পূর্ণিমাতিথি পর্ব ২১

পূর্ণিমাতিথি পর্ব ২১
লেখিকা-তাসনিম জাহান রিয়া

হঠাৎই উনি রেগে গিয়ে আমার হাত দুটো বিছানার সাথে চেপে ধরেন। হঠাৎ উনার রেগে যাওয়ার কারণটা আমি বুঝতে পারছি না। উনার এমন হুট হাট আক্রমনে কোনদিন না জানি আমি হার্ট এ্যাটাক করে ফেলি। উনি তীক্ষ্ণ কন্ঠে বলেন.,
তুমি….

উনি উনার কথা আর সম্পূর্ণ করতে পারলেন নাহ তার আগেই উনার ফোনটা বেজে ওঠে। উনি আমার এক হাত ছেড়ে দিয়ে ফোনটা বের করলেন। ফোনের স্কিনে এক পলক তাকিয়ে উনি আমাকে ছেড়ে দিলেন। ফোনটা নিয়ে ঝটফট বেলকনিতে চলে গেলেন। উনি বেলকনিতে চলে যেতেই আমি হাফ ছেড়ে বাঁচলাম। এতক্ষণ যেনো দমটা আটকে ছিলো।

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

কতক্ষণ ধরে লাফাচ্ছি ফুলটা পারার জন্য। কিন্তু কিছুতেই নাগাল পাচ্ছি না। এই বাসার সামনে একটা মোটামুটি বড় একটা বাগান আছে। বিভিন্ন ফুল গাছে ভরপুর। ফুল আমার বরাবরই প্রিয়। বেলী ফুল একটু বেশি প্রিয়। হুট করেই ইচ্ছে জাগলো বেলি ফুলের মালা গাঁথার। নিজের ইচ্ছেকে প্রাধান্য দিয়ে ফুল পারতে এসেছিলাম। কিন্তু হাত দিয়ে ফুল কিছুতেই নাগাল পাচ্ছি না। হুট করেই কারো হাসির শব্দ শুনে আমি ভয় পেয়ে গেলাম। হাসির শব্দটা একদমি অপরিচিত। আমি ঘাড়
ঘুরিয়ে পিছনে তাকাই। আমার থেকে একটু দূরে রুদ্র দাঁড়িয়ে আছেন। বুকে দুই হাত গুঁজে দেয়ালের সাথে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন।

আমি চোখ বড় বড় করে উনার দিকে তাকিয়ে আছি। উনি যে হাসতেও পারেন। সেটা আমার অজানা ছিল। ত্রয়ীর মতো আজকে আমারও মনে হচ্ছে উনি এতো কিউট কেনো? উনার হাসিতে আমি ফিদা হয়ে গেলাম। উফ এই মানুষটা এতো পারফেক্ট কেনো? উনার সবকিছুই নিখুঁত। হাসলেও যে একটা মানুষকে এতো সুন্দর লাগতে পারে আমার জানা ছিল না। ইচ্ছে করছে কপালে একটা নজর ফোটা দিয়ে দেই। যাতে কেউ নজর না দিতে পারে।

উনি আমার দিকে এগিয়ে আসতে আসতে বলেন, তোমার মতো আঙ্গুর সাইজ মেয়ে এই ফুল নাগাল পাবে না।
আমি গাল ফুলিয়ে উনার দিকে তাকাই। উনি কিউট না আস্ত একটা বজ্জাত। আমাকে পিঞ্চ মেরে কথা বলার একটা সুযোগও উনি ছাড়েন না। আমি চলে আসতে নিলে উনি আমাকে ডেকে ওঠেন,

কী হলো? ফুল নিবা না?
না এই ফুলগুলো দেখতে ভালো না।
আমার কথা শুনে উনি আরো বেশি হাসা শুরু করে দিয়েছেন। যেনো আমি কোনো জোক্স বলছি। উনি হাসতে হাসতে আমার উদ্দেশ্যে বলেন,

ইউ নো তোমার অবস্থাও হয়েছে শেয়ালের মতো। আঙ্গুর ফল টক।
আমি উনার দিকে তাকিয়ে রাগে কটমট করতে করতে বলি,
আমার কোচিংয়ের সময় হয়ে গেছে। আপনি কী নিয়ে যাবেন? নাকি আমি একাই চলে যাব।
আজকে আমার কোথাও যেতে টেতে ইচ্ছে করছে না। তুমি একাই চলে যাও। যেতে পারবা তো একা? রাস্তা চিনবা? তুমি তো আবার পিচ্চি রাস্তা-টাস্তা হারিয়ে ফেলতে পারো।
আমি উনার দিকে চোখ রাঙিয়ে তাকাই। তারপর শব্দ করে হেঁটে চলে আসি। শব্দ করে হেঁটে আসার উদ্দেশ্য হলো উনাকে বুঝানো আমি ভীষণ রেগে আছি।

উনি নিয়ে আসবেন নাহ বলেও নিয়ে আসছেন। আমি প্রথমে উনার সাথে না আসতে চাইলে উনি বলেন,
তোমাকে নিয়ে রিস্ক নেওয়া যাবে না। বউ গেলে বউ পাওয়া যাবে। কিন্তু এমন কিউট বউ পাওয়া যাবে না।
কোচিংয়ে আসতেই ত্রয়ীর বকবক শুরু হয়ে গেছে। ওর কথাটাকে পাত্তা না দিয়ে ক্লাসে চলে আসি। স্যার ক্লাস করাচ্ছেন হঠাৎ করে কেউ গুতা মারলো। পাশে তাকিয়ে দেখি ত্রয়ী। আমি ইশারায় জিঙ্গেস করি কী হইছে? ত্রয়ী ফিসফিস করে বলে,

ঐ ছেলেটা তোর কে হয়? বল না প্লিজ?
আমি ত্রয়ীর দিকে চোখ রাঙিয়ে তাকাই। আমার চোখ রাঙানো দেখে ত্রয়ী চুপ করে যায়। অতঃপর মনোযোগ সহকারে সবগুলো ক্লাস শেষ করি। ক্লাস থেকে ভাব নিয়ে বের হলাম। ত্রয়ী তখন থেকে এক প্রশ্নই করে যাচ্ছে। আমি ত্রয়ীর প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে একটু বেশিই ভাব নিয়ে হাঁটছি।

তুই এতো ভাব নিচ্ছিস কেনো? বল না ছেলেটা কে?
আমি বেশ ভাব নিয়ে বললাম, আমার খালাতো ভাই ।
আমার কথা শুনে ত্রয়ী অবাক হয়ে যায়। অবিশ্বাসের সুরে বলে,
তুই সত্যি বলছিস রিয়া? আমার বিশ্বাস হচ্ছে না। ঐ কিউট ছেলেটা তোর খালাতো ভাই। আমি ঙ্গান হারাবো।
আল্লাহ এই মাইয়া রুদ্র আমার খালোতো ভাই এটা শুনেই ঙ্গান হারানোর মতো ভাব করছে। যদি শুনতো রুদ্র আমার হাজবেন্ড। তাহলে হয়তো হার্ট এ্যাটাক করতো।

এতো সুন্দর খালাতো ভাই থাকতে তুই সিঙ্গেল। আমার বিশ্বাস হচ্ছে না। রিয়া সত্যি করে বল তো তোর খালাতো ভাইয়ের সাথে তোর কোনো চক্কর টক্কর চলছে না তো? এতো সুন্দর একটা ছেলে চোখের সামনে থাকলে সিঙ্গেল থাকা অসম্ভব।
বইন সবাই তো আর তোর মতো না। রাস্তা-ঘাটে যাকে দেখিস তাকে দেখেই ক্রাশ খাস। বাইক আছে এমন ছেলে দেখলে তো তুই পাগল হয়ে যাস। হোয়াট এ বাইক, হোয়াট এ বাইক বলে চিৎকার শুরু করিস। তোর আব্বু আসছে তোকে নিতে। যা এখান থেকে এখন ফুট।

আজকে তোক কথা শুনে আমি একটুও রাগ করলাম না। তোর খালাতো ভাইকে আমার ভীষণ ভালো লাগছে। উনাকে পটাতে তুই আমাকে সাহায্য করবি।
কথাগুলো বলে লজ্জা লজ্জা মুখ করে ত্রয়ী চলে গেলো। আমি ত্রয়ীর যাওয়ার দিকে আহাম্মকের মতো তাকিয়ে আছি। আমার জামাইকে পটানোর জন্য আমার কাছেই হেল্প চাইছে।

মামুনি রান্না করছে আর আমি মনোযোগ সহকারে মটরশুঁটি থেকে খোসা ছাড়াচ্ছি। এটা করতে আমার ভীষণ ভালো লাগে। মামুনি হঠাৎ বলে ওঠেন,
আমার রুদ্রটা আবার আগের মতো হয়ে যাচ্ছে। সেই চঞ্চল, দুরন্ত আর হাস্যজ্বল। আমি কতদিন পর আজকে ওকে প্রাণ খোলে হাসতে দেখলাম। সবই তোর জন্যই সম্ভব। তোর সাথে কেউ কিছুদিন থাকার পর কিছুতেই গম্ভীর মুখে থাকতে পারবে না। তুই ম্যাজিক জানিস। সবাইকে হাসিখুসি রাখার।
আর তোমার ছেলের সাথে থাকার পর কেউ হাসিমুখে থাকতেই পারে না। উনার বাতাস আমার গায়েও লাগছে। না জানি কোনদিন আমি হাসতে ভুলে যাই।

একটানা দুই ঘন্টা ধরে মুখস্থ করে যাচ্ছি। কিন্তু পড়া কিছুতেই শেষ হচ্ছে না। চুলে কারো স্পর্শ পেয়ে ঘাড় ঘুরিয়ে পিছনে তাকাই।
কী করছেন আপনি?

হুসসসস। তুমি তোমার পড়া পড়। আমার কাজে ডিস্টার্ভ করো না আর আমার কাজে তোমার কোনো ডিস্টার্ড হবে না।
উনি আমার চুল নিয়ে নড়াচড়া করছেন। আমি আবার পড়ায় মনোনিবেশ করলাম। খোপায় কিছু একটা লাগালেন। আগে থেকে চুলগুলো খোপা করা থাকাই উনাকে আর নতুন করে খোপা করতে হয়নি। নাকে বেলি ফুলের ঘ্রাণ আসতেই খোপায় হাত দেই। খোপায় মালা জাতীয় কিছু একটা পড়িয়ে দিয়েছেন। উনি উনার কাজ শেষ করে বলেন,
পারফেক্ট।

আমি গিয়ে ড্রেসিংটেবিলের সামনে দাঁড়ালাম।
আয়নার সামনে ঘুরে ঘুরে বেলিফুলের গাজরাটা দেখতে লাগলাম। অসম্ভব সুন্দর গাজরাটা। উনি উনার ফোনের দিকে তাকিয়ে বললেন,
এতো রাতে ইলান কেনো ফোন দিলো?
কল রিসিভ না করলে বুঝবেন কী করে? হয়তো কোনো দরকার। ফোনটা রিসিভ করুন আর স্পিকারে দিন আমিও কথা বলবো।

উনি ফোনটা রিসিভ করে স্পিকারে দেন। উনি ভ্রু কুচকে বলেন,
তোর আশেপাশে এতো গাড়ির আওয়াজ শুনে যাচ্ছে কেনো? তুই কোথায় এখন?
ব্রিজের ওপর দাঁড়িয়ে আছি।
তুই ব্রিজের ওপর সুইসাইড টুইসাইড করতে গেছিস নাকি?
ফাজলামি বাদ দে। আমি নিজের অনুভূতি প্রকাশ করতে এসেছি।
অনুভূতি প্রকাশ করার জন্য ব্রিজের ওপর যেতে হয়।

পূর্ণিমাতিথি পর্ব ২০

ভাই আমি বাবা হতে চলেছি। আই কান’ট বিলিভ দিস। নিউজটা শোনার পর আমি পাথর হয়ে গিয়েছিলাম। নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারছিলাম না। আমি নিজের ফিলিংসটা তোকে বুঝাতে পারবো না। পৃথিবীর সবচেয়ে সুখকর অনুভূতি হয়তো বাবা হওয়ার অনুভূতি। আমার বিশ্বাসই হচ্ছে না কেউ একজন আদো আদো গলায় আমাকে বাবা বলে ডাকবে। আমার হাত ধরে হাঁটবে। আমি আমার জীবনের সেরা আনন্দটা পেয়ে গেছি।
হঠাৎ করে কানে একটা আর্তনাদ ভেসে এলো। গাড়ির চাকার শব্দ শোনা গেলো। তারপর তারপর সবকিছু নিরব।

পূর্ণিমাতিথি পর্ব ২২