প্রণয়ের জলসাঘরে পর্ব ৬

প্রণয়ের জলসাঘরে পর্ব ৬
রেহানা পুতুল

আয়মান শান্তসুরে বলল,আমি যদি
তোমার থাকার ব্যবস্থা করি থাকবে?
কোথায় স্যার?
আমাদের বাসায়। জানি কি ভাবছ তুমি এখন?
বাজ পড়া পাখির মতো পিয়াসা স্থির হয়ে গেল। আয়মানের বলা বাক্যদ্বয়ের প্রতিটি শব্দ পিয়াসার কর্ণকুহুরে প্রবেশ করেছে অগ্নিকনা হয়ে। যা তার হৃদয়ে বহ্নিশিখার মত দাউদাউ করে জ্বলছে। পুড়ে ছাইঁ হচ্ছে তার অন্তরখানি।

মনে মনে বলল, আপনি ঠিকই ধরতে পেরেছেন স্যার। আপনার বলা কথাগুলো আমার কাছে ভীষণ তেতো লাগছে। ভারী অসহ্য ঠেকছে। বিষের পেয়ালায় মধু ঢাললে সে মধু পান করাও বিপজ্জনক। কি হচ্ছে আমার সাথে এসব। কেন যে বাবার সাথে মরে গেলাম না। কেন সবাই ভালোবাসার নামে করুণার পসরা সাজিয়ে বসেছে আমার জন্য। কেন শকুনের মতো আমাকে নিয়ে টানা হিঁচড়া চলছে। পিয়াসার আঁখিকোণ ছলছল করে উঠলো।
আয়মান ফের পিয়াসা বলে ডাক দিলো। পিয়াসা সম্বিৎ ফিরে পেল। আরক্ত দুটি চোখে একবার তাকালো আয়মানের দিকে।
আপত্তি আমাদের বাসায় থাকতে?

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

আপত্তি হওয়াটাই কি স্বাভাবিক নয় স্যার?
আয়মান আর বিশেষ ঘাটালোনা পিয়াসাকে। বেহায়াপানা তার অপছন্দ। ওকে। তুমি তোমার মত করে থাকো। ভুল বুঝলে বা উল্টো বুঝলে কিইবা করার আছে আমার। আয়মান জেনেবুঝেই রায়হানের প্রসঙ্গ তুললনা। চলে যাও পিয়াসা।
পিয়াসা পা ঘুরিয়ে বের হয়ে গেল অফিস থেকে। আয়মান পিয়াসার পিছনপানে নিষ্পলক চোখে চেয়ে রইলো।

তার মাস খানেক পরে একবিকেলে আয়মান কলেজের পাশের মার্কেটে একটি গহনার দোকানে গেল। উদ্দেশ্য সপ্তাহ আগে বানাতে দেওয়া ছোটবোনের কানের দুল জোড়া নিতে হবে। দোকানের কাছাকাছি হতেই দেখতে পেল সে দোকান বেরিয়ে যাচ্ছে পিয়াসা। সে আয়মানকে দেখেনি। আয়মান ও তাকে ডাকেনি।

কৌতুহলবশত আয়মান দোকানের ম্যানেজারকে জিজ্ঞেস করলো,
যে মেয়েটি এখন বেরিয়ে গেল সে কেন এলো?
এক জোড়া কানের দুল বিক্রি করলো। কেন ভাই আপনি চিনেন নাকি তাকে?
দোকানদারকে বিশ্বাসযোগ্য কিছু বলতে হবে, নয়তো কি না কি ভেবে বসে থাকে। হুম মেয়েটি আমার ঘনিষ্ঠজন। দুল জোড়া দেখানতো দেখি।

সে পুরোনো একটি বক্স থেকে বের করে দিলো পিয়াসার থেকে কেনা কানের দুল জোড়া। বলল, বুঝলাম না ভাই। বলছেন ঘনিষ্ঠজন। অথচ তার দুঃসময়ে পাশে নেই? আমরা যেন তাকে না ঠকাই। এটার জন্য কত অনুনয় করে কান্নারত কণ্ঠে বলল,এই দুল তার মৃত বাবার দেওয়া।
আয়মান দুল জোড়া দেখে চিনলো। পিয়াসার কানে এতদিন এই দুল জোড়া ছিল। বেশ মানাতো তাকে এই দুল জোড়াতে। আচ্ছা আপনারা কত টাকা দিয়েছেন তাকে?

তারা সোনা কতটুকু ছিল এবং কত মূল্য দিলো জানালো আয়মানকে।
আয়মান মানিব্যাগ থেকে দশ হাজার টাকার ম্যানেজারের হাতে দিয়ে বলল,বাকিটা কাল দিয়ে দিব। সমস্যা আছে? আর এটাকে ওয়াশ করে নতুন একটি সুন্দর বক্সে দেন।
আরেহ কিসের সমস্যা ভাই। আপনি আমাদের চেনা কাস্টমার। একটু পাঁচ মিনিট বসেন।
আয়মান ভাবে গরীব আর মধ্যবিত্তের সম্বল ওই আত্মসম্মানটুকই। তাই এই সম্মানকে বিকিয়ে দিয়ে তারা চলতে পারেনা। বাঁচতে পারেনা। নয়তো সেদিন আমাদের বাসায় থাকার কথা বলতেই বিনাদ্বিধায় রাজী হয়ে যেত পিয়াসা।
ভাইজান নেন। দুই জোড়াই রেডি।

আয়মান বাসায় গিয়ে আলিশার হাতে তার দুল দিয়ে দেয়। পিয়াসার দুল জোড়া নিজের রুমের আলমারির ড্রয়ারে অতি সাবধানে রেখে দেয়। চাবি দিয়ে বন্ধ করে ফেলে। এই ড্রয়ারে তার ব্যক্তিগত সবকিছু থাকে।
সেই রাতেই রায়হান আয়মানকে ফোন দিয়ে পিয়াসার কথা জানায়। জানতে চায়, কি বলিস দোস্ত ঠকব নাকি পিয়াসাকে বিয়ে করলে?

আয়মান গ্লাস থেকে পানি খেল। তার মাঝে কোন ভাবান্তর হলনা। যে কোন পরিস্থিতিতে নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করার অসীম ক্ষমতা তার। অন্যদিকে খুব চাপা স্বাভাবের ও ব্যক্তিত্ববান পুরুষ আয়মান। চট করে না বলা কথাগুলো ও বলতে পারেনা । না পারে নিজের মনের ভাব প্রকাশ করতে ।

ছোটবেলায় যখন বাবাকে হারিয়েছে । দেখেছে এই দোতলা বাড়িটার ভাড়া দিয়ে মা কোনমতে হিসেব করে করে দুই ভাইবোনকে বড় করেছে। পড়াশুনা করিয়েছে। অতিরিক্ত চাওয়া পাওয়াকে জলাঞ্জলী দিয়ে দেওয়ার অভ্যেসটা বেশ রপ্ত হয়ে গিয়েছে তার। এখন আস্তে আস্তে তাদের সংসারে সচ্ছলতা ফিরে এসেছে। মা বোনকে নিয়ে সে ভালই আছে। জীবনের নানা ঘাত প্রতিঘাতে প্রেম ভালোবাসা অধরাই থেকে গেল তার জীবনে। সবার জন্য সব কিছু নয়। এই নীতিতে আয়মান বিশ্বাসী।
ফোনের ওপাশ থেকে হাসির শব্দ ভেসে এল রায়হানের কানে। শুনতে পেল আয়মান বলছে, একদম ঠকবিনা। ভালো থাকবি তুই। কিন্তু তোর পরিবার কি মেনে নিবে? আংকেল, আন্টি, তোর বড় ভাই,বাকি সবাই? অপরদিকে পিয়াসাও তো রাজী নয় বললি। তাহলে?

রায়হান একটু চুপ থেকে, পিয়াসা দু চারমাস গেলে রাজী হয়ে যাবে। দরকার হলে ওর বন্ধুদের দিয়ে ওকে ম্যানেজ করাব। তোকে দিয়েও অনুরোধ করাব। তুই নিজে প্রেম প্রণয় থেকে বিচ্ছিন্ন।
তাই বলে কি বন্ধুর জন্য এটুকু করতে পারবিনা আয়মান?

ইংরেজি সাহিত্যের ছাত্র হয়ে কিভাবে পারিস প্রেম না করে থাকতে? নিরস গবেট কোথাকার।
আয়মান মুহুর্তেই বলল,হাজারবার পারব রায়হান। আমি আমার সর্বস্ব দিয়ে তাকে পজেটিভ করার চেষ্টা করব।
এই না হলো আমার প্রাণের বন্ধু। কিন্তু আমার বাসায় রাজী করানোটাই তো হিমালয় জয়ের মতো কঠিন। এটাইতো এখন বড় চিন্তার বিষয়। আচ্ছা রাখিরে। গুড নাইট।

গুড নাইট রায়হান। আগাম অভিনন্দন তোকে। মৃদু হেসে মোবাইল রেখে দিল।
গভীর রাত। ঘুম আসছেনা। সবকিছু কেমন যেন ধোঁয়াশা লাগছে। এলোমেলো লাগছে। আয়মান তার ডায়েরিটা ও ভিতরে থাকা নীল কালির কলমটা হাতে নিল। যেহেতু তার একাডেমিক বিষয় ছিল ইংরেজি সাহিত্য। তাই কবিতা, গান লিখার প্রতিও ঝোঁক রয়েছে কিছুটা ।
আর ইংরেজি কবিতাগুলো বাংলায় অনুবাদ করতে বেশ পছন্দ করে আয়মান ।

‘ কেমনে তোমায় আমি ভালবাসি ‘
” কতভাবে আমি তোমায় ভালবাসি? আমায় গণনা করতে দাও।
আমি তোমাকে ভালবাসি গভীরতায়, প্রশস্ততায় এবং উচ্চতায়।
আমার হৃদয় পোঁছাতে পারে, মোহ যখন তিরোহিত।
আমি তোমায় ভালবাসি প্রতিদিনের

অতি গোপন প্রয়োজনে, রাতে এবং দিনে।
আমি তোমায় মুক্তভাবে ভালবাসি,
আমি শুধুমাত্র তোমায় ভালবাসি।
আমি তোমায় ভালবাসি প্রতিটি নিঃশ্বাসে
হাসিতে, কান্নায়, জীবনের সব কিছু দিয়ে; এবং, ঈশ্বর যদি চায়,
মৃত্যুর পরেও আমি তোমায় আরো ভালবাসব। ”

এভাবে ইংরেজ কবি এলিজাবেথ ব্যারেট ব্রাউনিং এর কবিতা
‘ হাউ ডু আই লাভ দি ‘ র কিছু কিছু চরণ অনুবাদ করে লিখল।
বার কয়েক পড়ল। আপন মনে নিজের উপর ক্রুর হাসি হাসলো। কল্পনা করলো এক ঝলক। জীবন কি কেবলি নীল বিষাদের? নাকি রাশি রাশি শূন্যতা আর হাহাকারের ঝাঁপি বয়ে বেড়ানো? কি অদ্ভুত খারাপ লাগছে আমার।
রাতটাকে এত নিষ্ঠুর মনে হচ্ছে কেন।

এই ভিতরে আয়মান নিজ থেকে অতিরিক্ত একটি বাক্যলাপ ও করেনি পিয়াসার সাথে । রায়হানের বিষয় নিয়েও তার কোন মাথাব্যথা নেই। সবাই সবার মত চলুক। আনন্দে থাকুক।
রায়হান পিয়াসাকে রোজ ফোন দেয়। নানান গল্পগুজব করতে চায়। পিয়াসা দু চার বাক্য বলেই অনেক ছুতোয় ফোন কেটে দেয়। সম্ভবপর অনুযায়ী দূরত্ব বজায় রেখে চলে। রায়হান এসব গায়ে মাখেনা।

একদিন ক্লাসে কথাপ্রসঙ্গে পিয়াসা তাদের ‘ সুপার গ্লু বাহিনী ‘ র সাথে রায়হানের বিষয় শেয়ার করল। তারা পুলকিত হলো। তাকে মোটিভেটেড করতে লাগলো রাজী হওয়ার জন্য। নাহিদ বলল দেখ পিয়ু পাখি মেয়ে যেহেতু হয়েছিস। বিয়েতো কাউকে না কাউকে করতেই হবে। রায়হান স্যার টুকটাক হলেও তোর পাশে থেকেছে তোর ভাষ্যমতে। উদারতার হাত প্রসারিত করেছে।

সুতরাং মালা তার গলায় দেওয়া উচিত। কি বল গাইস?
হ হ ঠিক ঠিক বলে সবগুলো টেবিল চাপড়াতে লাগল। পিয়াসা মুখকে ধূসর বর্ণ করে প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করল,
মনে না টানলে মালা দেয়া যায় বা দেয়া উচিত? তোরাই বল?
আজব চিজ তুই পিয়াসা। তাহলে মন কারে চায় তোর?
কাউকেই না আপাতত। গেলাম বাই। টাটা। বলে পিয়াসা উঠে চলে গেল।

পিছন দিয়ে তারা নানা দুষ্টমিতে মেতে উঠল। তুলি ঠোঁট বাঁকিয়ে বলে আমারে ক্যান কোন স্যার পছন্দ করেনা। স্যার আর ছাত্রীর প্রণয়ের প্রতি আমার দূর্বলতা সেই প্রাগৈতিহাসিককাল হতেই। ছাত্রী লাজুক লাজুক বদনে পড়া নোট করবে। স্যার রোমাঞ্চিত দৃষ্টিতে ছাত্রীকে দেখবে। আবার চোখাচোখি হবে। একটু আঙ্গুলে আঙ্গুলে মৃদু ঘর্ষণ হবে। সেখান থেকে বিদুৎ উৎপন্ন হবে। সেই তাপ পরিবাহী হয়ে সমান্তরালভাবে দুটো হৃদয়ে ঢলে ঢলে পড়বে। আর তখনি ‘ চাহা হে তুজকো চাহুঙা হারদম। ‘ মান ছবির এ গান গাইতে গাইতে খুন হবে হবে দুজন।

বাকিরা ভ্রুকুটি নজরে হা হয়ে চেয়ে রইলো তুলির দিকে।
তুলি আরো বলতে লাগল,
আয়মান স্যারকে ভালোলাগে। কিন্তু স্যার যেন একটা মেশিন । রসকষহীন মানব। কি যে অপ্রতিরোধ্য আকর্ষণ লাগে আয়মান স্যারকে। উফফস! গাল ভরা খোঁচা খোঁচা দাঁড়ি। উড়ুউড়ু ঘন কেশ। হাঁটা কি সুন্দর। জাস্ট ওহ!
জেবা বলল রায়হান স্যার ও কি কম নাকি।

দেখতে দেখতে সময় গড়ালো। পিয়াসার ইন্টার পরিক্ষা শেষ হয়ে গেল। রায়হান ও আয়মান দুজন দুজনের মতো করে পিয়াসার পরিক্ষার বিশেষ খোঁজ খবর রাখল। রায়হান অনেকভাবেই পিয়াসাকে হেল্প করতে চাইল। কিন্তু পিয়াসা কোন হেল্পই আর নিলনা তার থেকে।
যাকে ভালোবাসতে এ হৃদয় সায় দেয়না। শুধু শুধু তার দান নিয়ে নিজেকে ঋনী করে রাখা একদম অনুচিত। এতে দাতার প্রত্যাশার পাল্লা ক্রমশ মজবুত হতে থাকবে।

রায়হান আয়মানকে বলল পিয়াসাকে ফোন দিয়ে যেন বোঝায় একটু জোর চেষ্টা দিয়েই। আয়মান পিয়াসাকে ফোন দিল। কিন্তু সুইচড অফ। পরেরদিন ও ফোন বন্ধ পেল। একটু চিন্তাগ্রস্ত হয়ে বিকেলেই পিয়াসার বাসায় গেল।
খোঁজ নিয়ে মিনা আন্টির বাসায় ঢুকল পিয়াসার কলেজের শিক্ষক পরিচয় দিয়ে। তিনি হতাশ নয়নে ব্যথিত হয়ে জানালেন,
স্যার আমি যে কি বিপদে আছি এই মেয়েটারে নিয়ে। পরশু আত্মহত্যা করতে গেছিলো। অল্পর জন্য বেঁচে যায়। কখন কি করে বসে ঠিক নাই। অনেক অসুখ এখন। পিছনের রুমে মাটিতে মরার মতো পড়ে আছে।
আয়মান চমকে গেল শুনে। তার মাকে ফোন দিয়ে সব জানালো। তার মা বলল তুই এক্ষুনি মেয়েটাকে নিয়ে আয় বাবা। পরে দেখছি বাকিটা।

আয়মান মিনা আণ্টির অনুমতিক্রমে বাইরে গিয়ে একটা সিএনজি ঠিক করে এনে গেটে দাঁড় করালো।
মিনা আন্টি পিয়াসার সব কাপড়চোপড় গুছিয়ে একটি ব্যাগে ভরে গেট পর্যন্ত এগিয়ে দিলেন। আয়মান পাঁজাকোলা করে পিয়াসাকে নিয়ে সিএনজিতে উঠে বসল। তার বুকের বাঁ পাশে পিয়াসাকে মিশিয়ে রেখেছে। নয়তো হাত সরিয়ে নিলেই পিয়াসা হেলে পড়ে যাবে ।

প্রণয়ের জলসাঘরে পর্ব ৫

এদিকে রায়হান সুখ সুখ মনে শেষ বিকেলের দিকে আয়মানদের বাসার উদ্দেশ্যে পথ ধরলো। উদ্দেশ্য পিয়াসার বিষয়ে সরাসরি যুক্তি পরামর্শ করতে হবে আয়মানের সাথে।
বাসার গেটে পৌঁছাতেই সে নির্বাক হয়ে গেল। দেখলো আয়মান কোলে করে পিয়াসাকে নিয়ে তাদের বাসায় ঢুকছে।

প্রণয়ের জলসাঘরে পর্ব ৭