সেদিন তুমি প্রেম নিয়ে এসেছিলে গল্পের লিংক || ফারজানা আফরোজ

সেদিন তুমি প্রেম নিয়ে এসেছিলে পর্ব ১
ফারজানা আফরোজ

বিয়ের ঠিক দুদিন আগে স্পন্দনকে অন্য একটি মেয়ের হাতে চুমু দেওয়া অবস্থায় দেখে শুভ্রতা পা দুটো থমকে দাঁড়ালো। পাথর ন্যায় দাঁড়িয়ে থেকে ঝাপসা চোখ দুটো বন্ধ করে আবারও তাকালো সামনে বসে থাকা স্পন্দন এবং অচেনা মেয়েটির পানে।

মনে মনে বলছে যেন তার দেখাটা মিথ্যে হয়, চোখের ভ্রুক্ষেপ ছাড়া অন্য কিছু নয়। কিন্তু সত্য কি মিথ্যা হয়? ধামাচাপা দেওয়া যায় কি আদৌ? ঠিক তেমনি শুভ্রতার মনে থাকা কথাটি সত্য হলো না, সত্য হলো স্বচক্ষে দেখা বাস্তব দৃশ্যটি। চরণ দুটো দ্রুত ফেলে স্পন্দনের সামনে দাঁড়ালো শুভ্রতা। পিছনে কারো উপস্থিতি টের পেয়ে স্পন্দন তাকালো সেদিকে।

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

গোলাপি কামিজ, খোঁপা করা চুল, মুখো মণ্ডলে রাগের আভাস, ঘৃনা মিশ্রিত দুটো চোখ দেখেই চট করে মনে পড়লো এই মেয়েই তার হবু বউ। মায়ের কাছ থেকে পাত্রীর ছবি দেখেছিল সে। বিয়ে করার মন-মানসিকতা ছিল না স্পন্দনের কিন্তু মায়ের অনুরোধে শুভ্রতার ছবি দেখেই এক পলকে প্রেমে পড়ে সে,

স্বচক্ষে না দেখে ছবি দেখেই বিয়েতে সম্মতি জানিয়ে দিয়েছিল সেদিন কিন্তু ছবিটিতে থাকা মেয়েটির মুখে ছিল একরাশ মায়া, এক আকাশ স্বচ্ছতা মিশ্রিত পবিত্র চাহনি কিন্তু আজ মেয়েটির মুখে কোনো প্রকার মায়া নেই, আছে শুধু তেজ, রাগ। নিজেকে সামাল দিয়ে ঠোঁটের কোনায় হাসি রেখে বলল, হ্যালো, আমি আফনান আবরার স্পন্দন। কেমন আছেন শুভ্রতা ?

রাগে ক্ষোভে ফুঁসছে শুভ্রতা। এ যেন ঝড়ের পূর্ব আভাস। রাগকে কিছুতেই সংযত রাখতে পারছে না সে। কিছু মুহূর্ত আগেও এই ছেলেটি অন্য একটি মেয়ের সাথে ছি ভাবতেই তার ঘৃনা লাগছে। রাগে তার পুরো শরীর কাঁপছে কিন্তু ছেলেটির মাঝে কোনো ভয় নেই, না আছে সংকোচ , ধরা পরে যাওয়ার জন্য নেই লজ্জা। একি অভিনয় নাকি অন্যকিছু। লোকটা কি তাকে বিয়ে করবে না বলে অভিনয় করছে? ভাবতে পারছে না সে। মাথাটা হঠাৎ করেই কাজ করা বন্ধ করে দিয়েছে।

স্পন্দন এক ধ্যানে তাকিয়ে রইল শুভ্রতার দিকে। শুভ্রতার সাড়াশব্দ না পেয়ে বিচলিত কণ্ঠে বলল, এনিথিং রঙ? ঠিক আছেন আপনি? প্রবলেম হলে বলুন আমায়। কি হয়েছে আপনার?
স্পন্দনের পাশে থাকা মেয়েটি কিছুই বুঝল না। সে ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে রইলো শুধু। তবে ঝামেলা যে হয়েছে সে ব্যাপারে কিছুটা আঁচ করতে পেরেছে।

ভয়ে স্পন্দনের একটি হাত শক্ত করে ধরে চোখের ইশারায় কিছু বুঝাতে চাইছে সে। শুভ্রতা মনোযোগী চোখে দেখল সে দৃশ্য। তাৎক্ষণিক তার মেজাজ আকাশ ছোঁয়ায় পরিণীত হলো। রাগকে নিয়ন্ত্রন করতে না পেরে স্পন্দনের গালে সজোরে থাপ্পড় বসিয়ে চেঁচিয়ে উঠল, এই মেয়ের সাথে কু’কীর্তি করে আমায় বিয়ে করতে চাচ্ছেন সামান্যতম ল’জ্জাবোধ নেই আপনার?

আপনি পুরুষ নাকি কা’পুরুষ? নিজের হাঁটুর বয়সী মেয়ের সাথে প্রেম লী’লা করে বিয়ে করতে চাচ্ছেন আমায়? ছি। আমি যদি আজ তাড়াতাড়ি না আসতাম তাহলে তো দেখতেই পেতাম না পাবলিক প্লেসে একজন ছেলে একটি মেয়ের হাতে লোক সমাবেশে চুমু দিচ্ছে।

স্পন্দন বিস্মিত হলো। রাগে তার পুরো শরীর রি’রি করছে। পাবলিক প্লেসে একজন মেয়ের হাতে থা’প্পড় খাওয়াটা সম্মানজনক নয় তার উপর মেয়েটা তাকে চরিত্র’হীন, কা’পুরুষ উপাধি দিয়েই চলছে। স্পন্দন মেয়েদের গায়ে হাত তোলাটা পছন্দ করে না সে কারণে একনো চুপচাপ শুভ্রতার দেওয়া অপবাদ সহ্য করে যাচ্ছে।

শুভ্রতা থামলো। এখন মনে হচ্ছে তার ভিতরে থাকা ক্ষোভ কিছুটা কমেছে। প্রতিবাদী মেয়ে হিসেবে স্কুল কলেজ সব জায়গায় তার আলাদা এক সুনাম রয়েছে। অন্যায় সহ্য করতে পারে না। কোথাও কিছু হলেই সেখানে জড়িয়ে পড়ে সে। এলাকার বকেটে ছেলেরা তাকে প্রতিবাদী আপু বলে চিনে জানে। এক কথায় সকলেই তাকে ভয় পায়।

মেয়ের এই উরুঁচন্ডি জীবনযাপন মানতে নারাজ তার মা বাবা। মেয়ে মানুষের এত রাগ ভালো না। রাস্তায় একা চলাচল করার সময় কখন কোন বি’পদ চলে আসে তার ঠিক নেই সেজন্য ইন্টার মিডিয়েট এক্সাম শেষ হবার এক দেড় মাসের ভিতরেই মেয়ের বিয়ে দেওয়ার জন্য উপছে পড়েছেন শুভ্রতার মা বাবা। বিয়ের পর শশুর বাড়িতে গিয়ে নাহয় বাকি পড়াশোনা করবে।

শুভ্রতা চলে যাবার প্রস্তুতি নিচ্ছিল। যাওয়ার আগে আবারও স্পন্দনের সামনে দাঁড়িয়ে কঠিন গলায় বলল, আপনাকে বিয়ে কিছুতেই করব না আমি। যে ছেলের চরিত্র ঠিক নেই সেই ছেলের সাথে এক ঘরে বসবাস কিংবা সংসার করা আমার পক্ষে সম্ভব নয়।

শুভ্রতা দ্রুত পা চালাল। স্পন্দন নিশ্চুপ থেকে বারবার নিজের রাগকে কন্ট্রোল করল। স্পন্দনের বিশেষ একটি গুণের মধ্যে রাগ নিয়ন্ত্রণ রাখা অন্যতম একটি গুণ। সকল পরিস্থিতে সে শান্ত থাকতে পারে। ঠাণ্ডা মাথায় কাজ করে সে। পাশে দাঁড়িয়ে থাকা মুনির দিকে তাকিয়ে হাসল স্পন্দন। মেয়েটা ভয়ে জড়োসড়ো হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। মুনিকে আশ্বাস দিয়ে হাতের ইশারায় বুঝালো , কিছুই হয়নি, ভয় পাওয়ার কিছু নেই। চল বাসায় যাই।

মুনি বুঝল খুব বড় একটা সমস্যা হয়েছে। মনেমনে রাগ হলো শুভ্রতার উপর। মেয়েটার কত্ত সাহস তার ভাইয়ের গায়ে হাত তুলেছে। ইচ্ছে করছে হাতে কা’মড়ে দিতে কিন্তু স্পন্দনের এসব পছন্দ নয় তাই সেও চুপচাপ দাঁড়িয়ে ছিল।
মুনি সম্পর্কে স্পন্দনের ছোট চাচার মেয়ে। মেয়েটা কথা বলতে পারে না, কানেও শুনে না।

বয়স সতেরো কিন্তু তার আচরণ আট/ দশ বছরের বাচ্চাদের মতন। মুনি প্রতিবন্ধী। মুরব্বিরা প্রায় বলে থাকে বাবা মায়ের পা’পের শা’স্তি নাকি সন্তান পেয়ে থাকে কথাটা কতটুকু সত্য জানা নেই তবে মুনি পাচ্ছে সেই শাস্তি। বাবা মায়ের অ’নৈতিক সম্পর্কে মুনির মায়ের গ’র্ভে মুনি আসে।

তাই অতি দ্রুত তারা বিয়েটাও সেরে ফেলে তবে বিয়ের পর চেয়েছিল এ’ব’র’শ’ন করাতে কিন্তু স্পন্দনের মায়ের কারণে পারেনি। প্রথম খুব আদর ভালোবাসা পেত মুনি কিন্তু যখন তার অসুস্থতা ধরা পরে তখনই তাকে দূরে সরিয়ে রাখে তার মা বাবা। বড় মা অর্থাৎ স্পন্দনের মা মুনিকে আদর যত্নে বড় করে তুলছেন।

মুনি বড় ভাই আর বড় আম্মু বলতে পাগল। যখন তাকে বলা হয়েছিল স্পন্দনের বিয়ের খবর তখনই বায়না ধরে সে বউ দেখবে। স্পন্দনের মা এক ঢিলে দুই পাখি শিকার করার মতো কাজ করলেন, এক স্পন্দন যেহেতু শুভ্রতাকে দেখেনি এই ফাঁকে শুভ্রতাকে তার ছেলের দেখা হয়ে যাবে অন্যদিকে মুনির ইচ্ছে পূরণ হবে। কে জানত এই দেখাটা তাদের জন্য মঙ্গল’জনক নয়।

দুপুরের রোদে ক্লান্ত শরীরে এক গ্লাস ঠান্ডা সরবতের কথা বলে সোফায় গা এলিয়ে দিলেন আজিদ হাওলাদার। তিনি সম্পর্কে শুভ্রতার বাবা। রিটায়ার্ড আর্মি অফিসার। শুভ্রতা বাসায় প্রবেশ করেই রাগে এক প্রকার চিৎকার করে বলল, বাবা, আমি এই বিয়ে কিছুতেই করব না। ছেলের চরিত্র ভালো না। তোমরা কি দিকে এমন বদ ছেলের সাথে আমার বিয়ে দিচ্ছ? বোঝা হয়ে যাচ্ছি তাই না। এই ছেলেকে বিয়ে করার চেয়ে সুই’সাইড করা ঢের ভালো।

শুভ্রতার ফর্সা মুখ রক্তিম আভা ধারণ করেছে। তার রাগ ভয়ানক রূপ ধারণ করে। এই রাগের কারণে সে প্রায় ভুল কাজ করে ফেলে। নিজের রাগকে কন্ট্রোল রাখার সামর্থ্য তার নেই। দ্রুত পা চালিয়ে নিজের রুমে চলে গেল। এত তাড়াতাড়ি বিয়ে করার ইচ্ছে তার মোটেও ছিল না তার উপর বাবা মা তার জন্য বাজে, অসভ্য ছেলে পছন্দ করেছে ভাবতেই তার রাগ আকাশ ছুঁয়ে যাচ্ছে।

ওয়াশরুমে ঢুকে ঝর্না ছেড়ে টাইলসের উপর বসে পড়ল সে। আপাতত মাথা ঠান্ডা রাখতে হবে।
স্পন্দন বাসায় প্রবেশ করেই কাউকে কিছু না বলে হনহন করে নিজের রুমে ঢুকে গেল। ছেলের মুখ দেখে আঁতকে উঠলেন রুজিনা বেগম। মুনকে ইশারায় জিজ্ঞাসা করলেন, কি হয়েছে?

মুনি যা দেখেছে ইশারায় বুঝালো তার বড় মাকে তবে চ’ড়ের ব্যাপারটা লুকিয়ে রাখল। স্পন্দন বলেছে থা’প্পড়ের কথা যেন কেউ না জানে। মুনি প্রতিবন্ধী হলেও বড় ভাইয়ের কথা সে অমান্য করে না তাই চুপচাপ লুকিয়ে গেল সে কথা। এদিকে রুজিনা বেগম চিন্তায় পড়ে গেলেন। এই বিয়েটা যদি না হয় তাহলে তার প্রিয় বান্ধবীকে মুখ দেখাতে পারবেন না। চট জলদি ফোন দিলেন শুভ্রতার মাকে……..

সেদিন তুমি প্রেম নিয়ে এসেছিলে পর্ব ২