পূর্ণিমাতিথি পর্ব ৩৩

পূর্ণিমাতিথি পর্ব ৩৩
লেখিকা-তাসনিম জাহান রিয়া

আমি উনার দিকে তাকালাম অনেক বার। কিন্তু উনি একবারের জন্যও আমার দিকে তাকালেন না। আমি অভিমানে মুখ ঘুরিয়ে নিলাম। আচমকা ব্রেক কষায় আমি সামনে দিকে হেলে পড়তে নিলেই এক জোড়া বলিষ্ঠ হাত আমার কোমড় চেপে ধরে। আমি অবাক চোখে উনার দিকে তাকাই। উনি নিষ্ফলক আমার দিকে তাকিয়ে আছেন। আমি তাকাতেই উনি আমাকে বড় সড় একটা ধমক দিয়ে বলে ওঠলেন,

এতো বড় হয়ে গেছো এখানে নিজেকে সামলাতে পারো না। কিছু পারো বা না পারো জেদটা ঠিকই ধরতে পারো।
আমি উনার দিকে তাকিয়ে হাসি মুখে বললাম, আমাকে সামলানোর জন্য তো আপনি আছেন।

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

উনি আমার দিকে বিরক্তির দৃষ্টি নিক্ষেপ করে আবার নিজের কাজে মনোযোগ দিলেন। আমি অনিমেষ তাকিয়ে আছি উনার দিকে। উনার আঙ্গুলের ডগা ব্যস্ত কিবোর্ডে। উনার চোখের দৃষ্টি ল্যাপটপের স্কিনে। আমার দৃষ্টি আটকে আছে তো উনাতেই। আজকে উনাকে একটু বেশিই সুন্দর লাগছে। উনার ওপর থেকে চোখ ফেরানোই দায়। আজকে উনি স্কাই কালার একটা শার্ট পড়েছেন আর কালো প্যান্ট। হাতে ব্রাউন কালার ফিতার একটা ঘড়ি। সামনের চুলগুলো কপালে ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে আছে। ইচ্ছে করছে উনার কপালের চুলগুলো একটু গুছিয়ে দেই। কিন্তু নিজের ইচ্ছাটাকে সংবরণ করলাম।

কাজ করার মাঝে মাঝে উনি ঠোঁট দিয়ে ঠোঁট চেপে ধরছেন। এই সাধারণ কাজটাও যেনো অসাধারণ লাগছে। ইশ আমার বরটা এতো সুন্দর না হলেও পারতো। কারো নজর যেনো না লাগে। উনি এবার ল্যাপটপের স্কিন থেকে দৃষ্টি সরিয়ে আমার দিকে তাকালেন। জিব দিয়ে ঠোঁট ভিজিয়ে বললেন,

চুলগুলো ঠিক করে দাও তো। প্রচণ্ড ডিস্টার্ভ করছে। ঠিক মতো কাজ করতে দিচ্ছে না।
উনার কথা শুনে আমি হা করে উনার দিকে তাকিয়ে আছি। উনি কী মাইন্ড রিড করতে পারেন? নাহলে আমার মনের কোণের জাগা সুপ্ত ইচ্ছেটা উনি কীভাবে জানলেন? আমাকে এভাবে বসে থাকতে দেখে উনি আবার বলে ওঠলেন,
এভাবে হা করে বসে আছো কেনো? তাড়াতাড়ি করো।

কিছুক্ষণ আগেই বাস থেকে নেমেছি আমরা। গাড়ির জন্য অপেক্ষা করছি আমরা। এখান থেকে ভ্যানে করে অথবা রিক্সায় করে বাকিটা পথ যেতে হবে। আংকেল আর রুদ্র ব্যাগ হাতে দাঁড়িয়ে আছেন। একটু পর পর উনি আমার দিকে অগ্নি দৃষ্টি নিক্ষেপ করছেন। ভয়ে আমি কাচুমাচু হয়ে দাঁড়িয়ে আছি। অপেক্ষা করাটা উনার কাছে বিরক্তিকর। উনার মতে লাইফের প্রতিটা মিনিটের মূল্য অনেক। একটা মিনিট অপচয় মানে অনেক কিছু। উনি যে আমার ওপর ক্ষেপে আছেন সেটা উনার মুখ দেখেই বুঝা যাচ্ছে।

গাড়ি ছাড়া বাসে করে আসার আইডিয়াটা আমারই ছিল। পরে মামুনি আমার সাথে তাল মিলিয়েছে। আমাকে হয়তো ধমক দিয়ে চুপ করিয়ে দিতেন। প্ল্যান ক্যান্সেল করে দিতেন। কিন্তু মামুনির বেলায় তো সেটা সম্ভব না। তাই বাধ্য হয়েই এসেছেন। মামুনিকে তো কিছু বলতে পারবেন না। তাই সবটা রাগ আমার ওপরই দেখাবেন।
আংকেল রুদ্রের হাতে ব্যাগটা দিয়ে এগিয়ে গেলেন রিক্সার খোঁজার জন্য। অল্প কিছুক্ষণের মাঝেই কাঙ্ক্ষিত জিনিস নিয়ে ফিরে আসলেন আংকেল।

বেশ কিছুক্ষণ হয়েছে রুদ্রর দাদুর বাড়ি এসেছি। বিশাল এক বাড়ি। উনার দাদা সখ করে এই বাড়িটা তৈরি করেছিলেন। সবাই মিলে এক সাথে এই বাসায় থাকবে। সবারই নিজের নিজের জীবনের জন্য সেটা সম্ভব হয়ে ওঠেনি।
আসার পর থেকেই আমাকে গ্রামের মহিলারা ঘিরে বসে আছে। একেক জন একেক রকম প্রশ্ন করছে।

অস্বস্তি আমারে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরেছে। হু হা ছাড় কোনো উত্তর দিচ্ছি না। এই বাসার আমি রুদ্র দাদু আর উনার ফুফিকে ছাড়া আর কাউকে চিনি না। কিছুক্ষণ পরেই মামুনি ধরে ধরে রুদ্রর দাদুকে নিয়ে আসে। বয়সের বাড়ে নুইয়ে পড়েছেন। গায়ের সেই উজ্জ্বল রং হারিয়ে গেছে। আগের মতো সেই শক্ত পোক্ত চেহেরা আর নেই। লাঠি নিয়ে হাঁটতে হয়। আমি উনার দিকে এগিয়ে আসতে নিলে উনি আমাকে হাত দিয়ে থামিয়ে দেন। আমাকে চোখের ইশারায় বসতে বলেন। আমিও ভদ্র মেয়ের মতো বস পড়লাম। উনাকে আমার সামনের একটা চেয়ারে বসে পড়লেন। আমার চিবুক ধরে বলেন,

মাশাল্লাহ। রুদ্রর বউ না যেনো একটা পরী। আমার তো তোমাকে ছোটবেলা থেকেই পছন্দ ছিল। খুব করে চাইতাম তুই যেনো রুদ্রের বউ হোক। আল্লাহ আমার মনের ইচ্ছেটা পুরণ করেছে।
আমি লজ্জায় মাথা নুইয়ে ফেললাম। তখনি সদর দরজা দিয়ে প্রবেশ করেন রুদ্র। রুদ্রকে দেখেই দাদু বলে ওঠে,
চাঁদের লাহান সুন্দর বউ পাইছো বলেই তো এই বুড়ির কথা ভুলে গেছে। একবারের জন্যও এই বুড়ি দাদির কথা মনে পড়ে না? তুই না বলতি আমি তোর প্রথম বউ। দ্বিতীয় বউকে পেয়ে প্রথম বউকে ভুলে গেলি।
রুদ্র কিছু না বলে চুলে হাত চালিয়ে মুচকি হাসে।

এতক্ষণে আমি হাফ ছেড়ে বাঁচলাম।ধম বন্ধ হয আসছিল। এতো মামুষের ভীড়ে আমি একা কখনোই থাকি নাই। আমাদের জন্য বরাদ্দকৃত রুমে এসে আমি স্কাপ খুলতে ব্যস্ত হয়ে পড়ি। হঠাৎ করে পিছনের দিকের একটা পিন আটকে গেলো। কোনো ভাবেই পিনটা ছাড়াতে পারছি না। হুট করে কোথা থেকে রুদ্র চলে এলো। উনি খুব সুন্দর করে পিনটা ছাড়িয়ে দিলেন। উনি গম্ভীর গলায় বললেন,

আত্ননির্ভরশীল হতে শিখো। নিজের সমস্যার সমাধান নিজেরাই করার চেষ্টা করে।তোমাকে আগলে রাখার জন্য সারাজীবন তোমার পাশে কেউ থাকবে না।
আমি কিছু না বলে টান দিয়ে উনার হাত থেকে পিনটা নিয়ে নিলাম। অতঃপর মুখ ভেংচি দিয়ে চলে আসলাম।

রাতের আকাশে মিটিমিটি তারা জ্বলছে। আমি আর রুদ্র ছাদে দাঁড়িয়ে আছি। দুজনেই চুপ চাপ। উনি হঠাৎই প্রশ্ন করেন।
মন খারাপ?
উহু।
তোমাকে কয়েকটা প্রশ্ন করি?
জ্বী বলুন।
তোমার মনে হয় না আমার সাথে বিয়ে হয়ে তোমার লাইফটা নষ্ট হয়ে গেছে?

সেটা মনে হবার তো কোনো কারণ নেই। আপনি একজন খুব ভালো হাজবেন্ড। আপনার দায়িত্ব পালনে কোনো রূপ ত্রুটি আপনি রাখেন না। আমার যখন যা চাই আমি মুখ ফুটে বলার আগে আপনি নিয়ে আসেন। আপনি আমার কোনো অভাব রাখেননি। হয়তো আমাকে ভালোবাসেন না। আমি এই যুগের মেয়ে হলেও একটা কথা খুব বিশ্বাস করি জীবনে বিয়ে একবারই হয়। কিন্তু আপনি তো আমার সাথে ভালো নেই। আমার সাথে আপনি দম বন্ধকর পরিস্থিতিতে আছেন। তাই হয়তো আপনাকে মুক্তি দিয়ে দিব। তবে ভাববেন না রিয়ার মুখে এক মনে আরেক। বাকি জীবনটা আমি একাই কাটিয়ে দিব।

এই মেয়ে তোমাকে এতো কথা বলতে কে বলেছে? তোমাকে বলেছি না তোমার মুক্তি নেই। আমাকে ভালো লাগুক আর না লাগুক তোমাকে আমার সাথেই থাকতে হবে। আমি তো প্রশ্নগুলো এমনি করছি তোমার উত্তর যদি হতো আমার সাথে বিয়ে হয়ে তোমার জীবন নষ্ট হয়ে গেছে তবুও আমি তোমাকে ছাড়তাম না
উনি একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললেন, তুমি আমার সম্পর্কে কিছুই জানো না। আজকে তোমাকে সব বলবো। এই কথাগুলো আমি কারোও কাছেই শেয়ার করি না। আমার একটা অতী……..
উনার কথার মাঝেই মামুনি ডেকে ওঠলো। আমি উনার দিকে এক পলক তাকিয়ে বললাম, আমি আপনার কথা পড়ে শুনবো। মামুনি ডাকছে আসি।

পূর্ণিমাতিথি পর্ব ৩২

এ বাড়ির পিছনে একটা বিশাল পুকুর রয়েছে। আমি হাঁটতে সেই পুকুর পাড়ে চলে এলাম। সময়টা এখন দুপুর। সবাই ঘুমাচ্ছে। এই দুপুরবেলা ঘুমানোর অভ্যাসটা আমার একদমি নেই। আনমনে পুকুরের পাড়ি দিয়ে হাঁটছিলাম। আচমকা একটা গর্তে পা পড়ে গেলো। টাল সামলাতে না পেরে আমি পুকুরে পড়ে গেলাম। সাতার না জানার কারণে এখান থেকে ওঠা আমার পক্ষে অসম্ভব। আস্তে আস্তে তলিয়ে যাচ্ছি পানির নিচে। দম বন্ধ হয়ে আসছে। এই বুঝি নিশ্বাসটাও আমার সাথে বেঈমানি করে চলে গেলো। বাঁচার আশা আস্তে আস্তে ক্ষীণ হয়ে আসছে।

পূর্ণিমাতিথি পর্ব ৩৪