পথান্তরে প্রিয়দর্শিনী পর্ব ৭

পথান্তরে প্রিয়দর্শিনী পর্ব ৭
মম সাহা

নিস্তব্ধ বিকেল, পরিবেশে। বিষন্নতা যেন আকাশে, বাতাসে বিদ্রোহ ঘোষণা করেছে। পুকুরে পানি গুলো সামান্য দোল খেলে যাচ্ছে নিজের মন মতন। পাতিহাঁস গুলো ডেকে ডেকে সারা হলো। এ এক মন মাতানো পরিবেশ। পুকুরের লাল টাইলস করা বাঁধানো ঘাটের এক কোণায় বসে আছে প্রিয়দর্শিনী। তার সামনেই সুঠাম দেহী পুরুষ দাঁড়িয়ে আছে। প্রিয়দর্শিনী কতক্ষণ চুপ থেকে উচ্ছ্বসিত কণ্ঠে বললো,
“প্রথমে তো আমি তোমাকে চিনতেই পারি নি,দৃষ্টান্ত দা। তুমি কিন্তু দারুণ দেখতে হয়েছো। কবে এলে দেশে?”

“তুই যেভাবে আমায় দেখে চমকে গিয়েছিলি। তোর ‘আপনি এখানে’ শুনে আমি তো প্রায় ভয়ই পেয়ে গিয়েছিলাম। দেশে এসেছি সপ্তাহ খানেক হলো। তুই কবে গ্রামে এলি? ঘরে না বসে পুকুর পাড়ে নিয়ে এলি কেনো?”
দৃষ্টান্তের প্রশ্নে দর্শিনীর হাসি কিছুটা কমে গেলো। তবে হাসির প্রদীপ নিভে যায় নি। কণ্ঠ কিছুটা খাদে নামিয়ে বললো,
“এইতো,আজই এলুম। তোমার সাথে আমার একটা কথা আছে, দৃষ্টান্ত দা। তুমি তো এখন এ গ্রামের সবচেয়ে ভালো ডাক্তার শুনলাম। তাই একটা দরকারেই এসেছি বলতে পারো।”
দর্শিনীর কথা বলার ধরণে ভ্রু কুঁচকালো দৃষ্টান্ত। পকেটে হাত গুঁজে ঘাড় বাঁকিয়ে প্রশ্নাত্মক দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললো,

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

“কী দরকার, দর্শি? এভাবে বলছিস কেনো?”
দর্শিনী এবার ডানে বামে তাকালো। ধৃষ্ট দূরে দাঁড়িয়ে খেলছে। আশেপাশে জনমানসের চিহ্ন নেই। দর্শিনী প্রায় ফিসফিসিয়ে বললো,
“আসলে দৃষ্টান্ত দা,আমার ভিতর আরেকটা প্রাণ বেড়ে উঠছে। এ সময় একটা ভালো ডাক্তারের সান্নিধ্যে থাকলে নাকি ভালো হয়। তাই এসেছিলাম তোমার কাছে। তুমি যদি আমার এ সময়ের চেক আপ টা করতে, অনেক উপকৃত হতাম।”
দৃষ্টান্ত চমকে উঠলো। চোখে মুখে উপচে পড়া খুশি ঝুলিয়ে বললো,
“বাহ্, অভিনন্দন আমাদের ছোট্ট দর্শি। ছোট্ট দর্শি মা হতে যাচ্ছে ভাবা যায়! তা এভাবে চো’রের মতন ফিসফিসিয়ে বলছিস কেনো রে?”
দর্শিনী থম মেরে গেলো দৃষ্টান্তের প্রশ্নে। বুক চিড়ে বেরিয়ে এলো অবহেলার দীর্ঘশ্বাস। চোখ গুলোতে ভীড় করলো যতনের নোনাজল। কণ্ঠ কেমন কেঁপে উঠলো। কাঁপা কাঁপা কণ্ঠ নিয়েই দর্শিনী বললো,

“এ কথা টা কেউ জানেনা, দৃষ্টান্ত দা। তুমিও কাউকে বলো না দয়া করে। গ্রামে এসেছি অনেক বাঁধা বিপত্তি পেরিয়ে। আমি চাই না আপাতত কেউ এ ঘটনাটি জানুক।”
দৃষ্টান্তের মনে সন্দেহের বীজ গাঢ়ো হলো। আনমনেই প্রশ্ন করলো,
“তোর স্বামী জানে তো?”
“নাহ্। সে এখন নতুন রঙে নিজেকে রাঙিয়ে নিচ্ছে। এটা জানার কোনো প্রয়োজন তার নেই। ধরতে পারো তাকে জানাবো না বলেই এতটা লুকোচুরি।”
দর্শিনী কথা থামিয়ে পূর্ণদৃষ্টিতে তাকালো দৃষ্টান্তের দিকে। দৃষ্টান্ত বিপরীত পাশের বসার জায়গা টাতে আরাম করে বসলো। একটা ভ্রু উচুঁ করে জিজ্ঞেস করলো,
“তোর হাসবেন্ডের কী আবার বিয়ে টিয়ে হয়েছে নাকি?”
দৃষ্টান্তের প্রশ্নে আৎকে উঠলো দর্শিনী। কীভাবে বুঝে গেলে দৃষ্টান্ত দা? দৃষ্টান্তের প্রশ্নে মাথা নিচু হয়ে আসলো তার। মিনমিন কণ্ঠে বললো,

“হ্যাঁ, নতুন বিয়ে করেছে। আর কিছু জিজ্ঞেস করো না দৃষ্টান্ত দা। দয়া করো।”
“ঠিক আছে। আর কিছু জিজ্ঞেস করবো না। তোর প্রেগন্যান্সির কথা আর কেউ জানবে না। নির্দ্বিধায় বাড়ি ফিরতে পারিস। এ কয়েকমাস আমিই তোর চেক আপ করবো।”
দর্শিনী কৃতজ্ঞতার হাসি দিলো। ভাইয়ের ছেলের হাত ধরে বাড়ির দিকে রওনা হলো। সে চোখ বন্ধ করে দৃষ্টান্তকে বিশ্বাস করতে পারে। দৃষ্টান্ত আর যাই হোক,বেইমানী করবে না। সেই ছোট বেলা থেকে দেখে আসছে। সবসময় স্নেহের হাত রেখেছে মাথায়।
“পিসি,তোমার গোপন কথা বলা শেষ?”
ধৃষ্টের প্রশ্নে ধ্যান ভাঙে দর্শিনীর। মুচকি হেসে সে উত্তর দেয়,
“হ্যাঁ, শেষ আমার বাবা।”
“ডাক্তারের সাথে তোমার কী গোপন কথা, পিসি?”
দর্শিনী পড়লো মহা মুশকিলে। এ ছেলে প্রশ্নের পাহাড় নিয়ে বসেছে।

সরকার বাড়িতে হৈচৈ। এই মধ্য বিকেলে বাড়ির বউ ঘুড়ি উড়াতে ব্যস্ত। পাড়ার কিছু ছেলেমেয়েও যোগ দিয়েছে তার সাথে। মোহনা কেবল খেয়ে বিছানায় শরীর এলিয়ে দিয়েছে। তার শরীর ভীষণ ক্লান্ত। কত গুলো দিন পর আজ এত কাজ করলো। তার মনে নেই শেষ কবে সে রান্নাবান্না করেছিলো। দর্শিনী আসার পরে সংসারের ধূলি পরিমান কাজও সে করে নি। আজ অনেক গুলো দিন বা বলা যায় অনেক গুলো বছর পর কাজ করেছে। রান্নাঘর সামলিয়েছে।
হঠাৎ হৈচৈ শুনে মোহনার আরামে ভাঁটা পড়লো। বিরক্তিতে কুঁচকে এলো কপাল। এসময়ে হৈচৈ করছে কে? নতুন বউয়ের গলা পাওয়া যাচ্ছে না? মোহনা দ্রুত উঠে বসলো। নতুন বউটা তাকে শান্তি দিলো না। ছুট লাগালো সে ছাদে। নড়বড়ে কোমর নিয়ে এমন ছুটাছুটি তার বিরক্ত লাগছে। ছাদে উঠে মোহনার চোখ ছানাবড়া। নতুন বউয়ের হাতে ঘুড়ির সুতো।
মোহনা দ্রুত এগিয়ে গেলো মায়ার কাছে। আশেপাশের ছাদ গুলোতে মানুষের ভীড়। মোহনার লজ্জায় মাথা কাটা যায় অবস্থা। দ্রুত মায়ার সামনে গিয়ে খপ করে মায়ার হাত চেপে ধরলো। ফিসফিসিয়ে বললো,

“বউ,কী করছো তুমি? তোমায় না সেদিন বলেছি নতুন বউরা এসব করে না। বউদের কাজ সংসার সামলানো।”
মায়ার ধ্যান তখন পুরো আকাশ জুড়ে। ঘুড়িটা না আবার কাটা যায়। শাশুড়ির কথা শোনার সময় তার নেই।
মোহনা বিরক্ত হলো। ছুটে গেলো ছেলের কাছে। বউকে একমাত্র ছেলেই সোজা করতে পারবে। সিঁড়ি ডিঙ্গিয়ে নিচে এসেই মোহনা হাঁক ছাড়লো,
“বাবু,বাবু দেখে যা তোর বউ কী করছে। বাবু।”
বিপ্রতীপ তখন সবে পাড়া বেরিয়ে ঘরে এসেছে। মাকে চিল্লাতে দেখে সে হন্তদন্ত হয়ে ঘর থেকে বের হলো। ব্যাতিব্যস্ত কণ্ঠে বলে উঠলো,
“কী হয়েছে, মা? মায়া আবার কী করেছে?”
মোহনা যেন জব্বর সুযোগ পেলো বউয়ের নামে নালিশ করার। দ্রুত ছেলের কাছে এগিয়ে এলো। ন্যাকামি করে বললো,
“বাবু,তোর নতুন বউ ছাদে ঘুড়ি উড়াচ্ছে। আমি কত নিষেধ করলাম শুনলোই না। পাড়া প্রতিবেশীরা মজা উড়াচ্ছে। তুই যা করার কর।”

বিপ্রতীপের মাথায় যেনো কেউ বিনে পয়সায় আগুন লাগিয়ে দিলো। মেয়েটার সাথে প্রেম করার সময় তো এত দস্যি মনে হয় নি। তবে, মেয়েটা এমন কেনো? এর একটা বিহিত করতেই হবে। বিপ্রতীপ ছুটলো ছাদে, বিহিত করার জন্য।
“এই সুতো ছাড় আরও, বল্টু। সুতো ছাড় তাড়া,,,”
বাকি কথা উচ্চারণ করতে পারলো না মায়া। সপাটে চড় পড়লো তার গালে। কিছুক্ষণের জন্য তার পৃথিবী যেন থমকে গেলো। চারপাশের হৈচৈ হঠাৎ করেই নিশ্চুপতা গ্রাস করলো। সবাই যেন মাত্র ঘটে যাওয়া ঘটনা টা বিশ্লেষণ করতে ব্যস্ত। হলো টা কী?
মায়া তার বাম গালে হাত দিয়ে সামনে দাঁড়ানো মানুষটার দিকে তাকালো। জাম রাঙা টিশার্ট শরীরে জড়ানো সুঠাম দেহী বিপ্রতীপ রক্তচক্ষু নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। মায়া হতবিহ্বল। অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে বিস্মিত কণ্ঠে বললো,
“আপনি আমায় চড় মেরেছেন!”

বিপ্রতীপের তখন রাগে শরীর কাঁপছে। রক্ত লাল চক্ষু জোড়া নিয়ে দাঁত কিড়মিড় করে বললো,
“হ্যাঁ, আমি মেরেছি। ছাড়া গরুকে দু এক ঘাঁ না দিলে বঁশে আনা যায় না। তাই দিয়েছি।”
মায়া কতক্ষণ টলমলে দৃষ্টি নিয়ে বিপ্রতীপে দিকে তাকিয়ে রইলো। মিনিট এক পেরুতেই পাশের ছাদ গুলোর দিকে তাকালো। সবাই কেমন হা করে তাদের দিকে তাকিয়ে আছে। মায়ার দৃষ্টি গেলো ছাদের সিঁড়িতে দাঁড়িয়ে থাকা শাশুড়ির দিকে। যার মুখে মুচকি হাসি।
মায়া নিজের চোখের কোণে আঙুল দিয়ে চিকচিক করা জলটুকু মুছে ফেলল। হাতের লাটাই টা ছুঁড়ে মারলো দূরে। বিকট শব্দ করে ভেঙে গেলো কাঠের লাটাই টা। বিপ্রতীপও সে শব্দে খানিকটা কেঁপে উঠলো। মায়া কাঠের লাটাইয়ের ভাঙা একটা টুকরো কুড়িয়ে নিলো। কেউ কিছু বুঝে উঠার আগেই ভাঙা টুকরোর কোণাটা দিয়ে শক্ত এক আঁচড় কাটলো বিপ্রতীপের ডান হাতে। বিপ্রতীপ সাথে সাথে বিকট শব্দে চিৎকার দিয়ে উঠলো। ফর্সা হাত খানায় লাল মোটা এক আঁচড় স্পষ্ট হয়ে ফুলে গেছে।

মোহনা হায় হায় করে ছুটে এসে ছেলের হাতটা আঁকড়ে ধরলো। মায়া বাঁকা হেসে মা ছেলের দিকে তাকিয়ে দাঁত কিড়মিড় করে বললো,
“ছাড়া গরুও যে পাল্টা জবাব দিতে জানে সেটা দেখিয়ে দিলাম। আমি প্রিয়দর্শিনী না। আমি মায়া। শক্তের জম, নরমের ছায়া।”
গটগট পায়ে ছাদ থেকে নেমে গেলো মায়া। পাশের ছাদে দাঁড়ানো ছেলেটা মুচকি হাসলো। মায়াকে যে সবাই চিনতে পারে না!

সারা গ্রাম ঘুরে সবে বাড়িতে পা রাখলো দর্শিনী আর ধৃষ্ট। মৃত্যুঞ্জয় তাদের উঠোনে বসে আছে। মৃত্যুঞ্জয়কে দেখে সামান্য ভ্রু কুঁচকালো দর্শিনী। ছেলেটার কী আর কোনো কাজ নেই? সারাদিনই এ বাড়িতে পরে থাকে!
দর্শিনীকে বাড়িতে প্রবেশ করতে দেখেই তার মা সরলা প্রশ্ন করলো,
“কোথায় ছিলি এতক্ষণ?”
দর্শিনী স্বাভাবিক ভাবে উত্তর দিলো,
“এইতো,একটু গ্রামটা ঘুরে দেখে এলুম।”
“এই পিসি,তুমি মিথ্যে বলো কেনো? তুমি তো শুধু গ্রাম ঘুরো নি।”

পথান্তরে প্রিয়দর্শিনী পর্ব ৬

ধৃষ্টের কথায় হৃৎপিণ্ড ছলাৎ করে উঠে দর্শিনীর। উপস্থিত সবাই ভ্রু কুঁচকে তাকায় দর্শিনীর পানে। নিপা রান্নাঘরে ছিলো। ধৃষ্টের কথা শুনে ছুটে এসে গদোগদো কণ্ঠে ধৃষ্টকে প্রশ্ন করে,
“তাহলে তোমরা কোথায় গিয়েছিলে,বাবা?”
“আমরা তো ভালো ডাক্তারের বাড়ি গিয়েছিলাম। পিসি তো অনেকক্ষণ লাগিয়ে গোপন কথা বলেছে ডাক্তারের সাথে।”

পথান্তরে প্রিয়দর্শিনী পর্ব ৮