মেঘমিশ্রিত পূর্ণিমা পর্ব ৯

মেঘমিশ্রিত পূর্ণিমা পর্ব ৯
ইফা আমহৃদ

“তোমার সাহস তো কম নয় চড়ুই। তুমি ধ্রুবকে ডিভোর্স দিতে চাও। ধ্রুবকে। তুমি চাইলেই এত সহজে মুক্তি মিলবে? অসম্ভব, এটা তোমার দুর্সাহস।”
বলেই টেবিলের উপর ফাঁকা গ্লাসটা মুঠো করে চেপে ধরলাম। বিকট শব্দে ভেঙে গেল। আমি কেঁপে উঠলাম। অতিদ্রুত দু-হাতের সহায়তায় চেপে ধরলাম কর্ণধার। আর্তনাদ করলাম। ধ্রুব স্যারের হাত থেকে রক্তধারা গড়িয়ে পড়ছে। কাঁচের টুকরো এখনও হাতে। টেনে টেনে বললাম, “র-ক্ত। র-ক্ত। প্লীজ হাত সরান।”

তৎক্ষণাৎ হাতটা পেছনে লুকিয়ে ফেললেন। বোধগম্য হল হয়ত, আমার ব্লাড ফোবিয়া রয়েছে। আমি একটু শান্ত হওয়ার প্রচেষ্টা চালালাম। পরক্ষণেই ধ্রুবের কথনগুলো মাথায় নড়েচড়ে উঠল। নিশ্চয়ই আমার লেখা চিঠি তিনি পাঠ করেছেন। নতুবা এতটা জানা সম্ভব নয়। অধর জোড়া স্বল্প ব্যবধানে নাড়িয়ে না বোঝার স্বরে শুধালাম,
“আপনি কেন আমার ব্যক্তিগত জীবন নিয়ে নাড়াচাড়া করছেন? কেন আমার অনুমতি ব্যতীত চিঠি পড়েছেন?”
তিনি কোনো প্রতিক্রিয়া করলেন না। পেছনে দেয়ালের সাথে পিঠ ঠেকিয়ে ভারসাম্য বজায় রেখে বললেন, “তুমি যার জন্য লিখেছ, সে পড়ছে!”
“মানে..
“মানে তুমি ধ্রুবের জন্য লিখেছ, ধ্রুবই পড়েছে। সেই ধ্রুব আমি নই, কিন্তু ধ্রুব তো। তবে আমি ধ্রুবের কাছে পৌঁছে দিতে পারি।”

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

“কীভাবে?” [সন্দিহান কণ্ঠস্বর আমার]
“তুমি যেই ধ্রুবের কথা লিখেছ, সে আমার বন্ধু।”
“মিথ্যা বলছেন আপনি? একেই তো আমার অনুমতি ব্যতীত চিঠি পড়েছেন আবার মিথ্যা বলছেন।”
আমাকে থামিয়ে দিয়ে তিনি বলতে শুরু করলেন, “ওয়েট! ওয়েট! তোমার কোনদিক দিয়ে মনে হয়েছে আমি মিথ্যা বলছি।
ধ্রুব জার্মানে গেছে, আমিও জার্মানে ছিলাম। তার মায়ের নাম রমিলা। আমিও তাকে মা বলে ডাকি। আমি ধ্রুবের বেস্টফ্রেন্ট। তাই ছোটবেলায় ঘটে যাওয়া সবকিছু আমাকে বলেছে।”
আমি কিংকর্তব্যবিমূঢ়। ধ্রুব স্যার ধ্রুবের মায়ের নাম কীভাবে জানলেন। সত্যি ধ্রুব তার বেস্টফ্রেন্ড না-কি তিনিই ধ্রুব, আমার সাথে মজা করছেন। তার উত্তর পেলাম না। আমি গভীর ভাবনা থেকে বেরিয়ে এলাম। ধ্রুব নেই। আমি কৌতূহল হল নিয়ে সামনের দিকে অগ্ৰসর হলাম। একটা রুমের ভেতর থেকে শব্দ শ্রবণ হতেই সেদিকে গেলাম। ধ্রুব স্যার হাত ব্যান্ডেজ করছেন।
আমাকে দেখে কাবার্ড খুলতে বললেন। ইতস্তত বোধ নিয়ে কাবার্ড খুলতেই একটা প্যাকেট পেলাম। পুরো কাবার্ড ফাঁকা। তিনি আমাকে শাড়িটা পড়তে বললেন এবং আজ বাড়িতে যেতে নিষেধ করলেন। ধ্রুবকে নিয়ে কথা বললেন তিনি। আমিও নিজের ভেতরের অনুভূতি ধরে রাখতে ব্যর্থ হয়ে সম্মতি দিলাম।

রঙিন আলোয় আলোকিত হয়েছে উৎসব মুখর পরিবেশ। আমি দাঁড়িয়ে আছি ধ্রুব স্যারের পাশে। বাড়ি থেকে কয়েক মুহুর্তের দূরত্ব অবস্থিত উৎসবটি। সাইকেলে এসেছি এখানে। সাথে এনেছে টিফিন ক্যারিয়ার। ধ্রুব স্যার নিজের হাতে রান্না করেছেন। আগেই দু’টো টিকেট সংগ্রহ করেছেন। তাই টিকেট কাউন্টারে লাইন দিতে হলনা। টিকেট দেখিয়ে ভেতরে প্রবেশ করলাম। তেমন একটা ভিড় নেই। আমাকে নিয়ে ফুলে সজ্জিত রাস্তার উপর দিয়ে হাঁটতে লাগলেন তিনি। আলো নেই। পূর্ণিমার চাঁদ উঠেছে। চাঁদের স্নিগ্ধ আলোয় সবকিছু স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। চারিদিকে ফুলের সুবাস আসছে। ধ্রুব স্যার আমাকে নিয়ে বসালেন একটা টেবিলে। চারটে মোমবাতি জ্বলছে। তিনি মোমবাতি নিভিয়ে দিলেন। আমার সাথে মিলিয়ে তিনিও কালো রঙের শেরওয়ানি পড়েছেন। পূর্ণিমার আলোয় তার ধবধবে সাদা মুখটা দেখা যাচ্ছে। একদম স্নিগ্ধ। মাতাল করা চাইনি। আমি অস্বস্তি নিয়ে শুধালাম,

“আমরা হঠাৎ এখানে কেন এসেছি?”
“এই উৎসবটা বছরে একবার হয়। আমি দেশে ফেরার পর এই প্রথম। দু’টো টিকিট বুকিং করেছিলাম। মা নেই, একা আসার মজা নেই। তাই তোমাকে নিয়ে এলাম।
বসো, আমি স্টার্ফকে ডাক দিচ্ছি। এসে খাবার সার্ভ করে দিবে।”
ফট করে বললাম, “আমি দেই!”
“তোমাকে পাকনামি করতে বলেছি? না-তো। ধ্রুব শুনলে আমাকে আস্ত রাখবে না।”

বলেই ফোনে টাইপিং করলেন। মিনিটখানেকের মধ্যেই একজন সার্ভেন্ট এলেন। টিফিন ক্যারিয়ার খুলে সার্ভ করতে লাগলেন। তিনটা বাটিতে তিন আইটেম। নুডুলস, হালিম, পায়েস। সাথে লেবুর রস। টক, ঝাল, মিষ্টি একসাথে। টেবিলের মাঝবরাবর কোল্ড ডিঙ্কের বোতল রেখেছেন, সাথে চিকেন ফ্রাই। ধ্রুব স্যারের ফোন এল। তিনি ফোন রিসিভ করতে অন্যপাশে গেলেন। আমি দৃষ্টি ফিরিয়ে হালিমে লেবুর রস মিশিয়ে মুখে দিলাম। হালিম বরাবরই আমার ফেভারিট। টকের মাঝেও ঝাল লাগছে। নুডুলস মুখে দিতেই ঝালে স্বাদবদল হল। মরিচের অভাব ছিল কি-না বুঝতে পারলাম না। এত ঝাল। আমি দ্রুত মাঝখান থেকে বোতল নিয়ে একঢোক পান করলাম। গুলিয়ে উঠল দেহ। তিঁতকুটে ঢেকুর উঠল। পেটের ভেতরে মোচড় দিয়ে উঠল। ঝালের মাত্রা কয়েকগুন বৃদ্ধি পেল। চোখ ঝাপসা হল। আমি অতিদ্রুত আরও এক ঢোক পান করলাম। পরক্ষণেই বোতল ফাঁকা। কিন্তু বিপরীতমুখী কাজ করছে। বোতল রেখে পায়েসের বাটি তুলে নিলাম। কয়েক চামচ মুখে তুলতেই শান্তি। ঝাল কমে এল। ইতোমধ্যে চোখের কণা পূর্ণ হয়ে এসেছে। মাথা চেপে বসে রইলাম।
তৎক্ষণাৎ ধ্রুব স্যার এলেন। চাঁদের আলোয় ততটা মুখ দেখতে পেলেন না আমার। কৌতূহলী হয়ে বললেন,

“এনিথিং রং? আর ইউ ওকে?”
“ফাইন, কিন্তু একটু পানি।”
ধ্রুব স্যার বোতল থেকে পানি ঢালতে গেলেন গ্লাসে। বোতল ফাঁকা। সন্দিহান হয়ে নাকের কাছে এনে স্মেল নিলেন। গম্ভীর গলায় বললেন,
“এটা এখানে কেন? কে এনেছে? তুমি কি এটা খেয়েছ?”
দাঁত কেলিয়ে বাচ্চাসুলভ কণ্ঠে বললাম, “না। খেতে পারিনি। এইটুকু ছিল। একদম এইটুকু। তুমি আবার অর্ডার দাও না!”
“অ্যাহ! তুমি এভাবে কথা বলছ কেন? আবার আমাকে তুমি করে বলছ।”
মুখ থেকে কথা কেড়ে নিয়ে বললাম, “হ্যাঁ তো! বলবই তো। যা ইচ্ছে তাই বলব। আমি তো প্রজাপতি। উড়তে পারি আকাশে। আপনি আমাকে কিচ্ছু বলতে পারবেন না, আমি তার পূর্বেই উড়ে যাবো। আমার ডানা গজিয়েছে। হি! হি! হি!”

বলেই হাত মেলে দিলাম। শাড়ির দরুন আঁচলটা ডানার চেয়ে কম লাগছে না। হি হি করে হাসছি। ধ্রুব স্যার এগিয়ে আসতে চাইলেই পিছিয়ে গেলাম আমি। লাফ দিয়ে চেয়ারে উঠলাম। হাতলের উপর উঠতেই ধপাস করে চেয়ার সমেত নিচে পড়লাম। আমি ওষ্ঠদ্বয় ঈষৎ ফাক করে পূর্বের অবস্থায় চেয়ারে রইলাম। নড়াচড়া নেই। আমার হাত ধরে উঠানোর প্রয়াস করলেন। আমি উঠলাম না। উল্টো হাত পা ছড়িয়ে ছিটিয়ে শুয়ে পড়লাম। তৎক্ষণাৎ উপস্থিত হল স্টার্ফরা। হাঁপাতে হাঁপাতে বলল,
“এনি প্রবলেম স্যার?”
রাগান্বিত স্বরে বললেন, “দেখতে পারছেন না কী প্রবলেম। আমি কি ডিঙ্ক অর্ডার করেছি? তাহলে ডিঙ্ক কেন এনেছেন?”
“স্যার ডিঙ্ক তো অর্ডার করা হয়েছে!”

“কে অর্ডার করেছে ভুতে? আমি কিংবা আমার ওয়াইফ তো করব না। তাহলে কে করবে?”
অবিলম্বে একজন স্টার্ফ এসে টেবিল নং ঠিক করে দিলেন। ক্ষমা চাইলেন ধ্রুব স্যারের কাছে। টেবিল নং নয় এবং টেবিল নং ছয় এলোমেলো হয়ে গেছে। ধ্রুব কিছু বললেন না, পরবর্তীতে দেখে নিবেন। আমি সবকিছু দেখতে লাগলাম। কিছুই মাথায় ঢুকছে না। গান গাইতে ইচ্ছে করছে। গলা ফাটিয়ে চিৎকার দিলাম,
“সদরঘাটে যাইও নাআ…
কেন যাবো না, বলো না।
সদরঘাটের মাইয়ারা দেয় লুঙ্গি ধইড়া টান। এক নিমেষে যাইবে মান সম্মান। বুঝছ, এরজন্য যাবে না।”
ওষ্ঠদ্বয় মিলিয়ে গেল একে অপরের সাথে। ধ্রুব স্যার তার বলিষ্ঠ পুরুষালি হাতের সহায়তায় মুখ চেপে ধরেছেন। আমি ছলছল চোখে চেয়ে রইলাম। তিনি অসহায় কণ্ঠে বললেন, “প্লীজ চড়ুই। প্লীজ। কাকের মত কা কা করো না। সবাই পালিয়ে যাবে!”

“আপনি আমাকে কাক বলছেন?”
“না, আমি তো তোমার প্রশংসা করছি।”
“সত্যি বলছেন তো?” [ সন্দিহান গলায়]
“আমি তোমাকে মিথ্যা বলতে পারি? এবার উঠো!”
ধ্রুব স্যার উঠানোর প্রচেষ্টা করতে লাগলেন। কোমরে আঘাত পেয়েছি। আমি ঠোঁট উল্টো বাচ্চাসুলভ আচরণ করে বললাম, “ব্যথা পেয়েছি!”
“আচ্ছা কষ্ট করে উঠো। ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাবো।”
“না, আমাকে কোলে নিতে হবে। তাহলে সুস্থ হব। প্লীজ!”
ধ্রুব তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে স্টার্ফদের দিকে অবলোকন করে আমাকে কোলে তুলে নিল। টেবিলে বসিয়ে হাতে একটা গ্লাস তুলে দিল। আমি মুখ কুঁচকে বললাম, “খাবো না, ওটা খাবো।”

মেঘমিশ্রিত পূর্ণিমা পর্ব ৮

“ওটা পঁচা, গন্ধ। এটা খাও আবার কোলে নিবো।”
“না, ওটাই খাবো।” ন্যাকা কান্নার স্বরে।
ধ্রুব স্যার আমাকে শান্তনা দিয়ে বোতল নিয়ে স্টার্ফদের হাতে দিলেন। ফিসফিসিয়ে কিছু একটা বললেন। আমি কান খাড়া করে শোনার প্রয়াস করলাম। কিন্তু কিছুই শুনতে পাচ্ছি না। চোখের সাথে কানেরও কি বারোটা বাজল?

মেঘমিশ্রিত পূর্ণিমা পর্ব ১০