লীলাবালি পর্ব ৮৫

লীলাবালি পর্ব ৮৫
আফনান লারা

মৃদুল বারান্দায় বিন ব্যাগটাতে এসে আরামসে বসেছে।যেন এই বাসা থেকে আর কোনোদিন বের হবেনা।রেগেমেগে জুথি ওর সামনে এসে বললো,’আপনি যাচ্ছেন না কেন?’
‘সকালের নাস্তা করাবেনা?হোটেলে গিয়ে খেতে হবে নাকি?কেমন হবু বউ তুমি?’
‘আমি আপনাকে বিয়ে করবোনা।বের হোন এখন’

‘করতে হবে!নাহলে তুলে নিয়ে যাব।এখন যাও নাস্তা নিয়ে এসো।আমি ওয়েট করছি, অনেক খিধে পেয়েছে’
জুথি হনহনিয়ে ওয়াশরুমের দিকে চলে গেছে সোজা।মৃদুল জানত সে নাস্তার জন্য যাবেনা।মেয়েটা সেই আগের মতই আছে।কোনো চেঞ্জ নাই।কবে ভালবাসবে?

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

জুথি ফ্রেশ হয়ে তোয়ালে দিয়ে মুখ মুছতে মুছতে বের হতেই দেখলো মৃদুল কোমড়ে হাত রেখে চেয়ে আছে।একদম বাহিরে দাঁড়িয়ে ছিল।ওকে ইগনর করে জুথি বিছানায় গিয়ে বসে বললো,’আপনি যান।আমার উপর জোরাজুরি চলবেনা’
কথাটা শেষ করতে না করতেই মৃদুল বিছানায় উঠে ওর একদম কাছে চলে এসে বললো,’চলবেনা?’
‘আমি কিন্তু চেঁচাবো’

সেসময়ে দরজায় নক করে বাবা বললেন,’জুথি মা খেতে আয় জলদি,দেখ তোর আম্মু নুডুলস রান্না করছে’
মৃদুল দাঁত কেলিয়ে জুথির হাত চেপে ধরেছে।জুথি তখন বললো,’বাবা আমি এখানেই খাব।আসতেছি’
‘দু বাটি নেবে।তোমাকে এয়ারপোর্ট থেকে আনতে গিয়ে আমার আজ সকালের খাওয়া এখন অবধি হয়নি’
‘আপনাকে সম্মান করি বলে চেঁচাচ্ছিনা।আর তাই আপনি অনেক জ্বালাচ্ছেন,সরুন সামনে থেকে’

‘সম্মান করতে বলেছি?অসম্মান করো।তোমার সব ভাল্লাগে’
কথাটা বলে মৃদুল লম্বা হয়ে শুয়ে পড়েছে জুথির পাশে।জুথি রাগে কটমট করতে করতে বিছানা থেকে নেমে পড়লো।রাগে ক্ষোভে মৃদুলের পেটে দু তিনটা ঘুষি মেরে চলে গেলো খাবার আনতে

‘কিরে তুই তো এক বাটির বেশি নুডুলস খাসনা, এখন দু বাটি নিচ্ছিস?বেশি খিধে পেয়েছে?’
‘না মানে হ্যাঁ।অনেক খিধে।বেশি করে দাও তো।ঐ গাজরের টুকরো গুলোও দাও’
মা এবার কোমড়ে হাত রেখে জুথির গাল টিপে ডানে বামে ঘুরিয়ে বললেন,’তোর শরীর ঠিক আছে?গাজর তো জীবনেও খাস না।আজ কি হলো?’

‘কিছু হয়নি।জলদি দাও’
মৃদুল জুথির রুম খুঁজে একটা ফ্যামিলি এলবাম পেয়েছে ততক্ষণে।সেখানে জুথির ছোটকালের একটা ছবি পেয়ে ছবি তুলে নিয়ে আগের জায়গায় রেখে দিয়েছে।
জুথি বাটি নিয়ে রুমে ঢুকে দরজা লাগিয়ে বাটি ওর হাতে দিয়ে বললো,’খান আর চলে যান।আর একদিন যদি আমার বাসায় এসেছেন তো বাবাকে জানিয়ে দেবো সব’

‘আমি গ্র্যাজুয়েট!!নাম করা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র,ভাল সিজিপিএ পেয়ে পাশ করেছি।
কাল পরশু ভাল বেতনের চাকরিও পেয়ে যাব।প্রাইভেট কোম্পানি তো রীতিমত বাসায় লেটার পাঠিয়েছে ইন্টার্ভিউ দিতে যাওয়ার জন্য।তোমার বাবা অনায়াসেই তোমার হাত আমার হাতে দিয়ে দিবে আর এই বাসায় আসার কথা বলছো?আজ রাতে আবারও আসবো।কি করবে বলো এবার’

জুথি কিছু না বলে বিছানার এক কোণায় বসে নুডুলস খাওয়ায় মন দিছে।মৃদুলের সাথে তর্কে পারা যায়না।সব কিছুর সমাধান তার কাছে থাকে।ঝগড়ায় সবসময় সে জেতে বলে এখন আর তর্ক করতে ইচ্ছে করেনা।
মনে হয় যুক্তিবিদ্যা ওনার প্রিয় সাবজেক্ট ছিল ইন্টারে।

কুসুম আর কলিকে রেখে রুমের বাহিরে চলে এসেছে অর্ণব।ওর ডাক্তারের কল এসেছিল।সচরাচর এই ব্যস্ত ডাক্তার কখনওই কলব্যাক করেন না,বরং কল দিলেও ধরেন না।কিন্তু আজ হঠাৎ তার কল এসেছে দেখে অর্ণব অবাক হলো কিছু।
‘ভাল আছেন স্যার?’

‘আগে বলুন মিসেস কুসুম কেমন আছে?আপনাদের পাসপোর্ট রেডি তো?কবে যাচ্ছেন?’
‘টাকা তো জমা দিলাম।দেরি হবে মনে হয়।’
‘পাসপোর্ট যদি আগে করিয়ে রাখতেন! এটা কিন্তু ঠিক হচ্ছেনা।যেকোনো সময়ে দূর্ঘটনা ঘটে যেতে পারে।এটা নরমাল অসুখ না।আপনাদের মাঝে আমি কোনো সিরিয়াসনেস দেখছিনা।একটু জলদি করতে হবে।সময় বেশি নেই।রুগীর যে অবস্থা ‘
‘হ্যাঁ আমারও অনেক চিন্তা হয় এ নিয়ে।তবে বেশি দেরি হবেনা।ততদিন আমি ওকে সুস্থ রাখার সব চেষ্টা করবো।’
‘সুস্থ রাখতে চাইলেই যে সুস্থ হওয়া যায় তা কিন্তু না।চাইলেই যদি সব হতো তাহলে আমরা ডাক্তাররা কেন আছি?’
অর্ণব মন খারাপ করে ফোন রেখে দিয়েছে।এরপর পেছনে ফিরে তাকিয়ে থাকলো রুমের দরজার দিকে।ভেতর থেকে কুসুমের অট্টহাসি শুনা যাচ্ছে।দোলনায় দোল খেতে খেতে সে হাসছে।তার এই ইচ্ছাটার ব্যাপারে যদি সে আগে জানত তবে অনেক আগেই পূরণ করত।বারবার মনে হয় বড্ড দেরি হয়ে গেছে।

‘বুবু আসো আবার দুলবে’
‘নাহ।তুই দোল,আমার শরীর ভাল লাগেনা’
কলি দোলনা ছেড়ে নেমে কুসুমের কপালে হাত রেখে মুছে দিয়ে বললো,’কেমন লাগে রে বুবু??শুবে?কিছু খাবে?’
‘ওনাকে একটু ডেকে দে যা’

কলি ওর কথা মতন বাহিরে এসে অর্ণবকে ডেকে বললো কুুসুমের কাছে যেতে।এরপর মায়ের কাছে ফিরে গেছে।মা তো বলেছিল অর্ণব দুলাভাই কুসুমের সাথে থাকলে ওদের রুমে না যেতে।
অর্ণব রুমে এসে দেখেছে কুসুম বিছানায় বসে ওর দিকে হাসি মাখা মুখে চেয়ে আছে।
‘কি হলো?ডেকেছিলে?’
‘আমার পাশে বসুন একটু’

অর্ণব বসেছে।কুসুম হয়ত অনেক কিছু বলতে চাইছিল।শুকনো ঠোঁট দিয়ে সেই রচনা তার আর বলা হলোনা।মলিন মুখে শুধু অর্ণবের ঝলঝল করা চোখ দেখছিল।এত বেশি ভালোবাসে মানুষটাকে যে তাকে আর দেখা হবেনা ভেবে বুকটা জ্বলে পুড়ে যাচ্ছে।ইচ্ছে হচ্ছে তাকে আঁকড়ে রাখতে।

এই মানুষটাকে পেয়েও পাওয়া হলোনা।কেন নিয়তি এমনটা করলো।তার ভালোবাসার প্রহর গুনা হয়নি,তার জন্য সেজে বিছানা তৈরি করা হয়নি।ফুলের বাসর হয়নি,প্রেম নিবেদন করা হয়নি তার আগে কেন অধ্যায় শেষের পথে!
মিশু ভাবী গর্ভবতী।তার কোল জুড়ে সন্তান আসবে।

‘আমার নিজের রাজপুত্র, রাজকন্যা দেখা হলোনা।আমার ঘর জুড়ে তাদের আনাগোনা,তাদের হইচই দেখা হলোনা।
এই মানুষটার ছোঁয়া পাওয়া হলোনা।আমার তো কিছুই পাওয়া হলোনা।পাওনা নিয়ে মরে যাব কাল পরশু অথবা আজই!’
‘কুসুম?কি হলো?ওমন করে কি দেখছো?কি দরকারে ডেকেছিলে?’

‘আমি না!’
‘কি?’
‘ভুলে গেছি।আপনি একবার আমায় জড়িয়ে ধরবেন?যেমন করে কাল ধরেছিলেন ঠিক সেরকম করে’
অর্ণব একটা সেকেন্ড দেরি না করে এগিয়ে এসে ওকে বুকে টেনে নিলো।কুসুম যে তার অসুখটা নিয়ে বিরাট বড় ডিপ্রেশনে আছে তা আর বোঝা বাকি নেই।ওর মাথায় হাত বুলাতে গিয়ে সে টের পেলো মাথায় আর চুল নেই বললেই চলে।তার পরেও সে আলতো করে হাত বুলিয়ে কুসুমের কানের কাছে ঠোঁট রেখে বললো,’তুমি ভয় পাচ্ছো?’
‘উহু’

‘তবে আমাকে খাঁমছে ধরে আছো কেন?’
‘আপনি দয়া করে এভাবে আমাকে ধরে রাখতে পারবেন?আমি যেন কোথাও না চলে যেতে পারি!আমাকে ধরে রাখলে আমি যেতে পারবোনা সত্যি!আমাকে ধরে রাখেন যেমন করে আমি ধরে রেখেছি আপনাকে।আমি আসলে যেতে চাইনা কোথাও!!

আমি আপনার সংসারে থাকতে চাই।এই সংসারটা আমার।আমি এর মিষ্টি-তেতোর স্বাদ নিতে চাই।আমি কোথাও যাব না,আমাকে যেতে দিয়েননা।ধরে রাখেন শক্ত করে।
আমি সবাইকে ছেড়ে যেতে চাইনা একটু বুঝেন।আমি আপনাকে ছাড়া থাকতে পারবোনা।আপনার প্রেমের অনুপস্থিতি আমাকে কষ্ট দেবে অনেক।আমি কিছু হারাতে চাইনা,কিন্তু আমার রোগ আমাকে জোরজবরদস্তিতে নিয়ে যাচ্ছে বিশ্বাস করেন!!!

আমি যেতে চাই না।আমি আরও বাঁচতে চাই।আমি আমার সংসারে আমার নিজের ছোট্ট রাজকন্যা,রাজকুমার দেখতে চাই,মা হতে চাই।আপনি ধরে রাখলে আমি যেতে পারবোনা জানেন?ছাড়বেন না!ছেড়ে দিলে আমি মরে যাবো,আর চোখ মেলবেনা আমার।ভোররাতের স্বপ্ন গুলো তবে সত্যি হয়ে যাবে’
কুসুমের কান্নাজড়িত বলা প্রতিটি কথা অর্ণবের গায়ে কাঁটার মতন এসে লাগছে।ওর কাঁপুনি সে সইতে পারছেনা।কাঁদতে কাঁদতে ওর হাঁপিয়ে ওঠা দেখা যাচ্ছেনা আর।

লীলাবালি পর্ব ৮৪

মিথ্যে আশ্বাস দিয়েও লাভ হলোনা।কুসুমের কান্না থামেনি।বরং সে আরও বেশি করে কাঁদছে।
অর্ণব ওর অগোচরে এত কেঁদেছে যে এখন তার চোখে পানি আসেনি।কুসুম ভেঙ্গে পড়েছে।ওকে সামলানোর কোনো উপায় তার মাথায় আসছেনা।

লীলাবালি পর্ব ৮৬