পূর্ণিমাতিথি পর্ব ৪৩

পূর্ণিমাতিথি পর্ব ৪৩
লেখিকা-তাসনিম জাহান রিয়া

খুব মনোযোগ দিয়ে রুদ্রর ছবি আঁকছি। আমি এতো ভালো আর্ট করতে পারি না। কোনোদিন সেরকম করে শেখাও হয়নি। ছবি আঁকি শখের বসে। হুট করেই আজকে ইচ্ছে হলো উনার ছবি আঁকার। আমি বরাবরই নিজের ইচ্ছেকে বেশি প্রাধান্য দেই। তাই তো পড়াশোনা রেখে ছবি আঁকতে বসেছি।

সিঁড়িতে ধুপ ধাপ পায়ের আওয়াজ শুনে বুঝতে পারলাম রুদ্র এসেছে। সেদিকে ভ্রু-ক্ষেপ করলাম না। নিজের সবটুকু মনোযোগ দিয়ে আমি ছবি আঁকতে ব্যস্ত উনি রুমে আসলেন উনার উপস্থিতি বুঝতে পেরেও কিছু বললাম না। উনি নিজের উপস্থিতি জানান দেওয়ার জন্য নিজের হাতের ফাইলটা ধুপ করে আমার সামনে টেবিলে রাখলেন। আমি উনার দিকে তাকালাম না। যেনো আমার সব ধ্যান ঙ্গান এই ছবি আঁকার মাঝে।
উনি মুখ দিয়ে বিরক্তি সূচক ‘চ’ উচ্চারণ করলেন। তবুও আমার কোনো হেলদুল নেই। হঠাৎই উনি আমার সামনে থেকে খাতাটা টেনে নিলেন। আমি বিরক্ত হয়ে উনার দিকে তাকালাম। উনার মুখ দেখে আমার বিরক্তি ভাবটা কেটে গেলো। উনি হয়তো এতক্ষণ খেয়াল করেননি যে আমি পড়াশোনা রেখে ছবি আঁকছিলাম। উনি হয়তো আগে থেকেই রেগে ছিলেন। উনার উপস্থিতি বুঝতে পেরেও কিছু বলি নাই দেখে রেগে গিয়েছিলেন। এখন তো আরো রেগে গেলেন।

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

উনার মুখ দেখে আমি চুপসে গেলাম। উনি খাতা থেকে দৃষ্ট সরিয়ে আমার দিকে অগ্নি দৃষ্টি নিক্ষেপ করলেন। আমি ভয়ে গুটিশুটি মেরে বসে রইলাম। উনি রাগে দাঁতে দাঁত চেপে বলেন,
পড়াশোনা বাদ দিয়ে ছবি আঁকা হচ্ছে। এতক্ষণ এমন একটা ভাব করছিলেন যেনো পড়াশোনা করে পৃথিবী উদ্ধার করে ফেলছেন। আপনি পড়াশোনা করবেন কেনো? আপনি তো সব পাড়েন। আপনি তো সবজান্তা। আপনার তো পড়াশোনা করার দরকার নেই। এতো বই টেবিলে সাজিয়ে রেখে লাভ কী? সব বই বিক্রি করে দিন। কষ্ট করে কলেজে যাওয়ার কী দরকার? কলেজে যাওয়াও বন্ধ করে দিন।
উনি রাগে গজ গজ করতে করতে ওয়াশরুমে চলে গেলেন। উনার রিয়েকশন দেখে আমি হতভম্ব হয়ে বসে রইলাম। আমি ভেবেছিলাম উনি কেমন রিয়েকশন দিবেন আর এখন কেমন রিয়েকশন দিলেন? উনি রেগে থাকলেও পড়াশোনা নিয়ে এভাবে কখনো কথা বলেন না। আজকে তো কলেজে যাওয়া বন্ধ করে দিতে বলছেন। হাউ স্ট্রেইন্জ।

আমি ডিনার করে রুমে আসতেই উনি গম্ভীর গলায় বলে ওঠলেন,
আমি সোজা সাপ্টা কথা বলতে পছন্দ করি। তাই তোমাকে ঘুরিয়ে পেঁচিয়ে না বলে সরাসরি বলছি ড. ইফাদের থেকে দূরে থাকবে। যতটা সম্ভব কথা কম বলবে। ক্লাসের বাইরে তো একদমি কথা বলবে না। তুমি আমার কথা বুঝতে পারছো?
না বোঝার মতো তো আপনি কিছু বলছেন না। আপনি পরিষ্কার বাংলা ভাষায় কথা বলছেন আর আমিও একজন বাঙালি তাই আপনার কথা না বোঝার মতো তো কোনো কারণ আমি দেখছি না। কিন্তু আমি এটা বুঝতে পারছি না ইফাদ স্যারকে নিয়ে আপনার সমস্যাটা কোথায়? ইফাদ স্যার আপনার কোন পাঁকা ধানে মই দিয়েছে?
তুমি বুঝবে না। বোঝার কথাও না। তুমি তো আর আমার জায়গায় নেই তাই আমার সমস্যাটা তুমি বুঝতে পারবে না। তুমি যদি ছেলে হতে আর তোমার যদি আমার মতো সুন্দরী একটা বউ থাকতো তাহলে বুঝতে পারতে আমার সমস্যাটা ঠিক কোথাই।
আপনি ঠিক কী মিন করতে চাইছেন বলুন তো।
কিছু না। তোমাকে আমি যেটা বলেছি সেটা মনে রাখলেই চলবে। এখন ঘুমোবে আসো।

আজকে কলেজ আসছি। রুদ্র আসতে দিতে চাইছিল না। আমি জোর করেই আসছি। এমনি একদিন মিস করছি আর মিস করা যাবে না। কিন্তু অসাবধানতা বশত রুদ্র যেটার আশঙ্কা করছিল ঠিক সেটাই হয়ে গেলো। আমার মাথার সাথে ত্রয়ীর মাথা স্বজুড়ে লেগে যায়। আঘাত প্রাপ্ত স্থানে পুনরায় আঘাত পাওয়ার কারণে সাথে সাথেই ব্লিডিং শুরু হয়ে যায়। তখন ইফাদ স্যার ক্লাস নিচ্ছিলেন। ব্যথায় আমার চোখ মুখ কুচকে গেলো। একটু জুড়েই আওয়াজ করে ওঠলাম।

সবার দৃষ্টি এখন আমার দিকে। ত্রয়ী ভয়ে কান্নাকাটি শুরু করে দিয়েছে। ইফাদ স্যার এগিয়ে আসার আগেই রুদ্র কোথা থেকে যেনো ছুটে আসেন। উনি এসেই আমার সামনে হাঁটু গেড়ে বসে মাথা ধরে চেক করা শুরু করে দিয়েছেন। রুদ্র অস্থির হয়ে বলে ওঠলেন,
এই তোমার কী বেশি ব্যথা করছে? দেখো একদম ভয় পেয়ো না। আমি আছি তোমার সাথে কিছু হবে না।
উনি আমার একটু ব্যথা পাওয়াতেই কেমন অস্থির হয়ে পড়েছেন। আমি ভয় পাচ্ছি না। কিন্তু উনি যে প্রচণ্ড রকমের ভয় পাচ্ছেন সেটা উনাকে দেখেই বুঝা যাচ্ছে। উনার হাত পা থরথর করে কাঁপছে। এর মাঝে একজন নার্স ছুটে আসে ফাস্ট এইড বক্স নিয়ে। রুদ্রর হাতে ফাস্ট এইড বক্স দিতে গেলে রুদ্র সরে যায়। চোখের ইশারায় নার্সকে বলে ব্যান্ডেজ করে দিতে। নার্সটা একটু অবাক হয়ে তবু কিছু বলে না।

এদিকে রুদ্রর কান্ড দেখে আমার ব্যথার কথা বেমালুম ভুলে গেলাম। এতো বড় ডক্টর হয়েও নাকি সামান্য ব্যান্ডেজ চেইন্জ করতেও হাত কাঁপছে। এতক্ষণে খেয়াল হলো আমি এখন হসপিটালে আর উনি আমাদের ক্লাসে বসে এমন পাগলামো করে যাচ্ছেন। আমি একবার সবার দিকে চোখ ভুলালাম। সবার মুখের ভাব দেখে যতটুকু আন্দাজ করতে পারলাম কেউ রুদ্রর ব্যাপার নিয়ে মাথা গামাচ্ছে না সবাই এখন আমার মাথায় আঘাত পাওয়া নিয়েই ব্যতিব্যস্ত। শুধু ইফাদ স্যার ছাড়া। উনার মুখে অন্য রকম একটা বিরক্তির ছাপ। উনাকে দেখেই বুঝা যাচ্ছে উনি রুদ্রর উপস্থিতি এখানে সহ্য করতে পারছে না। উনি আরো বেশি বিরক্ত উনার ক্লাসে পারমিশন না নিয়ে ঢোকার কারণে।

নার্সটা ব্যান্ডেজ চেইন্জ করে দিয়ে চলে যায়। আমার বিল্ডিং বন্ধ হতে দেখে রুদ্র শান্ত হয়। উনি আমার দিকে চোখ পাকিয়ে ধমক দিয়ে বলে ওঠলেন,
আজকে কলেজে আসতে নিষেধ করছিলাম না? কিন্তু আপনি আমার কথা শুনবেন কেনো? আপনি তো এখন এডাল্ট নিজের লাইফের ডিসিশান নিজে নিতে শিখে গেছেন।
উনার ধমকে আমি কেঁপে ওঠলাম। ত্রয়ী কেঁদে কেঁদে এসে বলল, তার বেখেয়ালির জন্য এমন হয়েছে। উনি ত্রয়ীর কথা শুনলেন না। সবার সামনে আমাকে কোলে তুলে নিলেন। সবাই অবাক হয়ে আমাদের দিকে তাকিয়ে আছে। আমি লজ্জায় অস্বস্তিতে রুদ্রর বুকে মাথা গুঁজে দিলাম। উনাকে যদি বলি নামিয়ে দিতে উনি আমার কথা শুনবেন না। উল্টো দু চারটা ধমকও দিয়ে দিতে পারেন।

উনি বাসায় আসার পর থেকে আমার সাথে একটা কথাও বলেনি। আমার খেয়াল রাখাই কোনো ত্রুটি উনি রাখেনি। যখন যেটা দরকার সেটা হাতের কাছে এগিয়ে দিচ্ছেন। সময় মতো খাবার খাইয়ে দিচ্ছেন। কিন্তু সমস্তটা করছেন নিঃশব্দে। মুখ দিয়ে টু শব্দও করছেন না। আমি উনার সাথে কথা বলার আপ্রাণ চেষ্টা করছি। কিন্তু উনি উনার সিদ্ধান্তে অটল আমার সাথে কথা বলবেন না।
উনি আমাকে মেডিসিন খাওয়াতে আসলে আমি উনার হাত ধরে টান দিয়ে আমার ওপরে ফেলে দেই। আচমকা এমন হওয়াতে উনি নিজেকে সামলাতে না পেরে আমার ওপর পড়ে যান। উনি আমার কাছ থেকে মুখ ফিরিয়ে ওঠতে নিলেই সাথে সাথেই আমি উনার কলার চেপে ধরি। কলার চেপে ধরে উনাকে নিচে ফেলে আমি উনার ওপর ওঠে আসি মুখ সিরিয়াস ভাব নিয়ে বললাম,

পূর্ণিমাতিথি পর্ব ৪২

এই ছেলে আপনার এতো ভাব কোথা থেকে আসে? হ্যাঁ? দেখছেন না এই সুন্দরী রমনী আপনার সাথে কথা বলার জন্য মরিয়া হয়ে আছে। আপনি জানেন না সুন্দরী রমনীদের উপেক্ষা করলে অভিশাপ লাগে। রূপের অভিশাপ।
উনি একটু কাত হয়ে আমাকে উনার নিচে ফেলে দেন। উনার কলার থেকে হাত দুটো ছাড়িয়ে আমার হাত দুটো উনার এক হাতে বিছানার সাথে চেপে ধরেন। আরেক হাত দিয়ে কপালের ওপর পড়ে থাকা চুলগুলো সরিয়ে দিতে দিতে বলেন,
এই সুন্দরী রমনীর রূপের অভিশাপে তো সেই কবেই আমি জ্বলে পুড়ে ছাই হয়ে গেছি।

পূর্ণিমাতিথি পর্ব ৪৪

1 COMMENT

Comments are closed.