প্রণয়ের জলসাঘরে পর্ব ১৩

প্রণয়ের জলসাঘরে পর্ব ১৩
রেহানা পুতুল

গোটা ডায়েরিটা যত্নের সাথে আরো কিছুক্ষণ দেখল ও পড়ল পিয়াসা।
শেষের এক পৃষ্ঠাতে লেখা পেল,
” জানো কেশবতী তোমাকে নিয়ে কত যে স্বপ্নে হারাই। বালুচরে ঘর বাঁধি। সাজাই আমার প্রণয়ের জলসাঘর। যেই জলসাঘরে তুমি ছাড়া দ্বিতীয় কোন নারীর আসন হবেনা। যেই জলসাঘরে আমি বেহুঁশ হয়ে তোমার উছলে পড়া রূপসুধা পান করবো। তোমার পায়ে পরাবো ঘুঙুর। কোমরে রূপোর বিছা। খোঁপায় থাকবে বকুল মালা। তোমার প্রণয় নৃত্য অবলোকন করব আমি বুঁদ হয়ে নেশাতুর নয়নে। তুমি আমার অপ্রতিরোধ্য আকর্ষণ কেশবতী। তুমি আমার প্রণয়ের জলসাঘরের রূপজান, রূপমাধুরী, মধুবালা,অঙ্গনা, লীলাবতী, চন্দ্রমুখী। ”

পিয়াসা ঝিরিঝিরি বৃষ্টির মতো হেসেই সারা। নিশ্চিত হলো আয়মান স্যারের কেশবতী সে ছাড়া আর কেউই নয়। মনে পড়ল গ্রামে দাদীকে বলছিল আয়মান,
কেশবতীকে না পেলে আর কাউকেই বিয়ে করবোনা। বিয়ে বাড়িতে ঘটে যাওয়া বিষয় নিয়ে যতটা বিষাদে বিরক্তিতে ছেয়ে গিয়েছে পিয়াসার মন। তার চেয়েও কয়েকগুণ বেশী ভালো হয়ে গিয়েছে এই ডায়েরিটা পড়ার পর।
পিয়াসা ডায়েরিটা যেভাবে ছিল ঠিক সেভাবেই রেখে দিল। মনে মনে ঠিক করল,

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

কিছুতেই বুঝতে দিবনা আমি যে বুঝেছি। দেখি মদনে কি করে। এবার জমবে প্রণয়ের জলসাঘর। এমন নাচান নাচাবো বান্দরের মতো। কলা ঝুলিয়ে রাখব মুখের সামনে। কিন্তু খেতে দিবনা। হুহু!
দেয়ালে আয়মানের দাঁড়ানো একটি বাঁধাই করা ফ্রেমে বন্ধী ছবি দেখতে পেল। এ রুমে খুব দরকার না হলে আসাই হয়না। তাই দেখতে পায়নি এতদিন। পিয়াসা ছবিটির সামনে দাঁড়ালো কোমরে দুইহাত দিয়ে।
বিড়বিড়িয়ে গাইলো,

” হিরো হিরো হিরো,তুমি আমার হিরো।
তুমি ছাড়া জীবনটা আস্ত একটা জিরো। ”
আই লাভ ইউ আয়মান। এই যে হ্যালো.. মিস্টার আয়মান শেখ, বুকের ভিতরে এত উথাল-পাতাল প্রেম নিয়ে ঘুমাও কি করে। উপর দিয়ে দেখলে মনে হয় সাধু। ভাজা মাছটিও উল্টো খেত জাননা। এখন তো দেখি ভাগে পেলে শুধু মাছ নয়,মাছের কাঁটাও হজম করে ফেলবে।

সেই স্কুলে থাকতেই তোমাকে লাইক করি। কলেজ শেষ দিলাম। ভার্সিটিতে উঠে গেলাম। প্রেমটাই হলনা আমাদের। আচ্ছা বলতো হ্যান্ডসাম পুরুষ। এভাবে চলতে থাকলে আমরা যে বুড়ো-বুড়ি হয়ে যাব। তো প্রেম করব কখন? বিয়ে করব কখন? পয়দা করব কখন? তুমি ছেলে মানুষ। তোমাকেই প্রপোজ করতে হবে। আর সেই পথ আমিই তৈরি করে দিব। হিঃহিঃহিঃ করে পিয়াসা কিটকিটিয়ে হেসে ফেলল।

ভালোবাসা মানুষকে মহান করে। ঔদার্য হতে শেখায়। বুকে জমে থাকা সকল ব্যথা যন্ত্রণা ঘৃণা দূর করে দেয়। পরিশুদ্ধ করে শ্রাবণ ঢলে ধুয়ে দেওয়া পথ ঘাটের মতো। তার প্রতি আয়মানের অনুরাগ, নিবেদন দেখে সে ভুলেই গেল এই রাতেই তার সাথে ঘটে যাওয়া বিশ্রী ঘটনাটি।
ঘড়ির কাঁটা রাত একটা ছুইঁ ছুইঁ।
আল্লাগো যে কোন সময় আমার মদন প্রেমিক এসে যাবে। চলে যাই।

পিয়াসা আয়মানের রুমের লাইট দরজা অফ করে আলিশা ও তার রুমে রুমে চলে গেল। চোখ বন্ধ করে ঘুমানোর মিথ্যে চেষ্টায় ক্লান্ত তার চঞ্চল দুটি আঁখি।

এদিকে বিয়ে বাড়ির ঘটনা রায়হানকে বলার পরে সে বুঝে নিল এটা কার কান্ড। তার ছোট ফুফুর জায়ের ভার্সিটি পড়ুয়া লম্পট ছেলে এটা করেছে পিয়াসাকে দেখেই। দাওয়াত না দিলেও এই ছেলে দূরাত্মীয়দের অনুষ্ঠানগুলোও মিস করেনা মেয়েদের লোভে। প্রতিটি পরিবারেই এমন বাজে চরিত্রের দুই একজন মানুষ থাকে। এরা নারী দেহ পেলেই হলো। কে, কি হবে, সম্পর্কে এগুলো যাচাই করার ও হিতাহিত জ্ঞান থাকেনা। রায়হান তাকে মেরে বের করে দিয়েছে। এবং আর কখনো যেন তাদের বাসায় না আসে আল্টিমেটাম দিয়ে দিয়েছে।

পিয়াসার জন্য রায়হানের মনের অন্তঃপুরে প্রণয় এখনো বহমান বহতা নদীর মতো। তার খুব ইচ্ছে করেছে হলদে সাজে পিয়াসাকে একটু ছুঁয়ে দেখতে। কিন্তু সময় ও পরিবেশ তার বিপক্ষে ছিল।
কিছুক্ষণ পর মোবাইলের নাম্বারে মেসেজের টুং করার আওয়াজ শুনে চোখ মেলল পিয়াসা । কোন অসভ্যরে তুই। এত রাতে মেসেজ দিলি।

আয়মানের নাম্বার দেখেই ঠোঁটের একপাশ কামড়ে ধরল পিয়াসা।
” কলিংবেলের আওয়াজে মার ঘুম ছুটে যাবে। গেট খোলো। ”
ওমাগো আমার যে কি শরম লাগছে। এই বলে পিয়াসা উঠে গিয়ে গেট খুলেই প্রায় দৌড় দিল রুমের দিকে। তা দেখেও আয়মান কোন বিশেষ হেলদোল দেখালোনা। সে বুঝে নিল সদ্য ঘটে যাওয়া ঘটনার জন্য পিয়াসা বিব্রতবোধ হচ্ছে তার সামনে। সেই বিষয় টেনে সে নিজেও পিয়াসাকে আড়ষ্টতায় ফেলে দিতে চায়না।

আজ বাইরে থেকে এসেই আয়মান পিয়াসাকে ফেসবুকে মেসেজ দিল। আমার রুমে আসো। পিয়াসা তিড়িংবিড়িং করে নাচতে নাচতে রুমের সামনে গিয়ে থামলো। চোখ মুখের দুষ্ট দুষ্ট ভাব লুকিয়ে ফেলল। ভিতরে ঢুকে দাঁড়ালো। মুখে কিছুই বলছেনা।
কেন ডেকেছি জিজ্ঞেস করবেনা?
কেন জিজ্ঞেস করব? আপনি

ডেকেছেন। আমি আসলাম। এবার কারণটাতো আপনিই বলবেন স্যার।
আয়মান উঠে দরজা ভিড়িয়ে দিল। লুকিয়ে রাখা একটি তাজা লাল গোলাপের তোড়া পিয়াসার দিকে বাড়িয়ে ধরলো নিবেদিত চোখে।
উচ্ছ্বল হাসি দিয়ে বলল,

শুভ জন্মদিন পিয়াসা। সুন্দর থেকে আরো সুন্দর হও।
পিয়াসা হকচকিয়ে গেল। উচ্ছ্বাস মাখা হাসি দিয়ে,
আমার জন্মদিন কিভাবে জানলেন?
জুকার বার্গের কল্যাণে ফেসবুক থেকে।
থ্যাংক ইউ স্যার। আমি যাই এবার?
তোমার ভালো লাগছে গোলাপ পেয়ে?

খুউব ভালো লাগছে। ফুল আমার ভীষণ প্রিয়।
তাহলে আমি যদি তোমাকে রোজ একটি করে গোলাপ এনে দিই। কেমন হবে?
দারুণ হবে স্যার।
তাহলে তুমি আমাকে কি দিবে?
পিয়াসা হাসি মুখ বিবর্ণ করে ফেলল। বলল,যারা বিনিময় আশা করে তাদের থেকে ফুল নিবইনা আর। পিয়াসা পা চালিয়ে চলে গেল।
পিয়াসা শুন প্লিজ…রাগ করোনা বলছি।

শিট। আমার কপালটাই খারাপ। ভাব জমাতেই পারছিনা। আবার প্রেম। বলি একটা মিন করে। বুঝে নেয় আরেকটা। আয়মান নিজের কপাল নিজেই ঠোকাতে লাগল।
পিয়াসার জন্মদিন উপলক্ষে কেক কাটা হবে সন্ধ্যায়। এই আয়োজন করেছে আলিশা। আয়মান কেক এনে দিয়েছে। কেক কাটা হলে সবাই সবাইকে খাওয়ালো। আয়মানের হাতে পিয়াসা কেক খেল। কিন্তু নিজে খাওয়ালোনা। আয়মান কিছুটা রাগ হয়ে চলে গেল। পিয়াসা বুঝেও না বোঝার ভান করে রইলো।

আয়মানের মা পিয়াসার পিঠে হাত দিয়ে নিজের রুমে নিয়ে গেলেন। সাথে আলিশাও গেল। তিনি বললেন,
মা তোমার কাছে একটা আবদার করবো। রাখবে?
পিয়াসা বুঝল ব্যাপারটা। বলল আপনাকে মায়ের মতো ভালোবাসি আন্টি। আপনার আবদার আমার শিরোদার্য।
তুমি না শুনেই বললে ?
হুম বললাম। বলেন আন্টি। আয়মানের মায়ের হাত ধরে অনুনয়ের ভঙ্গিতে বলল পিয়াসা।
আমি আয়মানের সাথে তোমার বিয়ে দিতে চাই। তোমার আপত্তি থাকলে চাইনা।
পিয়াসা চুপ করে রইলো।

আপু স্পষ্ট করে বল। এ যুগের মেয়ে হয়ে এত গুটিয়ে থাকা মানায়না।
আমার কোন আপত্তি নেই আন্টি।
ইয়েহ! আহা কি আনন্দ আকাশে বাতাসে। বলে ধেই ধেই করে হাত পা ছোড়াছুড়ি করতে লাগল আলিশা।
পিয়াসা মাথা নামিয়ে লজ্জাবনত চোখে তার রুমে চলে গেল। দরজা বন্ধ করে দিল। পিছন দিয়ে আয়মানের মা ও আলিশা আয়মানের রুমে গিয়ে,
পিয়াসা বিয়েতে রাজি জানালো।

আয়মান বিষ্পোরিত নয়নে মা বোনের মুখের দিকে বারবার চাইলো।
কিরে এমন ভাবে তাকাচ্ছিস কেন? অবিশ্বাস্য কিছু মনে হচ্ছে নাকি তোর কাছে?
আমার কান ঠিক আছেতো মা ? গোল গোল চোখে জানতে চাইলো আয়মান।
পাশ থেকে আলিশা বলল,তার মানে তুমি আপুর সাথে এমন কোন আচরণ করেছ,যার দরুন সে রাজী হওয়ার কথা নয়। এম আই রাইট ব্রো?

আয়মান নিরুত্তর রইলো চিন্তাগ্রস্ত মনে।
এরা চলে গেলে আয়মান পিয়াসাকে মেসেজ দিল। প্লিজ এক্ষুনি আমার রুমে আসো।
পিয়াসা এলনা। এরপর আয়মান উঠে গিয়ে পিয়াসার হাত ধরে টেনে নিজের রুমে নিয়ে আসল। দরজা বন্ধ করে দিল।
পিয়াসার দুই বাহুর উপরে হাত দিয়ে ধরে এনে খাটে বসালো। অল্প দূরত্ব বজায় রেখে সেও বসল।
মা আর আলিশা যা বলল তা কি সত্যি?

পিয়াসা থম মেরে আছে।
চুপ থাকা কোন সমাধান হতে পারেনা। মুখ দিয়ে উচ্চারণ করে বল সত্যিই?
হ্যাঁ সত্যি।
কারণটা জানতে পারি ?
আপনি যে কারণে রাজী হয়েছেন। ঠিক সেই একই কারণে আমিও রাজি হয়েছি।
তার মানে আমি যেমন মায়ের কথা ফেলতে পারিনি। তুমিও আমার মতো ফেঁসে গিয়েছ। মায়ের কথা ফেলতে পারনি। এইতো?

ঠিক তাই। বলল পিয়াসা।
এভাবে কি ভালো থাকা যায়?
খুব যায়।
ইম্পসিবল। যে তুমি আমাকে তোমার জন্মদিনের একটু কেক খাইয়ে দিলেনা। রেজাল্টের দিনে আনা মিষ্টি খাইয়ে দিলেনা। তাহলে আমি কি বুঝিনা তোমার মাঝে আমার স্থান কতটুকু?
বিয়ের রাতে মিষ্টি বেশী করে খাইয়ে দিয়ে পুষিয়ে দিব। নরম সুরে বলল পিয়াসা।
তুমি মায়ের জন্য রাজী হয়েছে। বুকের ভিতরে ঠিকই না ভালোলাগাটা পুষে রেখেছ।
সেইম কথা কি আমিও বলতে পারিনা আপনাকে?
খুব পারো। হাজারবার পারো। তাহলে আস আমরা বিয়ের আগেই সহজ হওয়ার প্র‍্যাক্টিস করি।
কিভাবে?

আয়মান হাত দিয়ে তার মাথার পিছনে চুলকাতে চুলকাতে, নাহ কিছুনা।
তাহলে আমি যাই? আরেকটি রিকুয়েষ্ট রাখবেন?
রাখব। মেঘকালো মুখে বলল আয়মান।
বিয়ের আগ পর্যন্ত যতটুকু সম্ভব দূরে দূরে থাকবেন আমার থেকে।
একটু বসবে পাশে?
কোন দুঃখে বলে পিয়াসা চলে গেল৷
আয়মান কল্পনা করতে লাগল বিয়ের সাথে পিয়াসাকে কিভাবে কেমন করে ভালোবাসবে। গোপনে রোমাঞ্চকর অনুভব করল।

আবার ভাবল,আমাকে দিয়ে কি সত্যিই কিছু হবে? কিন্তু কিছু একটাতো করতেই হবে।
বাসায় বিয়ের প্রস্তুতি চলছে। আলিশা কলেজে যাওয়া আসা করছে নিয়মিত। পিয়াসাও তার মতো করে ভার্সিটিতে যাচ্ছে আসছে। কলেজে ভর্তি হওয়ার পর হতেই আলিশার জন্য অংকের টিচার রাখা হয়েছে বাসায়। সে অংকে তুলনামূলক কাঁচা। সপ্তাহে তিনদিন আসে তার শিক্ষক। নাম শুভ। এই শিক্ষকের প্রতি আলিশা অনুরক্ত। একা হলেই শুভ স্যারের জন্য সে প্রণয় অনুভব করে। আজ শুভ যখন তাকে পড়াতে আসল বিকেলে। সে ভয়ানক এক কান্ড করে বসল। শুভ তাকে অংক করতে দিলো। সে অংক করে নিচে লিখে দিল।

” স্যার আপনি কি কাউকে লাভ করেন?”
শুভ না দেখার ভান করে রইলো। পড়া শেষে চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালে আলিশা শুভর দিকে চেয়ে,
স্যার আমার অংকে কি কোন ভুল ছিল?
শুভ শান্ত মেজাজে বলল,
ভুল হলে বলতাম আলিশা।

স্যার এক মিনিট ওয়েট প্লিজ।
পিয়াসার সাথে ঘটনাক্রমে শুভ’র আজ অবধি দেখা হয়নি। কারণ যেই তিনদিন যে সময়ে শুভ আলিশাকে পড়াতে আসে। ঠিক ওই সময়ে পিয়াসা বাইরে থাকে ক্লাসের জন্য। শুভ চলে গেলেই পিয়াসার আসা হয়। এ নিয়ে আলিশার মনে খুব আক্ষেপ। কেন তার শুভ স্যারকে দেখাতে পারছেনা পিয়াসাপুকে।

প্রণয়ের জলসাঘরে পর্ব ১২

আজ পিয়াসা ভার্সিটি যায়নি বাসায় রয়েছে। সুযোগ হাতছাড়া করা যাবেনা। আলিশা পিয়াসাকে হাত ধরে নিয়ে এলো।
স্যার আমার পিয়াসাপু। পিয়াসা সালাম দিয়ে চোখাচোখি হতেই থমকে তার শুভ। আটকে যায় তার দৃষ্টি।
তুমি জলিল কাকার মেয়ে পিয়াসা না?
হ্যাঁ। আপনি শুভ ভাই না? বিস্ময়ভরা চোখে জিজ্ঞেস করল পিয়াসা।
তোমাকে খুঁজে খুঁজে এই শহরে আমি। বলল শুভ।

প্রণয়ের জলসাঘরে পর্ব ১৪