প্রণয়ের জলসাঘরে পর্ব ৭

প্রণয়ের জলসাঘরে পর্ব ৭
রেহানা পুতুল

এদিকে রায়হান সুখ সুখ মনে শেষ বিকেলের দিকে আয়মানদের বাসার দিকে পথ ধরলো। উদ্দেশ্য পিয়াসার বিষয়ে সরাসরি যুক্তি পরামর্শ করতে হবে আয়মানের সাথে।
বাসার গেটে পৌঁছাতেই সে নির্বাক হয়ে গেল। দেখল আয়মান কোলে করে পিয়াসাকে নিয়ে তাদের বাসায় ঢুকছে।
সে প্রায় দৌড়েই পাশের একটি চোখের ডাক্তারের চেম্বারে ঢুকলো। সিরিয়াস মুডে ব্যস্ততার ভঙ্গিতে,

আসসালামু আলাইকুম, আমার চোখটা একটু দেখে দিন প্লিজ। আর চশমার পাওয়ারটাও ঠিক আছে কিনা দেখুন।
ডাক্তার চোখ দেখল। পাওয়ার দেখল। জানালো পাওয়ার ঠিক আছে। ডাক্তারের ভিজিট দিয়ে সে বের হয়ে গেল।
একটি নিরব গলিতে ঢুকে সিগারেটের পর সিগারেটের ধোঁয়া ছাড়ল। চোখ দুটো রক্তিম বর্ণ ধারণ করলো। যেন রক্ত চোষা পিশাচ । ভাবনার তলানীতে গিয়েও কোন সমীকরণ মেলাতে পারছেনা। আয়মানের চরিত্রের সাথে তার দৃষ্টিগোচর হওয়া বিষয়টা কিছুতেই যায়না। নিরেট ভদ্র আর বেরসিক একটা ছেলে আয়মান। বিপরীত লিঙের প্রতি তার বিন্দুমাত্র কিউরিওসিটি নেই। সেখানে অনুরাগ জন্মানোর প্রশ্নই উঠেনা।

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

ভার্সিটিতে আয়মানের প্রেমে হাবুডুবু খেয়েছে কত মেয়ে। আয়মান পাত্তাই দেয়নি। তাদের আবেগকে বাষ্পের মতো উড়িয়ে দিয়েছে । সেই আয়মান পিয়াসাকে ভালোবাসে। ভাবাই যায়না। সে নিজেই দেখেছে এই পিয়াসাকে আয়মান কি কঠিনভাবে বেত্রাঘাত করেছে।
দু’ চারটা মানুষের রক্ত ঝরাতে পারলে রায়হান নিজেকে দমাতে পারতো এখন। আয়মানের উপর ভিতরে ভিতরে ফুঁসে উঠছে সমুদ্রের উত্তাল ঢেউয়ের মতো। এভাবে বেশ কিছু সময় পার হয়ে গেল।

আয়মান পিয়াসাকে নিয়ে ঢুকলো আলিশার রুমে। কোল থেকে খাটে বিছানার উপর শোয়ালো। তার মা ছুটে এলো। সে দ্রুত পায়ে নিজের রুমে চলে গেল। ভিতর থেকে দরজা বন্ধ করে দিল। ধপাস করে বিছানার মাঝ বরাবর পড়ল। উপুড় হয়ে আছে। বিরতিহীনভাবে স্বাস উঠানামা করছে। এক অজানা অচেনা পুলক জাগানিয়া রোমাঞ্চকর অনুভূতি তাকে গ্রাস করে ফেলছে।

জীবনে এর আগে কখনোই তার হৃদয়ে কাউকে নিয়ে এমন অনুভব অনুভূতির উদয় হয়নি। না হওয়ারই কথা। এর আগে বাইরের কোন মেয়েকেই সে ভুলক্রমেও স্পর্শ করেনি। অথচ আজ একটি যুবতী মেয়েকে তার কোলে তুলে নিতে হলো। পড়ে যাবে করে কাঁধ ও বুকের সাথে মিশিয়ে নিতে হলো। পিঠের উপরে হাত দিয়ে রাখতে হল। ঘোরে চলে যাচ্ছে আয়মান। কেমন বোহেমিয়ান মনে হচ্ছে নিজেকে তার কাছে। আবার খানিক সংকোচ ও লাগছে। না তাকে এত বিবশ হলে চলবেনা। কারণ পিয়াসা তার বন্ধুর প্রেম। হবু লাইফপাটনার।

তার রুমের দরজায় ঠকঠক শব্দ হচ্ছে। অসহনীয় বিরক্তি নিয়ে উঠে দাঁড়ালো। দরজা খুলতেই দেখে রায়হান। অবাক হলনা। কারণ রায়হান প্রায় তাদের বাসায় আসে বহু আগে থেকেই।
কিরে দরজা বন্ধ কেন তোর? সতেজ,প্রাণময় চাহনিতে জিজ্ঞেস করলো রায়হান।
আয়মান নিজেকে স্বাভাবিক করে নিল আগেই। বলল, না শরীর ছেড়ে দিয়েছে তাই একটু রেস্ট নিচ্ছি। তোর প্রেম আলিশার রুমে। দেখেছিস?

না এখনো যাইনি। যাব। আলিশার কাছে ডিটেইলস শুনেছি।
হুম। তারাতো আর জানেনা তোর জন্যই গিয়েছি আর আনতে হলো। তুই বললি ফোন দিতে। বারবার দিয়েও পাইনি। পরে তোর কথা ভেবেই খোঁজ নিতে গেলাম। গিয়ে দেখি অনেক অসুস্থ। মাকে জানালাম। সবশুনে মা বলল বাসায় নিয়ে আসতে। সুইসাইডের কথাটা আয়মান লুকালো রায়হানের কাছে।

রায়হানের কোন অভিযোগ নেই আয়মানের উপর। ভুল বোঝার ঘেরাটোপ থেকে নিজেকে মুক্ত করে নিল। হাসিমুখে বলল, খুব উপকার করেছিস দোস্ত। তোদের বাসায় যখন তখন আসতে পারব পিয়াসার কাছে। কিন্ত সে যেখানে থাকতো,সেখানে বারবার গেলে সবাই মাইন্ড করতো।
স্ট্রেঞ্জ! তাতে কি। তুইতো ওকেই বিয়েই করতে যাচ্ছিস।
তা ঠিক। তবুও। বাসার সাইড তো এখনো পজেটিভ করতে পারিনি। এর আগে পিয়াসার দিকটা শতভাগ নিশ্চিত হই। পরে বাসার দিকটা দেখছি।

ওকে। যেভাবে সুবিধা মনে করিস। তাই কর। এখন এলি কেন সেটা বল?
ওই পিয়াসার বিষয়েই আলাপ করতে। তবে এখন যেহেতু তোদের বাসায় আছে সমস্যা নেই। আমি তার সাথে আরেক দফা বৈঠকে বসব। বলে রায়হান হেসে ফেলল।
এখন পিয়াসার কাছে যা তুই। বলল আয়মান। রায়হান উঠে গেল পিয়াসার কাছে। পাশে আয়মানের মা ও আলিশাও ছিল বসা।

পিয়াসা এখন একটু আরাম বোধ করছ?
পিয়াসা শ্রদ্ধাবনত চোখে রায়হানকে দেখল। মিনমিনিয়ে বলল একটু স্যার।
আয়মানের মা রায়হানের দিকে চেয়ে , ভালোই হলো। পিয়াসা তোমাদের দুই বন্ধুরই ছাত্রী। তাই তুমিও এসে এসে ওকে দেখে যেও।

রায়হান মনে মনে আন্দোলিত হয়ে উঠলো। অবশ্যই খালাম্মা। পিয়াসার দুঃসময়ে আয়মান আমি দুজনই পাশে রবো। তো খালাম্মা আমি এখন আসি। কাল আবার আসব। পিয়াসার মাথায় হাত রেখে কোমলকন্ঠে বিদায় নিল রায়হান।
পিয়াসা রাতে আলিশাকে জিজ্ঞেস করলো, আমি কিভাবে এসেছি তোমাদের বাসায়?

তোমার স্যারের কাঁধে চড়ে। এই বলে হিঃহিঃহিঃ করে কিটকিটিয়ে হেসে ফেলল আলিশা। তোমার কোন হুশ ছিলনা তখন পিয়াপু। ভাইয়া কোলে করে এনেছে। শুনে পিয়াসা মুখ ঢেকে ফেলল লজ্জায়। খুব অস্বস্তি হচ্ছে তার এখন।
কি করবে বল। ভাইয়া বেচারা যে নিরুপায় হয়ে গেল। কারণ আম্মাজানের হুকুম বলে কথা। অমান্য করার সাধ্যি কার আছে।

তিন চারদিনের মধ্যেই পিয়াসা সদ্য মাথা তুলে বেড়ে উঠা কচি গাছের চারার মতন ঝরঝরে হয়ে গেলো। আলিশার সাথে বন্ধুত্ব হয়ে গেল। তার মায়ের সাথেও সখ্যতা হয়ে গেল।
এই ভিতরে আয়মান পিয়াসার সাথে দেখাও করেনি। কথাও বলেনি। এতে পিয়াসার বেশ দুঃখবোধ হলো। ধরে নিল,আয়মান স্যার আসলেই আমাকে পছন্দ করেনা। মানবিকতার জায়গা থেকেই বাসায় এনেছে সুস্থ করার জন্য। কিন্তু আর একটিবার ও সামনে এলনা। অথচ রায়হান স্যার রোজ ফোনে খবর নিত। বাসায় এসে দেখে যেত। মিছে মিছে অন্যের দয়ায় এ বাসায় থাকার মানেই হয়না।

এক দুপুরে ভাত খেয়ে উঠার পর পিয়াসা তার ব্যাগ হাতে নিয়ে এসে বলল,
আন্টি আমি চলে যাচ্ছি। দোয়া করবেন। শুনে তিনি ও আলিশা চমকে গেল। তারা প্রবলভাবে বাধা দিল। সব বুঝিয়ে বলল যে তোমার কোথাও যাওয়া লাগবেনা। আমার যদি আরেকটা মেয়ে থাকতো। ফেলে দিতাম? বল? তাই বলছি পাগলামি করোনা মা। এখানেই থাকবে সবসময় আমাদের সাথে।
না আন্টি এভাবে আপনাদের বাসায় থাকব, খাবো । এটা আমার জন্য ভারী হীনমন্যতার ও নিচুতার। আমি এটা পারবনা প্লিজ।

আচ্ছা অন্তত আজ রাতটুকু থাক। আয়মান আসুক বাসায়। সে বরং কাল তোমাকে বাসে তুলে দিবে।
এই কথার উপরে পিয়াসা ব্যাগ নিয়ে আলিশার রুমে চলে গেল । আয়মান এলে বিষয়টা জানাল তাকে তার মা ও বোন। আয়মান তাদেরকে রায়হানের বিষয়টা জানাল। শুনে তার মা বলল,ওহ তাহলেতো ওর আমাদের বাসায় থাকতেই হচ্ছে বিয়ে হওয়া পর্যন্ত।

হুম তাই মা। আমি পিয়াসার সাথে রাতে কথা বলব। আশাকরি ফেলে দিবেনা।
শুনে আলিশা ভিমরি খেল যেন। তার চক্ষু চড়কগাছ। খেলখেলিয়ে উঠে আয়মানকে উদ্দেশ্য করে বলল, আমিতো ভাবছি পিয়াসাকে আমার ভাবি বানাব। তুমি সারাজীবন বলদই রয়েই যাবা। এত নাইস এত কিউট একটা মেয়েকে হাত করতে পারলেনা।

দেখলে মা কি অসভ্য একটা। প্রেম না করতে পারলে নাকি বলদ?
ঠিকই তো বলছি। প্রেম না করে কয়টা ছেলে থাকে এখন? যারা প্রেম করেনা। রোমান্স করেনা। আমি তাদের বলদ মনে করি।
এই তুই এত নিলজ্জ্ব কবে থেকে হলি? কেমন করে হলি? কলেজে পা না রাখতেই এই হাল তোর। আর…
এই থামবি দুই ভাইবোন। মায়ের ধমকে থেমে যায় আয়মান ও আলিশা।

রাতে আলিশাকে দিয়ে আয়মান পিয়াসাকে ডেকে নিল। পিয়াসা গেল আয়মানের রুমে। দরজা খোলা। পর্দা ফাঁক করা। দরজা বরাবর দুরুদুরু বক্ষে দাঁড়িয়ে আছে পিয়াসা।
বসো পিয়াসা। তোমার সাথে আমার জরুরী কথা আছে। পিয়াসা নরম হয়ে বসলো চেয়ার টেনে। আয়মান এগিয়ে গিয়ে আরেকটি চেয়ার নিয়ে পিয়াসার মুখোমুখি বসলো। পিয়াসা চেয়ার টেনে পিছনে নিতে চেষ্টা করতেই আয়মান চেয়ারের হাতল ধরে ফেলল। পিয়াসা হেরে গেল আয়মানের বাহুশক্তির কাছে। চেয়ার এক ইঞ্চি ও পিছনে নিতে পারলনা। সন্দেহতীত নজরে আয়মানের দিকে চাইলো।

এভাবে দেখছ কি? অন্যের হবু স্ত্রীকে একা পেয়ে আমি জডিয়ে ধরে বসব? আস্তে করে ভরাট গলায় বলল আয়মান।
শুনে পিয়াসা হতভম্ব হয়ে গেল। মনে মনে, নিজেই বলল কাউকে না জানাতে। এখন নিজেই দেখি বন্ধুকে জানিয়ে বসে আছে। থরথর করে কাঁপছে পিয়াসা। কিছুই বলতে পারছেনা। চুপটি হয়ে বসে আছে।
মা বলল তুমি নাকি গ্রামে চলে যেতে চেয়েছ? তাহলে রায়হানের কি হবে? তার সাথে প্রেম করেছ অথচ বিয়ে করবেনা। প্রতারণা হয়ে গেলনা পিয়াসা? তুমি কি তাহলে ছলনাময়ী নারী?

রাগে,ক্ষোভে পিয়াসা বেলুনের মত ফুলে যাচ্ছে। তার অভিমান আবেগ অনিয়ন্ত্রিত হয়ে পড়ল। কম্পিত অধরে আয়মানের দিকে তাকিয়ে, তারমানে উনি বলছে আমি প্রেম করি উনার সাথে? ছিঃ! একজন শিক্ষক এতটা মিথ্যুক, ধাপ্পাবাজির হতে পারে জানা ছিলনা। আমার ব্যাগে কিন্তু আরো দশটা ঘুমের ট্যাবলেট ‘ ইপনিল ‘ আছে। আজ রাতেই খেয়ে মরে যাব। তবুও না এই শহরে থাকব। না কাউকে বিয়ে করব।

আয়মান বুঝতে পারল পরিস্থিতি বেগতিক। কন্ঠকে খাদে নামিয়ে আস্তে করে বলল,খুব স্যরি পিয়াসা। এ কথাগুলো আমিই বলেছি। রায়হান একবার ও বলেনি তুমি তাকে লাভ কর। সে তোমার সাথে যতটুকু যা, ঠিক তাই বলেছে আমার কাছে। ওকে ভুল বুঝনা প্লিজ।

পিয়াসার রাগ কিছুটা স্তিমিত হলো রায়হানের উপর । এবার রাগ জাগ্রত হলো আয়মানের উপর। মনে মনে গজগজ করতে করতে বলল,তাহলে আমাকে আপনি মিথ্যে বললেন কেন? আপনি তো এমন মজা করার মানুষ নয় স্যার।
এক মিনিট আসছি বলে আয়মান উঠে গেল। খানিকবাদেই ফিরে এলো। হাতে পিয়াসার ব্যাগ। ব্যাগের ভিতরের সাইড পকেট থেকে ট্যাবলেটের পাতাটি হাতে নিল। একটা একটা করে সব ট্যাবলেটগুলো হাতে নিল। গ্লাসভর্তি পানিতে টুপটুপ করে ফেলে দিল। কিছুসময় পর গলে গেলে বেসিনের কল ছেড়ে গ্লাসের সব পানি ঢেলে ফেলল।
পিয়াসা নিরব থেকে অপলক নয়নে চেয়ে চেয়ে দেখলোই শুধু। তার বুকের ভিতর উথাল-পাতাল ঝড় শুরু হলো আয়মানের এই পজেসিভ আচরণে।

আয়মান ফের পিয়াসার মুখোমুখি হয়ে বসল চেয়ারে এসে। আচ্ছা যেজন্য ডেকেছি। আসল কথাটা বলি মন দিয়ে শোন, পিয়াসা নির্লিপ্ত চোখ দুটির পাতা তুলে চাইলো আয়মানের দিকে।
রায়হান তোমাকে ভালোবাসে। বিয়ে করে সুখী করতে চায়। সে আমার বন্ধু। আমি তাকে তোমার চেয়ে বেশি জানি। সুতরাং আমাদের বাসায় থাক তুমি । ও তার ফ্যামেলিকে রাজি করিয়ে আমাদের বাসা থেকে বউ বানিয়ে নিবে তোমাকে।
পিয়াসা চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালো। বলল, আমি আপনাদের বাসায় থাকব। পড়াশুনা চালিয়ে যাব। তবে রায়হান স্যারকে বিয়ে করতে পারবোনা। কারণ আমি ভুল করেও উনাকে শিক্ষক ছাড়া আর কিছুই ভাবিনা।

প্রণয়ের জলসাঘরে পর্ব ৬

রায়হান এত কিছু করার পরেও তাকে বিয়ে আপত্তির কারণটা কি একটু বলবে? তুমি কি অন্য কোন ছেলেকে পছন্দ করো?
নাহ স্যার। এসব আমার জন্য বিলাসিতা ছাড়া আর কিছুই নয়।
নিজের অজান্তেই আয়মানের হৃদয়াকাশে একদল সুখ পাখি চঞ্চল কলরবে মেতে উঠলো।

প্রণয়ের জলসাঘরে পর্ব ৮