পূর্ণিমাতিথি পর্ব ৬

পূর্ণিমাতিথি পর্ব ৬
লেখিকা-তাসনিম জাহান রিয়া

রুদ্র ফ্রেশ হয়ে ডাইনিং রুমে আসতেই মামুনি প্রশ্নের ঝড় তুলে দেয়। প্রশ্নগুলো আগেই করতে চেয়েছিল কিন্তু আংকেল থামিয়ে দিয়েছিল। কারণ তখন রুদ্র ভিজে জবুথবু অবস্থা ছিল।
বাসায় আসতে তোর এতো দেরি হলো কেনো? তোর ফোন বন্ধ ছিল কেনো? তুই বাসায় ভিজে ফিরলি কেনো? রিয়া বললো তুই নাকি বাসায় সিএনজি দিয়ে এসেছিস। তোর কোনো বিপদ হয়েছিল নাকি?

রুদ্র মামুনিকে জড়িয়ে ধরে বলে, রিলাক্স আম্মু। আমার কোনো বিপদ হয়নি। হসপিটাল থেকে বের হতেই বৃষ্টি শুরু হয়ে যায়। মাঝ রাস্তায় আসতেই গাড়ি নষ্ট হয়ে যায়। গাড়িতে কোনো ছাতা ছিল না। দৌড়ে গিয়ে ছাউনির নিচে আশ্রয় নেই। দৌড়ে যাওয়ার সময় ফোন পকেট থেকে রাস্তায় পড়ে যায়। ফোন ভিজে একাকার হয়ে যায়। তাই আর ফোন অন হয়নি। অনেকক্ষণ অপেক্ষা করার পর একটা সিএনজি পাই, আর সেই সিএনজি করে বাসায় আসলাম।
তুই গাড়িতে বসে থাকলেই পারতি তাহলে তো আর ভিজতে হতো না। এখন যদি জ্বর আসে। তোর জ্বর তো ভয়ানক। একবার আসলে সহজে ভালো হতে চায় না।

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

উফ আম্মু তুমি বোকাদের মতো কথা বলছ কেনো? গাড়িতে বসে থাকলে সিএনজি কী করে দাঁড় করাতাম? ছাউনিতে এসে না দাঁড়ালে সারা রাত আমাকে গাড়িতেই কাটিয়ে দিতে হতো।
উনি কথা বলছেন আর আমি উনার দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছি। কেনো জানি উনার দিকে তাকিয়ে থাকতে ভালো লাগছে। আমার নজর যাচ্ছে বার বার উনার কানের পাশের তিলটার দিকে। তিলটা যেনো আমাকে নিজের দিকে টানছে। পরক্ষণেই আমি নিজের চোখ সরিয়ে নেই। কোনো মিথ্যা মায়ায় আমি নিজেকে বাধতে চাই না।

ইতিমধ্যে রুদ্রের গা বেশ গরম হয়ে গেছে। তার যে ভয়ানক জ্বর হবে তাতে কোনো সন্দেহ নেই। রুদ্রের জ্বর ওঠলে বাচ্চাদের মতো হয়ে যায়। আউট অফ কনট্রোল হয়ে যায়। নিজে কী করে নিজেই বুঝতে পারে না। কিয়ৎক্ষণ পুর্বেই গা কাঁপানো জ্বর ওঠে। জ্বরের ঘোরে কী যেনো বিড়বিড় করছে। রুদ্রকে একটা প্যারাসিটামল খাইয়ে দেই।
হুট করেই রুদ্র নিজের মাথা আমার কোলের ওপর রাখে। আমি চমকে ওঠি। আমাকে আরো চমকে দিয়ে রুদ্র আমার কোলে মুখ গুঁজে দেয়। কেমন অদ্ভুত অনুভূতি হচ্ছে। হঠাৎই রুদ্রের কান্নার শব্দ আমার কর্ণকুহর হয়। আজকে যেনো আমার অবাক হবার দিন। রুদ্রে একের পর এক অবাক করে যাচ্ছে আমাকে। হঠাৎ রুদ্রের বলা কিছু কথা অস্পষ্টভাবে আমার কর্ণকুহর হয়।

রিয়া আমি কী খুব খারাপ? আমাকে কী ভালোবাসা যায় না? আমি কী কারো ভালোবাসা পাওয়ার যোগ্য নই? আমি যাকে ভালোবাসি সেই-ই আমাকে ছেড়ে চলে যায়। আমি ওকে অনেক ভালোবাসতাম। বিশ্বাস করো সত্যিই আমি ওকে আমি অনেক ভালোবাসতাম।কিন্তু ও আমার ভালোবাসাটা বুঝলো না। আমার ভালোবাসার কোনো মূল্যই ওর কাছে ছিল না। আমাকে রেখে অন্য একজনকে বিয়ে করে ফেললো।

আমার ভালোবাসাটা ছুড়ে ফেলে দিয়ে ও অন্য একজনের হাত ধরে চলে গিয়েছিল। এই কারণেই আমি বিয়ে করতে চাইনি। এখন আমার কাউকে ভালোবাসতে ভয় করে। কাউকে বিশ্বাস করতে পারি না। ভালোবাসলে যদি আমাকে ছেড়ে চলে যায়। চাইনি আমি কারো মায়ায় জড়াতে। কিন্তু না চাইতেও জড়িয়ে যায় একজনের মায়ায়। কাঁদলেও যে কাউকে এতো সুন্দর লাগে। সেটা আমি আগে জানতাম না। হঠাৎই মেয়েটার কান্না বন্ধ হয়ে যায়। মেয়েটা কান্না বন্ধ হয়ে যাওয়ায় আমার একটুও ভালো লাগেনি। ইচ্ছে করছিল মেয়েটাকে চিমটি দিয়ে কাঁদিয়ে দেই বা চকলেট দেখিয়ে বলি বাবু তুমি আরো কাঁদো কাঁদলে তোমাকে চকলেট দিব।

উনার কথা শুনে আমি খিলখিলিয়ে হেসে দেই। হঠাৎ এভাবে হেসে দেওয়ায় হয়তো উনি বিরক্তি বোধ করলেন। উনি বিরক্ত হয়ে বলেন,

একদম হাসবে না। আমার সামনে হাসবেও না কাঁদবেও না। তুমি হাসলেও বিরক্ত হয়ে যাই কাঁদলেও বিরক্ত হয়ে যাই। তোমাকেই আমার ভালো লাগে না। চলে যাও আমার জীবন থেকে। আমার জীবন থেকে অনেক দূরে চলে যাও। আমি আর কাউকে ভালোবাসতে চাই না। কাউকে না। কাউকে ভালোবাসলে এক বুক কষ্ট সহ্য করার মতো ক্ষমতা থাকতে হবে। যেই ক্ষমতা আমার নেই। তোমাকে ভালোবাসার পর যদি তুমি আমাকে ছেড়ে চলে যাও আমি ভেঙে চুরমার হয়ে যাব। আমার কোনো অস্তিত্বই থাকবে না। আমি চাই না আর কেউ আমাকে ভেঙে দিক। তুমি চলে যাও। আগে……….

উনার আর কোনো কথা আমার কর্ণকুহর হলো না। উনার শরীর তাপমাত্রা অস্বাভাবিক মাত্রায় বেড়ে চলেছে। কী করবো কিছুই বুঝতে পারছি না? আমি দৌড়ে গেলাম মামুনিদের রুমের দিকে। বেশ কয়েক বার নক করার পরই মামুনি দরজা খুলে দেয়। মামুনি উৎকন্ঠা হয়ে জিঙ্গেস করে।
রুদ্রের জ্বর এসেছে না?
আমি মাথা নাড়িয়ে হ্যাঁ বললাম। তৎক্ষণাত মামুনি ছুটলেন আমাদের রুমের দিকে। আমি আর আংকেলও পিছনে আছি।

মামুনি রুদ্রের মাথায় জল পট্টি দিচ্ছে। আমি কম্বল বের করে উনার গায় জড়িয়ে দিলাম। আংকেল অনবরত ফোন করে চলেছে। এট লাস্ট আংকেলের এক বন্ধু ফোন রিসিভ করলো। উনি মাত্রই হসপিটালের ডিউটি শেষে বাসায় ফিরছিলেন। উনি এখনি আসছেন।

কিছুক্ষণ আগেই ডক্টর আংকেল রুদ্রকে চেকআপ করে মেডিসিন দিয়ে গেছেন, আর বলে গেছেন, জল পট্টি দিতে। জ্বর একটু কমতেই আমি মামুনি আর আংকেলকে জোড় করে নিজেদের রুমে পাঠিয়ে দেই। উনাদের দুজনের হাই প্রেশারের সমস্যা। বেশি রাত জাগলে অসুবিধা হবে।
আমিই রুদ্রর মাথায় জল পট্টি দিচ্ছি। উনাকে এখন একটা অবলা শিশুর মতো দেখা যাচ্ছে। চোখ মুখ শুকিয়ে গেছে। মনে হচ্ছে কতদিনের অভুক্ত। হঠাৎই উনি ঠোঁট উল্টে দিলেন বাচ্চাদের মতো। উনার ঠোঁট উল্টানো দেখে আমি হেসে দিলাম।

কারো তীক্ষ্ণ কন্ঠের আওয়াজে ঘুম থেকে হুড়মুড়িয়ে ওঠলাম। রুদ্র আমার দিকে অগ্নি দৃষ্টি নিক্ষেপ করে আছে। ঘুমের রেশ এখনো পুরোপুরি কাটেনি। কিন্তু উনার বাঁজখাই গলা শুনে ঘুম বাবাজি উড়াল দিল।
এই মেয়ে তোমাকে আমি কী বলেছিলাম। আমাকে তুমি একটুও স্পর্শ করবে না। তোমার সাহস হয় কী করে আমার হাতের ওপর মাথা রেখে ঘুমানোর?

আমার ঠেকা পড়ে নাই আপনার হাতের ওপর মাথা রেখে ঘুমানোর। আপনি আমার হাত ধরে রেখেছিলেন। তাই বাধ্য হয়ে এখানে শুতে হয়েছে।
উনি এবার নিজের হাতের দিকে তাকালেন। হাতের দিকে তাকিয়ে উনি অপ্রস্তুত হয়ে পড়লেন। কারণ উনি এখনো আমার হাত ধরে রেখেছেন। উনি তাড়াতাড়ি আমার হাত ছেড়ে দিলেন। হাত ছেড়ে দিয়ে আমতা আমতা করে বলেন,
আমি মোটেও তোমার হাত ধরিনি। তুমি নিজে আমার হাতের মাঝে তোমার হাত গুঁজে দিয়েছ।

এবার প্রচণ্ড রাগ হলো। সারা রাত জেগে বাংলা সিনেমার নায়িকার মতো উনার সেবা করলাম। আর উনি সকাল হতেই বাংলা সিনেমার নায়কের মতো পাল্টি খাচ্ছেন। তাতো আমি মোটেও হতে দিব না। আমি তো এতো সহজে ছেড়ে দিব না।
আপনিই আমার হাত ধরেছিলেন। আমি না। আরো কতকিছু করলেন।
উনি সিরিয়াস হয়ে বলেন, কী করেছি আমি?

আপনি বুঝতে পারছেন নাহ?
নাহ আমি বুঝতে পারছি না। তুমি বলো।
আমি এবার চুপ করে থাকলাম। উনি এবার ধমক দিয়ে বলে ওঠলেন,
চুপ করে আছো কেনো? আন্সার মি। কী হয়েছিল?

পূর্ণিমাতিথি পর্ব ৫

আমি নিজের হাসি চেপে রেখে বললাম, আমি বলতে পারবো না। আমার লজ্জা লাগে।
কথাটা বলেই মুখ হাত দিয়ে ঢেকে দৌড়ে রুম থেকে বের হয়ে আসলাম। রুম থেকে বের হয়েই হেসে দিলাম। উনার মুখটা দেখার মতো ছিল।

পূর্ণিমাতিথি পর্ব ৭