পথান্তরে প্রিয়দর্শিনী পর্ব ২৮

পথান্তরে প্রিয়দর্শিনী পর্ব ২৮
মম সাহা

মোহনাকে নিয়ে হসপিটালে ছুটে গিয়েছে বিহু আর নিলয় কুমার। বিপ্রতীপ কেবল মাকে গাড়ি অব্দি তুলে দিয়েছে। মায়ের সাথে যাওয়ার কোনো ইচ্ছে সে প্রকাশ করে নি। তার মনে হয়েছে মায়ের সাথে যাওয়ার চেয়ে এখানে থেকে যাওয়া টা জরুরী বেশি। আধাঘন্টার মাঝে কী থেকে কী হয়ে গেলো কারো মাথায়ই যেন প্রবেশ করলো না। দর্শিনী কাঠের একটা বেঞ্চিতে বসে আছে। মোহনা যখন মাটিতে লুটিয়ে পড়লো তখন সে-ই তার হাতে জলের বোতলটা এগিয়ে দিয়েছে।

শান্ত তবে চিন্তিত ভাবে পরোখ করেছিলো। দৃষ্টান্ত জানালো স্ট্রোক করেছে। অতঃপর ধরাধরি করে তাকে নিয়ে যাওয়া হলো৷ তবে এই পুরোটা সময়ই বিপ্রতীপকে বিচলিত হতে দেখা গেলো না। সে নির্জীব হয়ে দর্শিনীর দিকে তাকিয়ে ছিলো। তার চোখ বলেছে সে অনেক কথা বলতে চায় কিন্তু দ্বিধার দেয়ালের কারণে বলা হয়ে উঠে নি।
মোহনার গাড়ি বেরিয়ে যেতেই বিপ্রতীপ দর্শিনীর পায়ের কাছে এসে বসলো। দর্শিনী তখন কেবল তার ঘর্মাক্ত মুখ খানা আঁচল দিয়ে মুছে নিচ্ছিলো। বিপ্রতীপকে পায়ের সামনে বসতে দেখে সামন্য চমকালো সে। তবে প্রকাশ করলো না। মুখে কাঠিন্য ভাব।

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

মৃত্যুঞ্জয় বাড়িতে কথা বলে এগিয়ে এসে এ দৃশ্য দেখে প্রচন্ড বিরক্ত হলো। বিরক্ত কণ্ঠে বলে উঠলো,
“আজব,পাবলিক প্লেসে এসব কেমন কাজ? আপনারা দেখি দারুণ ড্রামাবাজ।”
বিপ্রতীপের রাগ হলো। কপাল কুঁচকে রাগ সংযত করে বলল,
“একদম স্বামী-স্ত্রীর মাঝে তৃতীয় ব্যাক্তি হয়ে নাক গলাতে আসবেন না। হু আর ইউ ম্যান?”
” স্বামী-স্ত্রী! হাসালে ব্রো। আমি যেই হই না কেনো অন্তত প্রিয়দর্শিনীর চোখের জলের কারণ নই। তাই আপনার চেয়ে উপরের স্থানেই আছি। এখান থেকে উঠুন নাটক কম করে। একটু পর বড় গলায় বলা স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্কটারও ইতি টানা হবে। তখন দেখবো নাটক কই থাকে। আর তাছাড়া সাথে তো আপনার বর্তমান মিসেস দাঁড়িয়ে আছে, তার সামনে এসব করতে লজ্জা করে না?”

মুত্যুঞ্জয়ের তাচ্ছিল্য মাখা কথায় বিপ্রতীপ ফুঁসে উঠে। তেড়ে গিয়ে কিছু বলবে এর আগেই সপাটে চড় পড়ে তার গালে। সে কেবল থতমত খেয়ে যায়। চড় দেওয়া ব্যাক্তিটার দিকে তাকিয়ে দেখে প্রতাপ সাহা অগ্নিমূর্তি ধারণ করে দাঁড়িয়ে আছে। কপালে তার রাগে রগ ফুলে গেছে। ফর্সা ষাটোর্ধ্ব মানুষটার শরীরে রাগের এক আভা বের হচ্ছে। বিপ্রতীপ কিছুটা সময় চুপ রইলো। প্রতাপ সাহা আঙ্গুল উঁচিয়ে বেশ রুক্ষ স্বরে বলল,
“এ চড়টা তোমার গালে আগে পড়লে আমার মেয়ের জীবনটা সুন্দর হতো। পুরুষ মানুষের ব্যর্থতা কী জানো? তার মা,স্ত্রী আর কন্যাকে যত্নে রাখতে না পারে। আর আমার দেখা মতে তুমি পৃথিবীর সবচেয়ে ব্যর্থ পুরুষ। যে না মায়ের ছেলে হতে পারলো না স্ত্রীর ভরসা। তোমার পুরুষত্বে থু ফেলি আমি। আমার মেয়েকে তো সম্মান দিলে না এজীবনে, অন্তত নতুন যাকে এনেছো তার অসম্মান করো না।”

বিপ্রতীপ মাথা নিচু করে ফেললো। তার অনুশোচনা হচ্ছে না কিন্তু চরম ক্ষোভ জন্মাচ্ছে প্রতাপ সাহার উপর। তার পুরুষত্বে আঙ্গুল তুলছে! বিপ্রতীপ হাসলো, গালে হাত বুলিয়ে তীক্ষ্ণ কণ্ঠে বলল,
“আমার পুরুষত্বে আঙ্গুল তুলছেন? পুরুষ বলেই না দুই বউ নিয়ে ঘুরছি সমাজে ঝামেলা বিহীন। আমি পুরুষ বলেই আপনার মেয়ে অন্তঃসত্ত্বা। আমার পুরুষত্ব,, ”

আর কিছু বলতে পারে নি বিপ্রতীপ। এর আগেই দ্বিতীয় চড়টা পড়েছে তার গালে। সেটা মেরেছে দর্শিনী। বিপ্রতীপ এবার অবাক হলো। চরম অবাক। যে মেয়েকে মেরে ফেললেও টু শব্দ করতো না সে মেয়ে কিনা তার গালে চড় দিয়েছে!
ততক্ষণে দর্শিনী রণমুর্তি ধারন করলো। ঘৃণার দৃষ্টিতে বিপ্রতীপের সারা শরীরে চোখ বুলিয়ে তীক্ষ্ণ কণ্ঠে বললো,
“এসব করে নিজেকে পুরুষ দাবী করছো? এটা চরম কাপুরুষতা। পুরুষ, কাপুরুষ পরের ব্যাপার তুমি তো মানুষই হতে পারো নি। এই তোমার জন্য কত অশ্রু বিসর্জন দিয়েছি ভাবলেই ঘৃণা হচ্ছে। এমনকি তুমি আমার সন্তানকেও নিজের পুরুষত্বের ঐশ্বর্য মনে করো? সন্তান জন্ম দেওয়ার ক্ষমতা রাস্তার কুকুরেরও আছে। তবে কী তুমি নিজেকে সে রকমের পুরুষ দাবী করছো?”

বিপ্রতীপ থ বনে বিস্ফোরিত নয়নে তাকিয়ে রইলো। দর্শিনী তাকে রাস্তার কুকুরের সাথে তুলনা করতে পারলো?
পুরোটা ঘটনা চুপ করে হজম করলো মায়া। সে বিপ্রতীপ আর তার মাকে যতটা নোংরা ভেবেছিলো তার চেয়েও দ্বিগুণ নোংরা তারা। যদি আজ মোহনা মারা যায় তবে চরম তৃপ্তি পাবে মায়া। এসব মানুষের বেঁচে থাকা নিষেধ। কিন্তু মায়ার এটা ভেবে খারাপ লাগছে যে প্রতিশোধ আগুনে সে একজন স্ত্রীর থেকে স্বামীকে আর একটা নিষ্পাপ সন্তান থেকে তার বাবাকে আলাদা করেছে। কিন্তু এমন পুরুষের নৈকট্য ঠিক কতটা ভালো! হয়তো অজান্তে দর্শিনীর চরম উপকার করেছে সে।

থম মারা পরিস্থিতিকে শিথিল করতে দর্শিনীদের উকিল আসলো। ভেতরে যাওয়ার সময় হয়েছে বলে তাড়া দিলো। দর্শিনী সবার অগোচরে চোখের কোণে চিলিক দেওয়া অশ্রু কণাকে মুছে ফেললো। এসব অহেতুক আবেগের মূল্য নেই।
দর্শিনীর অশ্রু মোছার দৃশ্য পরোখ করলো মৃত্যুঞ্জয়। তার রাগ হলো। এমন নিচু স্তরের মানুষের জন্য চোখের জল বিসর্জন দেওয়া নেহাতই বোকামি ছাড়া কিছু না। মৃত্যুঞ্জয় রাগ থেকেই কর্কশ কণ্ঠে বলল,
“আসুন দর্শিনী। আমাদের যেতে হবে।”

দর্শিনী খানিক চমকালো গম্ভীর কণ্ঠে। তার উপর অবাক হলো নামটা শুনে। মৃত্যুঞ্জয় কখনো তাকে এভাবে ডাকে নি। অতঃপর মৃত্যুঞ্জয়ের কঠিন দৃষ্টি দেখে ব্যাপারটা আঁচ করে দর্শিনী। বিপ্রতীপও এত অধিকারবোধ থেকে ডাক শুনে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইলো। দর্শিনী বিপ্রতীপের মনের ভাবনাও বুঝলো। হঠাৎ কী মনে করে অদ্ভুত কণ্ঠে বলল,
“দর্শিনী না,প্রিয়দর্শিনী হবে ভিনদেশী সাহেব। চলুন যাওয়া যাক।”
কথা শেষে মুচকি হাসি দিয়ে পা বাড়ালো প্রিয়দর্শিনী। তার পিছে পিছে মুচকি হাসি দিয়ে মৃত্যুঞ্জয়, প্রতাপ সাহা আর দৃষ্টান্তও গেলো। বিপ্রতীপ কেবল অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো। দর্শিনী যেন তাকে চোখে আঙ্গুল দিয়ে নাম ডাকার অধিকারের গল্প শুনিয়ে গেলো। যে গল্পে বিপ্রতীপ এক তাচ্ছিল্যের পাত্র। এক পেয়ে হারানো নিম্ন শ্রেণীর মানুষ।

বিকেলের সূর্য অস্তায়মান। গরমের গুমোট ভাব হালকা এখন। অবশেষে চির জীবনের বিচ্ছেদ ঘটলো সম্পর্কের। তার সাথে একটা অদ্ভুত কাজ করলো দর্শিনী। যা সবার ভাবনার বাহিরে ছিলো। বিপ্রতীপের নামে মামলা করলো। স্ত্রী বর্তমান থাকতেও বিপ্রতীপ আরেকটা বিবাহ করেছে। যার জন্য বিপ্রতীপকে আপাতত জেলে নেওয়ার আদেশ দেওয়া হয়েছে। দর্শিনী জানে বিপ্রতীপ টাকার দাপটে হয়তো ছাড়া পেয়ে যাবে কিন্তু এটা ভেবে শান্তি যে বিপ্রতীপ যেই বিয়েকে নিজের পুরুষত্ব ভেবেছে সেই বিয়ে তার কাল হয়ে দাঁড়িয়েছে। দর্শিনী এমন কিছু করতো না যদি না বিপ্রতীপ তখন এমন দম্ভ প্রকাশ করতো। সেই দম্ভ চুর্ণ করার জন্যই এমন বিশাল ব্যবস্থা।
সারাদিনের ধকলে সবাই বেশ ক্লান্ত। দর্শিনীরা যেই গাড়িতে উঠতে যাবে মায়া হাজির হয়। মায়াকে দেখে দর্শিনী থামে। ফিচলে কণ্ঠে বলে,

“কী সই? কেমন দিলাম?”
“তুমি আমাকে ক্ষমা করো সই।”
দর্শিনী ভ্রু কুঁচকালো। অবাক কণ্ঠে বলল,
“ক্ষমা মানে? কেনো?”
“কেনোর কোনো উত্তর নেই। তবে আমি আমরণ ক্ষমা চেয়ে যাবো। তুমি ভীষণ ভালো,সই। আমি তোমার কপাল পুড়ালাম।”

“ভাগ্য লিখেন সৃষ্টিকর্তা। তুমি আমি উপলক্ষ্য মাত্র। তবে হ্যাঁ, আমার সংসার সুখের না হোক তবে নড়বড়ে হলেও আমার ছিলো। সেই সংসারটা ভাঙার জন্য আমি মায়া নামক মেয়েটাকে ক্ষমা করবো না। একজন সন্তানের মা হিসেবে আমার সন্তানকে এতিম বানানো মানুষটাকে আমি ক্ষমা করবো না। দীর্ঘশ্বাসেরও একটা অভিশাপ থাকে। তবে সইয়ের প্রতি আমার অভিযোগ নেই।”
মায়া মাথা নত করলো। “ভালো থেকো” বলে গুটি গুটি পায়ে এগিয়ে গেলো সামনে। অনেক কথা বলবে বলেও আর বলা হলো না।
মায়া যেতেই বিপ্রতীপ হাজির হলো। সাথে কনস্টেবলও আছে। বিপ্রতীপ করুণ স্বরে দু’হাত জোড় করে পাগলের মতন বলতে শুরু করল,

“আমাকে ছেড়ে যেও না প্রিয়দর্শিনী। অন্তত আমাদের সন্তানের কথা ভেবে থেকে যাও। প্লিজ দর্শিনী।”
দর্শিনী কেবল তাচ্ছিল্য হেসে গাড়িতে উঠে বসলো। বিপ্রতীপ গাড়ির কাঁচ ধরে সমানে আকুতি করে যাচ্ছে৷ একেই হয়তো বলে নিয়তি। যে ছেলেটা সকালেও আসার সময় ভেবেছিলো তার পা ধরে তার স্ত্রী করুণ আকুতি করবে, সে ছেলেটাই দিনশেষে স্ত্রীর পা ধরে আকুতি করছে। এ জন্যই বোধহয় বলে, সময় বদলাতে সেকেন্ড লাগে না।

পথান্তরে প্রিয়দর্শিনী পর্ব ২৭

দর্শিনীরা গাড়িতে উঠতেই গাড়ি স্টার্ট দিলো মৃত্যুঞ্জয়। দর্শিনী মাথা এলিয়ে দিলো সিটে। অদ্ভুত হলেও সত্যি যে আজ নিপা তার অনেক যত্ন করেছে। মৃত্যুঞ্জয় ক্লান্ত মেয়েটার মুখ পানে চেয়ে এসির পাওয়ার সামান্য কমিয়ে দিলো। তন্মধ্যেই নিপার ফোনে কল এলো। কল ধরেই সে চমকে গেলো। অবাক কণ্ঠে গাড়িতে থাকা মানুষ গুলোর উদ্দেশ্যে বললো,”আজ তৃণার আশীর্বাদ হয়ে গেছে।”

পথান্তরে প্রিয়দর্শিনী পর্ব ২৯