পূর্ণিমাতিথি পর্ব ১৮

পূর্ণিমাতিথি পর্ব ১৮
লেখিকা-তাসনিম জাহান রিয়া

চোখ খুলতেই উনার মুখটা প্রথম দেখতে পাই। উনার চোখ মুখে দুশ্চিন্তার ছাপ। আমাকে চোখ খুলতে দেখেই উনি গালে হাত গলিয়ে দিয়ে বলে ওঠলেন,
এখন কেমন লাগছে? আগের থেকে একটু বেটার ফিল করছো?
আমি মাথা নাড়িয়ে সাই জানালাম। আমি ওঠার চেষ্টা করতেই উনি আমাকে ধরে বসিয়ে দিলেন। আমি চারদিকে তাকিয়ে বুঝতে পারলাম এটা হসপিটাল। বাম হাত তুলতে নিলেই হাতে সুক্ষ ব্যাথা অনুভব করলাম। মুখ দিয়ে অস্পষ্ট ভেসে আসলো ‘আহ’

সাবধানে এতো নড়াচড়া করছো কোনো।
আমি এখানে আসলাম কী করে? আমি তো
তুমি এখন অসুস্থ। এসব নিয়ে টেনশন করার দরকার নেই। বাসার কেউ জানে না তোমার এই অবস্থার কথা।
আপনি বলেননি কেনো? তারা আমাকে নিয়ে টেনশন করবে না? আমি কতক্ষণ ধরে এখানে আছি?

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

তুমি দুই ঘন্টা ধরে এখানে আছো। বাসাই বলেছি তোমাকে নিয়ে আমি ঘুরতে গেছি। তোমার ভাই শুধু জানে। শাওন ভাই ঔষধ আনতে গেছে। বাসার আর কাউকে বলি নাই। তোমার মা আর আমার মা এই দুই মহিলা জানলে কাঁদতে কাঁদতে নিজেরাই অসুস্থ হয়ে পড়বে। পড়ে তাদের সামলাবো নাকি তোমাকে সামলাবো।

আমি ফিক করে হেসে দিলাম। আমার একটু হাত কেটে গেলেই আম্মু আর মামুনি কেঁদে কেঁদে অস্থির হয়ে যায়। মানুষ বলেই মায়ের পর যদি কেউ মায়ের মতো ভালোবাসতে পারে সেটা মায়ের বোন। অনেকের একটা মাও থাকে না সেদিক থেকে আমি অনেক ভাগ্যবান। আমার দুই দুইটা মা।
ভাইয়া হুড়মুড় করে কেবিনে ঢুকলো। কোনো দিকে না তাকিয়ে রুদ্রের দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করে,
রিয়ার ঙ্গান ফিরেছে?

তুমি নিজেই দেখো না।
আমার দিকে তাকিয়েই ভাইয়া একটা জুড়ে নিশ্বাস নিলো। যেনো এতক্ষণ দমটা আটকে ছিল।
বনু তুই ঠিক আছিস? তোর কোনো কষ্ট হচ্ছে না তো? কষ্ট হলে কিন্তু আমাকে বলবি।
আমি একদম ঠিক আছি। তুমি এতো চিন্তা করো না।

তোকে কে আঘাত করলো? কার সাথে তোর এতো শত্রুতা যে তোর ক্ষতি করতে চায়।
রুদ্র ভাইয়াকে থামিয়ে দিয়ে বললো, এখন এসব কথা থাক। এসব নিয়ে পরে কথায় ভালো।
ভাইয়া আর কিছু বললো না। মাথায় হাত দিয়ে বুঝতে পারলায় মাথায় ব্যান্ডেজ করা হয়েছে। আমি হাসফাস করছি। আমার এখানে একটুও ভালো লাগছে না। ভাইয়া আর উনি কথা বলছেন। আমি বিরক্তি নিয়ে বললাম,
বাসায় যাব কখন? আমার এখানে একটুও ভালো লাগছে না।
একটু পরই আমরা বাসায় চলে যাব। এখন চুপচাপ শুয়ে থাকো তো।

গাড়ি বাসার সামনে এসে দাঁড়াতেই উনি গাড়ি থেকে নেমেই আমাকে কোলে তুলে নিলেন। বিস্ময়ে আমার চোখ বড় বড় হয়ে গেছে।
কী করছেন কী? নামান আমাকে। আমি মাথায় আঘাত পেয়েছি পায়ে না। আমার পা একদম ঠিক আছে। আমি হেঁটে যেতে পারবো।
একদম চুপ। আরেকটা কথা বললে মুখ সেলাই করে দিব।

আমার প্রচন্ড রকমের অস্বস্তি হচ্ছে। নিজের বড় ভাইয়ের সামনে নিজের স্বামীর কোলে ওঠার থেকে লজ্জাজনক বিষয় আর কিছু হতে পারে। লজ্জায় আমি হাসফাস করছি। ভাইয়ার দিকে তাকালাম। ভাইয়া ফোন স্ক্রল করতে করতে আমাদের এমন ভাবে ক্রস করে গেলো যেনো আমাদের দেখতেই পাইনি। ভাইয়া আগে চলে গেলো আমরা পিছন পিছন আসছি।

ভাইয়া কলিংবেল বাজাতেই মামুনি এসে দরজা খুলে দেয়। মামুনির পিছনে আম্মুও আসে। হয়তো ভাইয়াই আম্মুকে এখানে রেখে গেছে। আমাকে উনার কোলে দেখে আম্মু আর মামুনি অস্থির হয়ে পড়ে। আমার মাথায় ব্যান্ডেজ করা দেখে আম্মু আর মামুনি কান্না-কাটি শুরু করে দিয়েছে। হাজারটা প্রশ্ন করছে। আমি আঘাত পেলাম কী করে? তাদের আগে জানানো হয়নি কেনো? ব্লা ব্লা।

আমি লজ্জায় এদিক ওদিক তাকাচ্ছি। আমি এখনো উনার কোলেই আছি। ভাইয়ার সামনেও এতোটা লজ্জা লাগেনি আম্মু আর মামুনির সামনে যতটা লাগছে। ভাইয়া আমার অস্বস্তিটা বুঝতে পেরে আম্মু আর মামুনিকে উদ্দেশ্য করে বলে,
তোমরা কী আমাদের বাইরে দাঁড় করিয়ে রাখবা? দেখছো মেয়েটা অসুস্থ। তার মাঝে তোমাদের দুই মহিলার হাজারটা প্রশ্ন। আগে ওদের ঢুকতে তো দাও। তারপর প্রশ্ন করো।

আম্মু আর মামুনি দরজার সামনে থেকে সরে দাঁড়ায়। উনি আমাকে নিয়ে ভিতরে ঢুকেন। আমাকে সোফায় বসিয়ে দিলেন। এতক্ষণে উনি মুখ খুললেন,
এজন্যই তোমাদেরকে বলা হয়নি। কিছু না হতেই কান্নাকাটি করে তোমরা দুজন বন্যা বানিয়ে দাও। তোমরা অসুস্থ হয়ে পড়লে তোমাদের স্বামীরা আমাদের দুজনকে ধরতো।
উনি আর ভাইয়া চলে গেলেন ফ্রেশ হতে। আম্মু আর মামুনি ব্যস্ত হয়ে পড়লো আমাকে নিয়ে।

রুদ্র সবাইকে বলেছে শরীর দুর্বল থাকায় আমি মাথা ঘুরে পড়ে গিয়েছিলাম। ঠিক মতো খাওয়া দাওয়া করি না বলে সবাই আমাকে হাজারটা কথা শুনালো। আব্বু কিছুক্ষণ আগে চলে গেছে। আমরা বাসায় আসার কিছুক্ষণ পর পরই আব্বু এসেছিল। আব্বুও এসে সেই আমার খাওয়া নিয়ে পড়লো। অবশ্য আব্বু আমাকে বকা দেয়নি। আব্বু জানে আব্বু আমাকে বকা দিলে আমি কান্নাকাটি শুরু করে দিব। সেই কান্না থামানোর সাধ্য কারো নেই।

বিছানায় হেলান দিয়ে বইয়ের পাতা মুখ ডুবিয়ে আছি। উনি ওয়াশরুমে গেছেন। প্রচন্ড বিরক্তি নিয়ে বইয়ের পাতা উল্টাচ্ছি। আমার এই বিরক্তির কারণ হচ্ছে আমার দুই মা। কথায় আছে না অতিরিক্ত কোনো কিছুই ভালো না। তেমনি উনাদের অতিরিক্ত সেবায় আমার প্রাণ উষ্টাগত। কিছুক্ষণ পরে উনি টাওয়াল দিয়ে মুখ মুছতে মুছতে ওয়াশরুম থেকে বের হলেন। উনি টাওয়ালটা বেলকনিতে মেলে দিয়ে আমার সামনে এসে দাঁড়ালেন। তখনি আম্মু আর মামুনির আগমন
ঘটে। উনাদের পিছনে পিছনে আংকেল আর ভাইয়াও আসে। মামুনি আমার পাশে বসতে বসতে উনাকে উদ্দেশ্য করে বলেন,

রুদ্র তুই আজকে তোর বাবার সাথে ঘুমা। আমি আর তোর খালামনি আজকে রিয়ার সাথে থাকবো।
আংকেল রুদ্রের কাধে হাত রেখে বলে, চল আজকে বাপ বেটা একসাথে ঘুমাবো। তার আগে আড্ডা দিব।
আংকেলের কথা শুনেই উনি লাফিয়ে আংকেলের থেকে দুই হাত দূরে সরে যান।
আম্মু আমি আব্বুর সাথে ঘুমাবো না।

তাহলে শাওনের সাথে ঘুমা।
একদমই না। আমি আব্বু বা শাওন ভাইয়া কারো সাথেই থাকবো না। শাওন ভাই ঘুমের মাঝে শরীরের হাত-পা তুলে দেয়। আর আব্বু….
আংকেলের দিকে তাকিয়ে রুদ্র থেমে যায়। মামুনি কিছুক্ষণ ভেবে বলে,

বাসায় তো রুমের অভাব ছিল না। কিন্তু সব রুমেই তো অপরিষ্কার। থাকা হয় না তো সব সময় খালিই পরে থাকে। শাওন তুই তোর আংকেলের সাথে থাক। রুদ্র একাই থাকুক।
তোমার জামাইয়ের সাথে আমি কিছুতেই থাকবো না। মনে আছে তিন বছর আগে আব্বু আর আম্মুর বিবাহ বার্ষিকীর দিন আমি আর আংকেল একসাথে ছিলাম। জানো না তো ঐদিন আংকেল আমাকে তুমি ভেবে জড়িয়ে ধরে কী কী বলছে। নাউযুবিল্লাহ আমার বলতেও শরম করে।

ভাইয়ার কথা শুনে আংকেল কাঁশতে কাঁশতে রুম থেকে বের হয়ে যান। আমরা সবাই হেসে দেই। রুদ্রও মুচকি মুচকি হাসছে। এই প্রথম আমি উনাকে আসতে দেখলাম। হাসলে উনাকে ভীষণ সুন্দর লাগে। হঠাৎই উনি গম্ভীর হয়ে বলে ওঠলেন,
থাকা নিয়ে চিন্তা করতে হবে না। আমি আজকে বাসায় থাকবো না আমার নাইট ডিউটি আছে। এখনি হসপিটালে যেতে হবে। আমি আসছি।
এই বলে উনি বেরিয়ে গেলেন। উনার পিছন পিছন ভাইয়াও চলে গেলো।

পূর্ণিমাতিথি পর্ব ১৭

এখন দুপুর দুটো বাজে। এতক্ষণে ফোনে গেইম খেলছিলাম। চরম বিরক্তি নিয়ে ফোনটা রেখে দিলাম। গেইম খেলতেও ভালো লাগছে না। আমি রুদ্রের দিকে তাকালাম। কী নিশ্চিন্তে উনি ঘুমাচ্ছেন। আমার নজর বার বার উনার কানের নিচের তিলটার দিকে যাচ্ছে। তিলটা আমাকে খুব টানছে। আচ্ছা এখন তো উনি ঘুমাচ্ছেন। একটু ছুঁয়ে দিলে নিশ্চয়ই খুব বড় ক্ষতি হয়ে যাবে না। আমি টুপ করে একটা চুমু খেয়ে নিলাম তিলটায়। সাথে সাথেই উনি নড়ে ওঠলেন। আমি ছিটকে দূরে সরে গেলাম। ভয়ে চোখ বন্ধ করে ফেললাম।

পূর্ণিমাতিথি পর্ব ১৯