প্রণয়াসক্ত পূর্ণিমা পর্ব ৫০ (১)

প্রণয়াসক্ত পূর্ণিমা পর্ব ৫০ (১)
Writer Mahfuza Akter

প্রণয়ী স্কুলের মাঠে গালে হাত দিয়ে বসে আছে। তার পাশেই প্রণয় ঘাসের ওপর হাত-পা ছড়িয়ে শুয়ে পড়লো। তার দৃষ্টি খোলা আকাশে নিবদ্ধ। সাদা ড্রেসে ধুলোবালি লেগে বাদামি বর্ণধারণ করেছে। প্রণয়ী ওর দিকে একবার তাকিয়ে চোখ সরিয়ে নিলো। বিরস মুখে বললো,

“আজকে মাদার্স ডে! আমি তো ভুলেই গিয়েছিলাম!”
প্রণয় ভ্রু-যুগল একত্রিত করে ফেললো। ঈষৎ বিরক্তি নিয়ে বললো,
“তোর মনে থাকেটা কী? এখানে থাকতে বিরক্ত লাগছে আমার। আগে জানলে এই দিনে স্কুলেই আসতাম না!”
“মা ছাড়া জীবন অনেক কষ্টের! তাই না, ভাই? আমাদের মা থাকলে অনেক ভালো হতো!”
প্রণয়ীর মলিন মুখের দিকে তাকিয়ে ঠোঁট উল্টালো প্রণয়। শোয়া থেকে উঠে বসে বললো,

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

“গাধী! পাপার সামনে এই কথা মুখেও আনবি না। পাপা যদি মন খারাপ করে, তখন?”
প্রণয়ী হালকা হেসে বললো, “আচ্ছা, বলবো না!”
কিছুক্ষণ পর ড্রাইভার গাড়ি নিয়ে এলে প্রণয়-প্রণয়ী গাড়িতে উঠে বসলো। প্রণয় ড্রাইভারকে জিজ্ঞেস করলো,
“পাপা কেন আসেনি?”
“স্যার ব্যস্ত ছিলেন! সার্জারী ছিল শুনলাম।”
প্রণয় গাল ফুলিয়ে বললো, “আচ্ছা!”

অরিত্রী সবেমাত্র পেশেন্ট দেখা শেষ করেছে। আজকের মতো তার ডিউটি শেষ। সন্ধ্যার আগেই আজ বাসায় চলে যাবে ভেবে খুশিমনে কফিটা শেষ করে উঠে দাঁড়ালো। এপ্রোনটা খুলতে যাবে এমনসময় নার্স ছুটে এসে জানালো,
“ম্যাম, ইট’স ইমার্জেন্সি। প্লিজ কাম উইথ মি!”
অরিত্রী এপ্রোনটা আর খুললো না। অগত্যা নার্সের সাথে ছুট লাগালো ইমার্জেন্সি ওয়ার্ডে। নার্স তাকে একটা কেবিনে নিয়ে গেল। আগে থেকেই বেশ কয়েকজন ডক্টর সেখানে ছিল। তাদের সাথে ডক্টর ক্লারাও ছিল। তিনি অরিত্রীকে দেখে বললো,
“কাম, ডিয়ার! এই পেশেন্টটা তোমার জন্য নতুন। নতুন এক্সপেরিয়েন্স হবে তোমার। এজন্য তোমায় ডেকে আনতে বলেছি।”

ডক্টর ক্লারার মুখে স্পষ্ট বাংলা কথা শুনে প্রথমে অবাক হয়েছিল অরিত্রী। পরে জানতে পেরেছিল, ওনার মা বাঙালি ছিলেন। এজন্য তার বাঙালিদের প্রতি অদ্ভুত টানও আছে। ওনার সাহায্য ছাড়া অরিত্রী হয়তো এতো ভালোভাবে নিজের জীবনটাকে এগিয়ে নিতে পারতো না। তার ডাক্তার হওয়ার পেছনে ডক্টর ক্লারার অনেক অবদান।

অরিত্রী এগিয়ে এসে ডক্টর ক্লারার পাশে দাঁড়ালো। সামনে পেশেন্টের দিকে তাকাতেই আঁতকে উঠল সে। মেয়েটার মুখের অর্ধাংশ পুড়ে ঝলসে গেছে একদম। অরিত্রী চোখ খিঁচে বন্ধ করে ফেললো। ডক্টর ক্লারার হাত খামচে ধরে বললো,
“ম্যাম, ওর এই অবস্থা কেন? কীভাবে হলো?”
“মেয়েটা স্টুডেন্ট। কেমিস্ট্রি ল্যাবে কাজ করার সময় দুর্ঘটনাবশত ওর মুখে…. এখন এসব কথার সময় না। লেট’স স্টার্ট আওয়ার ট্রিটমেন্ট!”

ডক্টর ক্লারার কথা শুনে অরিত্রী চোখ খুলে তাকালো। সবাই ইতোমধ্যে নিজ নিজ কাজ শুরু করে দিয়েছে। অরিত্রী মেয়েটার দিকে তাকিয়ে কয়েকবার ঘনঘন পলক ফেললো। চোখের সামনে ভেসে উঠলো এক দুর্বিষহ রাতের অস্পষ্ট দৃশ্যপট। অরিত্রী আবছা আবছা মনে করতে পারলো, কেউ একজন তার দিকে কিছু একটা ছুঁড়ে ফেলছে। কিন্তু পাশ থেকে আরেকজন এসে তাকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে ফেললো, আর তাৎক্ষণিক কারো তীক্ষ্ণ আর্তনাদ অরিত্রীর কর্ণকুহরে বাজতে লাগলো৷

অরিত্রী মাথার চুল খামচে ধরে পাশের চেয়ারে বসে পড়লো। গা থেকে ঘাম ঝরে পড়ছে ওর। চোখ দুটো নিভে আসতে চাইছে। অকস্মাৎ দেহটা হেলে পড়তেই অর্থী এসে ওকে আগলে ধরে নিলো। চিৎকার করে বললো,
“ম্যাম! অরিত্রী সেন্সলেস হয়ে গেছে।”
ডক্টর ক্লারা ইচ্ছে থাকা সত্ত্বেও আসতে পারলেন না। শুধু গলা উচিয়ে বললেন,

“ড. অর্থী, ওকে এখান থেকে নিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা করো। আমি দশ মিনিটের মধ্যে আসছি।”
অর্থী আর নার্স মিলে অরিত্রীকে একটা বেডে নিয়ে শুইয়ে দিলো৷ অর্থী তাড়াতাড়ি অর্ণব কল দিলো। বললো,
“অর্ণব, তাড়াতাড়ি হসপিটালে আয়! অরিত্রী অজ্ঞান হয়ে গেছে।”
অর্ণব হতভম্ব হয়ে বললো,
“হোয়াট? কীভাবে? আচ্ছা, আমি এখুনি আসছি!”
ডক্টর ক্লারা অরিত্রীকে চেকআপ করে বললেন,

“ব্রেইনে অতিরিক্ত প্রেশার দিয়ে ফেলেছে মেয়েটা! ওর খেয়াল রেখো, ড. অর্থী। সেন্স আসতে বেশ সময় লাগবে।”
ডক্টর ক্লারার কথার মাঝে অর্ণব ভেতরে প্রবেশ করলো। অর্ণবকে দেখে তিনি কিছুটা অপ্রসন্ন মুখে বেরিয়ে গেলেন। অর্থী বিষয়টা খেয়াল করলো। মনে একটু সন্দেহ জাগলেও প্রকাশ করলো না। অর্ণব অর্থীর সামনে এসে অরিত্রীর দিকে একবার তাকালো। চিন্তিত মুখে বললো,

“ও ঠিক আছে? কী হয়েছিল?”
“খুব চিন্তা হচ্ছে?”
অর্থীর মুখে তাচ্ছিল্যের হাসি। অর্ণব সেটা দেখে বিরক্ত হয়ে বললো,
“এখন অন্তত এসব ঢং বাদ দিতে পারিস? মেয়েটা অসুস্থ, তাই চিন্তা হচ্ছে!”
অর্থী নিজের মুখে কৃত্রিম অবাকতা ফুটিয়ে বললো,
“আচ্ছা? তুই যে ওকে নিয়ে এতো চিন্তা করিস, সেটার কোনো পরোয়া ও করে না। তোর এতো ভালোবাসার কথা তো অরিত্রী জানে না!”

“আগে জানতো! বুঝতো ও। কিন্তু এখন তো আমিই বুঝতে দেই না!”
অর্ণবের কথায় অর্থী মলিন হেসে বললো,
“ভালোবাসা অনেক অদ্ভুত জিনিস। মানুষের মাথা থেকে মুছে গেলেও মন থেকে সরে যায় না। অরিত্রীও সৌহার্দ্যকে কোনোদিন ভুলবে না। ওর মনে এই মানুষটা বেঁচে থাকবে সারাজীবন। তোরা যতই ওদের দূরে সরিয়ে রাখতে চাস না কেন!”

অর্ণব ক্রোধান্বিত চোখে তাকালো। দাঁতে দাঁত চেপে বললো,
“সৌহার্দ্যের নাম তুই ওর সামনে উচ্চারণও করবি না। আমি চাই না তোর সাথে ওর সম্পর্ক নষ্ট করতে। এতো বছর চুপ করে ছিলি, এখনো মুখটা বন্ধ রাখ।”
অর্থী ঈষৎ হেসে বললো,

“আমি তো কিছু বলবো না! কিন্তু সত্যটা আর কতো বছর চেপে রাখবি? আজ অরিত্রী এসিড ভিক্টিম এক মেয়েকে দেখে সেন্সলেস হয়ে গেছে। কেন, জানিস? ওর মস্তিষ্কে মধুর কথা নাড়া দিয়েছে। একদিন না একদিন ও সবটা জানতে পারবেই! সেদিন ও তোর আর মোহনা আন্টির কোনো পরোয়া করবে না।”
অর্ণব বিরক্ত হয়ে বললো,
“তোর ঘ্যানঘ্যান শোনার চেয়েও অনেক দরকারি কাজ আছে আমার। অরিত্রীর জ্ঞান ফিরলে আমায় জানাস। আমি বাইরে গেলাম।”

অর্ণব অর্থীকে পাশ কাটিয়ে চলে গেল। অর্থী ওর যাওয়ার দিকে বিস্ফোরিত চোখে তাকিয়ে রইলো। এতো বছর ও যতবার দেশে গেছে, নিজের চোখে দেখে এসেছে, সৌহার্দ্য কতটা কষ্ট ও ত্যাগ স্বীকার করে দুটো বাচ্চা সামলেছে! তবুও ও চুপ ছিল। কারণ ও অরিত্রীর ডক্টর হওয়ার পথে কোনো বাঁধা দিতে চায়নি। কিন্তু এখন আর কোনো কারণ নেই সময় নষ্ট করার। ঐ নিষ্পাপ দুটো বাচ্চার জন্য হলেও ওকে কিছু একটা করতে হবে! সবার আগে ডক্টর ক্লারার সাথে কথা বলতে হবে। অর্ণবকে দেখে ওনার মুখে অসন্তোষের ছাপ স্পষ্ট ছিল। এর পেছনে কারণ কী?

সন্ধ্যা নেমে এসেছে। কিন্তু ঘরে এখনো আলো জ্বলেনি। প্রহর নিজের হাতে কফি বানিয়ে ঘরের সামনে এলে। দরজা ঠেলে খুলতেই শব্দতরঙ্গের কারণে নীরবতায় কয়েক সেকেন্ডের জন্য ইতি ঘটলো। প্রহর ঘরের ভেতর প্রবেশ করতে নিলে ফোনকলে পা থেমে গেল। ফোনের স্ক্রিনে তাকিয়ে দেখলো, অর্থী কল করেছে। রিসিভ করে বললো,
“একটু ব্যস্ত আছি।”

ওপাশ থেকে অর্থীর ব্যস্ত কন্ঠ ভেসে এলো,
“আমার তো তোমার সাথে অনেক দরকারি কথা ছিল, ভাইয়া!”
প্রহর ভ্রু কুঁচকে বললো, “এখনই বলতে হবে?”
“তুমি ফ্রী হয়ে আমাকে একটু কল দিও। তোমার হেল্প লাগবে আমার, প্লিজ।”
“আচ্ছা, আমি কল ব্যাক করবো তোকে।”

অর্থী ফোন কেটে দিলো। সে জানে, প্রহর এখন কোথায় আছে! তাই ওকে বিরক্ত করলো না।
প্রহর কফির মগ দুটো বেডসাইড টেবিলে রাখলো। অন্ধকারে বাহির থেকে আসা অস্পষ্ট আলো কফি মগ থেকে ওঠা ধোঁয়াগুলো চোখে পড়ছে বেশ। প্রহর সুইচের দিকে এগিয়ে গিয়ে আলো জ্বালাতে যাবে, এমনসময় মেয়েলি সুর ভেসে এলো,

“আলো জ্বালিও না। অন্ধকারেই শান্তি পাই আমি!”
প্রহর ক্ষীণ তেজদীপ্ত কন্ঠে বললো,
“তোমায় দেখতে এসেছি। আলো ছাড়া দেখবো কী করে? দেখতে না দিলে তোমায় স্পর্শ করতে চাই। একবার তোমায় ছুঁয়ে দেওয়ার অনুমতি দেবে আমায়, মধু?”

প্রণয়াসক্ত পূর্ণিমা পর্ব ৪৯

(কথা রেখেছি! এই পর্বের আরেকটা অংশ কালকে দিবো। সবার রেসপন্স কাম্য।)

প্রণয়াসক্ত পূর্ণিমা পর্ব ৫০(২)