মেঘমিশ্রিত পূর্ণিমা পর্ব ৭

মেঘমিশ্রিত পূর্ণিমা পর্ব ৭
ইফা আমহৃদ

“মিস্ চড়ুই, তুমি কি ডিভোর্সি? তোমার আইডি কার্ডে শুধু চড়ুই দেওয়া। একটাতে মিস্ চড়ুই একটায় মিসেস চড়ুই, এভাবে সাইন করেছ! তোমার ডকুমেন্ট ফাইল দেখে আমি কনফিউজড!”
আইডি কার্ড দেখিয়ে বললেন তিনি।
বজ্রের ন্যায় আঘাত হানল শ্রবণপথে। ফট করে অবলোকন করলাম ধ্রুব স্যারের দিকে। তিনি সন্দিহান দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে আমার দিকে। আমার আইডি কার্ড তার কাছে কী করছে? আমি দ্রুত নিয়ে নিলাম। নিজেকে সামলে বললাম, “আপনার কাছে আমার আইডি কার্ড কী করছে?”

“তুমি সেদিন ভুল করে রেখে গিয়েছিলে। কেয়ারল্যাস। [এতদিন নিজের আইডি কার্ড নিজের কাছে নেই অথচ তার খেয়ালই নেই] আমি যেই প্রশ্নটা করেছি তার উত্তর দাও, তুমি ডিভোর্সি।”
তার মিনমিনে বলা কথাগুলোও শুনতে পেলাম। আমি তো ডিভোর্সি নই, এখনও একজনের বউ। তাছাড়া আমি আমার ব্যক্তিগত জীবন কারো কাছে শেয়ার করতে বাধ্য নই। গম্ভীর গলায় বলি, “না। আগের ভুল করে মিসেস লিখেছিল। তাছাড়া চড়ুই আমার নিকনাম। এটা ভার্সিটির আইডি কার্ড ন্যাসনাল নয়। তাই কিছু জানাইনি। এবার ঠিক করে দিয়েছি। কোথায় সাইন করতে হবে, দিন। করে দিচ্ছি।”
ধ্রুব স্যার দ্বিমত পোষণ করলেন না। আর যাই হোক, একজন স্টুডেন্টের ব্যক্তিগত জীবন সম্পর্কে অবগত না থাকাই ভালো। ফাইল বের করে দিলেন। কিছুদিন পর ফাইনাল ইয়ারে উঠব, তাই নতুন আইডি কার্ডের ডাক পড়েছে। আমাদের ক্লাসের আইডি কার্ডের দায়িত্ব ধ্রুব স্যারের উপর পড়েছে।
আমি সাইন করে সালাম দিয়ে বেরিয়ে এলাম। ফাংশনের কাছে এলাম। ওরা ইতোমধ্যে কাজ শুরু করে দিয়েছে।

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

আজ সূর্যের প্রখর রোদে চামড়া ঝলসে যাওয়ার ন্যায় অবস্থা। ফুলে সজ্জিত স্টেজ খুলার চেষ্টা করছি। ডেকোরেশনের সব জিনিস প্রায় গাড়িতে তোলা শেষ। স্টেজ খুললেই শেষ। উপরের ফুলগুলো খোলার দায়িত্ব পড়ছে আমার উপরে। পাশেই মই রাখা। বাঁশের খুঁটির সাথে মই ঠেকিয়ে উঠে গেলাম উপরে। মই ধরার দায়িত্ব নিরব ও তারিফের। পুরুষালি শক্তির কারণে মই কখনো পড়তে পারে না।
ওরা দুজন আমাকে বিরক্ত করার উদ্দেশ্যে নিচ থেকে নড়াচড়া করছে। আমি বাঁশের খুঁটি ধরার বিনিময়ে ঝুঁকে মই ধরলাম। হিতে বিপরীত হল। মই পড়ে যাওয়ার উপক্রম হল। ধ্যান ফিরতেই বাঁশ ধরলাম। ততক্ষণে যা হওয়ার হয়ে গেল। সবকিছু ভেঙে নিচে পড়লাম। নেত্রযুখল থমকে গেছে। দ্রুত গ্রথণ করে নিলাম। মাটি স্পর্শ করার পূর্বেই ফ্লীমি স্টাইলে হাজির ধ্রুব স্যার। কোমর জড়িয়ে বাঁচিয়ে নিলেন। আমি কম্পিত নয়নে দৃষ্টি মেলতেই ধ্রুব স্যারের রুদ্ধ দৃষ্টি আকর্ষণ করলেন। আমাকে দাঁড় করিয়ে দিয়ে রাগান্বিত কণ্ঠে বললেন,

“আমি তোমাকে হেল্প করতে বলেছি, পাকামি করতে নয়। জিম করা শরীর বলে নিজেকে সুপারম্যান মনে করছ কেন? ভুলে যাবে না, তোমার ললিপপে সব জিম ধুয়ে যায়।”
অবুঝ স্বরে বললাম, “বুঝলাম না, জিম আবার ধুয়ে যায় কেমনে?”
“তোমার মত চড়ুই পাখির মাথায় ঐসব ঢুকবে না। ক্লাসে যাও যাও।”
নত কণ্ঠে বলি, “হেল্প করব না।”
“না। দয়া করে ক্লাসে যান, আপনার সাহায্য লাগবে না। ঠিক সময়ে না আসলে, পুলিশ আমাকে হাজতে পাঠাত। যান।” [ব্যঙ্গ করে স্যার]
মনে মনে প্রবল উৎসাহ নিয়ে চলে এলাম। যদি জানতাম এমন করবেন। কাজ থেকে মুক্তি দিবেন, তাহলে আরও আগেই করতাম।

সূর্য পশ্চিমে হেলেছে। হালকা হয়েছে প্রখর রোদ্দুর। বাচ্চারা পার্কে খেলাধুলা করছে। বেঞ্চিতে বসে আছি আমি। বসন্তের হাওয়া বইছে। ফুলের সুবাস আসছে। প্রজাপতি উঠছে। অজ্ঞাত যুবকের সাথে দেখা করতে এসেছে প্রিয়া। সাথে আমাকে নিয়ে এসেছে। পুলিশি বেশে এসেছে সে। ঝোপের আড়ালে ঐ দিকটায় কথা বলছে। দেখতে বেশ সুন্দর। পুলিশের চাকরি করে বলে কথা, সুদর্শন যুবক হওয়ারই কথা। পেন্সিল পেন্টিং করছি আমি। তৎক্ষণাৎ ব্যাঘাত সৃষ্টি করল একটি কুকুর। বিরাগী চোখে অবলোকন করলাম। কুকুরটি ইতোমধ্যে পেন্সিলের সূচালো অংশ ভেঙে ফেলেছে। হা হুতাশ করলাম আমি। অসম্পূর্ণ পেন্টিংটা রেখে দিলাম ব্যাগে। গোধূলির রক্তিম আভা ছড়িয়েছে। আমি উঠে দাঁড়ালাম। সামনের দিকে অগ্রসর হলাম। এখন বাড়ি ফেরা দরকার। ওড়নায় টান পড়ল। কোনোরকম চেপে ধরে পশ্চাৎ ফিরি। কুকুরটা ওড়নার এক কোণ ধরে টানছে। এগিয়ে ওড়না ধরার প্রয়াস করতেই দৌড় দিল সে। কিংকতব্যবিমূঢ় হয়ে ওড়না আঁটকে ধরলাম। হুট করে আক্রমণ করার নিমিত্তে ফ্যালফ্যাল নেত্র দ্বারা চেয়ে রইলাম। সবকিছু মস্তিষ্কে হানা দিতেই আমিও ছুটলাম। বেশ খানিকটা পথ পেরিয়ে ব্রীজের উপর নিয়ে এলো। গার্ডরা আশেপাশে জঙ্গলের মাঝে কিছু খুঁজছে। কুকুরটা আমাকে সেখানে দাড় করিয়ে ঘেউ ঘেউ স্বরে ডেকে উঠল। কুকুরের ডাক শ্রবণ হতেই পশ্চাৎ ফিরল কেউ। পলক থেমে গেল। ধ্রুব স্যার এখানে কী করছেন? তিনি এগিয়ে এসে কুকুরটাকে কোলে তুলে নিলেন। আদর করে ধন্যবাদ দেওয়ার নিমিত্তে মুখ খুলতেই থেমে গেলেন। গার্ডদের উদ্দেশ্য করে বললেন,

“ডগকে নিয়ে যাও এখান থেকে। তোমরাও বাড়ি ফিরে যাও।”
“কিন্তু স্যার, আপনি একা!”
“কোথায় একা। একা নই। ঠিক সময়ে পৌঁছে যাবো আমি।”
তারা প্রতুক্তি করলেন না। নতজানু হয়ে পাজোড়া গতিশীল করে সম্মান প্রদর্শন করে স্থান ত্যাগ করলেন। আমি কৌতূহল দমিয়ে রাখতে না পেরে বললাম,
“ওটা আপনার কুকুর?”
“হ্যাঁ।” সোজাসাপ্টা উত্তর।
“তাহলে ডগ বলে কেন ডাকলেন? নাম ধরে ডাকতেন।”
“কুকুরের জন্য আমার মেমোরি নষ্ট করার কোনো মানেই হয়না। আমি সবকিছু সংক্ষেপে মনে রাখি।”

এরুপ প্রত্যুত্তরে মোটেও সন্তুষ্ট হলাম না। সামান্য একটা নামে মেমোরি নষ্ট হওয়া কী আছে, আশ্চর্য। ভ্রু কুঁচকে বললাম, “তাহলে আপনি আমার নামটাকে সংক্ষেপ করলেন না কেন?”
“সবকিছু সংক্ষেপ করা যায় না। যে আমার মনের সবটা দখল করে আছে তার নাম মেমোরি থেকে সরিয়ে ফেলা যায়? কখনোই যাবে না।
তাছাড়া, তোমার নাম সংক্ষেপ করলে হবে চড়। মানে থাপ্প’ড়। অন্যথায় চোড় মানে চো’র‌। তুমি কি চাও তোমাকে এই নামে ডাকি?”

বলেই শার্টের হাতা ফোল্ড করতে করতে চলে গেলেন তিনি। আমি পেছন থেকে আশ্চর্যান্বিত নয়নে চেয়ে রইলাম। আমার নামটা আর নাম নেই, পুষ্পা গান হয়ে গেছে। যে যেমন পারছে নেচে যাচ্ছে। আমি দীর্ঘশ্বাস ফেলে পুনরায় তাকালাম। ততক্ষণে দৃষ্টির অগোচরে চলে গেছেন তিনি। আমি উল্টো পথ ধরলাম। বাড়িতে এসে বসলাম। সামনে বাবুইয়ের এইচএসসি পরীক্ষা। পড়ায় সাহায্য লাগবে, তাই ওকে সাহায্য করতে গেলাম। আজ আর পড়া হল না।
মাঝরাতে নিদ্রা ভঙ্গ হল। ইদানীং রাতে জেগে যাই। যখন কাঁটায় কাঁটায় তিনটা বাজে। আজও তার ব্যতিক্রম হলনা। ধ্রুবের মায়ের পাঠানো ডিভোর্স পেপারটা কাবার্ড থেকে অতিশয় যত্নে বের করলাম। নিজের কোনো জিনিস এতটা যত্ন করেছি বলে মনে হয়না। অথচ নিজের সবচেয়ে অপছন্দের জিনিসটা যত্নে রাখা। তাচ্ছিল্যের হাসি দিয়ে খামটা খুললাম। ভেতরে মোড়ানো একটা চিঠি। আগে খুলিনি, তাই জানি না। হাতের লেখা চিনতে অসুবিধে হলনা, এই লেখাটা রমিলা অর্থাৎ ধ্রুবের মায়ের। তিনি লিখেছেন,

বউমা শ্রেয়া,
আমি চমকালাম। আজ কতগুলো বছর পর এই নামের সম্মোধন। ভুলতে বসেছিলাম, মায়ের দেওয়া নামটা‌ ‘শ্রেয়া’। মামার চড়ুই দেওয়া নামটাই সবাই জানে। বউমা শব্দটা লিখে কেটেছেন। হয়ত বুঝতে পেরেছেন, এই আহ্বান আমার জন্য নয়।
শ্রেয়া,
ভালো আছিস মা! আমার দেওয়া কথাটা রাখতে পারলাম না। বড়ো মুখ করে বলেছিলাম, তোকে আমার ছেলের বউ করব।‌ বউ ঠিকই করেছি কিন্তু প্রাপ্য সম্মানটুকু দিতে পারিনি।
ধ্রুব দেশে ফিরেছে। গ্ৰাম থেকে শহরে এনেছে আমায়। একসাথে থাকি এখন। তবে আমাদের মাঝে কথা হয়নি কখনো। ছেলের চোখে আমি অপরাধী, তোর চোখে অপরাধী। ধ্রুব হয়ত কখনো তোকে মানতে পারবে না। আমিও চাইনা, আমার মিথ্যা সিদ্ধান্তে তোর জীবনটা শেষ হয়ে যাক। তাই অনেক ভেবে চিন্তে সিদ্ধান্ত নিয়েছি, এই মিথ্যা সম্পর্ক থেকে তোদের দু’টোকেই বের করে আনব।

তোর মামাকে বলেছি, রাজপুত্র দেখে তোর বিয়ে দিতে। ধ্রুবের সাথে বিয়েটা ভুলে যাস। ছেলের সাতাশতম জন্মদিনে তাকে গিফ্ট দিতে চাই। চার বছর পরপর এই দিনটি আসে। গতবার কথাই বলেনি। শরীরের অবস্থা ভালো নয়। আগামীবার বেঁচে থাকব কি-না জানা নেই। এবার তার সবচেয়ে বড়ো গিফ্টটা দিতে চাই। পারলে ক্ষমা করে দিস। দয়া করে সাইন করে দিস পেপারে। ভালো থাকিস।
ইতি
রমিলা।

মেঘমিশ্রিত পূর্ণিমা পর্ব ৬

আমি চিঠিটা ভাঁজ করে রাখলাম। ধ্রুব দেশে ফিরেছে। অথচ আজ জানতে পারলাম। অভিমান জমাট বাঁধল। ভেতর থেকে মূল পেপার বের করলাম। ধ্রুব সাইন করেনি। হয়ত আমার পরে ধ্রুব সাইন করবে। কাঁপা কাঁপা হাতে সাইন করে দিলাম। যে আমার নয়, তাকে বেঁধে রাখা উচিত নয়। চিঠি লেখতে বসলাম। ধ্রুবকে দেওয়ার জন্য প্রথম এবং শেষ চিঠি।

মেঘমিশ্রিত পূর্ণিমা পর্ব ৮