগামাথা না বুঝলেও ভেতরে ভেতরে ভয়ানক অস্বস্তি অনুভব করছে।

সকালের একদম প্রথম শিফটে ক্লাস ছিল কুহুর। তাই বেশ সকাল সকাল বেরিয়ে আসতে হয়েছে। ফাল্গুন মাস। শীত যাই যাই করলেও সকালের দিকে এখনো ঠান্ডার রাজত্ব এরিয়ে যাওয়ার মতো নয়। তাই গায়ে পাতলা মতোন একটা নেভিব্লু সোয়েটার জড়িয়ে নিয়েছে। কিন্তু প্রথম ক্লাসটা করে ক্যান্টিনে ঢুকতেই বেশ গরম লাগল। খাবার ওর্ডার করে সোয়েটারটা খুলে রাখল পাশের চেয়ারে। বোরিং লাগছে বেশ। রীতিও আসেনি আজ। বলেছে পরের ক্লাসে জয়েন করবে। আস্ত ফাঁকিবাজ মেয়ে একটা।
খেতে খেতে চারপাশে বারবার তাকিয়ে নিজের অজান্তেই কাউকে খুঁজছিল কুহু। আবার নিজের অজান্তে হতাশও হয়ছে। খাওয়া শেষে কফি নিয়ে সোজা চলে গেলো লাইব্রেরীতে। ওয়ান টাইম কফির কাপে চুমুক দিতে দিতে বইয়ের পাতায় ডুবিয়ে ফেলল নিজেকে। হঠাৎ মাথায় কারো টোকা পড়তেই ভ্রু কুঁচকে চোখ তুলে তাকাল কুহু। পাশে মুখ ঘুরিয়ে দেখল নিরব বসে আছে। গায়ে ছাই রঙের লেদার জ্যাকেট, ক্লিন সেভ, লং লেন্থে কাটা বাদামি চুলে বরাবরের মতোই অসাধারণ লাগছে ওকে। চকলেট বয়। হেসে ফেলল কুহু।

কয়েকদিনে দুজনের সম্পর্কটা খুব সহজ স্বাভাবিক হয়ে গেছে। গভীর রাত অবধি হোয়াটসঅ‍্যাপে অপ্রয়োজনীয় আলাপে ডুবে থাকে দুজন, সরাসরি দেখা বা কথা ক্যান্টিনে নয়তো লাইব্রেরীতেই হয়। প্রথম কয়েকদিন বেশ আড়ষ্ট হয়ে থাকত কুহু। সিনিয়র ভাই আর র‍্যাগিং এর ভয়ে কথা বলতো নিরবের সাথে। কিন্তু কথা বলতে বলতে এখন ওরও খুব ভালো লাগে নিরবকে। কেমন ছটফটে একটা ছেলে। চুপচাপ বসে থাকেনা একদমই। যতক্ষণ পাশে থাকে কিছু না কিছু বলতেই থাকে। অকারণেই কুহুর ভীষণ ভালো লাগে নিরবের কথা শুনতে।
কুহু ভ্রু নাচিয়ে ইশারা করল, কী ব্যাপার?
ভুবন ভোলানো হাসি হাসল নিরব। হাত বাড়িয়ে এগিয়ে দিল কুহুর সোয়েটারটা। দু সেকেন্ড অবাক চোখে সোয়েটারটা দেখে মাথায় চাপড় মেরে আফসোসের ভঙ্গি করল কুহু। তারপর হেসে ফেলল। নিরবও হাসল। কুহু নিয়ে নিল নিজের সোয়েটার। এরপর ফোনটা হাতে তুলে মেসেজ করল নিরবকে। লিখল, ‘ আপনি ক্যান্টিনে গিয়েছিলেন?’
নিরব রিপ্লে লিখল, ‘ হ্যাঁ। তোমাকে খুঁজতে। তোমাকে তো পেলাম না। কিন্তু তোমার সোয়েটারটা পেয়ে গেলাম।’
রিপ্লে দেখে কুহু খানিকটা অবাক হয়ে তাকাল নিরবের দিকে। কুহুর চাহনীর অর্থ বুঝতে পেরে হাসল নিরব। আবার টাইপ করল, ‘ লাইব্রেরীতে জোরে কথা বলা যাবেনা। আর আমি বেশিক্ষণ ফিসফিস করতে পারিনা। ওটা মেয়েদের কাজ। তাই ভাবছি আজ এভাবেই কথা বলব।’

কুহু দুটো ঠোঁট দাঁতে চেপে ধরে মাথা ঝাকালো। নিরব লিখল, ‘তোমার বান্ধবী কোথায় আজ?’
‘ আসবে একটু পরে। সকালে ঘুম থেকে উঠতে পারেনি।’
‘ আমার মতো অলস। তবে ভালোই হয়। ওর না থাকা সুবিধাটা আমি ভালোমতো নিতে পারি।’
কুহু হাসল। তারপর লিখল, ‘ব্রেকফাস্ট করেছেন?’
‘বাড়ি থেকে করে এসছি। একটা কথা ভাবছি জানো?’
‘ না বললে জানব কীকরে?’
হেসে ফেলল নিরব। বলল, ‘ তা ঠিক। ভাবছিলাম তোমাকে নিয়ে ঘুরতে যাব। কিন্তু বাইরে তোমাকে গার্ড দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে দুই পালোয়ান। সবসময় তোমার সাথে কেন ঘোরে ওরা?’
কুহু একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। ঠোঁট ফুলিয়ে লিখল, ‘জানিনা। বাবা আর ভাইয়া পাঠায়। আস্ত কালো হাতি দুটো। আমার ওদের একদমই পছন্দ না।’

কুহুর গাল ফোলানো দেখে ঠোঁট চেপে হাসল নিরব। এবার আর টাইপ না করে ফিসফিসিয়ে বলল, ‘আমারও না।’
কুহু কিছু না লিখে বসে রইল চুপচাপ। পা দোলাচ্ছে টেবিলের নিচে। মিনিট খানেক পর নিরব বলল, ‘আচ্ছা তোমার বাবার নামটাই জানা হয়নি। কুড়ি বছরের মেয়েকে এতো প্রটেকশনে রাখার কী আছে? হারিয়ে যাবে ভাবে নাকি?’
কুহু আবার টাইপ করল, ‘ আমার বাবার নাম রাশেদ আমের। কেনো পাঠায় আমিও জানিনা।’
মেসেজটা পড়েই চমকে উঠল নিরব। চোখ বড় বড় করে তাকাল কুহুর দিকে। প্রায় চেঁচিয়ে বলে বলল, ‘ বলো কী_’
কুহু থতমত খেয়ে গেল। লাইব্রেরীতে থাকা সবাই তাকাল একবার। নিরব বুঝতে পারল এটা লাইব্রেরী। তাই নিজেকে সামলে নিয়ে কুহুর দিকে আরও খানিকটা এগিয়ে গিয়ে ফিসফিসিয়ে বলল, ‘বলো কী! রাশেদ আমেরের মেয়ে তুমি? আমের ফাউন্ডেশনের ওউনার! শুনেছি ভয়ানক লোক উনি। তার ছেলে রুদ্র আমেরতো আরও ডেঞ্জারাস জিনিস! আমি কি-না ঐ বাড়ির মেয়েকে র‍্যাগ দিয়েছিলাম! কী সাংঘাতিক! ভাগ্যিস তুমি ওনাদের কিছু বলোনি।’
কুহু চোখ ছোট ছোট করে তাকিয়ে দেখছিল নিরবকে। নিরব থামতেই কুহু টাইপ করল, ‘তো এখন থেকে কী আমায় ভয় পাবেন নাকি?’

নিরব আগের মতো ফিসফিস করেই বলল, ‘ নাহ! এখন আর ভয় পাওয়া সম্ভব না। অনেক এগিয়ে গেছি। ভ’য়া’ন’ক দুটো চিজকে সামলে এগোতে হবে। বেশ বুঝতে পারছি। কিন্তু একটা ফাউন্ডেশন ওউনারকে লোকে এতো ভয় কেনো পায় সেটাই বুঝিনা আমি। কী জ্বালা!’
কুহু নিঃশব্দ হাসি হাসল। গালে হাত দিয়ে ওর হাসির দিকে তাকিয়ে রইল নিরব। আচ্ছা, কুহু যদি শব্দ করে হাসতে পারতো? কতোটা মধুর হতো ওর হাসির শব্দ? নিরব কী পাগল হয়ে যেতো?

রাশেদের দরজার সামনে দাঁড়িয়ে ইতস্তত করছে রুদ্র। পৃথিবীতে এই একটা লোককেই ভয় পায় ও। তেমন সবচেয়ে বেশি শ্রদ্ধা আর ভালোবাসার জায়গাটাও তার জন্যেই বরাদ্দ। রাশেদের এক কথায় যেমন প্রাণ নিতে পারে, তেমন প্রাণ দিতেও পারে। সব করতে পারে এই মানুষটার জন্যে ও। সব।
উচ্ছ্বাসের কথা শুনে বুঝেছে গত বারোদিন প্রতি রাতেই যে রুদ্র প্রায় অচেতন হয়ে বাড়ি ফিরতো সেটা জানে রাশেদ। হয়তো আরও বেশিকিছু জানে। এই মানুষটার চোখে ফাঁকি দিয়ে কিছু করা প্রায় অসম্ভব ব্যপার। এ ঘরে আসত আসতে সবরকম প্রশ্নের জন্যে নিজেক তৈরী করে নিয়েছে রুদ্র। জবাবও সাজিয়ে নিয়েছ। মনে মনে সেগুলো আওড়ে নিয়ে লম্বা একটা শ্বাস ফেলল রুদ্র। এরপর দরজায় নক করে কিছু বলার আগেই ভেতর থেকে গম্ভীর আওয়াজ এলো, ‘ভেতরে এসো।’
রাশেদের সামনে দাঁড়াতে এর আগে কোনদিন এতো আড়ষ্ট বোধ করেনি রুদ্র। অনুভব করল এই প্রথম ঘাবড়ে গিয়ে হাত ঘামছে ওর। মনের সঙ্গে যুদ্ধ করে একপ্রকার জোর করেই ঢুকলো সিংহের গুহায়।

বরাবরের মতোই নিজের ইজি চেয়ারটাতে গা ছেড়ে বসে আছে রাশেদ। চোখ বন্ধ। ডান হাতের দু আঙ্গুলের মাঝে জ্বলন্ত সিগারেট। রুদ্র এগিয়ে গিয়ে দাঁড়ালো চেয়ার থেকে দুই হাত দূরত্বে। দু হাত সামনে একত্রিত করে। চোখ বন্ধ রেখেই সিগারেটে লম্বা এক টান দিল রাশেদ। ঘন খানিকটা ধোঁয়া ছেড়ে বলল, ‘ তোমাকে বলেছিলাম রুদ্র তুমি সম্পূর্ণ স্বাধীন। যা ইচ্ছে করতে পারো তুমি। শুধু দুটো ক্ষেত্রেই নিষেধাজ্ঞা জারি করেছিলাম আমি। এক, দলের প্রয়োজন ছাড়া অন্যের ক্ষতি হয় এমন কিছু করা যাবেনা। দুই, নিজের ক্ষতি করা যাবেনা। এমন কিছু করতে পারবেনা যাতে নিজের ওপর নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলো, তোমাকে আঘাত করার জন্যে অন্যরা সুযোগ পেয়ে যাক। আর এটাও বলেছিলাম যে এই দুটো নিষেধ অমান্য করলে তোমার স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ করতে বাধ্য হব আমি। বলেছিলাম?’
একপলক রাশেদের দিকে তাকাল রুদ্র। চোখজোড়া এখনো বন্ধ। রুদ্র যান্ত্রিক কন্ঠে বলল, ‘জ্বী।’

‘ আমার কথা রেখেছো তুমি?’
অপরাধীর মতো মাথা নিচু করে ফেলল রুদ্র। একটা কথাও বলল না। কয়েক সেকেন্ড চুপচাপ সিগারেট টানল রাশেদ। এরপর বলল, ‘মেয়েটাকে নিয়ে এসো। যত তাড়াতাড়ি পারো।’
চমকে তাকাল রুদ্র। কিছু বলার আগেই রাশেদ বলল, ‘তুমি আমার ছেলে রুদ্র। একদিন বেশি চট্টগ্রাম থেকে যাওয়া, চট্টগ্রাম থেকে ফেরার পর তোমার অদ্ভুত পরিবর্তন, বনানীর ফ্লাটে ঘনঘন যাতায়াত, রাত্রিযাপন, এরপর হঠাৎই মধ্যরাতে চরম মাতাল অবস্থায় বাড়ি ফেরা শুরু করা। তোমার কী মনে হয় এতোগুলো অস্বাভাবিক কর্মকাণ্ড করে গেছো তুমি আর আমি কোন খোঁজ নেই নি? তোমার শরীরে আমারই রক্ত বইছে রুদ্র। তোমাকে রন্ধ্রে রন্ধ্রে চিনি আমি।’
মুখে একটা কথাও এলোনা রুদ্রর। বিমূঢ় হয়ে তাকিয়ে রইল নিজের বাবার দিকে। কিন্তু ঘটনায গুরুত্ব বুঝতে পেরে দ্রুত সামলে নিল নিজেকে। ইতস্তত করে বলল, ‘কিন্তু বাবা..’

‘ মেয়েটা অপছন্দ করতো তোমাকে? থাকতে চায়নি? তোমার প্রতি কোনরকম দুর্বলতা প্রকাশ করেনি?’ রুদ্রর কথা থামিয়ে দিয়ে প্রশ্ন ছুড়লো রাশেদ।
ফোঁস করে একটা নিঃশ্বাস ফেলল রুদ্র। বলল, ‘ও অবুঝ বাবা। ওর কোন ধারণাই নেই ঠিক কীরকম জীবন যাপন করি আমি। চোখের সামনে কয়েকটা লোককে কাবু করতে দেখেই আমাকে হিরো ভেবে নিয়েছে ও। ফ্যান্টাসির মধ্যে আছে। ও শুধু জানে আমি ক্রি’মি’না’ল। কিন্তু কোন লেভেলের ক্রি’মি’না’ল সেটা ধারণা করাও ওর পক্ষে অসম্ভব। আগে-পিছে কিছু না ভেবেই থাকতে চাইছে আমার সাথে। হটকারি সিদ্ধান্ত এটা।’
‘ এতোকিছু জানার তো প্রয়োজন নেই ওর। এই বাড়ির মেয়েরা আমাদের ডার্ক সাইট থেকে অনেক দূরে। এসবের সাথে ওদের কোন সম্পর্ক নেই। সেভাবেই থাকবে ও। ঠিক যেভাবে কুহু মা আছে, জ্যোতি আছে।’

অধৈর্য হয়ে উঠল রুদ্র। রাশেদও কী উচ্ছ্বাসের মতো আবেগে ভেসে যাচ্ছে নাকি! অথচ এই বাবাই ওকে শক্ত হতে শিখিয়েছে। মানসিক শক্তি বাড়িয়ে প্রিয় জিনিগুলোও ত্যাগ করতে শিখিয়েছে। ছোটবেলা থেকে ওরই চোখের সামনে ওর প্রিয় খেলনা, পোশাক, জুতো, পছন্দের সবকিছু ওরই হাত দিয়ে নষ্ট করিয়েছে। এগারো বছর বয়সে ওর মায়ের দেওয়া প্রিয় লকেটটা ওর হাত দিয়েই দু টুকরো করিয়েছে রাশেদ। কারণ একটাই ছিল। ঐ লকেটটা এক মুহূর্তের জন্যেও ছাড়তোনা রুদ্র। সবসময় আগলে রাখতো নিজের কাছে। ওর অবুঝ কান্নাকেও সেদিন কানে তোলেনি রাশেদ। চরম নিষ্ঠুরতার সাথে ছোট একটা বাচ্চাকে দিয়ে তারই সবচেয়ে প্রিয় জিনিসটা দ্বি-খন্ডিত করিয়েছে। সহ্য ক্ষমতা বাড়িয়েছে। পাথর বানিয়েছে ওকে। আজ সেই রাশেদ এসব বলছে! রুদ্র বলল, ‘ এই নতুন প্রজেক্টের কাজ শুরু হওয়ার পর প্রতি সেকেন্ড আমার মাথায় মৃ’ত্যু ঝুলে থাকবে। যেকোন সময় শেষ হয়ে যাব আমি। এরকম অবধারিত অকাল বৈধব্য দিতে পারবেন আপনি একটা মেয়েকে? আমের ভিলায় আপনার চোখের সামনে আপনার পুত্রবধু বিধবা হয়ে ঘুরে বেরাবে সেটা সহ্য হবে আপনার?

অন্তর্হিত কালকূট পর্ব ৩৩

‘ সেরকম হলে আবার বিয়ে দেব ওর আমি। এখন থেকে ও আমারই মেয়ে। ওর চিন্তা তোমাকে করতে হবেনা।’
হতবাক হয়ে তাকিয়ে রইল রুদ্র ওর বাবার দিকে। বোকা বনে গেছে ও। কোনরকমে বলল, ‘ বাবা_’
সিগারেট ধরা হাতটা তুলে ইশারায় থামিয়ে দিল রাশেদ ওকে। হাত বাড়িয়ে অ্যাশট্রেতে ছাই ঝাড়তে ঝাড়তে বলল, ‘এক সপ্তাহের মধ্যে ওকে আমি আমার বাড়ির বউ করে ঘরে তুলতে চাই। কীভাবে কী করবে সেটা তুমি দেখো। কিন্তু এক সপ্তাহ পরে ও যেন আমের ভিলায় থাকে। আমার বৌমা হয়ে। আর এটা আমার অর্ডার।’

অন্তর্হিত কালকূট পর্ব ৩৪

2 COMMENTS

Comments are closed.