পারলে ঠেকাও পর্ব ১৯

পারলে ঠেকাও পর্ব ১৯
লেখিকাঃ দিশা মনি

ছদ্মবেশ নিয়ে হাসপাতালে প্রবেশ করেছে মধুজা ও সিরাজ। আজ তারা দুজন দরিদ্র সেজে এসেছে। দুজনে পরিকল্পনামাফিক অক্ষরের চেম্বারে এসে বসে। তাদের পালা আসতেই মধুজা ভেতরে যায়। অক্ষর মধুজাকে দেখামাত্রই চিনতে পারে। ভেতরে অক্ষরের একজন সহযোগী ছিল জন্য সে কিছু বলে না। মধুজার কথামতো তাকে না চেনার ভান করে পরীক্ষা নিরীক্ষা করে এবং তাকে কিছু চেকআপ করতে দেয়।

মধুজা বাইরে আসে। সিরাজের সাথে চলে যায় এক্স রে করতে। আজ সিরাজ মধুজার বাবা সেজে এসেছে। এইজন্য তাকে বয়স্ক মানুষ সাজতে হয়েছে। এক্স রে করা হয়ে গেলে সিরাজ মধুজার কথামতো হাসপাতালের কিছু কর্মকর্তাকে শুনিয়ে শুনিয়ে বলতে থাকে,
‘তুই চিন্তা করিস না মা। আল্লাহ আছে৷ দেখিস তোর কিছু হবে না। আমরা গরীব মানুষ আল্লাহ আমাদের সাথে অন্যায় করবে না।’
কথাগুলো বলতে বলতে চলে আসে তারা। এক্স রে রিপোর্ট আসার পর সেই রিপোর্ট নিয়ে অক্ষরের কাছে যায় মধুজা। অক্ষর সেই রিপোর্ট দেখে বলে,

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

‘এই রিপোর্ট অনুযায়ী তোমা,,, আই মিন আপনার হার্টে ব্লক আছে। অপারেশন করতে হবে।’
রিপোর্টটা দেখে অক্ষরের চোখ ছানাবড়া হয়ে যায়। কারণ মধুজার এরকম কোন সমস্যা হওয়ার কথা না। তার মানে মধুজার ধারণাই ঠিক। এখানে দরিদ্র মানুষকের টার্গেট করে ভুলভাল রিপোর্ট দেওয়া হয়। সুস্থ মানুষকে অসুস্থ প্রমাণ করে তাদের অপা’রেশনের নামে তাদের হার্ট, কিডনির মতো গুরুত্বপূর্ণ অর্গান বের করে নিয়ে সেগুলো বিক্রি করা হয়।
রাগে নিজের হাত মুষ্টিবদ্ধ করে নেয় অক্ষর। অসহায় মানুষদের সাথে যারা এমন ধোকাবাজি করে তাদের প্রতি ঘৃণায় তার গা গুলিয়ে আসে।

মধুজা কোন কিছু না বলে বেড়িয়ে আসে। এখন তাদের প্রধান উদ্দ্যেশ্য হলো যে করেই হোক আসল অপরাধীকে সামনে আনা। তার জন্য এখন অপেক্ষা করতে হবে অপারেশন পর্যন্ত।
অক্ষরের কেবিন থেকে বাইরে এসে মধুজা দেখতে পায় ডাক্তার কেয়াকে। ডাক্তার কেয়া ফোনে কারো সাথে কথা বলছিল। মধুজা গোপনে কথা শোনার চেষ্টা করে। তেমন কিছু শুনতে পায়না। শুধু এটুকুই শুনতে পায় যে কেয়া কাউকে বলছে,
‘নতুন একজনকে পেয়েছি।’

এটুকু শুনেই মধুজা আন্দাজ করে নেয় তার ব্যাপারেই কথা বলা হচ্ছে। মধুজা মনে মনে বলে,
‘১০ দিন পর অপারেশনের ডেট ফিক্সড করা হয়েছে। সেদিনই তোমাদের সবাইকে পাকড়াও করা হবে। কোন চিন্তা করোনা। ‘

মধুজা ও অক্ষর রুমে বসে আছে। চিন্তায় দুজনের ঘুম আসছে না। ইতিমধ্যেই নয় দিন অতিবাহিত হয়েছে। আর মাত্র ১ দিন পর অপা’রেশন করার কথা। মধুজা অক্ষরকে জিজ্ঞেস করে,
‘আচ্ছা হাসপাতালে সন্দেহভাজন কাউকে কি আপনার নজরে পড়েছে?’
অক্ষর অনেক ভেবে বলে,
‘তেমন কিছু না তবে ডক্টর কেয়াকে আমি কয়েকবার ডক্টর রাহেলা খানমের সাথে কথা বলতে দেখেছি।’
‘তিনি কে?’

‘তুমি জানো হসপিটালটি একটি বেসরকারি হসপিটাল। এই হসপিটালের প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন মিস্টার কবীর হুসাইন। কবীর হুসাইনের শ্যালক রুহুল আমিন বর্তমানে হাসপাতালের দায়িত্বে আছেন। আর রাহেলা খানম হচ্ছেন কবীর হুসাইনের স্ত্রী। আজ থেকে দশ বছর আগে একটি দূর্ঘটনায় কবীর হুসাইন মারা যান। তারপর রাহেলা খানম বিদেশে চলে যান। তারা নিঃসন্তান ছিলেন, তাই রাহেলা খানম নিজের ভাইকে হাসপাতালের দায়িত্ব দিয়ে চলে যান। রাহেলা খানম লন্ডনে একটি হসপিটালে ছিলেন এতদিন। মাঝে মাঝে দেশে আসতেন। এখন একেবারের জন্য চলে এসেছেন।’

‘বুঝলাম। আচ্ছা ডক্টর রাহেলা খানমের সাথে আগে থেকেই কি ডক্টর কেয়ার ঘনিষ্ঠতা ছিল।’
‘হুম। রাহেলা খানম যতবার দেশে আসতেন ডক্টর কেয়া ততবারই তার কাছাকাছি থাকত। এমনকি ডক্টর কেয়া মাঝে মাঝে বিদেশে গিয়েও রাহেলা খানমের সাথে দেখা করেছে বলে আমি শুনেছি।’
‘আমার সন্দেহ যদি ঠিক হয় তাহলে ডক্টর রাহেলাও এসবের সাথে জড়িত থাকতে পারে। তবে কোন প্রমাণ ছাড়া আমরা এভাবে কাউকে এলিগেশন দিতে পারি না। আমাদের আগে বিষয়টা নিয়ে ভালোভাবে ভাবতে হবে।’

অক্ষর ও মধুজা বিছানায় শুয়ে পড়ে। তাদের মাঝখানে একটা কোল বালিশ ছিল। মধুজাই কোল বালিশটিকে জড়িয়ে ধরে থাকে। কিছুক্ষণ পর অক্ষর বালিশটি সরিয়ে দেয়। মধুজা বুঝতে না পেরে অক্ষরকেই জড়িয়ে ধরে। অক্ষরও মধুজাকে নিজের দুই বাহুতে আবদ্ধ করে নেয়। মধুজা এবার চোখ মেলে তাকায়। অক্ষরকে এভাবে দেখে ইতস্তত বোধ করলেও কিছু বলে না। অক্ষর মধুজার কপালে নিজের ভালোবাসার স্নিগ্ধ পরশ একে দেয়।

ধীরে ধীরে আরো কাছে আসে তারা। অক্ষর অনেক কাছে চলে আসায় মধুজা বেশ ঘাবড়ে যায়। অক্ষর বুঝতে পেরে কিছুটা সরে আসে। মধুজাকে উদ্দ্যেশ্য করে বলে,
‘তুমি না চাইলে আমাদেরও মাঝে কিছুই হবে না। আমি চাই তুমি নিজে থেকে এসে আমার কাছে ধরা দেও। তাই আমি জোর জবরদস্তি করব না। তোমাকে আমি অনেক সময় দিয়েছি, সামনেও দেব। কারণ আমি জানি অপেক্ষার ফল মিষ্টি হয়। তবে তোমার কাছে একটাই অনুরোধ করব। বেশি দেরি করে ফেলোনা। যাইহোক তোমার জন্য একটা গিফট আছে।’

‘কি গিফট?’
অক্ষর মধুজাকে নিজের পকেট থেকে একটি গোলাপ বের করে দেয়। মধুজা খুব খুশি হয় গোলাপটি পেয়ে। অক্ষর আরো একটি গোলাপ বের করে মধুজাকে প্রপোজ করে। মধুজা পুরো অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে।
অক্ষর মৃদু হেসে একটি চকলেট বের করে মধুজাকে দিয়ে বলে,
‘এই নাও আজ চকলেট ডে তে তোমার জন্য ক্যাটব্যারি ডেইরি মিল্ক এনেছি। এই ক’দিন ব্যস্ত থাকায় তোমার সাথে রোজ ডে আর প্রপোজ ডে সেলিব্রেট করতে পারি নি। তবে এখন থেকে কিন্তু সেলিব্রেট করব। প্রতিটা দিন এখন থেকে আমরা সেলিব্রেট করব।’

রাত এখন ১১ টা, মধুজা গভীর ঘুমে আছন্ন। অক্ষরের ঘুম ভেঙে যাওয়ায় সে একটু ছাদে চলে আসে। রাওনাফ নিজের বোনের ছবি বুকে আগলে ছাদেই দাড়িয়ে ছিল। অক্ষরকে দেখে সে চলে যাচ্ছিল তখন অক্ষর বলে,
‘তোমার বোনকে খুব মিস করো তাইনা?’
রাওনাফ কান্নাজড়িত গলায় বলে,

‘অনেক বেশি মিস করি। আপুর সাথে কা’টানো সব মুহুর্ত আমার এখনো মনে পড়ে। একসাথে স্কুলে যাওয়া,খুনশুটি, মা’রামারিগুলো খুব মনে পড়ে। কিছু মানুষের লোভের কারণে সব শেষ হয়ে গেল।’
‘হুম। তুমি এসব নিয়ে ভেবো না। আসল অপরাধীরা অবশ্যই সাক্ষী পাবে।’

‘আপনাকে কিছুদিন থেকে একটা কথা বলতে চাই। কিন্তু নিজের জড়তার কারণে বলতে পারছি না। আমি আপনাকে ভুল ভেবেছিলাম যে আমার বোনের মৃত্যুর পেছনে হয়তো আপনার হাত আছে। সেই জন্যই আপনার উপর প্রতিশোধ নিতে চেয়েছিলাম। আপনাকে প্রাণে মা’রারও চেষ্টা করি। সবকিছুর জন্য আমি ক্ষমা চাইছি। কোন কিছু বিচার না করে প্রতিশোধের নেশায় অন্ধ হয়ে গেছিলাম।’
অক্ষর রাওনাফের মাথায় হাত বুলিয়ে বলে,

‘তুমি অনেক ছোট। কোন কিছু বিচার বিবেচনা করার ক্ষমতা তোমার কম। তবে তোমার একটু সচেতন হওয়ার প্রয়োজন ছিল। তোমার মা-বাবা কোথায়? তারা কিছু জানে না এই ব্যাপারে?’
রাওনাফ মাথা নিচু করে বলে,

‘আমি মা-বাবাকে কিছু না বলে বাড়ি থেকে পালিয়ে এখানে এসেছি। আমার লক্ষ্য ছিল প্রতিশোধ নেওয়া। আসলে আমাদের গ্রামেরই একটি মেয়ে আপনাদের বাড়িতে আগে কাজ করত। হঠাৎ করে মেয়েটির বিয়ে ঠুক হয়ে যাওয়ায় সে কাজ ছেড়ে চলে আসে। গ্রামে এসে আমাদের বলেছিল কেউ কাজ করতে চাইলে আসতে পারি এখানে। সেইদিন আমি ওর থেকে ঠিকানা নিয়ে এখানে চলে আসি। আপনার মার সাথে কথা বলে এখানে কাজ করতে শুরু করি।’

‘সবকিছু বুঝতে পারলাম। আমি তোমাকে বলব এখন তোমার ফিরে যাওয়া উচিৎ। তোমার মা-বাবা তাদের এক মেয়েকে হারিয়েছে এখন তুমিও এভাবে দূরে থাকলে তাদের অবস্থা কেমন হবে সেটা বোঝার চেষ্টা করো।’
‘আমিও ফিরে যেতে চাই।’

পারলে ঠেকাও পর্ব ১৮

‘আমি ব্যবস্থা করে দিবো।’
কথাটা বলেই অক্ষর ছাদ থেকে নিজের রুমে চলে আসে।

পারলে ঠেকাও পর্ব ২০