পূর্ণিমাতিথি পর্ব ৩২

পূর্ণিমাতিথি পর্ব ৩২
লেখিকা-তাসনিম জাহান রিয়া

রুদ্রর কথায় মনে হলো ত্রয়ীর সাহসটা বেড়ে গেলো।
এই বেয়াদপ মহিলা আমাকে রেখে একা একা বিয়ে করে ফেলেছে। বিয়েতে কী আমি বেশি খেয়ে ফেলতাম? এক পিস রোস্ট আর এক প্লেট পোলাওই তো খেতাম। বলুন এটা কী ঠিক করছে আমার সাথে? বিয়েতে দাওয়াত তো দিলোই না। তার ওপর বিয়ের এতোদিন হয়ে গেলো আমাকে একটা বারের জন্যও জানালো না বিয়ের কথা। আমাকে অন্য কারো কাছ থেকে জানতে হয় ওর বিয়ের কথা।

রিয়া তোমার সাথে এটা একদমি উচিত করেনি। রিয়ার উচিত তোমাকে ডাবল ট্রিট দেওয়া।
আগে জানতাম সব সময় বিপরীত ধর্মী দুইটা মানুষের বিয়ে হয়। কিন্তু রিয়ার বেলায় সেই নিয়ম পাল্টে গেলো। রিয়া তো কিপ্টা রিয়ার জামাই আরো বেশি কিপ্টা। বজ্জাত লোক একটা। এতোদিন হইছে বিয়ে করছে। কিন্তু নিজের শালিদের খোঁজ খবর নিবে না।

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

রুদ্র ত্রয়ীর দিকে চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে আছে। রুদ্র রিয়েকশন দেখে আমার ভীষণ হাসি পাচ্ছে। আমি মাথা নিচু করে বসে আছি। ত্রয়ীর মার কাছে মামা বাড়ির বিচার দিচ্ছে। ত্রয়ী যখন জানতে পারবে যার কাছে আমার হাজবেন্ডের নামে বিচার দিচ্ছে সেই-ই হাজবেন্ড। তখন ত্রয়ীর রিয়েকশন কেমন হবে? ছেড়ে দে মা কেঁদে বাঁচি। রুদ্র দুই তিন বার কেশে গলাটা একটু পরিষ্কার করে বলে,

যার নামে এতো মহান মহান বাণী বলছো। তাকে তোমার দেখতে ইচ্ছে করছে না?
কে বলছে দেখতে ইচ্ছে করছে না? অবশ্যই দেখতে চাই। ঠিকানা জানলে এখনি গিয়ে দেখা করে আসতাম। পাতালে থাকলে পাতালেই গিয়ে দেখা করে আসতাম।
তাই নাকি? তোমাকে কষ্ট করে পাতালে গিয়ে দেখা করতে হবে না। যাকে দেখার এতো ইচ্ছে সে তোমার সামনেই বসে আছে।

মানে?
আমিই রিয়ার হাজবেন্ড। ড. আরাফ আয়মান রুদ্র।
কথাটা শুনা মাত্রই ত্রয়ী লাফিয়ে ওঠে। আচমকা এমন ভয়ানক কথা বার্তা ত্রয়ীর হজম হচ্ছে না। পুরো ব্যাপারটা ত্রয়ীর বোধগম্য হতে সেকেন্ড বিশেক লাগলো। ব্যাপারটা বোঝা মাত্রই ত্রয়ী আমতা আমতা করে বলে,
স্যার বাসায় আমার অনেক কাজ। আজকে মেহমান আসবে তো। আম্মু একা একা সব করতে পারবে না। আমি আসি স্যার।

ত্রয়ীর কথাটা আমার কর্ণগোচর হওয়া মাত্রই আমি ত্রয়ীর দিকে চোখ বড় বড় করে তাকাই।
যে মেয়ে নাকি জীবনে এক গ্লাস পানি ঢেলে খায় না। সে নাকি তার মাকে সাহায্য করবে। সাহায্যের নামে সব গোছানো জিনিস এলোমেলো করে দিবে। বেশ বুঝতে পারছি ত্রয়ী রুদ্রর থেকে পালানোর জন্য মিথ্যা বলছে। ত্রয়ী কথাগুলো বলেই নিজের ব্যাগটা নিয়ে কোনো রকম দৌড়ে পালালো। যেনো এখান থেকে গেলেই সে বাঁচে। যাওয়ার আগে অবশ্য আমাকে চোখ রাঙিয়ে যেতে ভুল করেনি। এর মানে সে আমাকে পড়ে দেখে নিবে।

বাসায় এসেছি মিনিট বিশেক হয়েছে। রুদ্রর আমার সাথে আসার কথা ছিল না। কিন্তু আংকেলের জরুরি তলবে হসপিটাল থেকে ছুটি নিয়ে বাসায় আসতে হয়েছে। উনার দাদু অনেক অসুস্থ হয়ে পড়েছে। আর উনি আমাকে দেখতে চেয়েছেন। আংকেলরা দুই ভাই বোন। আংকেল শহরে থাকে আর আংকেলের বোন গ্রামে। আর আংকেলের মা উনার বোনের কাছে থাকে। উনার নাকি শহরের ইট, পাথরের দেয়ালে বন্দি হয়ে থাকতে ভালো লাগে না। উনি যতদিন বেঁচে আছেন ততদিন মুক্ত পাখির মতো বাঁচতে চান। গ্রামের নির্মল হাওয়ায় বাঁচতে চান।

এখন সবাই মিলে দল বেঁধে গ্রামে যেতে হবে। মামুনি ব্যাগ ট্যাগ গোছানো শুরু করে দিয়েছে
আমার মাঝে ব্যাগ গোছানোর কোনো তাড়া নেই। এই না যে আমার যাওয়ার ইচ্ছে নাই। আমার এসব ব্যাগ ট্যাগ গোছানো অসহ্য লাগে। ব্যাগ গোছানোর কাজটা তো আমি উনাকে দিয়ে করাবো। আমি অলস ভঙ্গিতে বিছানার ওপর বসে আছি। উনি শাওয়ার নিতে ওয়াশরুমে গেছেন। উনি বের হলেই আমি শাওয়ার নিতে যাব।

ফোনে টুং টাং আওয়াজ করে মেসেজ আসছে। মেসেজগুলো ত্রয়ীই পাঠাচ্ছে। আমাকে তখন কিছু বলতে পারেনি বলে এখন মেসেজ করে জ্বালিয়ে মারছে। আমি ভাবলেশহীন ভাবে মেসেজের রিপলাই দিচ্ছি। ত্রয়ী ১০টা মেসেজ দিলে আমি একটা দিচ্ছি।

ওয়াশরুমের দরজা খোলার আওয়াজ হতেই আমি লাফিয়ে ওঠলাম। টাওয়াল দিয়ে চুল মুছতে মুছতে ওয়াশরুম থেকে উনি বের হয়ে আসছেন। আমি বিছানা থেকে নেমে এক পা এক পা করে উনার দিকে এগিয়ে যাচ্ছি। উনি প্রথমে খেয়াল না করলেও পরে উনি ঠিকই খেয়াল করলেন আমি উনার দিকে এগিয়ে যাচ্ছি। উনি ভ্রুচকে তাকান আমার দিকে। উনি বিরক্তি নিয়ে বললেন,

ফাজলামো বাদ দিয়ে শাওয়ার নিয়ে এসো। আমাদের এখনি বের হতে হবে। তুমি যদি রেডি হতে লেইট করো তাহলে তোমাকে রেখেই চলে যাব।
আমি উনার কথাটা পাত্তা না দিয়ে বললাম, আপনি এতো সুন্দর নাহলেও পারতেন ডাক্তারবাবু। আপনাকে এতো সুন্দর হতে কে বলেছিল? আফটার শাওয়ার লুক আপনাকে……..

আমি কথাটা অসমাপ্ত রেখেই ঠোঁট কামড়ে ধরলাম। আমার কথা বার্তা আর কাজ কর্মে উনি অনেকটাই ঘাবড়ে গিয়েছেন। আমি আরেক পা এগিয়ে যেতেই উনি দু পা পিছিয়ে গেলেন। উনার অবস্থা দেখে আমি আর হাসি চেপে রাখতে পারলাম না। ফিক করে হেসে দিলাম। হাসতে হাসতে বললাম,
ডাক্তারবাবু আপনি সত্যিই ভীতু।
উনি চোখ ছোট ছোট করে আমার দিকে তাকিয়ে আছেন। হয়তো বোঝার চেষ্টা করছেন আমার মতিগতি। আমি ওয়াশরুমে চলে এলাম।

আপনি একটু রুম থেকে যান তো।
উনি ল্যাপটপে মনোযোগ দিয়ে কোনো কাজ করছিলেন। উনি ল্যাপটপের স্কিনেই দৃষ্টি রেখে বলেন,
আমি এখন রুম থেকে যেতে পারবো না। দেখছো না কাজ করছি।
প্লিজ যান না। আমি শাড়ি পড়বো।
‘আমি শাড়ি পড়বো’ কথাটা শোনা মাত্রই উনি আমার দিকে তাকালেন।
হঠাৎ শাড়ি কেনো পড়বা?

শাড়ি পড়বো না কেনো? প্রথম বারের মতো শ্বশুরবাড়ি যাচ্ছি। প্রথম বারের মতো দাদি শ্বাশুড়ির সাথে দেখা করতে যাচ্ছি। আমাকে শাড়ি পড়তে হবে না? আমাকে দেখে মনে হতে হবে না যে আমি আপনার বউ।
শাড়ি পড়লেও তুমি আমার বউ শাড়ি না পড়লেও তুমি আমার বউই থাকবা। দাদুর সাথে তোমার প্রথম বার দেখা হচ্ছে না। এর আগেও অনেক বার দেখা হয়েছে।
যখন দেখা হয়েছিল তখন তো আর আমি আপনার বউ ছিলাম না। এখন আমি আপনার ওয়াইফ। তাই আমাকে শাড়ি পড়তেই হবে।

একদম না। তুমি শাড়ি পড়বে। তোমাকে দেখে মনে হয় না তোমার বিয়ে হয়ে গেছে। গ্রাউন বা অন্য কোনো ড্রেস পড়লে তোমাকে দেখে এইট নাইনের বাচ্চা মনে হয়। কিন্তু শাড়ি পড়লে তোমাকে বড় বড় লাগে। পরে দেখা যাবে গ্রামের মহিলারা তোমার জন্য ফটাফট বিয়ে প্রস্তাব নিয়ে আসছে। আমি তোমাকে নিয়ে একদম রিস্ক নিতে পারবো না।

এট লাস্ট আমার উনার পছন্দ করা জামা পড়েই আসতে হয়েছে। উনি আমাকে শাড়ি পড়ে আসতে দেননি। আমিও উনাকে শর্ত দিয়েছিলাম উনি যদি ব্যাগ গুছিয়ে দেন তাহলে আমি শাড়ি পড়ে আসবো না। উনি আমার শর্ত শোনা মাত্রই রাজি হয়ে গেলেন।

আমরা সবাই এখন বাসে বসে আছি। উনি আর আংকেল গাড়ি করে যেতে চাইলে। আমি আর মামুনি জেদ ধরি বাসে করে যাবো। অগত্যা উনাদের আমাদের সাথে বাসে করেই যেতে হচ্ছে। আমি জানালা দিয়ে বাইরের পরিবেশ দেখতে ব্যস্ত আর উনি ল্যাপটপ কাজ করতে ব্যস্ত।

পূর্ণিমাতিথি পর্ব ৩১

আমি উনার দিকে তাকালাম অনেক বার। কিন্তু উনি একবারের জন্যও আমার দিকে তাকালেন না। আমি অভিমানে মুখ ঘুরিয়ে নিলাম। আচমকা ব্রেক কষায় আমি সামনে দিকে হেলে পড়তে নিলেই এক জোড়া বলিষ্ঠ হাত আমার কোমড় চেপে ধরে।

পূর্ণিমাতিথি পর্ব ৩৩