মেঘমিশ্রিত পূর্ণিমা পর্ব ৬

মেঘমিশ্রিত পূর্ণিমা পর্ব ৬
ইফা আমহৃদ

‘ছিঁড়ে গেছে’ কথাটা তুমুল বেগে বাড়ি খেল। আমি নতজানু হয়ে পিছিয়ে গেলাম। ঠেকে গেলাম পেছনে। গাছের সাথে বাড়ি খেলাম। তার কটু উক্তি কমার নামই নিচ্ছে না। না এক চুল পরিমান নড়ছে। আমাকে অস্বস্তির হাত থেকে বাঁচাতে অ্যাঞ্জেলের ন্যায় হাজির হলেন ধ্রুব স্যার। আমার মাথা থেকে পা অবধি পর্যবেক্ষণ করে গম্ভীর গলায় বললেন,
“কোনো সমস্যা হয়েছে?”
আরও শেটে গেলাম গাছের সাথে। মিনমিনিয়ে বললাম, “না, স্যার।”
“তাহলে গাছের সাথে এভাবে মুচড়া-মুচড়ি করছ কেন? গাছটাকে ধ’র্ষণ করার মতলব করতেছ না-কি? আশ্চর্য। অনুষ্ঠান ওখানে হচ্ছে, এখানে নয়। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ছেলেদের মজা দিচ্ছ।”
ইতিকথা বিরবির করে বললেন তিনি। তবে আমার কানে ঠিকই পৌঁছাল। না পেরে এবার কেঁদেই দিলাম। পেছনে ফিরে পিঠ দেখালাম। নাক টেনে কান্নামিশ্রিত কণ্ঠে বললাম,
“আপনি দেখেছেন আমি মজা দিচ্ছে। ভিড়ের চাপে আমার ব্লাউজের চেইন ছিঁড়ে গেছে। এখানে এসে একটু দাঁড়িয়েছি, এই ছেলেগুলো অবধি বাজে দৃষ্টিতে..

আর বলতে পারলাম না। তার পূর্বেই ধ্রুব স্যার চ্যাঁচিয়ে উঠলেন।
“এটা কোন ধরনের অস’ভ্যতা’মি। তোমাদের বোনের মত একটা মেয়ে বিপদে পড়ছে। তোমরা হেল্প না করেই এইসব করছ? তোমার মত স্টুডেন্ট এই অনুষ্ঠানে থাকার যোগ্য নয়, বেরিয়ে যাও। আমার চোখের সামনে যাতে না দেখি, দেখলে চড়িয়ে সবকিছু দাঁত ফেলে। যাও..
ছেলেগুলো ধ্রুব স্যারের হুঙ্কার শুনেই প্রস্থান করলেন। নতুন স্যার হলেও ভার্সিটিতে তার দাপটে কোণঠাসা করে রাখেন সবাইকে। স্বাভাবিক কণ্ঠে বললেন, “সেফটিপিন দিয়ে আটকিয়ে নাও!”
“সেফটিপিন নেই।”
“তাহলে আছে টা কী, ইডিয়েট! শাড়ি পড়ছ সেফটিপিন রাখবে না।”
ধ্রুব স্যার দ্রুত ফোন বের করে ফোন করলেন কাউকে। তার কথার ধরণ থেকে মনে হল, রাহাত স্যার। কিন্তু ভালোভাবে কথা শুনতে পেলেন না। ভিড়ভাট্টা হইচই শব্দ শোনা যাচ্ছে। কিয়ৎক্ষণ অতিবাহিত হওয়ার পরে উপস্থিত হলেন রাহাত স্যার।
“এতবার ফোন দিচ্ছিস কেন?”
“ভিড়ের ভেতরের না দাঁড়িয়ে পাশে গিয়ে ফোন রিসিভ করা যেত না? বাদ দে, সেফটিপিনের ব্যবস্থা করে দিতে পারবি?”
“আমি আবার এইসব কোথায় পাবো?”

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

রাহাত স্যার চলে গেলেন। পদচারণ করলেন ধ্রুব স্যার। কাগজ লাগানোর পিন মেশিন বের করলেন পকেটে থেকে। সোজাসাপ্টা বললেন, “ঘুড়ে দাঁড়াও।”
নিজের ঘুড়িয়ে দিলেন। পিন মেশিনের সাহায্যে চেইন টা ভালোভাবে লাগিয়ে দিলেন। সেফটিপিনে আঁটকে রাখা আঁচলটা খুলে পেঁচিয়ে পিন দিয়ে লাগিয়ে দিলেন। কাগজে লাগান পিন শেষে জামায় লাগালেন তিনি।
“নাও পারফেক্ট। আপাতত ওদিকে যাওয়ার দরকার নেই। এখানে বসে থাকো তোমরা। প্রয়োজন হলে আমি এসে সামনে নিয়ে যাবো। কেমন!”
বলেই স্থির পা জোড়া গতিশীল করে সামনের দিকে অগ্রসর হলেন। আমি লজ্জা নত মাথা তুললাম। আজ আর কারো মুখোমুখি হতে পারব না। তাই ঝটপট বেরিয়ে এলাম। বাড়িতে গিয়ে দরজা বন্ধ করে বসে রইলাম। সেদিন আর ঘুম হলনা। নির্ঘুম রাত পেরিয়ে ভোরের সূচনা হল। ফজরের আযান দিল। আমি নামাজ আদায় করে ব্যালকেনিতে বসলাম। সাড়ে পাঁচটায় বাজেনি। এতক্ষণ কীভাবে সময় অতিবাহিত করব। অনেকদিন জিমে যাওয়া হয়না। তাই ড্রেস চেঞ্জ করে জিমের ব্যাগ কাঁধে নিয়ে বেরিয়ে এলাম। শিতল হাওয়ার সাথে হেঁটে হেঁটে পৌঁছে গেলাম জিমে। তখন ছয়টা পাঁচ বাজে। অনেকেই এসেছে। ছয়টায় ওপেন করা হয়, তাই কোনো সমস্যা হল না।

সাতটা পনের বাজে। সাইকেলিং করছি। ঘেমে একাকার হয়ে গেছি। অনেকদিন পর বিধেয় অনেক কষ্ট হচ্ছে। আজ আর করব না। নেমে এলাম। ব্যাগের কাছে এসে এক ঢোক পানি পান করলাম। ব্যাগে নিয়ে বেরিয়ে আসার প্রয়াস করতেই ধাক্কা খেলাম কারো সাথে। ছিটকে পড়ল পানির বোতল। বোতল না তুলে সামনের মানুষটিকে কিছু বলার প্রয়াস করতেই স্তব্ধ হয়ে গেলাম। ধ্রুব স্যার সামনে দাঁড়িয়ে আছে। ভুল দেখছি নাতো? চোখ পরিস্কার করে পুনরায় তাকালাম। না আমার দৃষ্টি ভ্রম নয়। সন্দিহান স্বরে বললাম,
“আপনি এখানে? আপনাকে তো কখনো এখানে দেখি নি?”
“তুমি! তুমি এখানে কী করছ? তোমাকেও এর আগে দেখিনি।”
“আমি তো সবসময়ই আসি। মাসে দশ থেকে এগারো দিন। আপনি কেন এসেছেন?”
“মানুষ এখানে কেন আসে? নিশ্চয়ই জিম করতে, মাছ ধরতে তো নয়। আশ্চর্যান্বিত কথা বার্তা।”
“তাহলে আপনি আমাকে কেন জিজ্ঞাসা করেছেন, আমি কেন এসেছি? হম!”
“তোমাকে দেখতে শুকনো টিকটিকির লেজের মত লাগে। শুকনো টিকটিকির লেজ জিম করে বিশ্বাস যোগ্য হয়নি। তাই জিজ্ঞেস করলাম।”

আমি তেড়ে কিছু বলতে গিয়েও থেমে গেলাম। তার সাথে কথা বলাই বেকার। উল্টো রাজ্যের কথা শুনিয়ে দিবে আমায়। আমি ব্যাগ নিয়ে বেরিয়ে এলাম। তৈরি হয়ে ভার্সিটিতে যেতে হবে। ধ্রুব স্যার আসার পর থেকে পড়ে যাওয়া আর ছিঁড়ে যাওয়া জিনিসটা অটোমেটিক শুরু হয়ে গেছে। কখনো জ্ঞান হারিয়ে পড়ে যাচ্ছি, কখনো ব্লাইজের চেইন ছিঁড়ে যাচ্ছে। কখনো ললিপপ গুলো পড়ে যাচ্ছে, তো আবার উপর থেকে পানি পড়ছে।

পুরো ভার্সিটি খুঁজেও কোথাও দেখা পেলাম না ওদের। বেল বেজে গেছে। আমি ক্লাসের দিকে অগ্ৰসর হলাম। ততক্ষণে স্যার ক্লাসে ঢুকে গেছেন। ধ্রুব স্যার ক্লাসে। আমাকে ক্লাসে ঢোকার অনুমতি দিলেন না। গম্ভীর গলায় দশ মিনিট দাঁড়িয়ে থাকতে বললেন। ক্লাসে এসে বাইরে হাঁটাহাঁটি কেন করি তার শাস্তি। আমি দরজায় হেলান দিয়ে স্যারের লেকচার শুনছি। পাঁচ মিনিট অতিবাহিত হওয়ার পরেই স্যার কড়া গলায় ভেতরে প্রবেশ করতে বললেন। ধন্যবাদ জানিয়ে ভেতরে ঢুকলাম। ‘ওমা’ যাদের জন্য এতক্ষণ বাইরে দাঁড়িয়ে ছিলাম তারা ভেতরে। পেছনে ওদের পাশে বসতে গেলেই কড়া হুকুম জারি করলেন মহাশয়। শান্ত কণ্ঠে বললেন,
“সামনে বসো! কালকে বসন্ত উৎসবে শেষে তোমাকে কেন দেখা যায়নি?”
“শরীর ভালো লাগছিল না, স্যার?”
“তোমার ফ্রেন্ড সার্কেলের সবাই অসুস্থ ছিল? ভয়ে জ্ঞান হারিয়েছ তাই চারদিন কলেজ মিস্ দিয়েছ, কালকে এসেই সাথে সাথে চলে গেছ। থাকাটা বাধ্যতামূলক ছিল। অনেক কষ্টে ভার্সিটি সাজানো হয়েছিল, কিন্তু তোমরা তার দামই দিলে না। নট অ্যালাউ। আমি অন্তত আমার ক্লাসে এটা অ্যালাউ করব না। তোমাদের প্রথম শাস্তি, তোমরা কেউ জোড়ায় ক্লাসে বসবে না। চারজনে চার কোণে আর একজন মাঝে। দ্বিতীয় শাস্তি, সবকিছু খুলতে কর্মীদের কাজে হেল্প করবে। মনে থাকে যেন।”

ক্লাস মিস্ দিয়ে ক্যাম্পাসে বসে আছি। দাঁতের কারণে নখের অবস্থা নাজেহাল। আমরা আড্ডায় বসেছি। আড্ডার মেইন কারণ হল প্রিয়া। তার বিয়ে ঠিক হয়েছে। কাল রাতেই জানতে পেরেছে। তাই নিয়ে মন খারাপ বললেই চলে এককথায়। নিরব হা হুতাশ করতে করতে বলল, “তুই কি আদৌ মেয়ে? মা বাবা তোর বিয়ে ঠিক করে দিল আর তুই নাচতে নাচতে রাজি হয়ে গেলি। এখন আমাদের সামনে ফ্যাঁচ ফ্যাঁচ করে কাঁদছিস। হাউ ওয়ান্ডারফুল! আমাকে বিয়ের কথা বললে, কালকেই মারিয়ারে নিয়ে পালিয়ে যেতাম। ”
“কী করতাম আমি। বাবাকে প্রচুর ভয় পাই‌!” [অশ্রুসিক্ত নয়নে প্রিয়া]
বিরক্তি নিয়ে তারিফ বলল,
“ছেলের নাম কী? কী করে? বয়স কত? বাড়ি কোথায়? ছবি দেখেছিস?”
“জানি না। ভয় করে যে..
নিরাশ কণ্ঠে বলে, “নে! আমারে নে। নিয়ে পানিয়ে চুবিয়ে দেখ তোর ভয় কমে কি-না? আশ্চর্য। যদি বুড়া দাদার সাথে তোর বিয়ে দেয়। তখন কী করবি, বুড়ার ই ধরে টানবি? একটু পরে দেখবি, ওটা পেঁকে লেওয়া হয়ে হাতে চলে এসেছে।”
নাক কুঁচকে বললাম আমি, “ছিঃ! কী কস এডি!”
“আবার ছিঃ কস। এডিই ওর প্রাপ্য‌। বল’দির মত সং সেজে না থেকে একটু মাথাটাকে কাজে তো লাগাতে পারিস।”
টেনে টেনে বলল প্রিয়া, “ছেলে পুলিশ, নামটা মনে নেই। ‘ত’ দিয়ে হতে পারে।”
অবাক কণ্ঠে বলল,

“বাহ্! বাহ্! তা মনে কেন থাকবে?
তোর বাপ মায় তো খাইয়ে দাইয়ে একটা কুমির পুষে। কুমিরের কী আর অতকিছু মনে রাখে? ও শুধু পারে গিলতে। যত্তসব।”
আমরা গভীর ভাবনায় লিপ্ত হলাম। কী করে বিয়েটা আটকানো যায়। তারিফ ব্যাগ নিয়ে ললিপপ ব্যাগ করে কাঠি সমেত মুখে পুড়ে বসে রইল। এটা নতুন কিছু নয়। অতঃপর বলল, “খেউ খেউ খেউ।”
ললাট কুঁচকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি নিক্ষেপ করে বলল নিরব, “তুই কুত্তার মত খেউ খেউ না করে, ললিপপ বের করে কথা বল।”
“থানাটাকেই যদি বো’ম মে’রে উড়িয়ে দেই তবে? না থাকবে পুলিশ, না হবে বিয়ে।”
“চুপ করবি তুই। দেখলে প্যাঁদানি তো দিবেই। সাথে জেল তো হবে, ফাঁসিও দিতে পারে।”
“তোরে কইছে।”

মেঘমিশ্রিত পূর্ণিমা পর্ব ৫

শুরু হয়ে গেল‌। একেই তো কোনো উপায় পাচ্ছিনা, আবার এদের এই অবস্থা। বিরক্তি নিয়ে কিছু বলার প্রয়াস করতেই জুনিয়র ভাই হাজির। হাঁপাতে হাঁপাতে বলল,
“এখানে বড়ুই কে? ধ্রুব স্যার তাকে ডেকে পাঠিয়েছে।”
“হাউ ফানি বড়ুই।”
অট্টহাসিতে ফেটে পড়ল। সব ছেড়ে শুরু হয়ে গেল। ছেলেটা বলেই হাওয়া। ধ্রুব স্যার এটা ইচ্ছে করে করেছে, এটা বুঝতে সময় লাগল না আমার।

মেঘমিশ্রিত পূর্ণিমা পর্ব ৭