মেঘমিশ্রিত পূর্ণিমা পর্ব ১০

মেঘমিশ্রিত পূর্ণিমা পর্ব ১০
ইফা আমহৃদ

রাত্রির মধ্যভাগে পৌঁছেছে। পূর্ণিমার চাঁদ একটু বেশিই প্রজ্বলিত। স্নিগ্ধ আলো প্রকট। গালে হাত রেখে এদিক ওদিক ছোট ছোট দৃষ্টিতে চেয়ে আছি। ধ্রুব স্যার পাশে অসহায় হয়ে বসে আছেন। ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়ালাম। পা ব্যথা করছে। চোখজোড়া গ্ৰথণ হয়ে আসছে আপনাপনি। আমি হাতের সহায়তায় বড়ো বড়ো করে টেনে ধরলাম চোখের পাতা। অগ্ৰসর হলাম সামনের দিকে। ধ্রুব স্যারও এলেন পিছু পিছু। শাড়ির অবস্থা নাজেহাল। কুঁচিগুলো খুলে ঝুলে পড়েছে নিচে। পায়ে বেঁধে হোঁচট খেয়ে পড়ে যেতে নিলেই বলিষ্ঠ পুরুষালি হাতের সাহায্যে বেষ্টিত করে নিলেন। বিরবির করে বললেন,
“ফোন নিয়ে আসাই ভুল হয়েছে। না কল আসত, না রিসিভ করতে যেতাম। না এমন পরিস্থিতির সম্মুখীন হতাম। ইচ্ছে ত করছে।”
“আইসক্রিম খাবো।”
“কী?”
আঙুল দিয়ে ইশারা করে বললাম, “ঐযে আইসক্রিমওয়ালা। আইসক্রিম খাবো।”
“এখন নয়, পরে।”

বায়না ধরেছি। হাত ছাড়িয়ে বসে পড়লাম নিচে। আদুরে গলায় বললাম এখনই। আদুরে আবদার। ধ্রুব স্যার কোনো উপায় না পেয়ে বাধ্য হয়ে, আইসক্রিম কিনে দিলেন। এদিকে শাড়ির কুঁচিগুলো খুলে যাচ্ছে ক্রমশ। আমাকে নিয়ে দ্রুত পাশের নাগরদোলায় উঠলেন। আমি আইসক্রিম খেতে লাগলাম। নাগরদোলা চলন্ত হলেই খামচে ধরলাম ধ্রুব স্যারের হাত। উপরে গিয়ে স্থির হল। তিনি তৎক্ষণাৎ আমার হাত ছেড়ে ঝুঁকলেন। ধীরে ধীরে কুঁচিগুলো গুছিয়ে গুঁজে দিলেন। কেঁপে উঠলাম আমি। ধ্রুব স্যারকে দৃঢ় বাঁধনে আঁকড়ে ধরে রইলাম। এদিকে নাগরদোলা চলন্ত হল পুনরায়। মাথা ঘুড়তে লাগল। এমনিতেই ওটা খাওয়ার পর থেকেই হেসে যাচ্ছি, সাথে মাথা ঝিম ধরে আছে। এখন একটু বেড়েই গেল। আমি মাথা চেপে ধরলাম। তিঁতকুটে ঢেকুর উঠল। শরীরটা গুলিয়ে উঠল। আমি গলা চেপে ধরলাম। পরক্ষণেই বমি করে দিলাম ধ্রুব স্যারের কালো পাঞ্জাবিতে। তিনি কিছু বললেন না, যেন এটা হওয়ারই ছিল। বরং তার পকেট থেকে রুমাল বের করে মুখ মুছিয়ে দিলেন। সবকিছু ক্রমশ ঝাঁপসা হতে লাগল। দেহটা জমে গেল শীতলতায়। নেত্রযুগল গ্ৰথণ করতেই শরীরটা হালকা হয়ে গেল। সমস্ত ভর ছেড়ে দিলাম ধ্রুব স্যারের উপর। মস্তিষ্ক অচল হয়ে গেল। ঢুবে গেল আঁধারে। জ্ঞান হারালাম সেখানে। আর কিছু মনে নেই।

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

জ্ঞান ফিরতে নিজের বেডের উপর অনুভব করলাম।‌ এসি অন করা। ব্লাঙ্কেট দিয়ে শরীর মুড়িয়ে রাখা হয়েছে। হাই তুলে ব্লাঙ্কেট সরিয়ে উঠে বসলাম। অচেনা রুমে নিজেকে আবিষ্কার করলাম। তবে অসুবিধে হল না, ধ্রুব স্যারের বাড়ির একটি কক্ষ। দেয়াল ঘড়ির দিকে অবলোকন করে বোধগম্য হল এখন এগারোটা সাত বাজে। আমি তো সাধারণ এতসময় ঘুমাই না। আজকে কেন এত সময় ঘুমিয়েছি। পরক্ষণেই কালকে রাত্রে ঘটে যাওয়া ঘটনাগুলো স্মৃতির পাতায় প্রকট হল। আমাকে কীভাবে এখানে এনেছে তিনি। ডেসিং টেবিলের বড়ো আয়নায় নজর আঁটকে গেল। পড়নে ঢিলেঢালা সবুজ রঙের কামিজ। এমা! আমার শাড়ি কোথায়? ধ্রুব স্যার কিছু করেনি তো! তিনিই বা কোথায় গেছেন। মাথাটা এখনও ঝিমঝিম করছে। কী খেয়েছিলাম।
আমি ওয়াশরুমের উদ্দেশ্য পা বাড়ালাম। বাড়ি ফিরতে হবে, নিশ্চয়ই মামুনি চিন্তা করছেন। অবশ্য কালকে রাতে একবার ফোন করে বলেছিলাম, বাড়িতে ফিরব না।
কাবার্ড খুলে কালকে পড়ে আসা সালোয়ার কামিজ বের করলাম। চোখ বন্দী হল পাশেই একটা পেপারের দিকে। আমি হাতে নিলাম। এটা তো আমার পরীক্ষার পেপার। যেগুলো মিসিং ছিল, তাহলে এখানে কী করছে। পেপারগুলো মেলতেই দেখলাম ধ্রুব স্যারের সাইন করা। শেষের ফাঁকা পাতায় লেখা,

“যেমন তোমার হাতের লেখা তেমনি বর্ণনা। মাত্র তিন মার্ক দেওয়া সম্ভব নয়। চল্লিশ দিলেও কম। কিন্তু ত্রিশে পরীক্ষা। তাই নিজের কাছে রেখে দিলাম।”
কিংকতব্যবিমূঢ় হলাম। বেশি মার্ক পাওয়ার উপযুক্ত বলে পেপাই মিসিং করে দিলেন তিনি। ব্যাগে জামা কাপড় নেওয়ার সাথে পেপারগুলোও নিয়ে নিলাম। বাড়ির উদ্দেশ্যে বেরিয়ে এলাম। গার্ডরা কিছুতেই আসতে দিবে না। ধ্রুব স্যার বারবার বলে গেছেন, আমাকে যাতে যেতে না দেয়। তিনি ভার্সিটিতে গেছেন।

মাঝখানে অতিবাহিত হয়েছে দু’দিন। যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন ছিল পুরোপুরি। ভার্সিটিতে যাইনি। ফোন করলে রিসিভ করিনি। দুদিনে নিজেকে প্রস্তুত করে নিয়েছি। পূর্বের ন্যায় দিনগুলো অতিবাহিত করব। ধ্রুব তো আমায় চায়না। তাহলে কেন ধ্রুব স্যারের থেকে ধ্রুবের খবর নিবো। এতে কষ্ট বাড়বে বৈ কমবে না। পড়াশোনায় মনোযোগ স্থাপন করেছি।
আজ ভার্সিটিতে এসেছি। আমার সাথে এসেছে বাবুই। এইচএসসি পরীক্ষার পর সেও এই ভার্সিটিতে ভর্তি হতে চায়। দেখতে এসেছে। একপ্রকার জোর করেই এনেছি। নাহলে দু’দিন ভার্সিটিতে না আসার কারণ, সেদিন কোথায় ছিলাম, ফোন কেন রিসিভ করিনি, হ্যাত ত্যান। তৌফিক বাবুইয়ের সাথে মজার ছল করে বলল,
“মামুনি কোন ক্লাসে পড় তুমি?”
নিরব তৌফিকের কাঁধে মৃদু শব্দে চপল মে’রে বলল, “শা’লা, ওর বোন তোর বন্ধু হলে ও কেমনে তোর মামনি হয়?”

“মামা, ঢং করিস না। তুই আমার মামা, চড়ুই আমার মামনি হয়। মামনির বোন তো মামনিই হবে। তাছাড়া আমি ওরে প্রেক্টিস করাচ্ছি, কিছুদিন পর রাস্তায় বখাটেরা ধরলে যাতে নার্ভাস না-হয়!”
তৌফিক উল্টো পাল্টা যুক্তি উপস্থাপন করল। মুহুর্তেই হাসির রোল পড়ল। বাবুই চরম বিরক্ত হল। মুখ শক্ত করে বলল,
“শুনো, আমি তোমার চেয়ে বেশি ছোট না। বুঝছ? পাঁচ বছরও হবে না। আমাকে একদম মামুনি বললে না।”
“তাহলে কি বাবু বলল?”
“আমি বাবুও না। তুমি চুপ করো। তোমার নাম তৌফিক। কিন্তু তুমি মোটেও তেমন নয়। সারাক্ষণ বকবক করো।”

বলেই বাবুই উঠে গেল। ক্যাম্পাসের দিকে গেল হাঁটা চলা করতে। ফোন আছে বিদেয় হারিয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা নেই বললেই চলে। বাবুই চোখের আড়ালে যেতেই নিরব রাগান্বিত কণ্ঠে বলে, “তুই জীবনেও মানুষ হবি না, শা’লা। জীবনেও না। চিনিস না, জানিস না। মেয়েটার পেছনে লেগে গেলি।”
“তো! কী করব, বসে থাকব? প্রিয়া হবু জামাই পেয়ে আমগো ভুলে গেছে। তুই মারিয়ারে নিয়ে পালিয়ে যাওয়ার ধান্দায় আছিস। চড়ুইয়ের অবস্থা ভালো নয়, ধ্রুব স্যারের সাথে তার বেশ ভাব। আমি আর আঁখি খরচার খাতায়। তাই যারে পাই, লাইন মা’রার চেষ্টা করি। তোর বোনকে দিস, তাইলে আর লাইন মা’রব না। শোন তোর গার্লফ্রেন্ড আছে, আমারে শা’লা ডাকবি না, দুলাভাই ডাকবি। নতুবা কেমন জানি লাগে। ট্রিট হিসেবে আগামী বছর, তোরে মামা ডাক শুনামু। রাজি?”
দাঁতে দাঁত চেপে নিরব বলে, “দাঁড়া তোরে বিয়া করাইতেছি।”
তৌফিক সময় অতিবাহিত না করে সর্বশক্তি প্রয়োগ করে ছুটল। তার পিছুপিছু ছুটল নিরব। বিস্ময়ে তাকিয়ে থেকে একত্রে হেসে উঠলাম আমি।

বেল বেজে উঠল। ক্লাসের উদ্দেশ্য পা বাড়ালাম আমি, আঁখি আর প্রিয়া। ‘গুড মর্নিং’ বলে ধ্রুব স্যার প্রবেশ করলেন। তিনি শব্দ করে হাঁটা পছন্দ করেননা। তাই তার উপস্থিতি সহজে অনুমান করা সম্ভব নয়। সর্বপ্রথমে তার দৃষ্টি আমার নিকট নিবদ্ধ হল। তীক্ষ্ণ দৃষ্টি তার। এই দৃষ্টির মানে কি? কী এমন করেছি, বুঝতে পারলাম না। অতঃপর বাবুইয়ের দিকে তাকিয়ে সোজাসাপ্টা বললেন, “তুমি কে? তোমাকে তো আগে দেখিনি। বয়সও কম। কোন ক্লাস?”
নতকণ্ঠে বলি, “আমার বোন।”
“আমার জানামতে তোমার কোনো বোন নেই।” [সন্দিহান স্বরে]
“মামাত বোন।”
‘হম’ বলে বসতে বললেন তিনি। টেবিলের উপর বসে বললেন,
“আমি সাতদিনের ছুটি নিয়েছে। মার্চের দুই তিন তারিখ থেকে কার্যকর হবে। ফিরতে ফিরতে তোমাদের পরীক্ষা শুরু হয়ে যাবে। তাই তোমরা মন দিয়ে পড়বে। পরীক্ষা শেষেই কিন্তু টুরে যাবো। রেজাল্ট ভালো না হলে যেতে ইচ্ছে করবে না। মনে থাকবে?”
অবিলম্বে চ্যাঁচামেচির সূচনা হল। ধ্রুব স্যারের ভার্সিটিতে আগমনের পর থেকে স্টুডেন্ডদের অনুপস্থিত হার কমে গেছে। পড়াশোনাও করে, কখন কোন প্রশ্ন ধরে, না পারলে প্রেস্টিজ পাংচার। তাই! সবার মাঝখান থেকে মাহি দাঁড়িয়ে বলল,
“প্লীজ স্যার, আপনি যাবেন না।”

ধ্রুব স্যার টেবিলের উপর করতলের সাহায্যে আঘাত করে বললেন, “সাইলেন্ট, আমি যাচ্ছিনা। গ্ৰামে যাচ্ছি কিছুদিনের জন্য। কত বছর পর দেশে ফিরেছে, দাদা দাদি আছে। দেখা করব।
এবার আসা যাক মেন পয়েন্টে, যে কারণে তোমাদের বলা। অনেকেই এখনো আইডি কার্ড সংগ্রহ করনি। আমি প্রিন্সিপাল স্যারের কাছে রেখে যাবো। তোমরা সংগ্রহ কর।”
আইডি কার্ড মস্তিষ্কে হানা দিতেই দ্রুত আঁখিকে বললাম, “কীসের আইডি কার্ড?”
“ধ্রুব স্যারের কাছে আমাদের আইডি কার্ডের দায়িত্ব ছিল না, এটা!”
স্যার ক্লাসে মনোনিবেশ করলেন। সবাই উৎসাহ নিয়ে ক্লাসে মনোযোগী। মনোযোগী কি আর তার পড়ার জন্য? তাকে দেখতেই ব্যস্ত।

মেঘমিশ্রিত পূর্ণিমা পর্ব ৯

ক্লাস শেষে প্রস্থান করার সময়ে আমার আইডি কার্ডটা হাতে ধরিয়ে দিলেন। মিসেস চড়ুই দেখে চমকে উঠলাম। ফট করে স্যারের মুখশ্রীর দিকে তাকিয়ে কৌতূহলী স্বরে বললাম,
“মিসেস চড়ুই কেন?”
“ভুল থাকলে কেবিনে এসে ঠিক করে নিও। অন্য টিচারের ক্লাস এখন।”

মেঘমিশ্রিত পূর্ণিমা পর্ব ১১