প্রণয়াসক্ত পূর্ণিমা পর্ব ৫১

প্রণয়াসক্ত পূর্ণিমা পর্ব ৫১
Writer Mahfuza Akter

অরুণী চোখ তুলে তাকালো। সৌহার্দ্যের প্রখর চোখের দিকে নজর পড়তেই মুখ জুড়ে শুকনো হাসি খেলে গেল ওর। পরক্ষনেই হাতের তালুতে ভর দিয়ে বসা থেকে উঠে দাঁড়ালো সে। শুভ্র ফিকে রঙের শাড়ির প্রান্তদেশ মেঝেতে গড়িয়ে ধীর পায়ে এগিয়ে গেল। সৌহার্দ্যের মুখোমুখি চোখে চোখ রেখে দাড়ালো অরুণী। দু’হাত মুষ্টিবদ্ধ করে লৌহদন্ড ধরে উৎসুক দৃষ্টি মেলে তাকিয়ে রইলো নিষ্পলক। সৌহার্দ্য বিব্রত হয়ে দৃষ্টি সরিয়ে নিলো। অরুণীর এমন নজর ওর একদম অপছন্দ। অরুণী হাসলো। বললো,

-আমার নজরে বিব্রত হওয়ার কিছু নেই, সৌহার্দ্য! আমার চোখ জুড়ে তোমার জন্য অঢেল প্রেম আছে, এটা সত্যি। কিন্তু তোমাকে পাওয়ার কোনো সাধ বা তৃষ্ণা নেই।
সৌহার্দ্য ভ্রু কুঁচকালো। অরুণীর কাছে এমন কোনো কথা যেন একদমই অপ্রত্যাশিত ছিল! অরুণীর নিজের ঠোঁট কামড়ে হাসলো আবার। মেয়েটা হয়তো নিজের কান্না নিয়ন্ত্রণ করতে চাইছে। সৌহার্দ্য বলার মতো কিছু পেল না। ক্ষণিকের নীরবতা শেষে অরুণী আবার বললো,

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

-অবাক হয়েছো? আমি কিন্তু সত্যি বলছি! দেরিতে হলেও তিক্ত বাস্তবতা বুঝতে পেরেছি আমি। যখন তোমাকে হারানোর বেদনায় আমার ভেতরে তীব্র দহন শুরু হয়েছিল, ঠিক তখনই আমার বাবা সেই আগুনে ঘি ঢেলেছে। হিতাহিতজ্ঞানশূন্য হয়ে যা ইচ্ছে, তাই করেছি। কিন্তু দিনশেষে আমি প্রতারিত, আমার প্রাপ্তির খাতা শুন্য! আমার অপরাধের বোঝা বড্ড বেশি ভারী হয়ে গেছে। আমার হাত আমি বহুবার র*ক্তা*ক্ত করেছি। এই হাতের মালিক তোমায় ডিজার্ভ করে না, সৌহার্দ্য।

দেরীতে হলেও আমি বুঝতে পেরেছি যে, তোমায় পাওয়ার যোগ্যতা আমার নেই। তোমার আর আমার সম্পর্ক বদলেছে। তুমি অরিত্রীর বর! তোমার দিকে সেরকম চোখে তাকানোও আমার জন্য পাপ। আমি আমার পাপের বোঝা আর বাড়াতে চাই না। আমার মন আজ অকপটে মেনে নিতে বাধ্য যে, সৌহার্দ্যের প্রাণজুড়ে শুধুমাত্র চাঁদের অস্তিত্ব-ই সুন্দর!
সৌহার্দ্য দীর্ঘশ্বাস ফেললো। যাক! দেরী করে হলেও অরুণী তার ভুলটা বুঝতে পেরেছে। সে ম্লান হেসে অরুণীর দিকে তাকিয়ে বললো,

-তোমার জীবন আজ এই বদ্ধ কারাগারে কাটানোর কথা নয়, অরুণী! ডক্টর তুমি। হসপিটালে রোগীর কাঁধে ভরসার হাত রেখে তাদের সেবা করাটা তোমায় মানায়। কিন্তু তুমি সেটা বাদ দিয়ে আমার জীবন এলোমেলো করে দেওয়ায় মগ্ন ছিলে। আজ তোমার জন্য তরী আমার জীবন থেকে হারিয়ে গেছে, আমার বাচ্চা দু’টো এতো বছর মা ছাড়া থেকেছে, বড় হয়েছে। মা থাকা সত্বেও ওরা আজ মাতৃহীন। এসব কিছুর জন্য তোমায় আমি চাইলেও ক্ষমা করতে পারবো না, অরুণী।
অরুণী শুকনো হাসি দিয়ে বললো,

-ক্ষমার যোগ্য কোনো কাজ করিনি, তাই তোমার ক্ষমা আমি প্রত্যাশাও করি না। তুমি আমায় বাকি জীবনটা এই দম বন্ধকর জায়গায় কাটিয়ে দিতে দিলেও পারতে!
-তোমার অপরাধের তুলনায় তোমার শাস্তি আসলেই অনেক তুচ্ছ আর এটা আমার কারণেই হয়েছে। কারণ তরীর ইচ্ছেটা তুমি পূরণ করেছো। ও সবসময়ই চেয়েছে, ওর মায়ের খু*নী যথাযথ শাস্তি পাক। সেই শাস্তিটা ও নিজের হাতে দিতে চেয়েও পারেনি। তুমি ওর ইচ্ছে পূরণ করেছো।

আরমান আহমেদকে যেই মৃত্যুটা তুমি দিয়েছো, এর চেয়ে বড় শাস্তি আর দেওয়া সম্ভব না। ওনার লা*শে*র দিকে কেউ তাকাতে পারেনি। তোমার করা সব অপরাধের পেছনে কলকাঠি তো উনিই নেড়েছেন! তাই তোমার প্রতি একটু সহানুভূতি থেকে সবটা করা। দু-এক মাসের মধ্যেই তোমাকে মুক্ত করে দেওয়া হবে। বাকি জীবনটা সুন্দর ভাবে কাটিও! ভালো কিছু করতে না পারলেও অন্তত অন্যায় কিছু করো না।
সৌহার্দ্য আর কালক্ষেপ করলো না। পা ঘুরিয়ে চলে গেল অরুণীর দৃষ্টি সীমার বাইরে। অরুণী অশ্রুসিক্ত চোখে তাকিয়ে হাসলো। আনমনে বললো,

-তোমার বর অরিত্রীর মাঝে দূরত্ব সৃষ্টির জন্য আমিই দায়ী। কিন্তু কিছু কিছু দূরত্বও অনেক প্রয়োজন! তুমি এটা একদিন বুঝবে, সৌহার্দ্য।

সৌহার্দ্য বাড়ি ফিরলো দুপুরের পর। ক্লান্ত শরীর নিয়ে ঘরে প্রবেশ করতেই বেডের দিকে চোখ পড়লো। প্রণয়-প্রণয়ী বিছানায় এলোমেলো হয়ে ঘুমাচ্ছে। সৌহার্দ্য ওদের দিকে তাকিয়ে আনমনেই হেসে ফেললো। এগিয়ে গিয়ে দুজনের মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে কপালে চুমু দিলো।
ফ্রেশ হয়ে ডাইনিং রুমে গিয়ে বসতেই সৌহার্দ্যকে দেখে দাদী বললো,

-রোজ রোজ দুপুরের খাবার দুপুর গড়িয়ে যাওয়ার পর খাইলে চলবে? এতো দেরী করে বাড়ি ফিরিস ক্যান? একদিন একটু তাড়াতাড়ি ফেরার চেষ্টা কর!
সৌহার্দ্য খেতে খেতে বললো,
-কী করবো বলো, দাদী? ডক্টরদের জীবন এমনই হয়! হুটহাট ইমার্জেন্সি পড়ে যায়। আর তাছাড়া আজকে তো হসপিটালের জন্য দেরী হয়নি!
দাদী ভ্রু কুঁচকে জিজ্ঞাসু চোখে তাকিয়ে বললো,
-তাহলে ক্যান দেরী হইসে?

-অরুণীর সাথে দেখা করতে গিয়েছিলাম। আর কয়েকদিন পরই তো ওকে ছেড়ে দেবে!
দাদী মুখ গোমড়া করে বসে রইলেন। সুজাতা সৌহার্দ্যকে খাবার পরিবেশন করতে করতে বললেন,
-কেন যে ওর সাথে দেখা করতে যাস! তোর বাবার সামনে ভুলেও একথা মুখে আনিস না।
দাদী বিরস মুখে বললো,
-ঐ মেয়ের সাথে আর দেখা করার দরকার-ই নাই তোর। ও তো ছাড়া পাইতেছেই! এখন নিজের মতো চলতে দে ওরে। ওর থেকে দূরে দূরে থাকাই সবার জন্য ভালো।

সৌহার্দ্য খেতে খেতে মাথা নাড়লো। খাওয়া শেষে ঘরে ঢুকতেই দেখলো প্রণয়ী ঘুম থেকে উঠে বসে জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে আছে। সৌহার্দ্য ওর পাশে বসে মাথার চুলে হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বললো,
-ঘুম কেমন হলো আমার প্রিন্সেসের?
প্রণয়ী মুখ ঘুরিয়ে বাবার দিকে তাকালো না। কিছু বললোও না। প্রণয়ীর নীরবতা দেখা সৌহার্দ্য ভ্রু কুঁচকালো। বললো,
-মন খারাপ? ইজ দেয়ার এনিথিং রোঙ্?
-আমাদের মা কবে ফিরে আসবে, পাপা?
প্রণয়ীর প্রশ্ন শুনে সৌহার্দ্যের মুখ মলিন হয়ে গেল। প্রণয় হুট করেই শোয়া থেকে উঠে বসে প্রণয়ীর মাথায় নিজের হাত দিয়ে আঘাত করলো। অগ্নি দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললো,

-গাধী, তোকে কী বলেছিলাম? স্টুপিড মেয়ে!
সৌহার্দ্য প্রণয় আর প্রণয়ী দুজনকেই নিজের দুই পাশে বসালো। দুজনের দিকে একবার তাকিয়ে বললো,
-পাপা তোমাদের খুব একটা ভালোবাসতে পারে না, তাই না?
দুজনেই না-বোধক মাথা নাড়ালো। প্রণয়ী মলিন মুখ করে বসে রইলো। প্রণয় বললো,
-তোমাকে আমরা অনেক ভালোবাসি, পাপা। কিন্তু মাম্মাকেও অনেক মিস করি। আজকে মাদার্স ডে ছিল। এজন্যই প্রণয়ীর মুড অফ!
প্রণয়ী সৌহার্দ্যের দিকে তাকিয়ে বললো,

-তুমি কেন এতোদিন পর্যন্ত আমাদের মায়ের ছবি পর্যন্ত আমাদের দেখাওনি? আমাদের মা কেমন ছিল, পাপা?
সৌহার্দ্য দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো,
-সে রূপের তরী ছিল। যদি আকাশের চাঁদ এবং তাকে পাশাপাশি দাঁড় করানো হয়, তবে সবার দৃষ্টি তার দিকেই আঁটকে থাকবে। তার মেঝে গড়ানো আঁচল, ঢেউ খেলানো চুল, শুভ্র ও ঈষৎ রক্তিম রঙা মুখশ্রী আর সেই নিষ্পাপ হাসির বর্ণনা কেউ বলে শেষ করতে পারবে না। এমনকি আমিও না!
প্রণয় আর প্রণয়ী দুজনই সৌহার্দ্যের দিকে তাকিয়ে একসাথে বললো,

-মা কবে ফিরে আসবে, পাপা?
সৌহার্দ্য ম্লান মুখে হেসে বললো,
-যেদিন আমার অপেক্ষার পালা শেষ হবে!
-সাত বছরেও অপেক্ষার অবসান হলো না?
-অমাবস্যার অবসান ঘটিয়ে একদিনের ব্যবধানে।চাঁদের দেখা ঠিকই পাওয়া যায়। হয়তো আমাদের জীবনে অমাবস্যা সাতবছর ছিল! কিন্তু চাঁদকে তো একদিন দেখা দিতেই হবে, তাই না?

অর্থী বিরক্তি নিয়ে অরিত্রীর দিকে তাকিয়ে আছে। অরিত্রী মনযোগ দিয়ে ম্যাগাজিন পড়ছে। অর্থী বললো,
-এই চান্স মিস করিস না, ইয়ার! সুযোগ জীবনে বারবার আসে না।
অরিত্রী হেসে বললো,
-তোমার মনে হয়, মা মানবে কোনোদিন?
-কিন্তু তোর লাইফে সবকিছুরই এক্সপেরিয়েন্স নিতে হবে।
অরিত্রী আনমনে বললো,
-ইচ্ছে তো আমারও হয়! কিন্তু আবার ভয়ও হয়। মনে সাহস জুগিয়ে উঠতে পারছি না আসলে….

প্রণয়াসক্ত পূর্ণিমা পর্ব ৫০ (২)

(পরবর্তী পর্ব কাল সন্ধ্যার দিকে দিবো। ভুল-ত্রুটি মার্জনীয়।)

প্রণয়াসক্ত পূর্ণিমা পর্ব ৫২