পূর্ণিমাতিথি পর্ব ৩৫

পূর্ণিমাতিথি পর্ব ৩৫
লেখিকা-তাসনিম জাহান রিয়া

হঠাৎই উনার ফোনটা বেজে ওঠলো। উনি এখানেই বসেই ফোনটা রিসিভ করলেন। উনার একটা কথায় আমার কর্ণগোচর হলো প্রীলিয়া মারা গেছে। কথাটা শুনে আমি বাকরুদ্ধ হয়ে গেলাম। নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারছি না। মাথাটা ঝিমঝিম করছে। সবকিছু কেমন এলোমেলো লাগছে।

প্রীলিয়া আপু মারা গেছে? কীভাবে? এটা আদো সত্যিই? এটা কীভাবে সম্ভব? রুদ্র ফোনে কথা বলা শেষ করতেই আমি রুদ্রর দিকে তাকালাম। আমি কিছু বলতে যাব তার আগেই রুদ্র আমার ঠোঁটের ওপর আঙ্গুল রেখে চুপ করিয়ে দেয়। মোলায়েম কন্ঠ বলে,

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

তুমি অসুস্থ। তোমার রেস্ট নেওয়া প্রয়োজন।
তোমাকে টেনশন করতে হবে না। প্রীলিয়া কীভাবে মারা গেছে সেসব তোমার না ভাবলেও চলবে। শুধু মনে রাখবে সমাজ থেকে আবর্জনা দূর হয়েছে। স্বার্থপর মানুষদের সাথে এমনি হওয়া উচিত। এখন চুপচাপ ঘুমাও।
আমি উনার কথার বিপরীতে আর কিছু বললাম না। উনাকে এখন কিছু বললেই ধমকে ওঠবেন। প্রীলিয়া আপু মারা গেছে এটা শুনে খারাপ লাগছে তবে একজন মানুষ হিসেবে প্রীলিয়া আপু আমার মামাতো বোন এটার জন্য না। প্রীলিয়া আপু আমার সাথে অনেক অন্যায় করেছে যা ক্ষমার অযোগ্য।

আজকে আমরা ঢাকায় ফিরে এসেছি। আরো দুই একদিন থাকার কথা ছিল কিন্তু প্রীলিয়া আপুর মৃত্যুর সংবাদ শুনেই ঢাকাই ফিরে আসা। প্রীলিয়া আপু স্বার্থপর হতে পারে আমরা তো নই। প্রীলিয়া আপু হয়তো অনেক অন্যায় করেছে। কিন্তু আমরা তো মনুষ্যত্বহীন নই। তাই ঢাকাই ফিরে আসা। একটা কথা প্রচলিত আছে। ‘কুকুর যদি তোমাকে কামড় দেয় তাহলে কী তুমিও কুকুরকে কামড় দিবে?

ঢাকায় এসেই প্রথমেই রওনা দেই প্রীলিয়া আপুদের বাসার উদ্দেশ্যে। বাসায় পৌছাতেই শরীরের ভিতর কেমন যেনো একটা করে ওঠলো। ভিতরটা অস্থির অস্থির লাগছে। নিজেকে স্থির রাখার প্রচেষ্টা করেও ব্যর্থ হচ্ছি। রুদ্র হয়তো আমার পরিস্থিতিটা বুঝতে পেরেছেন। তাই তো পিছন থেকে এসে আমাকে ধরে আসস্থ করেন। বাসায় প্রবেশ করতেই মামির হৃদয় বিধারক কান্না কর্ণগোচর হয়। মামি চিৎকার করে কাঁদছে। মামির কান্নার শব্দের নিচে সবার কান্নার শব্দ চাপা পড়ে গেছে।

এই মানুষটার জন্যই এতক্ষণ ধরে ভীষণ কষ্ট হচ্ছিল। বার বার শুধু এটাই মনে হচ্ছিল এই মানুষটা কীভাবে সহ্য করবে নিজের একমাত্র মেয়ের মৃত্যু। মামা আর প্রীলিয়া আপু আমাকে দেখতে না পারলেও মামি আমাকে ভীষণ আদর করতো। মামির ভালোবাসার টানেই আমি এই বাসায় বার বার ছুটে আসতাম।

রুদ্র আমাকে নিয়ে প্রীলিয়া আপুর ডেড বডির কাছে যান। আমার আর রুদ্রর পিছনে মামুনি, আংকেল, রিদি আপু, নিয়াম ভাইয়া সবাই এসেছেন। নিধিকে বাসায় রেখে আসা হয়েছে। প্রীলিয়া আপুর লাশটা দেখার পর আমার অন্তর আত্না কেঁপে ওঠলো। কী ভয়ানক মৃত্যু হয়েছিলা প্রীলিয়া আপুর। মুখ থেতলে গেছে। দেখতে ভয়ংকর লাগছে। আমি ভয় পেয়ে পিছিয়ে গেলাম। রুদ্র আমাকে শক্ত করে ধরে। আমি উল্টো ঘুরে রুদ্রর বুকে মুখ গুঁজে কেঁদে দেই।

মামা সিঁড়ির কাছটায় বসেছিল। এতক্ষণ আমাদের লক্ষ্য না করলেও এখন ঠিকই দেখতে পান। আমাদের দেখা মাত্রই আমাদের দিকে ছুটে আসেন। আমাকে ধাক্কা দিয়ে রুদ্রর থেকে সরিয়ে দেন। রুদ্রর কলার চেপে ধরে দাঁতে দাঁত চেপে বলেন,

আমি জানি তুমিই আমার মেয়েকে মেরেছো। পুলিশ অফিসার একে এরেস্ট করুন। তুমি ছোটবেলা থেকেই আমার মেয়েকে সহ্য করতে পারতে না আর এখন তো…..
রুদ্র নিজের কলারটা মামার হাত থেকে ছাড়ানোর আগেই আব্বু এসে ধাক্কা দিয়ে মামাকে দূরে সরিয়ে দেন। আব্বু চিৎকার করে বলেন,

অনেক সহ্য করেছি তোমাদের অন্যায় আবদার। তোমাদের অন্যায় আবদার পুরণ করতে গিয়ে আমার মেয়েকে কষ্ট দিয়েছি। এখন রুদ্রর বিরুদ্ধে আর একটা উল্টা পাল্টা কথা বললে এর ফল কিন্তু ভালো হবে না। নিজের মেয়েকে ভালো করে মানুষ করতে পারনি। জেদী, বদমেজাজী, উগ্র মেয়ে ছিল। লাই দিয়ে দিয়ে মেয়েকে তো একেবারে মাথায় তুলে ফেলেছিলে। মেয়ের কোনো অন্যায়ই তো তোমার চোখে পড়তো না। তোমার মেয়ে ড্রিংকস করে ড্রাইভ করে এক্সিডেন্ট করেছে। এখানে রুদ্রর…..

রুদ্র আব্বুকে ফিসফিস করে কিছু একটা বলেন। যেটা শোনার পর আব্বু চুপ করে যায়।
রুদ্র দুই পকেটে হাত গুঁজে দিয়ে মামার দিকে তাকিয়ে বলেন,
তো মিস্টার আহম্মেদ আপনি কী যেনো বলছিলেন? আমি আপনার মেয়েকে মেরেছি? আমি আপনার মেয়েকে ছোটবেলা থেকে সহ্য করতে পারতাম না এটা একদম ঠিক কথা।

ওর মতো অহংকারী মেয়েকে কারোরই সহ্য হবে না। আপনি কিছু একটা বলতে গিয়ে আটকে গেলেন। আপনি প্রীলিয়া মারার কারণটা বলতে গিয়েও আটকে গেলেন। আচ্ছা আপনি যখন বলতে পারছেন না তাহলে আমিই বলছি। শুনুন পুলিশ অফিসার মিস প্রীলিয়া আমার ওয়াইফকে বার বার হত্যা করার চেষ্টা করেছে। কিন্তু প্রতিবারই ব্যর্থ হয়। গাড়ি দিয়ে ধাক্কা দিয়ে মেরে ফেলতে চেয়েছিল। সব পরিকল্পনা ব্যর্থ হওয়ায় আমার স্ত্রীর খাবারের সাথে বিষ মিশিয়ে মারতে চেয়েছিল। সেই পরিকল্পনাও সফল হয়নি আমার বন্ধুর জন্য।

তাই প্রীলিয়ার সব রাগ ক্ষোভ গিয়ে পড়ে আমার বন্ধুর ওপর। প্রীলিয়া এতোটাই প্রতিহিংসা পরায়ণ যে আমার বন্ধুকেও হত্যা করার পরিকল্পনা করে। সেই পরিকল্পনায় সফল হয়ে গিয়েছিল। আপনারা তো জানেনই সেই ব্যাপারটা। আপনিই তো আমার বন্ধুর কেইসটা হ্যান্ডেল করছিলেন। ড. ইলানের কেইস। লাস্ট মুহূর্তে কেউ একজন এসে ইলানকে হসপিটালে নিয়ে যায়। হসপিটাল থেকেও ইলানকে কিডন্যাপ করে নিয়ে আটকে রাখে। ইলান সেখান থেকে নিজের জীবন নিয়ে কোনো মতে পালিয়ে আসে। মি. আহম্মেদ আমি ইচ্ছে করলে আপনার মেয়ের বিরুদ্ধে কতগুলো কেইস ঠুকে দিতে পারতাম আপনার ধারণা আছে। আমি ওকে বাঁচার জন্য সুযোগ দিয়েছিলাম। কিন্তু প্রীলিয়া নিজেই সেই সুযোগটা কাজে লাগায়নি।

মামা এবার অফিসারকে উদ্দেশ্য করে বলেন, অফিসার আপনার হয়তো আর বুঝতে বাকি নেই আমার মেয়ের এক্সিডেন্ট এই ছেলেই করিয়েছে। এই ছেলের কথার দ্বারাই তা প্রমাণ হয়ে গেছে। আপনি এরেস্ট করুন।
আপনার কথায় তো আমি উনাকে এরেস্ট করবো না। আপনার কাছে কোনো প্রমাণ আছে? নেই তো। আপনার কথায় আমি একজন ভদ্রলোককে হ্যারাস করতে পারি না। ফর ইউর কাইন্ড ইনফরমেশন ড. রুদ্র গত দুই দিন ধরে ঢাকার বাইরে ছিলেন। আপনার মেয়ে ড্রাংক ছিল। আউট অফ কনট্রোল হয়ে এক্সিডেন্ট করেছেন। এখানে ড. রুদ্রর কোনো হাত নেই।

প্রীলিয়া আপুর মৃত্যুর আজকে দুই দিন হয়ে গেছে। ঐদিন প্রীলিয়া আপুর জানাযার পর পরই আমরা চলে আসি। আমার হাতের কলমটায় টান পড়ায় আমার ভাবনায় ছেদ পড়ে। রুদ্রর কর্কশ গলা শুনে মাথা তুলে রুদ্রর মুখের দিকে তাকাই।
তোমাকে কতদিন বলেছি না কলম কামড়াবে না। এটা বদ অভ্যাস।
আমি কী সব সময় কলম কামড়াই। টেনশন হলে একটু কামড়াই।
তো এতো কীসের টেনশন তোমার?

প্রীলিয়া আপুর মৃত্যুটা আমার স্বাভাবিক মনে হচ্ছে না। আমরা যা দেখছি আসলে তা নয়। কিছু তো আছেই। যা আমাদের সবার দৃষ্টির আড়ালে রয়ে গেছে।
পড়াশোনা তো সব বাপের বাড়ি পাঠিয়ে দিয়েছ। পড়াশোনায় মনোযোগ দাও। এসব কথা তোমাকে না ভাবলেও চলবে। এই ছোট মাথায় এতো চাপ নিয়ো না। আর হ্যাঁ নেক্সট টাইম কলম কামড়াবে না।

পূর্ণিমাতিথি পর্ব ৩৪

টেনশন হলে কী করবো?
রুদ্র আমার কথা কর্ণপাত না করে চলে গেলো। বেশ বুঝতে পারছি রুদ্র আমার কাছ থেকে কিছু আড়াল করছে। কিন্তু সেটা কী আমাকে জানতেই হবে? আব্বুর সাথে একবার দেখা করা দরকার।

পূর্ণিমাতিথি পর্ব ৩৬