পথান্তরে প্রিয়দর্শিনী পর্ব ৩৫

পথান্তরে প্রিয়দর্শিনী পর্ব ৩৫
মম সাহা

দখিনা বাতাসে যখন লেবুর ঘ্রাণ ভেসে এসেছিল তখন রাতটাকে আরেক ধাপ নিঃসঙ্গ মনে হয়েছিলো। ঘরের টিনের উপর ডাহুক ডাকছে কী ভীষণ করুন সুরে। কী ভীষণ অসহায়ত্ব সেই সুরখানায়! আজ মুক্ত ডাহুক হতে পারে নি বলে দর্শিনী নিজের নিঃসঙ্গতা, অসহায়ত্বটা প্রকাশ করতে পারে নি।

বাবার চোখের জল দেখেও পাথরের ন্যায় দাঁড়িয়ে ছিলো। মেয়ে হয়ে জন্ম নেওয়া টা ছিলো তার জীবনের সবচেয়ে বড় ভুল। ছেলে হলে নিশ্চয় এত কিছু সহ্য করতে হতো না। মেয়ে বলেই হয়তো বাবার চোখের জল হয়েছে, ছেলে হলে বাবার ঘাড়ের দায়িত্ব ভাগ করার মানুষ হতো। মেয়ে জীবন এতটা বৃথা কেনো! আজ মেয়ে বলেই কী ডাহুকের চেয়েও বেশি পরাধীন দর্শিনী! একটা সামান্য জীব হয়ে ডাহুকও নিজের হাহাকার উজাড় করে দিতে পারছে তবে দর্শিনী কেনো নয়! কারণ সে কেবল মানুষ না, মেয়ে মানুষ, পরাজয়ের ফানুস।

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

নিজের বিষাদ যখন প্রকৃতিতে ঢেলে দিতে মত্ত দর্শিনী তখনই ফোনটা শব্দ করে কেঁপে উঠে। ফোনের দিকে তাকিয়ে নাম্বারটা পরিচিত নাকি অপরিচিত ভাবতে ভাবতেই ফোনটা কেটে যায়। দ্বিতীয়বার রিং বাজতেই ফোনটা ধরে সে। ক্ষীণ স্বরে “হ্যালো” বলতেই বিপ্রতীপের কণ্ঠ ভেসে এলো,
“শুভ জন্মদিন প্রিয়দর্শিনী। আই নিড ইউ।”

আকষ্মিক এমন কথায় চমকে গেলো দর্শিনী। কয়েক মুহূর্ত কেবল সে ভাবলো,এই কথা খানা বলা ব্যাক্তিটা তার ভ্রম না সত্য! কিঞ্চিৎ ভাবনাচিন্তার পর যখন সে ধাতস্থ হলো এটা বিপ্রতীপ সে তড়িৎ গতিতে কেঁপে উঠলো।
দর্শিনীকে চুপ থাকতে দেখে বিপ্রতীপ দ্বিধা দ্বন্দ্বে পড়ে গেলো। নিবিড় কণ্ঠে আবার বললো,
“কথা বলবে না আমার সাথে, দর্শিনী?”

দর্শিনীর হাত-পা অসার হয়ে গেলো। প্রায় কত গুলো দিন পর বিপ্রতীপ এত ভালো করে কথা বলছে? দিন বললে ভুল হবে,অনেক গুলো মাস পর বিপ্রতীপ এত নরম স্বরে কথা বলছে। প্রায় দশ এগারো মাস। দর্শিনী স্মৃতির কোণায় কোণায় হাতরেও পেলো না বিপ্রতীপ কবে বদলেছে সেই তারিখ। বিপ্রতীপ একদিনে বদলায় নি, প্রতিটি দিন, প্রতিটি ক্ষণে ক্ষণে বদলেছে। দর্শিনীকে অসহ্যকর একটা জীবন দিয়ে বিপ্রতীপ বদলেছে। তবে আজ, এতদিন পর এত শীতলতা কেনো!

“দর্শিনী, তুমি কী আছো লাইনে? কথা বলছো না কেনো? কথা বলবে না?”
দর্শিনীর ধ্যান ভাঙলো। মুখ চোখ কাঠিন্যতায় ছেয়ে গেলো। হৃদয় মাঝে কালো রাঙা মেঘ সরে গিয়ে উত্তপ্ত লেলিহান শিখার উদয় হলো। সেই লেলিহান শিখায় উৎপন্ন হওয়া ক্রোধ ছুঁড়ে মেরে বললো,
“কথা বলার কথা তো ছিলো না। আমাদের কথা তো সেই কবেই ফুরিয়েছে। তবে আজ নতুন করে এত জাঁকজমক ভাবে সেটা জিজ্ঞেস করছো যে?”
বিপ্রতীপ থমকালো,বিরস কণ্ঠে বললো,

“আমি ক্লান্ত দর্শিনী। ভীষণ ভাবে ক্লান্ত গো। আর একটা বার আমার ক্লান্তি দূর করার মানুষ হবে? কথা দিলাম, আর কখনো কষ্ট দিবো না।”
বিপ্রতীপের এমন কথায় হতভম্ব দর্শিনী। এত গুলো বছর পর আজ বিপ্রতীপের মনে পড়লো দর্শিনীর কথা? অথচ এই দর্শিনীও তো কতবার আগলে নিতে চেয়েছে সেই হৃদয়হীন পুরুষকে, তখন কই ছিলো সে মানুষ? অতীত ভেবে তাচ্ছিল্য হাসলো দর্শিনী। তাচ্ছিল্য কণ্ঠেই বললো,
“বাহ্,মায়ার মজা শেষ তবে? তোমার নূন্যতম লজ্জা কবে হবে আমি জানিনা, মরার আগে আর একটা বার মানুষ হওয়ারও তো চেষ্টা করলে পারো। আর কত নিচে নামবে? কিছু তো শরম করো।”

দর্শিনীর তাচ্ছিল্য কথায় আজ বিপ্রতীপের রাগ হচ্ছে না, বরং তার মনে হচ্ছে সে এটারই যোগ্য। তবুও আরেকটা বার নিঃস্বার্থভাবে ভালোবাসার মানুষটাকে পেতে হলে সে কিছু কথা তো সহ্য করতেই পারবে।
দর্শিনী হঠাৎ করে রেগে গেলো। উচ্চস্বরে বললো,
“আর কখনো যদি তুমি আমায় কল দেও তবে মনে রেখো,তোমার জন্য ভয়ানক কিছু অপেক্ষা করছে। তোমাদের টাকা আছে তাই আইন আটকে রাখতে পারছে না তোমাদের তবে আমারও কিন্তু ধ্বংসলীলা চালানোর সামর্থ্য কম নেই। তুমি মায়ার কাছে কলটা দেও, ওর সাথে কথা আছে।”

বিপ্রতীপে মুখ চোখ শক্ত হলো। দর্শিনীর এমন কড়া কথা যে তার ভালো লাগলো না সেটারই বহিঃপ্রকাশ ঘটালো তার অঙ্গভঙ্গি। সে বিরক্তি নিয়ে বললো,
“মায়া অসুস্থ দর্শিনী। হঠাৎ করেই পেট ব্যাথায় নিশ্চল হয়ে গেছে সে। তাই হসপিটালে নিয়ে আসা হয়েছে তাকে।”
দর্শিনী বিপ্রতীপের বিরক্তি স্বরে বলা কথা গুলো শুনে তাজ্জব হয়ে গেলো। যে মানুষটা পছন্দ করে বিয়ে করা স্ত্রী হসপিটালে ভর্তি সে কীভাবে এসব নোংরামি করতে পারে? এরা আদৌও মানুষ।

ঘৃণায় দর্শিনীর শরীর রি রি করে উঠলো। এক দলা থু থু ফেলে বললো,
“তোমার মতন নোংরা পুরুষ পৃথিবীতে আর দুটো নেই। ছোট্ট মেয়েটার এই অসুস্থতায় তুমি আমাকে তেল মারতে এসেছো? ভেবেছো গলে যাবো? কি নোংরা গো তুমি! লজ্জা করে না তোমার তাই না? নষ্ট পুরুষ।”
বিপ্রতীপ এবার রেগে গেলো। রাগী স্বরে বললো,
“আমি নোংরা হলে তুমি কী ভালো? ভেবেছো আমি কিছু বুঝি না তাই না? কোর্টে যে সেদিন তোমার আশিক তোমার খেয়াল রাখলো, কত নাটক দেখালো আমরা বুঝি না এসবের মানে? তুমি কোথাকার ভদ্র গো?”
বিপ্রতীপের এহেন কণ্ঠের পরিবর্তনে হা হয়ে গেলো দর্শিনী। তবে এটা জানা কথাই, বিপ্রতীপের স্বার্থে আঘাত লাগলে সে মুখোশ খুলতে দু সেকেন্ডও দেরি করে না। কিন্তু মায়ার জন্য ভীষণ চিন্তা হচ্ছে,মেয়েটা হঠাৎ করে অসুস্থ হলো কীভাবে? নাকি এসব ঐ বাড়ির মানুষের কারসাজি?

দর্শিনী ভেবে কূলকিনারা পেলো না কী করবে সে, অতঃপর ধীর কণ্ঠে বললো,
“আমি আসছি বিপ্রতীপ, খুব শীগ্রই আসছি। তৈরী থেকো।”
দর্শিনীর শেষ কথায় বিপ্রতীপের মুখে হাসি বিস্তৃতি লাভ করলো। ফোনটা ধীর হাতে কেটে দিলো। তন্মধ্যেই ইমার্জেন্সি রুম থেকে বের হয়ে এলো ডাক্তার। বিহু এগিয়ে গেলো। উৎকণ্ঠা নিয়ে প্রশ্ন করলো,
“মায়ার কী হয়েছে, ডাক্তার? হঠাৎ মাংস খাবার পরই এমন ব্যাথা শুরু হলো কেনো? কী সমস্যা!

হৈমন্ত চোখ-মুখ শক্ত করে দাঁড়িয়ে আছে। সে ভেবে রেখেছে, যদি মোহনার কারসাজি হয় এটা তাহলে সে মোহনাকে ছাঁড়বে না। দরকার হয় জীবনের প্রথম ও শেষ খু*নটা মোহনাকেই করবে।
কিন্তু হৈমন্তের ভাবনায় পানি ঢেলে ডাক্তার উচ্চারণ করলো অন্য বাক্য,
“মায়ার দুটো কিডনির অবস্থা বেশ খারাপ। একটা কিডনি পুরো ৯৫% নষ্ট হয়ে গিয়েছে, আর তার সাথের টা এটার সংস্পর্শে থেকে ৫৫% ড্যামেজ হয়ে গিয়েছে। খুব শীগ্রই আপনারা ডোনার খুঁজে বের করুন। নাহয় মেয়েটাকে বাঁচানো যাবে না। আর,খাবারের জন্য কিছুই হয় নি।”
হৈমন্ত যেন থ বনে গেলো। মায়ার শরীরে এত বড় রোগ অথচ তারা টের পেলো না! রোগটা তো আর একদিনে হয় নি,বছরের পর বছর যাবত হয়েছে তবে তারা টের পেলো না কেনো? নাহ্,এত তাড়াতাড়ি এই সাহসী মানবীকে জীবনের কাছে হারতে দেওয়া যাবে না।

আজকে যে দর্শিনীর জন্মদিন, সেটা সে ভুলেই গিয়েছিল। বিপ্রতীপ মনে না করালে হয়তো মনে পড়তো না। কি অদ্ভুত! অথচ আগে তার জন্মদিনে রাত বারোটা বাজার সাথে সাথে বাড়িতে একটা খুশির আমেজে ভরে যেতো। দর্শিনী নিজেই খুব উদগ্রীব থাকতো নিজের জন্মদিন নিয়ে। জন্মদিন আসার দশদিন আগে থেকে সবারে বলে বেড়াতো। ভীষণ ছটফটে ছিলো কিনা। অথচ সে মেয়েটার কি বিরাট পরিবর্তন। সময় সব পারে। এইযে, ছটফটে দুরন্ত স্বভাবের দর্শিনীকে কেমন নির্জীব করে দিয়েছে!

সকাল হতেই দর্শিনী পরিপাটি হয়ে গেছে। আজ সে একটা জায়গায় যাবে, সেখান থেকে পারলে আজই শহরে যাবে। ঐ বাড়ির রহস্য মিটাতে হবে তাকে। এখন, এই মুহূর্ত থেকে রহস্য উদঘাটন শুরু না করলে বিরাট কিছু হতে পারে। তার মনটা যে ভীষণ কু গাইছে।
জলপাই রঙের শাড়িটা বেশ মানিয়েছে দর্শিনীর গোলগাল শরীরে। চোখে গাঢ়ো কাঁজল,ঠোঁটে গোলাপি রঞ্জক। কি মোহনীয় তার রূপ! কবি দেখে মুগ্ধ হয়ে দু লাইন ছড়া বেঁধে হয়তো বলতেন,

“নারীর প্রতি মোহের দৃষ্টি ফেলো নাকো নষ্ট পুরুষ,
মুগ্ধতায় নারীকে খোঁজো, সে যে এক স্নিগ্ধ ফানুস।”
দর্শিনী উঠোনো পা দিতেই প্রতাপ সাহা মেয়ের দিকে এগিয়ে গেলেন। পাঞ্জাবির পকেট থেকে কি যেন একটা বের করে পড়িয়ে দিলেন মেয়ের গলায়। দর্শিনী অবাক হয়ে চাইলো। ওমা,স্বর্ণের চেইন!
প্রতাপ সাহা মেয়ের মাথায় স্নেহের হাত বুলিয়ে বললেন,
“জন্মদিনের শুভেচ্ছা, মা।”

দর্শিনী কিঞ্চিৎ হাসলো, জড়িয়ে ধরলো বাবাকে। ধীরে ধীরে বড়দা ছোটদাও এগিয়ে এলো। বড়দা কোনোরকম খুড়িয়ে হাঁটতে পারে। ছোটদা এগিয়ে এসে দর্শিনীকে স্বর্ণের এক জোড়া কানের দুল দিলো। দর্শিনী উঁচু পেট নিয়ে প্রণাম করতে গেলে দু’হাত দিয়ে আটকে দেয় ছোটদা। বোনের মাথায় স্নেহের হাত বুলিয়ে ছোট বেলার মতন আদরের ঝুড়ি খুলে দেয়।
প্রদীপ মাথা নিচু করে এগিয়ে যায়। একটা সাদা শপিং দর্শিনীর দিকে এগিয়ে দিয়ে ক্ষীণ স্বরে বললো,
“শুভ জন্মদিন, পুতুল। তোর বড়দা এখন অক্ষম। অত দামী দামী উপহার দিতে পারছে না। এই সামান্য উপহার টুকু নে।”
দর্শিনী ভাইয়ের মুখ চেপে ধরলো। শাসনের স্বরে বললো,
“তোমরাই তো আমার উপহার দাদা। অমন অলুক্ষণে কথা বলবে না বললাম। কী এনেছো গো? কাঁচের চুড়ি?”

প্রদীপ টলমলে দৃষ্টিতে হ্যাঁ জানালো। দর্শিনী খুশিতে আহ্লাদী হয়ে গেলো। তারপর কিছু একটা ভেবে রান্নাঘরে তাকালো। আগে বাবার বাড়ি থাকতে বড়বৌদি জন্মদিনের দিন সকাল বেলা পায়েস রান্না করে দিতো। আজ বোধহয় দিবে না। ছোট্ট শ্বাস ফেললো সে। মা বোধহয় ঘরে আছে। প্রণাম করে আশীর্বাদ চাইতে হবে। প্রতিবার দর্শিনী একাজ টাই করেছে। অতঃপর সে ছুটলো মায়ের রুমের দিকে। মাকে প্রণাম দিবে,বড় বৌদি আর ছোট বৌদিকেও দিবে।
কিন্তু নিপার ঘরের সামনে যেতেই থমকে গেলো দর্শিনী। না চাইতেও সজাগ হয়ে উঠলো কান। নিপা ফোনে কাকে যেন বলছে,

পথান্তরে প্রিয়দর্শিনী পর্ব ৩৪

“তুমি বলেছো বলেই আমি প্রিয়কে মেনে নিয়ে ভালো আচরণ করেছি।”
দর্শিনী অবাক হয়ে গেলো। তাহলে ছোট বৌদি এতটা ভালো আচরণ অন্যের কথা শুনে করেছে! কিন্তু কেনো?

পথান্তরে প্রিয়দর্শিনী পর্ব ৩৬