প্রণয়াসক্ত পূর্ণিমা পর্ব ৩৭

প্রণয়াসক্ত পূর্ণিমা পর্ব ৩৭
Writer Mahfuza Akter

প্রেগন্যান্সি রিপোর্টের পৃষ্ঠাগুলোতে একবার চোখ বুলিয়ে আপনমনেই মলিন মুখে হাসলো তরী। এমনটা তো হওয়ারই ছিল! শুধু কনফার্মেশনের জন্য টেস্টগুলো করানো। শাড়ির আঁচল মাথা পর্যন্ত টেনে বেরিয়ে গেল সে হসপিটাল থেকে।
পেছন থেকে অরুণী তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো তরীর চলে যাওয়ার দিকে। কিছু একটা মনে হতেই রিসিপশনে গিয়ে বললো,

“এক্সকিউজ মি! কিছুক্ষণ আগে একটা মেয়ে রিপোর্ট কালেক্ট করে গেল যে, নাম অরিত্রী সেহরীশ! ওনার কী প্রব্লেম?”
“খুন সম্ভবত উনি প্রেগন্যান্ট। শিওরলি বলতে পারছি না, ম্যাম!”
কথাটা শুনে অরুণীর মুখ মলিন হয়ে গেল। চোখের কোণে জল জমতে সময় নিল না। আঙুল দিয়ে পানিটুকু মুছতে মুছতে ভাবলো, এমনটা তো হওয়ারই ছিল!

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

সৌহার্দ্য ডিউটি শেষে হসপিটাল থেকে বেরিয়ে এলো। গাড়িতে ওঠার সময় সামনে তাকাতেই অদূরে অরুণী আর অর্ণবকে কথা বলতে দেখতে পেল। সৌহার্দ্য ভ্রুকুটি করে তাকিয়ে রইলো ওদের দুজনের দিকে কিছুক্ষণ। ‘ওরা দুজন এখন, এখানে, একসাথে কী করছে?’- প্রশ্নটা মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে সৌহার্দ্যের। ওদের দিকে এগোতে গিয়েও এগোলো না। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে থেমে গেল। আজ তরীকে একটু বেশি সময় দেবে বলে তাড়াতাড়ি বাসায় ফিরছে সৌহার্দ্য। এমনিতেই তরীর কালকের আচরণে সে বেশ চিন্তিত। তাই আগ বাড়িয়ে অরুণীর কাছে যাওয়ায় মন সায় দিল না। ফোন বের করে ওদের দুজনের একটা ছবি তুলে নিয়ে গাড়িতে উঠে বসলো সৌহার্দ্য।

অরুণী আর অর্ণবের একসাথে থাকাটা সৌহার্দ্যকে ভাবাচ্ছে বেশ। কেন যেন মনে হচ্ছে, ওদের দুজনের উদ্দেশ্য খুব একটা ভালো না! অর্ণব তরীকে ভালোবাসতো, এখনো বাসে হয়তো! ভয়টা এখানেই! সৌহার্দ্য গাড়ির জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে এসব ভাবছিল, এমন সময়ই প্রহর কল দিলো।
“আজকে দেখা করিস যদি তোর সময় হয়!”

সৌহার্দ্য দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো, “আজকে সম্ভব না। হঠাৎ দেখা করার কথা বলছিস কেন? বাসায় চলে আয় আমার!”
“বাসার সবার সামনে এসব বলা গেলে তো চলেই আসতাম! তোর বউয়ের সামনে এসব বললে কখন দেখবি আমাকেই আকাশের তারা বানিয়ে দিবে!”

সৌহার্দ্য বিরক্ত হয়ে বললো, “স্টপ টকিং ননসেন্স!”
“সৌহার্দ্য, আ’ম সিরিয়াস! মজা করছি না আমি তোর সাথে। তরীর আচরণ আমার কাছে সন্দেহজনক লাগলেও এখন আমি নিশ্চিত যে, খু*ন*গুলো তরী-ই করেছে। এই সত্যিটা তুইও জানিস। আর খুব শীঘ্রই এটা প্রকাশ পাবে সবার সামনে। তখন….”

সৌহার্দ্য ওকে থামিয়ে দিয়ে বললো,
“কিছু প্রকাশ করবি না তুই। যা হওয়ার, তা হয়ে গেছে! চাঁদকে আমি আমার থেকে দূরে সরতে দিবো না। তোর সন্দেহ সত্যি বলে প্রমাণিত হলে তুই কিছু প্রকাশ করবি না। সব কেইস ক্লোজ করে দিবি। আমি চাঁদকে নিয়ে অনেক দূরে চলে যাবো।”

“সৌহার্দ্য, তুই পাগল হয়ে গিয়েছিস। তোর চাঁদের প্রেমে উ*ম্মা*দ হয়ে তুই ন্যায়-অন্যায় ভুলে গিয়েছিস!”
“হ্যাঁ, তোর যা মনে করার করে নে। কিন্তু আমি যা বলেছি, তুই সেটাই করবি। নয়তো আমার থেকে খারাপ কেউ হবে না।”
প্রহরকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে সৌহার্দ্য ফোন কেটে দিলো। প্রহর হতাশ চোখে ফোনের স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে রইলো।

সৌহার্দ্য বাড়ি ফিরলো বিকেলে। হাতে একগোছা লাল গোলাপ আর মুখে হাসি নিয়ে নিজের ঘরে ঢুকতেই দেখলো, ঘরে কেউ নেই। সারাঘরে একবার চোখ বুলিয়ে হাত থেকে এপ্রোন আর স্টেথোস্কোপটা টেবিলে রাখলো। বারান্দা, ওয়াশরুম চেক করেও তরীকে না পেয়ে তার মাকে ডাকলো। সুজাতা কফি নিয়ে ঘরে ঢুকতেই সৌহার্দ্য বললো,
“মা! চাঁদ…. ”

“নিজের বাবার কাছে গেছে। দুপুরে বেরিয়ে ছিল, পরে আমাকে কল দিয়ে বললো, বাবার বাসায় কয়েকদিন থেকে আসবে। আমি আর কী বলবো?”
সৌহার্দ্য রাগী কন্ঠে বললো, “ও যেতে চাইলো, আর তুমি ওকে পারমিশন দিয়ে দিলে!”
সুজাতা অবাক হয়ে বললো,

“তো আমি ওকে আটকাবো কেন? আর তুই এমন করছিস কেন? তুই জানিস না? তোকে বলে যায়নি ও?”
“আমায় না জানালে জানবো কী করে? এমনটা কেন করলো ও? আমাকে একবার জানানোর প্রয়োজন মনে করলো না! ও জানে না, ওকে ছাড়া থাকতে পারি না আমি?”
সৌহার্দ্য গাড়ির চাবি নিয়ে আবার বেরিয়ে গেল। সুজাতা পেছন থেকে ডাকলেও শুনলো না। ড্রয়িংরুমে আসতেই দেখলো, প্রহর ভেতরে আসছে। সৌহার্দ্য অবাক হয়ে বললো,

“তুই? তুই আবার এখানে কেন এসেছিস?”
প্রহর মুখ বাকিয়ে বললো,
“তোরা বাপ-ভাই-বোন মিলে শান্তিতে থাকতে দিলে তো আর আসতাম না! কাছ দিয়েই যাচ্ছিলাম। মধু ফোন করে বললো, তোর বাবা নাকি দেখা করতে চেয়েছে আমার সাথে। তাই আসতেই হলো।”
সৌহার্দ্য কিছু না বলে দ্রুত গতিতে পা চালিয়ে বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেল। প্রহর হতভম্ব হয়ে ওর যাওয়ার দিকে তাকিয়ে বললো,

“এই ছেলে আবার কই যাচ্ছে? মাত্র-ই না বাসায় ফিরলো!”
সৌহার্দ্য কয়েক মিনিটের মধ্যেই গাড়ি নিয়ে তরীর বাড়ির সামনে পৌঁছালো। কলিং বেল বাজানোর কিছু মুহুর্ত পর মোহনা দরজা খুলে দিলেন। সৌহার্দ্যকে দেখে হাসি মুখে বললেন,
“আরেহ্ বাবা, তুমি! এসো, ভেতরে এসো! তরী, দেখ কে এসেছে?”

সৌহার্দ্য কোনো রকমে হাসার চেষ্টা করে ভেতরে প্রবেশ করলো। ড্রয়িং রুমে তরী আর অর্ণবকে পাশাপাশি বসে থাকতে দেখে রাগের মাত্রা বেড়ে গেল সৌহার্দ্যের।
“কে এসেছে, মা?”
বলে সামনে তাকাতেই সৌহার্দ্যকে দেখে চোখ কপালে তুলে ফেললো তরী। অবাক কন্ঠে বললো,
“তুমি এখানে…”

সৌহার্দ্য রাগী দৃষ্টিতে একবার তরী আর একবার অর্ণবকে দেখে হনহনিয়ে তরীর রুমে চলে গেল। তরী হতভম্ব হয়ে সৌহার্দ্যের পিছু পিছু গেল। সৌহার্দ্য গম্ভীর হয়ে বিছানায় বসে আছে। তরী দরজা চাপিয়ে দিয়ে সৌহার্দ্যের সামনে এসে দাঁড়াতেই সৌহার্দ্য দ্রুত গতিতে উঠে দাঁড়িয়ে তরীর বাহু চেপে ধরলো। রাগী কন্ঠে বললো,
“প্রথমত, আমাকে না জানিয়ে এ বাসায় থাকতে এসেছো! দ্বিতীয়ত, অর্ণবের সাথে পাশাপাশি বসেছো আমি অপছন্দ করা সত্ত্বেও! এখন তোমায় কী শাস্তি দেওয়া উচিত, তুমিই বলো।”

তরী অবাক চোখে তাকিয়ে বললো,
“শাস্তি? ক্… কিসের শাস্তি? সৌহার্দ্য, আমার কথা শোনো। আমি তোমাকে রাতে জানাবো ভেবেছিলাম। তুমি তখন ফ্রী থাকতে, তাই তখন কল করবো ভেবেছিলাম।”

“শাট আপ! অজুহাত বানানো বন্ধ করো। তুমি ভালো করেই জানো, তোমার কল আমি এক রিংয়েই রিসিভ করি। সার্জারী থাকলে অন্য ব্যাপার! আমার থেকে দূরে থাকার জন্যই আজকে তুমি এখানে চলে এসেছো। কালকে রাতে তোমার কান্না দেখেই কিছুটা আন্দাজ করেছি আমি। নিশ্চয়ই কিছু একটা ঘটেছে! কী হয়েছে আমায় বলো?”
তরী ভীত দৃষ্টিতে সৌহার্দ্যের দিকে তাকালো। নিজেকে সামলে আশে পাশে তাকাতে তাকাতে বললো,
“কিছু হয়নি, সৌহার্দ্য! তুমি বেশি ভাবছো। বাবা আমার সাথে দেখা করতে চেয়েছিল, তাই ভাবলাম কয়েকদিন এখানে থেকে যাই।”

সৌহার্দ্য ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে রইলো তরীর দিকে। কেন যেন চেয়েও তরীকে ওর বিশ্বাস করতে ইচ্ছে হচ্ছে না! তবুও বললো,
“তাহলে দেখা করে চলে যাই, চলো। এখানে থাকতে হবে না। এই অর্ণবের সাথে এক বাড়িতে তো আমি তোমাকে থাকতে দেবোই না!”
তরী আমতা আমতা করে বললো,

“অর্ণব ভাই তো এ বাড়িতে শুধু রাতে থাকে। সারাদিন তো থাকে না। তুমিও থাকো আজকে। আমি শুধু দুদিন থাকবো। পরশু চলে যাবো বাসায়!”
অনিচ্ছা সত্ত্বেও সৌহার্দ্য মাথা নাড়িয়ে সম্মতি জানালো। তরী খুশি হয়ে বললো,
“আমি কফি নিয়ে আসছি তোমার জন্য।”
“নিজের জন্যও এনো। একা একা কফি খাই না আমি তোমাকে ছাড়া।”

তরী শাড়ির আঁচল কোমরে গুঁজে রান্নাঘরে চলে গেল। কয়েক মিনিটের মধ্যেই দুই কাপ গরম গরম কফি এনে একটা সৌহার্দ্যের হাতে দিলো। দুজনে কফি খেতে খেতে গল্প করলো অনেক। সৌহার্দ্য কফি খাওয়া বাদ দিয়ে তরীর হাসি মুখের দিকেই তাকিয়ে রইলো। এই একটা জায়গায়ই তার সকল সুখ, আনন্দ, আবেগ, অনুভূতি।

হঠাৎ গা গুলিয়ে উঠতেই তরী চমকে বসা থেকে দাঁড়িয়ে গেল। ছুটে ওয়াশরুমে চলে গেল সে। এই ভয়টা-ই সে পাচ্ছিল। এখন সৌহার্দ্যের হাতে ধরা না পড়লেই হয়। সৌহার্দ্য হন্তদন্ত হয়ে তরীর পিছু পিছু এলে তরী সৌহার্দ্যের মুখের ওপর দরজা লাগিয়ে দিলো। ব*মি করে ফ্রেশ হয়ে দশ মিনিট পর ওয়াশরুম থেকে বেরিয়ে এলো তরী। শাড়ির আঁচল দিয়ে মুখ মুছতেই দেখলো, সৌহার্দ্য ওর দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। তরীর বুক কেঁপে উঠল এই ভয়ে যে, সৌহার্দ্য সবটা বুঝে ফেললো কি না!

সৌহার্দ্য এগিয়ে এসে তরীর চোখের দিকে তাকিয়ে রইলো কিছুক্ষণ। ওর হাতের কব্জি চেপে ধরে মনযোগী ভঙ্গিতে কিছু একটা পরখ করলো। পরমুহূর্তেই অবিশ্বাস্য দৃষ্টিতে তরীর ভীত মুখশ্রীর দিকে তাকিয়ে বললো,
“প্রেগ্ন্যাসি টেস্ট করতেই অরুণীর হসপিটালে গিয়েছিলে, তাই না?”

প্রণয়াসক্ত পূর্ণিমা পর্ব ৩৬

(সবার রেসপন্স প্রত্যাশিত! আর হ্যাঁ, গল্পের প্লট যেভাবে সাজিয়েছি, গল্প সেভাবেই এগোবে। সবাইকে ধৈর্য্য ধরার অনুরোধ রইলো। ভালোবাসা🖤)

প্রণয়াসক্ত পূর্ণিমা পর্ব ৩৮