মেঘমিশ্রিত পূর্ণিমা পর্ব ৮

মেঘমিশ্রিত পূর্ণিমা পর্ব ৮
ইফা আমহৃদ

ধ্রুব স্যারের ফ্রি টাকা নষ্ট করতে স্টুডেন্টরা উঠে পড়ে লেগেছে। ঘণ্টাখানেক পূর্বে স্যার জানিয়েছেন, আজ তার ক্লাসে ত্রিশ মার্কসের পরীক্ষা হবে। যে যে দশের উপরে অর্জন করবে, তাকে ফ্রিতে টুরে নেওয়া হবে দুইমাস পর। তাই মনযোগ সহকারে পড়ছে সকলে।
ক্লাসে প্রবেশ করে আমিও বই বের করে পড়তে বসলাম। টুরে যাওয়ার শখ নেই, তবে রেজাল্ট খারাপ হোক এটা কখনোই চাইনা। তাছাড়া স্যার যেগুলো মার্ক করে দিয়েছেন, সেগুলো আরও আগেই পড়া শেষ আমার। রিভিশন কম্পিলিট করলেই সমাপ্ত।

পড়ার মাঝপথে ধ্রুব স্যারের কণ্ঠস্বর শ্রবণ হল। তিনি জিজ্ঞাসু কণ্ঠে বলছেন, “এই চিঠিটা কার?”
মস্তিস্কে ‘চিঠির’ কথা উপস্থিত হতেই দৃষ্টি সরালাম বইয়ের পাতা থেকে। চটজলদি বইয়ের পাতা খুঁজতে লাগলাম। কাল রাতে চিঠিটা এই বইয়ের মাঝেই রেখেছিলাম, কিন্তু নেই। প্রথম বেঞ্চিতে বসার ফলে হাওয়াতে উঠে সামনেই গেছে। অবিলম্বে উঠে দাঁড়িয়ে মিনমিনে স্বরে বললাম, ” আমার চিঠি।”
“তুমি চিঠিও লেখ? বিদেশি স্বামীর জন্য, বুঝি?”
‘বিদেশি স্বামী’ শব্দটায় একটু থমকালাম। অহেতুক বেশিই চমকালাম। তিনি জানলেন কীভাবে। মানছি, আমার দেওয়া প্রতুক্তি সন্দেহজনক ছিল। তাই বলে এতটা। শিক্ষককে প্রশ্ন করা সাজে না। তাই নতজানু হয়ে কাতর কণ্ঠে বললাম,
“স্যার, প্লীজ চিঠিটা দিন। ওটা আমার ব্যক্তিগত সংক্রান্ত। আমি চাইনা, আমার ব্যক্তিগত জীবন সম্পর্কে কেউ অবগত থাকুক। প্লীজ দিন।”

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

স্যারের চোয়াল দৃঢ় হয়ে এল। দাঁতে দাঁত চেপে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি নিক্ষেপ করলেন। চিঠিটা চেপে ধরলেন মুঠোয়। অসংখ্য ভাজ পড়ল। একদম বেহাল অবস্থা হয়েছে। আমাকে পুনরায় চিঠি লিখতে হবে। আমি দীর্ঘশ্বাস নিয়ে হাত মেলে দিলাম। ধ্রুব স্যার চিঠি তো দিলেনই না বরং চিঠিটা মুচড়ে জিন্সের পকেটে রেখে দিলেন। গম্ভীর গলায় বললেন, “যদি ব্যক্তিগত হত, থাকলে এই চিঠিটা পাবলিকলি আনতে না। যখন এনেছ, তখন ফিরত পাচ্ছ না।”
বলেই সামনের দিকে অগ্ৰসর হলেন। আমি বিস্ময় দৃষ্টিতে চেয়ে রইলাম। এটা কেমন কথা, আশ্চর্য। টেবিলের উপরে বই রেখে হোয়াইট বোর্ডে প্রশ্ন লিখতে লাগলেন। আমি রাগে ফুঁসতে ফুঁসতে নিচের দিকে চেয়ে রইলাম। চিঠিটা কারো কাছে রাখা যাবেনা, ধ্রুব স্যারের কাছে তো নয়ই। আমি চুপ করে পরীক্ষায় মনোযোগ স্থাপন করলাম। ক্লাস শেষে স্যারের কেবিনে গিয়ে স্যরি বলে নিয়ে আসব।

পরীক্ষা ভালোই হয়েছে। সবগুলো প্রশ্নের উত্তর ঠিকঠাক দিয়েছি। কিন্তু পরীক্ষার রেজাল্ট ভালো হয়নি। সেটা আমায় মাথায় ঢুকছে না। মাঝখানের কয়েকটা পেজ মিসিং। ধ্রুব স্যার বলছেন আমি না-কি এইভাবেই জমা দিয়েছি। অথচ প্রিয়া, আঁখি, নিরব ও তারিফ আমারটা দেখে দেখে লিখে সাতাশ পেল। আমি সেখানে ত্রিপল জিরো। ত্রিপল জিরোকে আঁটকে দিয়েছে বড় একটা জিরো দিয়ে। যেন মাঝখানে তিনটা মিষ্টি আর উপরেরটা মিষ্টির প্যাকেট। ক্লাসে বাকি স্টুডেন্টরা বিস্ময় দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে আমার দিকে। হয়ত তাদের মস্তিষ্ক এটাই ধারণ করতে পারছে না, ক্লাস টপার কীভাবে ফেল করল। আমার বিচলিত অবস্থা দেখে ফোড়ন টেনে প্রিয়া বলল,
“আমার মাথায় এটাই ঢুকছে না, তোর বাকি পেজগুলো কোথায় গেল।”
বিদ্রুপ করে প্রতুক্তি দিল তারিফ, “হাউ ফানি। এখনও তোর মাথায় ঢুকছে না। পুলিশ জামাই বুঝি তোকে কালকে কিছু বুঝায়নি।”
“দেখ তারিফ। তৌফিকের সম্পর্কে একদম এভাবে বলবি না।” [একরোখা জবাব দিল প্রিয়া]
এমনিতেই পরীক্ষার খাতা নিয়ে চিন্তায় মাথা ফেটে যাওয়ার উপক্রম সাথে যোগ হয়েছে এদের বকবকানি। ধমকে বললাম,

“চুপ কর বাপ আমার। প্লীজ চুপ। বিরক্ত লাগছে আমার।”
আমতা আমতা করে আঁখি বলল, “আমরা স্যারকে বলি আমরাই তোরটা দেখে লিখে সাতাশ পেয়েছি। তোর তাহলে ত্রিশে ত্রিশ পাওয়ার কথা।”
ঝাঁঝালো স্বরে বলি, “যা বল, বারণ করেছে কে? এখন শাস্তি একা আমি পাবো। বললে আমরা সবাই। চুপচাপ বসে থাক।”
বলেই ফুঁপিয়ে উঠলাম। ক্লাস নাইনের পর থেকে পরীক্ষায় ফেল তো দূর থাক, দশ মার্ক কম পাই নি, সেখানে ত্রিপল জিরো। আমার এরুপ অবস্থা থেকে বিচলিত হয়ে পড়ল বন্ধুমহল। আমাকে শান্ত করতে নিরব গম্ভীর গলায় বলল,
“দেখ চড়ুই, এটা ক্লাস পরীক্ষা। আমরা কেউ তোকে ছাড়া টুবে যাবো না। প্রমিজ।
এই শা’লায় ইচ্ছে করে এমন করছে। প্রিয়ার হবু জামাই ধলা উল্লুকটাকে দিয়ে তোর পরীক্ষার পেপার খুজাবো। প্রয়োজনে আবার পরীক্ষার ব্যবস্থা করব, তবুও থাম।”
মুহুর্তেই হেসে উঠলাম আমি। আমার সাথে তাল মিলিয়ে ওরা হেসে উঠল। হাসির শব্দ একটু বেশিই প্রকট। ধ্রুব স্যারের কর্ণধার অব্দি পৌঁছে গেল। স্যার সন্দিহান দৃষ্টিতে অবলোকন করলেন। পরীক্ষায় জিরো দেওয়ার পরেও এত আনন্দ আসে কোথা থেকে। তবে তেমন কিছু বললেন না। সোজাসাপ্টা বললেন,

” সবাই টুরে যাবে তুমি যাবে না, এটা ভালো দেখায় না। আজ থেকে আগামী একমাস তুমি আমার কাছে পড়বে। টুরের আগে তোমার একটা পরীক্ষা নিবো। মার্কস ভালো পেলে তুমিও যেতে পারবে।”
বলেই এগিয়ে এলেন তিনি। একটা ভিজিটিং কার্ড এগিয়ে দিলেন। আমি সৌজন্য হাসি দিয়ে কার্ডটা হাতে নিলাম। ফেল করলে এত সুবিধা, জানলে ক্লাসের সবাই ফেল করত। স্যার তো জনেনা, পড়াশোনায় সবাই ঢেড়স। সবাই তো আমার খাতাই দেখে লিখেছে, তাই তাদেরও একটা হক আছে। আমি যখন স্যারের বাড়িতে যাবো, সবাইকে নিয়ে যাবো। হি! হি! হি!

নীল অন্তরিক্ষ বড্ড বেশি বিভাসিন। চারদিকে ছড়িয়ে আছে অন্ধকার। সূর্য ঢুবে গেছে। চাঁদ উঠতে ঢেড় দেরি। ফুলে গন্ধে মোমো করছে। বসন্তে ফুল ফুটেছে নিশ্চয়ই। আমরা দাঁড়িয়ে আছি ধ্রুব স্যারের বাড়ির সামনে। রাজপ্রাসাদে চেয়ে কোনো অংশে কম নয়। চারদিকে গার্ডরা আবৃত করে আছে। আমি ক্লাসের সবাইকে নিয়ে হাজির হয়েছি ধ্রুব স্যারের বাড়ির সামনে। গার্ডরা ধ্রুব স্যারের অনুমতি ব্যতিত কাউকে প্রবেশের অনুমতি দিবেন না। স্যারের কন্টাক্ট নাম্বার নেই। আমি এগিয়ে সামনে যেতেই গার্ডরা আমার দিকে গভীর চোখে চাইলেন। নিজেদের ভেতরে কিছু বলাবলি করে পথ ছেড়ে দাঁড়ালেন। আমি সবাইকে নিয়ে ভেতরে ঢুকলাম। একজন গার্ড আমাদেরকে বাড়ির ভেতরে নিয়ে গেলেন। ধ্রুব স্যার বিস্ময় দৃষ্টিতে চেয়ে রইলেন সবাইকে দেখে। আমি চাপা হাসলাম অগোচরে। ধ্রুব স্যার বললেন,
“তোমরা সবাই এখানে কী করছ? আমি তো শুধু চড়ুইকে পড়ানোর কথা বলেছিলাম।”
দাঁত কেলিয়ে বললাম, “আসলে সবাই পড়াশোনায় দূর্বল, তাই সবাইকে নিয়ে এসেছি। ভালো করেছি না।”

ধ্রুব স্যার রক্তচক্ষু করে চেয়ে রইলেন। কিছু বললেন না। সৌজন্য হাসি দিয়ে সামলে নিলেন।
“আসলে মা গ্ৰামে গেছে। আমার চাচাত ভাইয়ের জন্য মেয়ে দেখতে। সপ্তাহখানেক পর বিয়ে। বাড়ি ফাঁকা। আমি সেফদের হাতের তৈরি খাবার খেতে পারি না। নিজেই রান্না করছি।
মা ফিরলে পড়াবো। আপাতত পারছি না।”
সবাই খুশি হলেন। ক্রাশ বলে কথা। তবে চলে যেতে হবে বলে মুখটা দেখার মত ছিল। আমিও যাওয়ার প্রয়াস করতেই হোঁচট খেলাম কিছুর সাথে। ভারসাম্যহীন হয়ে ধপাস করে পড়লাম নিচে। চশমা ছিটকে গেল। খুঁজতে লাগলাম। কিন্তু পাচ্ছি না। সবাই এগিয়ে আসতে চাইলে ধ্রুব স্যার মিষ্টি কণ্ঠে বললেন,
“তোমরা যাও। স্টার্ফদের দিয়ে খুঁজে দিচ্ছি চশমা। পায়েও হয়ত ব্যথা পেয়েছে, বরফ লাগিয়ে দিচ্ছি।”
সবাই চলে গেল। বিকট শব্দে দরজা বন্ধ করে দিলেন ধ্রুব স্যার। আমি কেঁপে উঠলাম। ঝাপসা চোখে কিছুতেই চশমা খুঁজে পাচ্ছি না। চশমা বের করে দিলেন। আমি অতিদ্রুত চোখে পড়লাম। তবুও ঝাপসা। ফেটে গেছে গ্লাস। উঠে দাঁড়িয়ে সামনের দিকে অগ্ৰসর হলাম। সবকিছু ঝাপসা। আলোতে গেলে যদি পরিষ্কার দেখতে পারি। ফলস্বরুপ, দেয়ালে বাড়ি খেলাম। মাথা টনটন করে উঠল। ধ্রুব স্যার আমাকে দ্রুত আলোর কাছে নিয়ে গেলেন। পানি ভর্তি গ্লাস এগিয়ে দিলেন। পান করে কিয়ৎক্ষণ নেত্রযুগল গ্ৰথণ করে রইতে বলেন। তার কথ্যমত চোখ বন্ধ করে রইলাম। পরক্ষণেই মাথায় শীতলতা অনুভব করলাম। ধ্রুব স্যার আইস ব্যাগ এনে মাথায় প্রেস করছে। বেশ কিছুটা সময় অতিবাহিত হওয়ার পরে সবকিছু পরিষ্কার হয়ে উঠল।

মেঘমিশ্রিত পূর্ণিমা পর্ব ৭

“কেমন লাগছে?”
“ওকে স্যার!
কিন্তু আমি এখন বাড়িতে যাবো।” [মিনমিনে স্বরে]
বিলম্বে ভয়ংকর রুপ ধারণ করলেন। চোখ মুখ শক্ত করে টেনে টেনে বললেন,
“আমি তোমাকে একা পড়তে আসতে বলেছিলাম কি?”
“আমি আসলে..
“চুপ! একদম চুপ! আমি যেটা আস্ক করছি, সেটা বলবে‌।”
“হ্যাঁ!”
“ওদেরকে কেন নিয়ে এসেছ?এন্সার মি, ইডিয়েট।”

মেঘমিশ্রিত পূর্ণিমা পর্ব ৯