পূর্ণতা নাকি শূন্যতা পর্ব ৪

পূর্ণতা নাকি শূন্যতা পর্ব ৪
রেজওয়ানা রমা

সিদ্ধাত ভাইয়া ধরে নিলো। আমি সিদ্ধাত ভাইয়ার কোলে। দুইজন দুইজনের দিকে অপলক ভাবে তাকিয়ে আছি। কোথায় যেন হারিয়ে গেছি দু’জনই। সবাই যে আমাদের দেখে মিট মিট করে হাসছে সে খেয়াল আমাদের কারো ই নেই। মনে হচ্ছে যেন এ কোনো এক কল্পনা রাজ্য।

যেখানে শুধু মাত্র আমি আর সিদ্ধাত ভাইয়া। চারিপাশে ফুলের সৌরভ। পাখির কিচিরমিচির আওয়াজ। নদীর স্রোতের কলকল শব্দ। দু’জনই মুগ্ধ চোখে তাকিয়ে আছি। আমার সামনে থাকা মানুষ টি অসম্ভব সুন্দর। মায়াবী চোখে তাকিয়ে আছে আমার দিকে। আমিও ডুক্স গিয়েছি তার ওই চোখের চাহনি তে। এতো সুন্দর একটা রোমান্টিক মুহুর্ত কে বারো টা বাজিয়ে নোভা বলে উঠলো,

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

– আপনাদের শুভদৃষ্টি শেষ হলে আমরা অনুষ্ঠান টা শুরু করতে পারি।
নোভার এমন কথায় তারাতারি দুইজন দুইজনকে ছেড়ে দিয়ে উঠে দাঁড়ালাম। উফফ। ধ্যাত এখন লজ্জা লাগছে। কারো দিকে তাকাতেই পারছি না। লজ্জায় মাথা নিচু করে দাড়িয়ে আছি। নোভা হাত ধরে টেনে নিয়ে গেলো। আর সিদ্ধাত ভাইয়া চলে গেল উনার ফ্রেন্ড সিফাত ভাইয়ার কাছে।

আমাদের হল রুম টা খুব সুন্দর করে সাজানো। ফুল আর লাইট দিয়ে পুরো রুম টা সাজানো হয়েছে। এখানে সবাই আছে। আমার পরিবারের সবাই। আম্মু, আব্বু, দাদা, দাদিমা, কাকাই, কাকিমনি, ফুপ্পি, ফুপা। আমার কাজিনরা সবাই আছে। আবার নানু, নানিমা, মামা, মামিমা, খালা মনি। সবাই আছে। পুরো বাড়ি টা আত্মীয় স্বজন গমগম করছে। আর সিদ্ধাত ভাইয়ার পরিবারেরও সবাই আছে। লামু ( ফুপাতো বোন) এসে আমাকে টেনে নিয়ে যায়।

লামু : এই তো ঈশা আপু আর সিদ্ধাত ভাইয়া চলে এসেছে। নাও এবার শুরু করো।
আম্মু: হ্যাঁ হ্যাঁ। এই নে ঈশা এটা সিদ্ধাত কে পরিয়ে দে মা।
আমি: হুম

আম্মু আমার হাতে একটা আংটি ধরিয়ে দিলো। আর বড় মা সিদ্ধাত ভাইয়ার হাতে। মানে আজকে আমাদের এনগেজমেন্ট। সিদ্ধাত আংটি নিয়ে এগিয়ে আসছি। উফফ কিভাবে তাকিয়ে আছে রাক্ষস টা। এতো সুন্দর কেন এই রাক্ষস টা। ইসস কিভাবে হাসছে। আমি এবার চোখ নামিয়ে নিলাম।

রাক্ষস টা আমার সামনে এসে দাড়িয়েছে। মৃদু হাসি মুখে। আমার হাত ধরে আংটি পরাতে যাবে আমি তখন উনার দিকে একটু খানি তাকিয়েছি আর ওমনেই চোখ মারলো আর আমি সাথে সাথে চোখ নামিয়ে নিলাম। রাক্ষস একটা। উফফ। আমিও আংটি পরিয়ে দিলাম। এবার আমাদের দুইজন কে পাশাপাপাশি বসিয়েছে। সবাই আছে এখানে। তৌহিদ (মামাতো ভাই) এবার সকলের উদ্দেশ্য বলে,

– এবার সবাই একটা করে গান গাইবে।
নোভা: হ্যাঁ হ্যাঁ একদম ই তাই।
আম্মু: তোদের এইসব গানে আমি নেই
বড় মা: আমিও নেই

গানের কথা শুনে তো বড় বাবা আর আব্বু আগেই উঠে গেছে। তার পর আম্মু আর বড় মা এমন করে বলে। এক এক করে সবাই চলে যায়। কিন্তু দাদা, দাদিমা আর নানা, নানিমা কে কেউ যেতে দেয় নি। বাড়ির গুরুজন সবাই আমাদের দুইজন কে দোয়া করে চলে গেলো। এখন আছি আমরা, আমার কাজিন, নোভা, ইতি, আর সিফাত ভাইয়া। আমি স্টেজের মাঝখানে বসে আছি। ডান পাশে রাক্ষস, বাম পাশে নোভা আর ইতি। আর রাক্ষসের পাশে সিফাত ভাইয়া। সবাই আড্ডা দিচ্ছে। আমি এখনো রাক্ষসের সাথে ভালো করে কথা বলছি না। হুহ বলবো ও না। আমাকে অনেক কাদিয়েছে। এর মধ্যেই ইতি বলে,

– এখন গান হবে
মিতু ( আমার কাজিন): না না ইতি আপু গান নয় নাচ হবে
নোভা: নাচ, গান দুইটাই হবে।
তৌহিদ : কিন্তু নাচবে কে?
মিতু: তুই নাচবি

মিতুর কথায় সবাই হেসে দিলো। আর তৌহিদের মুখ টা দেখার মত ছিল।
নোভা: আচ্ছা টস হবে। যা উঠবে তাকে তাই করতে হবে।
সবাই নোভার কথায় সমর্থন জানালো।

নোভা আর ইতি কিছু কাগজে নাচ, গান, অভিনয় ইত্যাদি লিখেছে। ওরা সবাই এবার খেলছে। আমি দেখছি আর রাক্ষস টা আমার সাথে কথা বলার চেষ্টা করছে। হিহি কিন্তু আমি পাত্তাই দিচ্ছি না। আমার পাত্তা না পেয়ে রাক্ষস টা লুচির মত ফুলছে। আমার বেশ মজাই লাগছে। এবার রাক্ষস টা আমার গলার কাছে মুখ এনে ফিস ফিস করে বলল,

– কথা বলবি নাকি অন্য রূপ দেখবি
এই কথা শুনে আমার কলিজার পানি শুকিয়ে গেছে। একটা ঢোক গিলে উত্তর দিলাম,
– তোমার রূপ কয় টা?
– অনেক গুলো (ভিলেন মার্কা হাসি দিয়ে)

– বহুরূপী মানুষ কিন্তু আমার মোটেও পছন্দ নয়।
– ওই আমি বহুরূপী?
-তুমি ই তো বললে
-উফফ।
– কিইই
– তুই এমন কেন?
– আমি কেমন?
– অনেক কিউ….
– কি বলেন?
– পেত্নী
– ভালো

হুহ আমি নাকি পেত্নী। শালা খাটাস একটা। আমাকে পেত্নী বলে। হুহ আর কোনো কথাই বলবো না। একটু খানি কথা বলছি ভাব বাড়ছে হুহ। মুখ ঘুরিয়ে বসে আছি। আর রাক্ষস টা মিটমিট করে হাসছে। আমার আরো রাগ হচ্ছে। গা জ্বলে যাচ্ছে আমার। আমার রাগ আরো বাড়িয়ে দিতে রাক্ষস টা আবার মুখ টা কাছে এনে বলে,

– তোকে কেন বিয়ে করেছি জানিস?
আমি রাক্ষসের কথাই প্রশ্নসূচক চাহনি তে তাকিয়ে আছি। রাক্ষস টা আবারও বলে,
– জানিস না তো? জানবি কি করে। তোকে তো বলি নাই। কষ্ট পাবি তাই।
এবার গম্ভীরস্বরে বললাম।

– বলে ফেলো।
– শুনবি?
– হুম
– কষ্ট পাবি তো
– পাবো না বলো

– আসলে তোকে দেখতে তো পুরোপুরি পেত্নীর মত। গায়ের রং একবারেই কালো। ঠিক পাতিলের তলার মতো। আর চোখ গুলো ট্যারা। হাটিস তো প্রতিবন্ধিদের মত। তোকে তো কেউ বিয়ে করতো না। দয়া দেখিয়ে আমি বিয়ে করে নিলাম আর কি।
রাক্ষসের কথা শুনে আমার পুরো গায়ে আগুন জ্বলছে। রাগে বোম হয়ে গেছি পুরোটা। রাগে রাক্ষসের শার্টের কলার ধরে চিৎকার করে বললাম,

– ওই রাক্ষসের বাচ্চা রাক্ষস।কি বললি তুই? আর একবার বল? জাস্ট একবার বল। বল। সাহস থাকলে আর একবার বল। আমি দেখতে কি? পেত্নীর মত? আমি পাতিলের তলার মত কালো? আমার চোখ গুলো ট্যারা? আমি প্রতিবন্ধিদের মত হাটি? ওই রাক্ষসের বাচ্চা। তুই পাতিলের তলার মত কালো। তোর চোখ ট্যারা। তুই নিজে প্রতিবন্ধি। শালা খাটাস, রাক্ষস, মুডির বাচ্চা।

আমার এসব কথা শুনে বাকি খেলা বন্ধ হয়ে গেছে অলরেডি। সিদ্ধাত ভাইয়া তো একবারেই চুপ হয়ে গেছে। আমার মুখে এসব কথা আগে কখনই শুনে নি। বেশ অবাক হয়েছে বুঝতে পারছি। নোভা আর ইতি সাথে সাথে আমার কাছে চলে আসে।
নোভা: কি হয়েছে ঈশা এতো রাগ করছিস কেন?

ইতি: হঠাৎ রেগে গেলি কেন?
আমি: চুপ থাক তোরা।
বলে উঠে এলাম হল রুম থেকে। দৌড়ে নিজের রুমে যাচ্ছিলাম। বড় মা পিছন থেকে ডাকে,
বড় মা: ঈশা মা কোথায় যাচ্ছিস এভাবে?

আমি: বড় মা ( বলেই কেদে দিলাম)
বড় মা: কি হয়েছে মা
আমি: আমার চোখ ট্যারা? আমি পাতিলের তলার মত কালো? আমি প্রতিবন্ধিদের মত হাটি?
বড় মা: কে বলেছে এসব? নিশ্চয় সিদ্ধাত?
আমি: আহ! বলো না আগে

বড় মা: না মা। আমার মেয়ে একটুও ট্যারা নয়। আমার চোখ গুলো তো হরিণী চোখ। আর গায়ের রং তো দুধে আলতা।
আমি: তোমার ছেলের রাতে ভাত বন্ধ
বড় মা: সিদ্ধাত মজা করেছে মা।

আমি: চুপ করো। বলেছে কেন জিজ্ঞাসা করো। বিচার চাই আমার। না হলে আজকে আমি কিচ্ছু খাবো না। গেলাম এই আমি
বড় বাবা: ঈশা মা সিদ্ধাত কাজ টা মোটেও ঠিক করে নাই। তুমি মন খারাপ করো না। সিদ্ধাত কে খুব বকে দেবো।
আমি: তোমার ছেলে আরো কি কি করেছে জানো? এই দেখো আমার হাত দুটি দেখো
বড় বাবা : মেরেছে?

আমি: না। আমার হাত শক্ত করে চেপে ধরেছে। দেখো না কি হয়েছে।
বড় বাবা: সিদ্ধাত কে বকে দেবো। কেন আমার মেয়ের হাতে ব্যাথা দিয়েছে।
আম্মু: ভাইজান আপনার আসকারা পেয়ে পেয়ে ঈশা একটা বাদর তৈরী হয়েছে। ওকে আর আসকারা দেবেন না
আমি: এই ভিলেন আম্মু। একদম চুপ থাকো। নিজে একটা ভিলেন আমার ভালো বড় বাবা কেও ভিলেনগিরি শেখাচ্ছো। তোমাদের সিদ্ধাত কি ধোয়া তুলসী পাতা?

এর মধ্যে হল রুম থেকে সবাই বের হয়। রাক্ষস টা আগে আগে। রাক্ষস কে দেখে বড় মা বলে,
বড় মা: কি রে সিদ্ধাত কি বলেছিস মেয়ে টা কে?
সিদ্ধাত: আমি? আমি কি বললাম?
আমি : আমি পেত্নীর মত দেখতে। চোখ গুলো ট্যারা। এসব কে বলেছে? ( কোমরে হাত দিয়ে)
সিদ্ধাত: কে বলেছে?

আমি: এ বাড়িতে একটা রাক্ষস থাকে। সে বলেছে
সিদ্ধাত: ওমা তাই নাকি। তো কোথায় সে রাক্ষস টা?
বড় মা: সিদ্ধাত এসব কেন বলেছিস তুই ওকে?
সিদ্ধাত ভাইয়া: আমি বলেছে?? কখন বললাম?
বড় বাবা: তুই বলিস নাই?

সিদ্ধাত ভাইয়া: না
আমি: সিদ্ধাতের বাচ্চা তুই রাক্ষস জানতাম, কিন্তু মিথ্যাবাদি সেটা জানতাম না। খবিস, তুই আমার সাথে আর কথাই বলবি না। খাটাস বলেই নিজের রুমে চলে আসি। বড় মা, বড় বাবা সবাই আমাকে ডাকছিলো কিন্তু কারো কথাই কোনো কর্ণপাত না করে চলে এসেছি। রুমের দরজা বন্ধ করে রেখেছি। রাগ হচ্ছে খুব।

রাক্ষস টা অস্বীকার করলো। একবার পাই হাতের কাছে তুলে একটা আছাড় দেবো। রাগে গা জ্বলছে। মনে হচ্ছে রুমের সব ভেঙে ফেলি। রাগে গজগজ করছি আর জুয়েলারি গুলো খুলছি। শাড়ি টা আর চেঞ্জ করলাম না। ধরাম করে বিছানায় লাফিয়ে পড়লাম। উপুড় হয়ে শুয়ে আছি। এখনো রাগ হচ্ছে।

কি বলল রাক্ষস টা। আমাকে দয়া করে বিয়ে করেছে। উনি বিয়ে না করলে আমার বিয়ে হতো না। কত বড় কথা। এই কথা টা তো বড় বাবা বড় মা কে বলতেই ভুলে গেছি। উফফ ঝগড়ার সময় মেইন মেইন পয়েন্ট গুলো ভুলে যাই। ধ্যাত। এবার তো নিজের ওপর রাগ হচ্ছে। এখন আনুমানিক রাত ১০ টা বাজে। ডিনার টাইম।

আম্মু ডাকতে এসেছিলো। খাবো না বলে দিয়েছি। রুমের লাইট অফ করে শুয়ে পড়লাম। কখন যে ঘুমের দেশা পাড়ি জমালাম নিজেও জানি না।

☆☆ হাই, আমি সিদ্ধাত চৌধুরী। ওরফে ঈশার রাক্ষস রাজা । এতোক্ষন তো ঈশার স্টোরি শুনলেন। আমার স্টোরি টা শুনবেন না? চলুন আমার স্টোরি শেয়ার করি, আমার স্টোরি টা শুরু হয়েছিলো আজ থেকে ১১ বছর আগে। যখন আমি এসএসসি এর পর ঈশাদের বাড়িতে গিয়েছিলাম তখন থেকে আমার গল্প শুরু। সেদিন যখন আব্বুর প্রস্তাবে আংকেল বলেছিলো,

পূর্ণতা নাকি শূন্যতা পর্ব ৩

– আমার মেয়ে এখনো ছোট।
সেদিন খুব রাগ হয়েছিল। রেগে সেদিন খাবার টেবিল থেকে উঠে গিয়েছিলাম। মাথায় শুধু একটা কথাই ঘুরছিলো ঈশা কে আমার চাই তো চাই। সেটা যেকোনো মুল্যে। ঈশা দের বাড়ি থেকে বের হয়ে সোজা সিফাতের বাসায় গেলাম। সিফাত কে নিয়ে পার্কে যাই। অতঃপর,,,

পূর্ণতা নাকি শূন্যতা পর্ব ৫