প্রণয়াসক্ত পূর্ণিমা পর্ব ৪৯

প্রণয়াসক্ত পূর্ণিমা পর্ব ৪৯
Writer Mahfuza Akter

ড. অরিত্রী সেহরীশ!
দরজার ওপর লেখা নামটায় নিজের আঙুল স্পর্শ করিয়ে আনমনেই হাসলো অর্ণব। নব ঘুরিয়ে ভেতরে ঢুকতেই দেখলো, পুরো ঘর বেশ অন্ধকার। জানালার মোটা পর্দা ভেদ করে ক্ষীণ আলো ভেতরে প্রবেশ করছে। নিজের হাতে কপাল চাপড়ালো অর্ণব। বিরবির করে বললো,
“নাহ, এই মেয়ে শুধরাবে না!”

ঘরের দুপাশের দুটো জানালার পর্দা টেনে দিতেই পুরো ঘর আলোয় ঝলমল করে উঠলো। শুভ্র দেয়ালে পেশাগত ডাক্তারি পোশাকের হাস্যোজ্জ্বল মেয়েটির দিকে কিছুক্ষণ অপলক চেয়ে রইলো অর্ণব। ভ্রম কাটতেই সপ্রতিভ চোখে তাকালো সে। দুরন্ত পায়ে বেডের দিকে যেতে বললো,
“ঘুম থেকে কি আজ উঠবি না? বেলা কয়টা বাজে খেয়াল আছে? আংকেল আর আন্টি ডেকে হয়রান হয়ে গেছে তোকে ডাকতে ডাকতে!”

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

বেডে থাকা ঘুমন্ত দেহটা হালকা নড়েচড়ে কম্বল মুড়ে উল্টো ঘুড়ে শুয়ে পড়লো। অর্ণব প্যান্টের পকেটে হাত ঢুকিয়ে চোখ ছোট ছোট করে চেয়ে রইলো কিছুক্ষণ। হঠাৎ কম্বল টেনে সরিয়ে বললো,
“ডিউটি আছে না তোর? পেশেন্টরা তোর জন্য ওয়েট করবে? আমারও মিটিং আছে। উট তাড়াতাড়ি!”
ঘুমন্ত মেয়েলি সুর ভেসে এলো হঠাৎ,
“কাম অন, ইয়ার! কাল সারাদিন ওটি-তে ছিলাম। আ’ম সো টায়ার্ড। আজ সারাদিন ঘুমাবো আমি!”
অর্ণব ঘড়ি দেখলো। নাহ্, আর দেরি করা যাবে না! তাহলে সে নিজেই লেইট হয়ে যাবে। তাই ঘর থেকে বেরিয়ে যেতে যেতে বললো,

“আচ্ছা, ঘুম ভাঙলে আফনাদ আঙ্কেলের বিপিটা একটু চেক করিস। প্রেশার বেড়েছে মনে হয় ওনার! বারবার তোর কথা জিজ্ঞেস করছিল, বলছিলো অরিত্রীকে ডেকে দিতে। বেশ অসুস্থ লাগছে বলছিলো আমাকে।”
অরিত্রী কম্বল সরিয়ে এক ঝটকায় উঠে বসলো। অক্ষিগোলক বড় করে তাকিয়ে চকিত কন্ঠে বললো,
“হোয়াট? এটা তুমি আমাকে আগে বলোনি কেন?”

উত্তর এলো না। অর্ণব মিটমিট করে হাসতে হাসতে বেরিয়ে গেল ঘর থেকে। অরিত্রী তড়িৎ গতিতে বিছানা ত্যাগ করে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। ছুটে এলো ডাইনিং রুমে। এলোমেলো দীর্ঘ চুলগুলো মুখে গায়ে লেপ্টে যেতেই সেগুলো ঠিক করার চেষ্টা করলো সে। সামনে তাকিয়ে দেখলো, মিস্টার আফনাদ হেসে হেসে মোহনার সাথে কথা বলছেন আর খাচ্ছেন। অরিত্রী ভ্রু যুগল একত্রিত করে বললো,
“বাবা, তুমি অসুস্থ?”

মিস্টার আফনাদ সামনে তাকালেন। অরিত্রীর পোশাক দেখে বুঝার বাকি নেই যে, সে মাত্র ঘুম থেকে উঠেছে। নিশ্চয়ই অর্ণব ঘোল খাইয়ে ঘুম থেকে উঠিয়েছে। মোহনা নিজের হাসি লুকানোর বৃথা চেষ্টা করে বললেন,
“তোমার বাবা তোমাকে দেখেই সুস্থ হয়ে গেছেন। এখন ফ্রেশ হয়ে এসে খেয়ে নাও!”
বাবা-মাকে ওভাবে মিটমিট করে হাসতে দেখে অরিত্রী বুঝতে পারলো, অর্ণব ওকে মিথ্যে বলেছো। দাঁতে দাঁত চেপে বিরবির করে সে বললো,

“অর্ণব ভাই! বাজে লোক একটা! আমি তোমাকে ছাড়বো না।”
হসপিটাল থেকে বারবার কল আসছে। অরিত্রী কুর্তির ওপর এপ্রোন পরে কল রিসিভ করলো,
“ম্যাম, দেয়ার ইজ এন এমারজেন্সি! আ পার্সন ইজ ভেরি ব্যাডলি ইনজিওর্ড।”
“আ’ম কামিং উইথিন টেন মিনিট’স!”
অরিত্রী ফোন রেখে নিজের ব্যাগ নিয়ে বেরিয়ে গেল। গাড়িতে বসতেই বললো,
“আঙ্কেল, একটু ফাস্ট ড্রাইভ করবেন, ওকে?”

“কীভাবে ফাস্ট ড্রাইভ করবো, ম্যাডাম? কালকে সারারাত স্নোফল হয়েছে, আর কানাডার স্নোফল নিয়ে তো তোমার এতো বছরে বেশ ভালো আইডিয়া হয়ে গেছে আই হোপ‌!”
মেয়েলি কন্ঠ শুনে অরিত্রী ভ্রু কুঁচকে পাশে তাকাতেই চমকে উঠলো। চোখ দুটো চকচক করে উঠলো। খুশিতে ঝাপিয়ে পড়লো মেয়েটির ওপর,
“অর্থী আপি!! হোয়াট আ সারপ্রাইজ! তুমি আসবে আমাকে আগে বলোনি কেন?”
অর্থীও অরিত্রীকে জড়িয়ে ধরলো। আহ্লাদী গলায় বললো,
“বলে দিলে তোর এই খুশিটা দেখতাম কীভাবে, হুম?”

“এজন্যই কয়েকদিন তোমাকে অনলাইনে পাচ্ছিলাম না। খুব রাগ হচ্ছিল! আমি ভাবছিলাম, তুমি বাংলাদেশ গিয়ে আমাকে ভুলে গেছো।”
অর্থী হেসে গাড়ি স্টার্ট দিলো। বললো,
“তোকে তো ভুলতে পারি না! কিন্তু বিডিতে গেলে মনটাই খারাপ হয়ে যায়, ইয়ার। ভাইয়াকে দেখলেই চোখে পানি চলে আসে আমার। একটা এক্সিডেন্ট আমার হাসিখুশি ভাইটাকে কী বানিয়ে দিলো! এখন তো সে কথাও বলে না কারো সাথে ঠিক মতো।”

অরিত্রীর মন খারাপ হয়ে গেল। বিষণ্ণ মুখে বাইরে দৃষ্টি নিবদ্ধ করে বললো,
“ভালোবাসার মানুষ দূরে সরে গেলে অনেক কষ্ট হয়, আপি। মনে হয় যেন ভেতর থেকে প্রাণটাই বেরিয়ে এলো!”
অর্থী ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে হাসলো। বললো,
“তোর কথা শুনে মাঝে মাঝে মনে হয়, তুই এসবে বেশ এক্সপেরিয়েন্সড!”
অরিত্রী মলিন মুখে হাসলো। আনমনে বললো,

“এক্সপেরিয়েন্স নিয়ে তো জানি না! বাট কেন যেন মনে হয় বাবা-মা যা বলে, সেসব বাদেও আমার জীবনে আরো কিছু আছে। সাত বছর আগে সব অচেনা হয়ে গেলেও কিছু কিছু জিনিস আমার মস্তিষ্কে গেঁথে আছে। এই দেশটা আমার কাছে বড্ড অচেনা লাগে, জানো? কোনো আকর্ষণ কাজ করে না আমার মধ্যে। বাবা-মা ছাড়াও আমার কাছের কেউ ছিল। হয়ত এখনও আছে! মাঝে মাঝে ঘুমের ঘোরে অনেক কিছু আমার সামনে ভেসে ওঠে, যেগুলো নিছকই স্বপ্ন বা কল্পনা নয়। কিন্তু আমি আসলে কিছুই মিলিয়ে উঠতে পারি না!”

“আমার মনে হয়, তোর একবার বাংলাদেশে যাওয়া উচিত। হয়তো এতে তোর সাথে পজিটিভ কিছু ঘটতে পারে।”
অরিত্রী হতাশ গলায় বললো,
“কোনো লাভ নেই! আমি নাকি ছোটবেলা থেকেই এখানে বড় হয়েছি। বিডি-এর সাথে আমার কোনো যোগসূত্র আছে বলে মনে হয় না! তাছাড়া মা আর অর্ণব ভাই আমাকে যেতে দিবে না কখনো।”
অর্থী ক্ষীণ বিরক্তি মিশ্রিত সুরে বললো,

“সবার কথা ছাড়! তোর যাওয়ার ইচ্ছে নেই, সেটা বল।”
অরিত্রী বাইরের দিকে তাকিয়ে রইলো নীরব মুখে। এসব নিয়ে ভাবতে ইচ্ছে করে না একটুও। ভাবলেই ভয়ে, আশঙ্কায় গলা শুকিয়ে যায় একদম!

মিস্টার আফনাদ বারান্দায় বইয়ে চোখ রেখে বসে আছেন। কিন্তু তার মনযোগ বইয়ে নেই। একটু অবসর পেলেই পুরনো অপরাধবোধ যেন মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে। তিনি কি ঠিক করেছেন? অরিত্রীর হাসি মুখটা দেখলে মনে হয়, মেয়ের সুন্দর জীবনের জন্য তিনি যা করেছেন একদম ঠিক করেছেন। সেদিন মোহনার কথা না শুনলে আজ অরিত্রী একজন সফল ডক্টর হয়ে নিজের স্বপ্ন পূরণ করতে পারতো না। কিন্তু পরমুহূর্তেই আবার মনে হয়, তিনি প্রতারণা করেছেন। সৌহার্দ্যকে ঠকিয়ে সদ্যোজাত দুটো নিষ্পাপ প্রাণকে মাতৃহীন করেছেন। সেদিন মোহনার সাথে ওনার কথোপকথন ও কার্যকলাপ এখনো চোখে ভাসে তাঁর!

~সাত বছর আগে~
“আফনাদ সাহেব, আমি আপনাকে বলে দিচ্ছি! আমার মেয়ের জীবনে আমি আর কারো কালো ছায়া পড়তে দেব না। ওকে একটা সুন্দর জীবন দেওয়ার জন্য হলেও আমাদের এই দেশ ছাড়তে হবে।”
মিস্টার আফনাদ চিন্তিত মুখে বসে ছিলেন। মোহনার মুখে এমন কথা শুনে তিনি অবাক চোখে চাইলেন,

“মাথা ঠিক আছে তোমার? মেয়েটা জীবন-মৃত্যুর মধ্যে বসে আছে, আর তুমি….. পাগলামি করো না এসব নিয়ে আর!”
মোহনা চোখ মুছলেন। আজ তরীর এই অবস্থার জন্য তিনিই কোনো না কোনোভাবে দায়ী। সেদিন যদি জোর করে তরীকে বিয়ে দেওয়ার জন্য উঠে পড়ে না লাগতেন, তাহলে আজ তরীর সাথে সৌহার্দ্যের বিয়ে হতো না। এগে তরীর জীবনও এমন বিপর্যয়ে পড়তো না! ভেবেই তিনি বিরস মুখে বললেন,
“আমার কারণেই আজ মেয়েটার এই অবস্থা। ওর জীবনে এতো দুঃখের জন্য আমিই তো দায়ী। আমার জন্য ওর বিয়ে সৌহার্দ্যের সাথে হলো, আর…. ”

অর্ণব ওনার কথার মাঝে দাড়ি টেনে দিয়ে বললো,
“আরেহ্ বিয়ে তো ভাগ্যের ব্যাপার! এটা নিয়ে নিজেকে দোষ দিচ্ছো কেন? তবে বিয়ের আগে ওর জীবনটা আরো সুন্দর হতে পারতো।”
মোহনা আঁচলে চোখ মুছে বললেন,
“আমার জন্য ওর কপালে কোনো সুখ জুটলো না। জন্ম দেইনি বলে ওর মা হতে পারিনি আমি। কিন্তু আর না! আমার করা ভুল আমি শুধরে নেবই। ওর জীবনে আমি আর দুঃখের ছায়া পড়তে দেব না। অর্ণব তুই সব ব্যবস্থা কর। আমরা এই দেশ ছেড়ে চলে যাবো।”

আফনাদ আর অর্ণব দুজনেই চকিত দৃষ্টিতে তাকালো। অর্ণব অবাক কন্ঠে বললো,
“তরীর এই অবস্থায় কীভাবে যাবো আমরা? আর সৌহার্দ্য মানবে না কোনোদিন! ওদের দুটো বাচ্চা আছে, আন্টি!”
“তরীর চিকিৎসা বিদেশে করার ব্যবস্থা করতে হবে। অস্ট্রেলিয়া যাওয়ার কথা সবাই জেনে গেছে, তাই ওখানে যাওয়া যাবে না। আমার এক বান্ধবী কানাডায় সেটেল্ড। আমরা সেখানে যাবো। আর সৌহার্দ্য বা অন্য কাউকে কিছু জানানো যাবে না। সবটাই লুকিয়ে করতে হবে।”
মিস্টার আফনাদ তেতে উঠে বললেন,

“পাগল হয়েছো? তুমি যেমন তরীর মা, তেমনি তরীও দুটো সদ্যোজাত বাচ্চার মা। ওদের থেকে তরীকে আলাদা করতে কীভাবে চাইছো তুমি?”
মোহনা কারো কথা কামে নিলেন না। নিজের সিদ্ধান্তে অনড় থেকে অর্ণবকে সবটা করতে বাধ্য করলেন। হসপিটাল থেকে ডিসচার্জ নিয়ে রাতের প্রাইভেট ফ্লাইটে কানাডা পাড়ি জমালেন তারা।
প্রায় মাসখানেক পর তরী কোমা থেকে বেরিয়ে এলো। চোখ খুলতেই নিজেকে নিজেই চিনতে পারলো না সে। সে এরকম কীভাবে হলো? তার বয়স তো মাত্র সাত বছর হওয়ার কথা ছিল! তার মা কোথায়? মাকে কি সত্যি সত্যিই মেরে ফেলেছে? নাকি ওটা একটা দুঃস্বপ্ন ছিল? তরীর অস্বাভাবিক আচরণ দেখে ডক্টর ক্লারা বললেন,

“উনি কি এর আগে কখনো কোনো এক্সিডেন্ট বা বাজেভাবে আহত হয়েছিলেন?”
“হ্যাঁ, অনেক ছোট ছিল তখন ও। ওর মায়ের মৃত্যু নিজের চোখে দেখেছিল। এরপর ওর বাবা ওকে…..”
মিস্টার আফনাদ সবটা খুলে বলতেই ডক্টর চিন্তিত ভঙ্গিতে মাথা নাড়ালেন। বললেন,

“আসলে এরকম কেইস অনেক রেয়ার। কিন্তু এটাই আপনাদের পেশেন্টের সাথে ঘটেছে। ওর সাত বছর বয়সের এক্সিডেন্টের পরবর্তী সময় থেকে রিসেন্ট এক্সিডেন্ট পর্যন্ত সময়টা ওর মেমোরি থেকে হারিয়ে গেছে। ওর এখন শুধু মনে আছে সেই এক্সিডেন্টের আগের সময়টুকু। খুবই ক্রিটিক্যাল স্টেজে আছে মেয়েটা। আপনারা সবাই ওর কাছে অচেনা।”
অর্ণব আর মিস্টার আফনাদ নির্বাক হয়ে বসে রইলেন। মোহনার মিশ্র অনুভূতি হচ্ছে। তিনি জিজ্ঞেস করলেন,
“এক্সিডেন্ট দুটোর মধ্যবর্তী সময়ের স্মৃতি কি ওর আর কখনো মনে পড়বে না?”

“পড়বে। হিস্ট্রি রিপিট’স ইটসেল্ফ! যদি কোনো ঘটনার পুনরাবৃত্তি হয়, পুরনো জায়গা ও মানুষগুলো ওর চোখে ধরা দেয়, তাহলে ধীরে ধীরে তরীর সবটা মনে পড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা আছে।”
মোহনা সিদ্ধান্ত নিলেন, তরীকে তার আগের জীবন থেকে সম্পূর্ণভাবে সরিয়ে ফেলবেন। একটা নতুন জীবনের সাথে পরিচয় করাবেন, যার প্রতিটি প্রভাত হবে ভালোবাসায়। সারাজীবন যতটা ভালোবাসার ঘাটতি তরী অনুভব করেছে, তার সবটা পুষিয়ে দিতে হবে তাকে।
দুর্বলতার খোলসে আবৃত কঠিন সত্তার সেই তরী নামটা চিরতরে হারিয়ে গেল সেদিনই! কোমল, মিষ্টি ও প্রাণবন্ত অরিত্রীকে নিজের হাতে গড়ে নিলেন মোহনা। নিজের স্বপ্ন পূরণের দিকে এগিয়ে যাওয়ার পথে একবারও পেছন ফিরে তাকানোর সুযোগ দিলেন না ওকে।
বর্তমানে অরিত্রী একজন সফল কার্ডিওলজিস্ট। ডাক্তার হওয়ার স্বপ্ন তার পূরণ হলেও কেন যেন মনে হয় এর জন্য বেশ বড় ত্যাগ স্বীকার করতে হয়েছে তাকে। সৌহার্দ্য, মধু, দাদী, রায়হান, সুজাতাকে সে ভোলেনি। নিজের বাবার করা সেই নিষ্ঠুরতাও মনে আছে। কিন্তু সবটা সে এখন ভুলে থাকতে চায়। তবুও মনে একটা প্রশ্ন জাগে! সাত বছর বয়সের সেই এক্সিডেন্টের পর তারা কানাডায় চলে এলে এই দেশ তার কাছে এতো অচেনা লাগে কেন? তার মা-বাবা কি মিথ্যে বলছে নাকি এটা তার মনের ভুল? হয়তো সে-ই ভুল ভাবছে!
*
সৌহার্দ্য বেশ তাড়াহুড়ো করে হসপিটালে ঢুকছে। একটা সার্জারি আছে আজকে। কিন্তু প্রণয়-প্রণয়ীকে স্কুলে দিয়ে আসতে গিয়ে জ্যামের কারণে লেইট হয়ে গেছে। চেম্বার থেকে ড্রেস চেঞ্জ করে তড়িঘড়ি করে বেরিয়ে এলো সে। হাতে গ্লাভস পরতে পরতে হাঁটার সময় সিনিয়র ডক্টরের সাথে ধাক্কা লাগলো। ডক্টর হেসে বললেন,
“বি কেয়ারফুল, মাই বয়! এতো তাড়াহুড়োর কি আছে?”
“স্যার, অপারেশন ছিল একটা। তাই….”

“সেটা আরো আধাঘন্টা পিছিয়ে দিয়েছি। অন্য একটা ইমার্জেন্সি পড়ে গেছে হঠাৎ!”
“আচ্ছা? এটা তো আমাকে কেউ জানায়নি!”
“তুমি এলে আমিই জানাবো ভাবলাম। তোমার কিউট বাচ্চা দুটো কেমন আছে?”
সৌহার্দ্য মলিন হেসে বললো,
“বুঝে উঠতে পারি না, স্যার! মাঝে মাঝে মনে হয়, আমার ভালোবাসা ওদের জন্য যথেষ্ট না।”
“মায়ের অভাব পূরণ করা কি এতো সহজ? তুমি সেকেন্ড ম্যারেজ করছো না কেন? আই হাইলি রেকমেন্ড ইউ টু ম্যারি এগেইন!”

সৌহার্দ্য ম্লান কন্ঠে বললো,
“আপনি কখনো কাউকে ভালোবেসেছেন, স্যার?”
ডক্টর চিন্তিত ভঙ্গিতে বললো, “আমার স্ত্রী আমাকে অনেক ভালোবাসে। আমি বোধহয় ততটা ভালোবাসি না।”
সৌহার্দ্য দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো,
“কখনো ভালোবাসবেনও না। ভালোবাসা একটা ভুল, যা আমি করে ফেলেছি। হয়তো সারাজীবন এই ভুলের মাশুল গুনতে হবে আমায়।”

প্রণয়াসক্ত পূর্ণিমা পর্ব ৪৭+৪৮

সৌহার্দ্য সামনের দিকে চলে গেল। ডক্টর ওর যাওয়ার দিকে তাকিয়ে রইলো। তার এতো বছরের জীবনে ভালোবাসার চেয়ে রহস্যময় জিনিস আর দ্বিতীয়টা দেখেছেন বলে মনে পড়ছে না। সৌহার্দ্য তারই ছাত্র ছিল। কিন্তু সৌহার্দ্যকে আজ নিজের থেকে বেশি অভিজ্ঞ মনে হচ্ছে। হয়তো ও জীবনবোধ বেশি করে অনুভব করেছে বলেই!

প্রণয়াসক্ত পূর্ণিমা পর্ব ৫০ (১)