প্রণয়াসক্ত পূর্ণিমা পর্ব ৫০ (২)

প্রণয়াসক্ত পূর্ণিমা পর্ব ৫০ (২)
Writer Mahfuza Akter

প্রহর আলো জ্বালালো না। অন্ধকারেও বাহির থেকে আসা আবছা আলোয় সবকিছুর অবয়ব স্পষ্ট। সে দৃপ্ত পায়ে মন্থর গতিতে এগিয়ে গেল বিছানায় হেলান দিয়ে বসা মানবীটির দিকে। ঘরজুড়ে পিনপতন নীরবতার মাঝে শুধু নিঃশ্বাসের ঘনতর শব্দ প্রবাহ কর্ণকুহরে প্রতিধ্বনিত হচ্ছে।

প্রহর বিছানার প্রান্তভাগে বসলো। মধুর হাতের ওপর হাত রাখতে সেকেন্ড পেরোনোর আগেই মধু একটানে নিজের হাত সরিয়ে নিলো। দৃষ্টি জুড়ে কাঠিন্য ভর করলো ওর। প্রহর ম্লান মুখে তাকালো মধুর অবয়বের দিকে। বললো,
“কষ্ট দিয়ে কি খুব ভালো লাগে তোমার? তুমি কি আমাকে আর ভালোবাসো না?”

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

মধুর কান্না পেল। চোখ ছাপিয়ে অশ্রু বেরিয়ে এলো। সে কীভাবে প্রকাশ করবে নিজের অসহায়ত্ব? প্রহর কেন বুঝতে চায় না? নীরব কান্নার মাঝে হঠাৎই হেঁচকি উঠে গেল মধুর। প্রহর বুঝতে পারলো, মধু কাঁদছে। মধুর গালের দিকে হাত বাড়িয়ে দিতেই মধু ওর হাত সরিয়ে দিলো। প্রহর বিরস মুখে হেসে বললো,
“তোমার চোখের প্রতিটা অশ্রুকণা সাক্ষী দিচ্ছে, তুমি আমাকে ঠিক কতটা ভালোবাসো!”
“আমার জীবনের একমাত্র আফসোস এটাই যে, আমি তোমাকে ভালোবাসি।”

প্রহর এবার দূরত্ব ঘোচালো। অকস্মাৎ মধুকে নিজের বুকের মাঝে আগলে নিলো। ব্যাপারটা এত তাড়াতাড়ি ঘটলো যে, মধু দূরে সরার কথা ভাবার সুযোগও পেল না। মধুর চুলে অগুণিত বার ওষ্ঠ স্পর্শ করিয়েও ক্ষান্ত হলো না সে। নির্মল কন্ঠে বললো,
“যা ঘটে গেছে, সেটাকে তো আর বদলানো যাবে না! কিন্তু সামনের দিনগুলো তো আমার সুন্দর করে কাটাতে পারি, তাই না?”

মধু লেপ্টে রইলো প্রহরের বুকে। কয়েক মুহূর্ত এভাবে কাছাকাছি থেকে নিজের মনের তৃষ্ণা কিছুটা তো মিটে যাবে অন্তত! বারবার দূরে ঠেলে দেওয়ার নিয়ম টই মুহুর্তে একটু ভঙ্গ হলে খুব একটা ক্ষতি তো হবে না! ভেবেই মধু অবসন্ন কন্ঠে বললো,
“কী বলতে চাইছো?”
প্রহর দীর্ঘশ্বাস ফেললো। মধুর মাথায় আরেকবার চুমু এঁকে বললো,
“যা হয়েছে, ভুলে যাও!”

মধু ফুপিয়ে কেঁদে উঠলো। অবাধ্য জলগুলো ঝরে পড়তেই মধু প্রহরকে ঝাপটে ধরে বলতে লাগলো,
“আমি কীভাবে ভুলবো, প্রহর? ভুলতে চাইলেও আমি ভুলতে পারি না। আমার জীবনের সাথে সবটা এমন ভাবে জুড়ে গেছে, আমি চাইলেও সেটা মুছে ফেলতে পারবো না। আয়নায় তাকালে নিজেকে দেখেই আঁতকে উঠি আমি। আমার চেহারা নষ্ট হয়ে গেছে, এক চোখের দৃষ্টি শক্তি হারিয়ে গেছে।

কীভাবে আমার সামনের দিনগুলো সুন্দর করবো বলো? আমাকে যে বাকি জীবনটা ঘরবন্দী হয়ে কাটাতে হবে! লোকে আমায় দেখলে কী বলবে? আমি কীভাবে গিয়ে দাঁড়াবো মানুষের মাঝে?”
“তুমি যেমন ছিলে, ঠিক তেমনভাবেই দাঁড়াবে সবার মাঝে। আমি তো আমার সেই মধুকে দেখতে চাই, যে কারো পরোয়া করতো না। আজ তার মুখে যা শুনছি, সেগুলো বড্ড বেমানান ঠেকছে।”

“পরিস্থিতি সবটা বদলে দিয়েছে, প্রহর। মধু তো সেদিনই মরে গেছে, যেদিন ওর লোকের সামনে দাঁড়ানোর সব যোগ্যতা হারিয়ে গেছে। এখন আমি বেঁচে আছি শুধুমাত্র শ্বাস-প্রঃশ্বাসের জন্য, প্রাণহীন, নির্জীব হয়ে।”
প্রহর হতাশার সুরে বললো,

“তাহলে কি আমার কোনো মূল্য নেই তোমার জীবনে?”
“আমার জীবন তো শেষই হয়ে গেছে! তোমার জীবনে এখন আমার কোনো অস্তিত্ব থাকাই উচিত না। কেন এখনো আমার জন্য নিজের জীবনটাকে থামিয়ে রেখেছো? আমি তো কোনোভাবেই তোমার জীবনের পরিপূরক হতে পারবো না! আমার সেই যোগ্যতা নেই।”
প্রহর আলিঙ্গনের প্রখরতা বাড়িয়ে বললো,

“তুমি আমার বউ, আমার সহধর্মিণী। আমাদের দুজনের জীবন তো অনেক আগেই এক সুতোয় বাঁধা পড়ে গেছে! তোমার হয়তো আমায় প্রয়োজন নেই। কিন্তু আমার বেঁচে থাকার জন্য হলেও তোমাকে প্রয়োজন।”
“তাহলে আমার একটা কথা রাখবে?”
“বলো!”

“আমি একবার বাবা-মা আর ভাইয়ার সাথে দেখা করতে চাই।”
প্রহরের হাতের বাঁধন আলগা হয়ে গেল। কন্ঠে দৃঢ়তা বৃদ্ধি করে বললো,
“আমি কাউকে জানতে দেবো না যে, তুমি বেঁচে আছো। তুমি আমার সাথে থাকবে শুধুমাত্র আমার হয়ে! আর কারো ছায়াও আমি পড়তে দেবো না তোমার জীবনে।”

প্রহরের কঠোর গলায় বলা কথাগুলো শুনে মধু ওকে ধাক্কা দিয়ে নিজের থেকে সরিয়ে দিলো। বললো,
“চলে যাও তুমি! কখনো আমার কাছে আসার চেষ্টা করবে না। আমার অসহায়ত্বের সুযোগ নিয়ে তুমি আমায় এভাবে আড়াল করে রেখেছো। এর জন্য তুমি কারো কাছ থেকে ক্ষমা পাবে না, প্রহর! তোমার আর আমার দূরত্ব কখনো মিটবে না।”
প্রহর মলিন হেসে বললো,
“কিন্তু আমি দূর থেকেই ভালোবাসবো, আজীবন ভালোবাসবো।”

অরিত্রীর জ্ঞান ফিরেছে বেশ কিছুক্ষণ আগে। অর্থী ওর পাশে এসে বসলো। কাঁধে হাত রেখে বললো,
“এখন কেমন লাগছে? ঠিক আছিস?”
অরিত্রী চোখ তুলে তাকালো। আনমনে বললো,

“একজন আমার গায়ে এসিড মেরেছিল, কিন্তু একটা মেয়ে আমাকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দেওয়ায় ওর মুখের ওপর এসিড পড়েছিল। এরকম একটা ঘটনা আমার জীবনে ঘটেছিল। এটা কবে ঘটেছে? তুমি কি জানো?”
অর্থীর চোখ দুটো চকচক করে উঠলো। সে চকিত চোখে তাকিয়ে বললো,
“এগুলো তোকে কে বললো?”

“কেউ বলেনি। কিন্তু আমার কিছুটা মনে পড়েছে। তুমি কি জানো এর আগে-পরে কী হয়েছিল?”
অর্থী সচেতন চোখে বাইরের দেখা তাকালো। সপ্রতিভ কন্ঠে বললো,
“তোর সব প্রশ্নের উত্তর আমি তোকে দিবো। কিন্তু এখন না। অর্ণব আশেপাশেই কোথাও আছে। তোর জীবনে অনেক কিছু ঘটে গেছে, অরিত্রী! তুই সেগুলো পেছনে ফেলে অনেক দূর এগিয়ে এসেছিস, তোর লক্ষ্যে পৌঁছেছিস। কিন্তু এবার তোকে পেছনে ফিরে তাকাতে হবে। তোর জন্য যে অনেক প্রিয়জনেরা অপেক্ষায় আছে!”
অরিত্রী অবুঝ মুখে বললো,

“মানে? আমি তোমার কোনো কথা বুঝতে পারছি না!”
“বোঝাবো তোকে! তুই শুধু….. ”
“কী বোঝাবি তুই?”
অর্ণবের গলা শুনে দুজনেই কিছুটা চমকে উঠলো। দরজার দিকে তাকাতেই দেখলো, অর্ণব ওদের দিকে সন্দিগ্ধ চোখে তাকিয়ে আছে। অর্থী হাসার চেষ্টা করে বললো,

“তেমন কিছু না। আমি তো ওকে এমনিতেই বলছিলাম! ওর মাথায় একটু পেইন হচ্ছে। তাই বুঝাতে চাচ্ছিলাম যে, সেন্সলেস হওয়ার পর এরকম একটু-আধটু পেইন হওয়াটা নরমাল।”
অর্ণবের কথাটা বিশ্বাস হলো না তেমন একটা! তবুও কিছু বললো। অরিত্রীর দিকে তাকিয়ে বললো,
“চল, তোর মেডিসিন গুলো নিয়ে নিয়েছি। এখন বাসায় গিয়ে একটু রেস্ট নিলেই শান্তি লাগবে দেখিস!”
অর্থী অরিত্রীকে ধরে নিয়ে গেল গাড়ি পর্যন্ত। ওদের বিদায় করে দিয়ে অর্থী ডক্টর ক্লারার কাছে গেল। ওনার কেবিনে নক করে বললো,

“ম্যাম, মে আই কাম ইন?”
ডক্টর ক্লারা হেসে বললেন,
“ইয়েস, এসো। অরিত্রী চলে গেছে।”
“ইয়েস ম্যাম! আমি এখন ওর ব্যাপারে কথা বলার জন্যই আপনার কাছে এসেছি। বিগত সাতটা বছর অরিত্রী আপনার আন্ডারে, আপনার খুব কাছাকাছি ছিল। তাই আপনার থেকে বেশি আর কেউ আমাকে হেল্প করতে পারবে না।”
ডক্টর ক্লারা বিস্ময় নিয়ে বললেন,

“হেল্প? কিসের হেল্প?”
“ম্যাম, আমি চাই অরিত্রীর যেসব স্মৃতি হারিয়ে গেছে, সেসব আবার ফিরে আসুক।”
“সেটা তো আমিও চাই! কিন্তু ওর মা মিসেস মোহনা আর কাজিন মিস্টার অর্ণব আমার কথা মানতে নারাজ। তাদেরকে আমি অনেকবার বোঝানোর চেষ্টা করেছি যেন বিডিতে অরিত্রীকে নিয়ে যায়। ওখানে গেলে ওর জন্য ব্যাপারটা পজিটিভ হবে।”

অর্থী চকিত দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললো,
“তার মানে অর্ণব আর মোহনা আন্টি জেনে বুঝে সবটা করছেন?”
“হ্যা, অতিরিক্ত ইমোশনাল হয়ে ওনারা অরিত্রীর-ই ক্ষতি করছেন। কিন্তু এটা তারা বুঝতে চাইছেন না।”

“আচ্ছা, তাহলে আমরা যদি অরিত্রীকে ওর জীবনে ঘটা সবকিছু বলে দেই, এতে তো কোনো সমস্যা হবে না, তাই না?”
“হবে। অলরেডি সাত বছর চলে গেছে। এখন আমরা হুট করে ওকে সবটা মনে করানোর জন্য প্রেশারাইজ করতে পারবো না। এতে হিতে বিপরীত হওয়ার চান্স বেশি। এক মাত্র উপায় হলো ওকে বাংলাদেশে নিয়ে যাওয়া। ওখানে গেলে ও চেনাজানা পরিবেশে নিজে থেকেই সবটা মনে করার চেষ্টা করবে।”
অর্থী হতাশ হলো। অরিত্রীকে বাংলাদেশে নিয়ে যাওয়া কখনো সম্ভব না। মোহনা আর অর্ণব এমনটা কোনো দিন ঘটতে দেবে না। ব্যর্থ মনে অর্থী বেরিয়ে গেল চেম্বার থেকে।

কারাগারের ছোট্ট একটা কোণে হাঁটুর ভাঁজে কপাল ঠেকিয়ে বসে আছে অরুণী। পরনে সাদা ধুলোবালি মিশ্রিত শাড়ির একপ্রান্ত মেঝেতে এলোমেলো হয়ে পড়ে আছে। আজ সাত বছরেরও বেশি সময় পেরিয়ে গেছে অরুণী সূর্যের আলোও দেখে না। তার তো বেঁচে থাকার ইচ্ছে-ই মরে গেছে। আরমান আহমেদের লা*শের পাশে দাড়িয়ে সে নিজে আত্মসমর্পণ করেছিল। তার জীবনটা আজ কতই না সুন্দর হতে পারতো!

প্রণয়াসক্ত পূর্ণিমা পর্ব ৫০(১)

কিন্তু একজনের খেলার গুটি হয়ে সেই সুন্দর জীবনটার এক বড় অংশ সে কারাগারেই কাটিয়ে দিলো। আর কয়েকটা মাস পরেই তার কারাদণ্ড শেষ হবে। অথচ নিজের মনে এখন এই জেলখানা থেকে বের হওয়ার বিন্দুমাত্র ইচ্ছে খুজে পাচ্ছে না অরুণী।
“পাপের তুলনায় শাস্তির বোঝাটা বড্ড কম হয়ে গেল। তবুও আত্মশুদ্ধি তো হলো! কী বলো, ড. অরুণী?”

প্রণয়াসক্ত পূর্ণিমা পর্ব ৫১