পূর্ণিমাতিথি পর্ব ১৯

পূর্ণিমাতিথি পর্ব ১৯
লেখিকা-তাসনিম জাহান রিয়া

এখন দুপুর দুটো বাজে। এতক্ষণে ফোনে গেইম খেলছিলাম। চরম বিরক্তি নিয়ে ফোনটা রেখে দিলাম। গেইম খেলতেও ভালো লাগছে না। আমি রুদ্রের দিকে তাকালাম। কী নিশ্চিন্তে উনি ঘুমাচ্ছেন। আমার নজর বার বার উনার কানের নিচের তিলটার দিকে যাচ্ছে। তিলটা আমাকে খুব টানছে। আচ্ছা এখন তো উনি ঘুমাচ্ছেন। একটু ছুঁয়ে দিলে নিশ্চয়ই খুব বড় ক্ষতি হয়ে যাবে না। আমি টুপ করে একটা চুমু খেয়ে নিলাম তিলটায়। সাথে সাথেই উনি নড়ে ওঠলেন। আমি ছিটকে দূরে সরে গেলাম। ভয়ে চোখ বন্ধ করে ফেললাম। উনার কোনো সাড়া শব্দ না পেয়ে আস্তে আস্তে চোখ খুললাম। উনি নড়েচড়ে আবার ঘুমিয়ে পড়েছেন। উনার ঘুমন্ত মুখটা দেখে হাফ ছেড়ে বাঁচলাম। চুপিচুপি রুম থেকে বের হয়ে গেলাম।

আজকে মনটা বেশ ফুরফুরে। আমার মনটা তো তখনি ফুরফুরে থাকে যখন ভাইয়াকে খোঁচাতে পারি। আজকে ভাইয়ার ক্রাশের সামনে ভাইয়ার মান-সম্মান প্লাস্টিক বানিয়ে দিয়েছি। ফুরফুরে মেজাজ নিয়েই রুমে ঢুকলাম। রুমে ঢুকে উনার মুখটা দেখে ভয়ে চুপসে গেলাম। উনি আমার দিকে অগ্নি দৃষ্টি নিয়ে তাকিয়ে আছেন। ক্রুদ্ধ কন্ঠে বলে ওঠলেন,
বিহান তোমাকে কেনো ফোন দেয়?

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

কথাটা বলতে বলতে উনি আমার দিকে দু পা এগিয়ে আসলেন। ভয়ে আমি দু পা পিছিয়ে গেলাম।
কী হলো চুপ করে আছো কেনো? বিহানের নাম্বার তোমার ফোনে সেইভ করা কেনো? আন্সার মি। বিহান তোমাকে কেনো ফোন দিচ্ছে?

আমি তো বিহানের নাম্বারটা নিজের ফোন থেকে ডিলিট করতেই ভুলে গিয়েছিলাম। এটা নিয়েও এখন উনি রাগ দেখাবেন। নিজের হতবুদ্ধির জন্য নিজেকেই গালি দিতে ইচ্ছে করছে। আমি আমতা আমতা করে বললাম,
আমি কী করে বলবো? আমি তো ফোন দিচ্ছি না, বিহান আমাকে ফোন দিচ্ছে। বিহান আমাকে কেনো ফোন দিচ্ছে সেটা আপনি বিহানকেই জিঙ্গেস করুন।

তুমি ওর সাথে যোগাযোগ না রাখলে ওর সাহস হতো না তোমাকে ফোন দেওয়ার।
আজব আমি কেনো ওর সাথে যোগাযোগ রাখতে যাব? আমি তো….
আমি কথা বলার মাঝখানেই আমার ফোনটা আবার বেজে ওঠলো। বিহানের নামটা দেখেই মেজাজটাই খারাপ হয়ে গেলো। বুঝতে পারছি না এই ছেলেটার সমস্যা কী? কেনো আমার সুখের সংসারে আগুন লাগাতে চাইছে? বিহানকে কিছু কড়া কথা শোনানোর জন্য উনার হাত থেকে ফোনটা নিতেই উনি আমার হাত থেকে ফোনটা কেড়ে নিয়ে ছুঁড়ে মারেন। শব্দে আমি কেঁপে ওঠি। মুহুর্তের মাঝেই আমার চোখের সামনে আমার প্রিয় ফোনটা ভেঙে তিন টুকরো হয়ে গেলো। জলে চোখ আমার টই টম্বুর হয়ে গেলো। উনি আমার বাহু চেপে ধরে বলেন,

তোমার ফোনের কোনো দরকার নেই। ফোন ইউস করার বয়স এখনো তোমার হয়নি। পড়াশোনা করবা, খাবা, ঘুমাবা আর কোচিংয়ে যাবা আসবা। বাসার কারো সাথে যোগাযোগ করতে হলে আমার ফোন থেকে অথবা আম্মুর ফোন দিয়ে কথা বলবা। না থাকবে বাঁশ আর না বাঁজবে বাঁশি। নেক্সট টাইম তোমাকে যদি বিহানের সাথে যোগাযোগ করতে দেখি এর ফল কিন্তু ভালো হবে না। মাইন্ড ইট।

কথাগুলো বলেই উনি আমাকে ছেড়ে দিলেন। হনহনিয়ে রুম থেকে চলে গেলেন। উনার সাথে বিয়ে হয়েছে বলে আমার কোনো স্বাধীনতা থাকবে না? নিজের ইচ্ছে মতো চলাফেরা করতে পারবো না। অসম্ভব আমি এতোটাও বাধ্য মেয়ে নই।

আমি আর ত্রয়ী একটা কফি শপে বসে আছি। উনাকে অনেক বলে কয়ে কোচিংয়ের কাছের কফি শপটাই এসেছি। উনি সাফ সাফ বলে দিয়েছেন একা একা বাসায় ফেরার চেষ্টা যাতে না করি। উনি আমাকে নিয়ে যাবেন।
দোস্ত দেখ ছেলেটা কত্তো কিউট। ফর্সা, লম্বা কোনো নায়কের থেকে কম লাগছে না। এই ছেলের বউ যে হবে সে তো ভাগ্যবতী। ইশ আমি যদি সেই ভাগ্যবতী হতে পারতাম। উফ এই ছেলেটা যদি আমার হাজবেন্ড হতো। কপালে নজর ফোটা লাগিয়ে দিতাম। কেউ যাতে নজর না দিতে পারে। দেখ গালগুলো কেমন ফোলা ফোলা। ইচ্ছে করছে গালটা টেনে দেই।

ত্রয়ীর কথাশুনে আমি কফি শপের প্রবেশদ্বারের দিকে তাকাই। কফি শপে রুদ্র ঢুকছে। আমার চোখ দুটো বড় বড় হয়ে গেছে। গলায় কফি আটকে গিয়ে কাশি ওঠে গেছে। কিন্তু আমার বান্ধবীর সেদিকে নজর নেই। সে তো রুদ্রকে নিয়ে কল্পনার জগৎ এ ভাসছে।
দোস্ত দেখ ছেলেটা আমাদের এদিকেই আসছে। দেখ ছেলেটার হাটার স্টাইল। সিরিয়াসলি আমি এবার হার্ট এ্যাটাক করে ফেলবো।

আমি নিজেকে সামলে নিয়ে আবার রুদ্রর দিকে তাকাই। রুদ্র আমাদের টেবিলের অনেকটাই কাছে চলে আসছে। উনি আমাদের টেবিলের সামনে দাঁড়িয়ে আমাকে উদ্দেশ্য করে বলেন,
তোমার কফি খাওয়া শেষ?
আমি মাথা নাড়িয়ে সম্মতি জানায়।
চল এবার।

আমি চেয়ার ছেড়ে ওঠলাম। উনার পায়ের সাথে পা মিলিয়ে হাঁটছি। একবার ঘাড় ঘুরিয়ে পিছনে তাকালাম। আমাদের দুজনকে একসাথে দেখে ত্রয়ী যে বেশ অবাক হয়েছে। সেটা ত্রয়ীর মুখ দেখেই বুঝা যাচ্ছে। এতোটাই অবাক হয়েছে যে মুখটা হা হয়ে গেছে। আমি ত্রয়ীর দিকে তাকিয়ে চোখ মারলাম। ত্রয়ী চমকে ওঠে। আমি মুচকি হেসে চলে এলাম।
উনি গাড়িতে ওঠলেন। আমিও উনার পিছন পিছন গাড়িতে ওঠলাম। উনি আমার দিকে একটা চকলেট এগিয়ে দিলেন। আমি চকলেটটা নিতে নিতে বললাম,
ক্ষতিপূরণ দিচ্ছেন নাকি ঘুষ?

যা ভাবো তাই। তোমার সাথে ওমন ব্যবহার করা আমার উচিত হয়নি। আমার সবচেয়ে বড় সমস্যা রাগ ওঠলে আমি নিজের রাগ কনট্রোল করতে পারি না। তবে তোমার একটা বিষয় আমার ভালো লাগে।
আমার কোনো বিষয় আপনার ভালো লাগতে পারে। আমি তো ভাবতেই পারছি না। আমি যা করি সবই তো আপনার অপছন্দ।

আমার রাগ ওঠলে তুমি অযথা তর্ক করো না।
অন্য সময় তুমি আমার সাথে যেভাবে তর্ক করো, তখন তুমি শান্তভাবে আমাকে বুঝানোর চেষ্টা করো। স্বামী স্ত্রীর সম্পর্ক হওয়া উচিত আগুন আর জলের মতো। একজন রেগে গেলে আরেকজন শান্ত থাকতে হয়।
আমি উনার দিকে তাকিয়ে আছি। উনি সামনের দিকে তাকিয়ে এক মনে ড্রাইভ করে যাচ্ছেন। উনি যে স্বামী স্ত্রীর সম্পর্কের কথা বললেন উনি কী আমাকে নিজের স্ত্রী বলে মানেন? প্রশ্নটা আর করা হলো না। কিছু প্রশ্নের উত্তর না জানাই ভালো। উনার উত্তরটা যদি পজিটিভ হয় তাহলে হয়তো আমি খুশি হবো। যদি নেগেটিভ হয় তাহলে হৃদয়ে দহন বাড়বে। শুধু শুধু নিজের কষ্ট বাড়ানোর তো কোনো মানে হয় না।

বাসাই এসে প্রীলিয়া আপুকে ড্রয়িংরুমে বসে থাকতে দেখে আমি চমকে গেলাম। হুটহাট এদের আগমন আমার সুবিধার ঠেকছে না। আমার পিছনে এসে রুদ্র দাঁড়ায়। আমি পিছন ফিরে একবার রুদ্রর দিকে তাকাই। রুদ্র চোখ মুখ শক্ত করে বলে,
কী ব্যাপার প্রীলিয়া? তুমি এখানে কী করছো?
প্রীলিয়া সোফা ছেড়ে ওঠে দাঁড়ায়। আমাদের দিকে এগিয়ে আসতে আসতে বলে,
বারে আমি বুঝি আমার ফুফির বাসায় আসতে পারি না।
না আসতে পারো না। কেনো এসেছো এখানে?

ফুফির বাসায় আসতে বুঝি কোনো কারণ লাগে? ফুফির বাসায় তো যেকোনো সময় আসা যায়। ফুফির বাসায় আসতে কোনো নিমন্ত্রণ লাগে না আর না লাগে কোনো কারণ। বিনা নিমন্ত্রণেই তো মানুষ ফুফির বাসায় যায়।
প্রীলিয়া আপুর কথাগুলো হয়তো উনার পছন্দ হয়নি। প্রীলিয়া আপুর এমন হেয়ালিপনায় রুদ্র আরো রেগে গেলো। চোয়াল শক্ত করে বলে,

পূর্ণিমাতিথি পর্ব ১৮

কীসের ফুফির বাসা? আমার আম্মু তোমার ফুফি না। তোমাদের সাথে আমাদের কোনো সম্পর্ক নেই। তাই তোমার কোনো অধিকার নেই আমাদের বাসায় আসার। সন্নিতা দি, ,, সন্নিতা দি।
রুদ্রর ডাক শোনা মাত্রই সন্নিতা দি ছুটে আসে। এসব কিছুর মাঝে আমি নিরব দর্শক।
শুনো এই মেয়ে যাতে নেক্সট টাইম আমাদের বাসায় না ঢুকতে পারে। এখন ওকে ঘাড় ধাক্কা দিয়ে বাসা থেকে বের করে দাও আর দাঁড়য়ানকে বলে এসো ওকে যেনো নেক্সট টাইম আমাদের বাসায় ঢুকতে না দেয়।

পূর্ণিমাতিথি পর্ব ২০