প্রমত্ত অঙ্গনা পর্ব ৩৫

প্রমত্ত অঙ্গনা পর্ব ৩৫
আরোহী নুর

আঁখি আদৃত আবারও হাসপাতাল চলে আসলো,আদৃতের মনের সব রাগ ধুয়ে গিয়ে পেলো সুখের ঠিকানা,আঁখিকে আবারও ফিরে পেয়েছে সে,আর খুব জলদি তাকে নিজের করে জীবনে নিয়ে আসবে,আশায় ভরে উঠল মন।অপরদিকে আঁখির মনের সুখের দোলা দোলছে,

এতবছর পর আবারও নিজের সত্য ভালোবাসাকে ফিরে পেয়েছে সে,তবে মনে আছে বেশ দ্বিধাদ্বন্দও,এতো কিছুকে অদেখা করে কিভাবে সে আদৃতের জীবনের সাথে জড়িয়ে যেতে পারে,আদৃত তো তাকে দু’দিনের সময় দিয়েছে তবে সে কি পারবে দু’দিনের মধ্যে সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে?না আংটিটাও খুলে নেওয়ার ক্ষমতা কুলিয়ে উঠতে পারবে না আঁখি।এতবছর পর ভালোবাসার মানুষটিকে ফিরে পেয়ে তাকে ফিরিয়ে দেওয়ার ক্ষমতা কুলিয়ে উঠতে পারছে না।

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

হাসপাতালে আসতেই দু’জনের উপর পরল আবার অজস্র কাজের চাঁপ,আদৃত তাড়াতাড়ি তার সকল কাজ সেরে নিচ্ছে, আঁখির সাথে সে কিছু সময় কাটাতে চায় একান্তে, তার মনে জমে থাকা অজস্র কথা তাকে জানাতে চায়।
আঁখির হঠাৎ একটা কাজ পরে ডা.আশরাফ খানের সাথে।উনার কেবিনের সামনে গিয়ে দরজায় নক করবে তখনি ভিতরে ইন্সপেক্টর জিসানকে দেখতে পায়,আশরাফ খানের বিপরীত দিকের চেয়ারে বসে আছে সে,দরজা বেশ খানিক খোলা থাকায় তাকে স্পষ্ট দেখতে পেলো আঁখি।আঁখি ভিতরে না গিয়ে বরং বাইরে দাঁড়িয়ে তাদের কথা শুনতে লাগল।

″হুম ইন্সপেক্টর জিসান,তা আপনার এখানে আসার কারণ জানতে পারি?″
″ডা.আশরাফ খান,আমি এখানে এসেছি অনেক জরুরি একটা প্রয়োজনে।″
″কি সাহায্য করতে পারি আমি আপনার?″
″ড্রাইবার মফিজ মিয়াকে তো আপনি চিনেন?শুনেছি উনি আপনার বাড়িতে আগে ড্রাইবার হিসেবে ছিলেন।″
″হ্যাঁ ও অনেক ভালো লোক,অনেক বিশস্তও,আমার বাড়িতে অনেক বছর কাজ করেছে,কিন্তু গত ৪ বছর আগে ও হঠাৎ আমার চাকরি ছেড়ে দেয়,কারণ জিজ্ঞেস করলে তেমন কিছু বলতে চায় না,কিছুদিন পর জানতে পারি সে তার পরিবার নিয়ে তার দেশের বাড়ি চলে যায়।″

″সে জায়গাটা কোথায় বলতে পারবেন?″
″যতটুকু জানি ওর আসল বাড়ি বরিশালে,কিন্তু সঠিক জায়গা বলতে পারব না।″
″উনার কোনো আত্নীয় আছে এখানে আপনার পরিচিত?বা এমন কাউকে চিনেন যেখানে উনি কাজ করতেন?″
″না,এমন কাউকে আমি চিনি না,আর ও আমাদের বাড়ি ছাড়া আর কোথাও চাকরি করে নি কখনও।তা আপনি এতসব কেন জানতে চাইছেন?″

″আপনাকে আমি বেশি কিছু বলতে পারব না,তবে এটুকু বলতে পারব যে একটা কেসের জন্য উনার খোঁজ করছিলাম আমি,কিন্তু উনার ঠিকানায় এসে জানতে পারলাম উনি এখন আর সেখানে থাকেন না।আচ্ছা চলি তাহলে।″
জিসানকে উঠে আসতে দেখে আঁখি সেখান থেকে সরে দাঁড়ালো, জিসান তাকে না দেখেই চলে গেল।আঁখি মনে মনে এক গভীর ভাবনায় ডোব দিল।

আদ্রিশ কক্ষে প্রবেশ করল দূর্বল শরীর নিয়ে,ম*দে*র নেশায় মশগুল হয়ে এসেছে,শরীরের বিভিন্ন স্থানে ক্ষত তার,অবশ্য চিকিৎসা নিয়ে এসেছে,রিদিকা তখন বিছানায় বসে ছিল,আদ্রিশকে উক্ত অবস্থায় দেখে রিদিকা বিচলিত হয়ে তার পাশে ছোটে আসলো।
″কি হয়েছে আদ্রিশ তোমার?তোমার শরীরে এসব ব্যন্ডেজ কিসের?″

রিদিকা আদ্রিশের ক্ষতগুলোতে হাত বুলিয়ে কথা বলতে লাগলে আদ্রিশ তাকে সজোরে এক ধাক্কা দেয়,যাতে সে ছিটকে ফ্লোরে গিয়ে পরে।এবার আদ্রিশ গর্জে উঠে বলতে লাগে।
″বা*জে,নোং*রা নারী আমার পাশে আসার চেষ্টাও করবি না,আজ তোর জন্যই আমার এ হাল,তোর দিকে তো তাকাতেও ইচ্ছে করে না এখন আমার।″

″তুমি আমায় অবিশ্বাস করছ আদ্রিশ,আমি শুধুই তোমার,আমাকে ফাঁসানো হচ্ছে, তুমি যা দেখেছ সব বানোয়াট।″
″জানিনা কি বানোয়াট কি সত্য,কিন্তু যেদিন তোকে হাতেনাতে পেয়ে যাব সেদিন তোর আমার বাড়িতে শেষ দিন হবে,এখন সর আমার চোখের সামনে থেকে।আমার সামনেও পরবি না বলে দিলাম।নিজেকে যদি নির্দোষ প্রমাণ করতে পারিস তবে আমার কাছে আসিস ভেবে দেখব তোর কথা।″

″ও তাই,আমার কোনো দোষ আছে কি না তার প্রমাণ ছাড়াই আমাকে দোষী মানলে,আমার সাথে বাজে ব্যবহার করছ,আর ওই আঁখি,যে কি না তোমাকে এতো অপমান করল,তোমাকে মারলো ও,তোমার পরিবারকেও নিয়ে গেল,তারপরও ও ভালো,বড় তো সেদিন চেঁচিয়ে বলছিলে ওর নামে কেস দিবে,কোথায় কি করলে শুনি?″
আদ্রিশ তেড়ে গিয়েই এবার রিদিকার থুতনী চেঁপে ধরল।রাগে ক্ষোভে ক্ষেপে উঠে বলে এবার।

″ওই নোংরা মুখে যদি আর একবারও আমার আঁখির নাম নিয়েছিস তবে ওই মুখ সেলাই করে দিব আমি,রাগে বলেছিলাম বলে আমি আমার আঁখির বিরুদ্ধে যাব কি করে ভাবলি তুই!আমি ওকে ভালোবাসি,ও আমাকে প্রাণে মেরে ফেললেও ততটাই বেসে যাব,আমার তো ভুল হয়েছে তোর মতো নোং*রা*কে এনে ঘরে তোলা,তকে স্ত্রীর মর্যাদা দেওয়া,সত্যি বলতে আমি তোকে কখনও ভালোবাসি নি,

তোর প্রতি আমার ছিল অল্প ভালোলাগা,তোর ডং করা নম্র ভদ্র ব্যবহারে আমি অল্প আকর্ষিত হয়েছিলাম তোর প্রতি,তোর সৌন্দর্য আর শরীর কেমন জানি টানত আমাকে তোর কাছে,তাই তোকে পেতে চেয়েছিলাম,কিন্তু কেন জানি তোকে বিয়ে করতে গেছিলাম!তোর মতো নোংরাকে বিয়ে ছাড়াও তে ভো*গ করতে পারতাম, কিন্তু না মোহকে আমি ভালোবাসা ভেবেছি,কিন্তু এখন বুঝতে পারছি,সত্যি বলতে এখন আর তোর প্রতি কোনো আকর্ষণ আসে না আমার।তোর কাছে আসতেও কেমন জানি বিচ্ছিরি অনুভুতি আসে,তোকে তো দেখতেও মন চায় না।সর আমার চোখের সামনে থেকে।″
রিদিকাকে আবারও প্রবল ধাক্কা দিয়ে ফেলে চলে গেল আদ্রিশ তার কক্ষের বাইরে।

″আচ্ছা চলি ডা.আদৃত,আর কালকে দেখা হচ্ছে।″
″এই যে আঁখির মিস্টার ড্রাইবার আপনার ম্যাডাম আজ বাড়ি আসবেন না বাড়ি চলে গিয়ে বলে দিবেন বাকি সবাইকে,এবার যান আপনি।আর ডা.সাহেবা আপনি বরং আমার সাথে চলুন।″
″দেখুন রাত হয়ে গেছে বাড়ি যেতে হবে।″
″আমি কোথায় বলছি এখন দিন,আর আমিও তো তোমায় বাড়ি নিয়ে যাচ্ছি।″
″আপনার বাড়ি!″

″হ্যাঁ বাড়িটা আমার কিন্তু কিছুদিন পর তোমারও হবে।″
″এতো কনফিডেন্ট!অভার কনফিডেন্ট কিন্তু ভালো না।″
″আহনাফ আদৃত মির্জার কনফিডেন্ট কখনও সস্তা বা লোক দেখানো হয় না।″
″ফ্লার্ট করছেন আমার উপর?″ভ্রু নাচিয়ে বলল আঁখি।
″আমি তো ভালবাসা প্রকাশের অল্প প্রচেষ্ঠা করছি মাত্র,কেউ ফ্লার্ট মনে করলে আমার কি করণীয়,তবে যাই করছি নিজের হবু স্ত্রীর সাথেই তো করছি।″

আলতো স্বরে মিনমিনিয়ে আঁখির চোখে চোখ রেখে আদৃতের বলে যাওয়া কথা আচমকা এক লজ্জায় ফেলে দিল আঁখিকে,মুচকি হেসে চোখ সরিয়ে নিয়ে বলল।
″আপনি বড্ড ফাজিল হয়ে গেছেন,নিরামিষ ছিলেন সেটাই ভালো ছিল।″
″হুম চলুন এবার,মা বলেছে তোমাকে নিয়ে যেতে,আজ থাকতে হবে তোমায় আমাদের বাড়িতে।
তবে চলুন আমার মায়ের ছেলের হবু বউ,থুক্কু ডা.আঁখি।″

″আপনি সত্যিই বড্ড পাজি হয়ে গেছেন।″
কথাটা বলে আঁখি লজ্জামিশ্রিত হাসি দিয়ে আর আদৃতের দিকে না তাকিয়েই গাড়িতে উঠার জন্য দরজা খোলতে হাত বাড়াবে তার আগে আদৃত এসে হালকা টানে দরজাটা খুলে দিল।
″এবার ভিতরে যাও।″
আঁখি উত্তরে মৃদু হেসে ভিতরে ঢুকে গেল।

গাড়ি চলছে আপন গতিতে,আজকে আদৃতের চেহারা থেকে হাসি যেন নামছেই না,আলতো এক বাঁকা হাসি ঠোঁটের কোণে স্থির রেখে গাড়ি চালাতে মনোনিবেশ করেছে আদৃত,আঁখি লক্ষ্য করছে তাকে খুব তীক্ষ্ণ নজরে।ফর্সা চেহারাতে খোঁচা দাঁড়ি তার বড্ড মানানসই,বাইরের বাতাস তার চুল দুলিয়ে দিয়ে যাচ্ছে, আজ বাতাসের সাথেও বেশ হিংসে হচ্ছে আঁখির,প্রেমিক এই পুরুষের সানিধ্যে নিজেকে ছাড়া সে কাউকেই মেনে নিতে যে চাই নি কখনও,হোক না কেন সে অস্তিত্বহীন কোনো কিছু।
আঁখির ধ্যানে বাঁধা দিয়ে সামনে দৃষ্টি স্থির রেখেই বলল আদৃত এবার।

″আমার কি নতুন করে রূপ ফুটেছে?″
″কেন?″
″না মানে,ছয় বছর পর আজ কাউকে আবারও বিমোহিত হয়ে তাকাতে দেখতে পেলাম অপলকে।″
″আড়চোখে আমাকে দেখছেন বুঝি!″
″আমার মন তো তোমারই পাশে,সে তো সর্বক্ষণ তোমাকেই দেখে যায়।″
″কথা শিখে গেছেন বড্ড।″

″তোমার সান্নিধ্যের পাওনা। তা গান শুনবে?″
″গান শোনা কখন থেকে পছন্দের তালিকায় এলো?″
″যখন থেকে প্রেমে পড়েছি তোমার। ″
আঁখি আবারও মৃদু হেসে জানালা দিয়ে বাইরের দিকে দৃষ্টি সরিয়ে নিল।আদৃতও মুচকি হাসিতে একটা গান বাজিয়ে দিল।
কি করে বলব তোমায়!

আসলে মন কি যে চায়,
কেন সে পালিয়ে বেড়ায়,তোমার থেকে।
তুমি জানতে পারো নি কতো গল্প পোড়ে যায়।
তুমি চিনতে পারো নি আমাকে হায়…
গানটির একপর্যায়ে আদৃত লক্ষ্য করতে পারে আঁখি কান্না করছে,সাথে সাথে গান বন্ধ করে গাড়ি আটকিয়ে আঁখির জন্য পেরেশান হয়ে উঠে।

″কি হয়েছে আঁখি?কাঁদছ কেন?″
″আমাকে কি আপনি কখনও ক্ষমা করতে পারবেন?হয়ত আমার ভালোবাসার কাছে দমে গিয়ে আমাকে নিজের জীবনে ভরে নিতে চাইছেন,কিন্তু মন থেকে কি কখনও ক্ষমা করতে পারবেন?″
″কিসের ক্ষমা আঁখি?কি বলতে চাইছ তুমি?″

″এই তো,আপনি আমায় ভালোবেসে আর কাউকে জীবনে ভরে নিতে চান নি,এক আমিতেই সীমাবদ্ধ থাকলেন আপনি আর আমি অনায়াসে জীবনে এগিয়ে গেলাম,আসলেই আমার ভালোবাসায় খুঁত ছিল তাই তা পুর্ণতা পায় নি,নিঁখুত তো ছিল আপনার ভালোবাসা যা আমার ভালোবাসার কাছে মান হারিয়েছে।″
আদৃত এবার আঁখিকে টেনে বুকের সাথে মিশিয়ে নিয়ে বলল।

″কখনও না আঁখি,এমনটা আর কখনও বলো না।তোমার ভালোবাসায় কোনো খুঁত ছিল না,বরং তোমার অসহায়ত্ব আর দূর্বলতার সুযোগ আদ্রিশ নিয়েছে এতে তোমার কোনো দোষ ছিল না।″
″জানেন আপনি যখন চলে গেছিলেন তখন আমি অনেক ভেঙে পরেছিলাম,কোথাও গিয়ে মনের শান্তিটুকু পেতাম না,ভাইয়া বাবার সাথে ফ্রি থাকলেও তখন তাদেরও কিছু জানাতাম না,কারণ আমি জানতাম এসব জানালে উনারা আমার সুখের জন্য আপনাকে আমার কাছে নিয়ে আসার চেষ্টা করতেন,

যা ব্যাঘাত ঘটাত আপনার সুখের জীবনে,আঙ্কেল আর বাবার সম্পর্ক নষ্ট হতো।তখন একমাত্র আদ্রিশই ছিল যার সংস্পর্শে শান্তি খোঁজে পেতাম,মনের শান্তির লোভে তার সাথে থাকতাম প্রায় সময়,সে সত্যিই তখন আমার দূর্বলতার সুযোগ নিয়ে আমার পাশে চলে এসেছিল,ওকে ছাড়া থাকতেই পারতাম না,ও আমার অভ্যেসে পরিণত হয়েছিল,

যখনই আপনার স্মৃতি আমাকে জ্বা*লা*ত*ন করত ছোটে যেতাম ওর কাছে,ওর প্রতি একটা টান সৃষ্টি হয়েছিল আমার মনে,জানিনা সেটা ভালোবাসা ছিল না কি অন্য কিছু,কিন্তু ওকে আমি হারাতে চাই নি,মন ভাঙার ব্যথা যে কতটা যন্ত্রণাদায়ক তা আপনাকে হারিয়ে বুঝেছি,তাই সে ব্যথা আমি দ্বিতীয়বার সহ্য করার ক্ষমতা জুটিয়ে উঠতে পারি নি।মনের শান্তির পরিণামস্বরুপ ওকে পেতে স্বার্থপর এর মতো সব ত্যাগ দেই আমি।আমাকে ক্ষমা করে দিবেন আপনি?″

″পাগলি কি যে বলে।ওই আদ্রিশ তার কর্মফল নিশ্চয়ই পাবে,এখানে তোমার কখনও কোনো দোষ ছিল না,তাছাড়া আমার সুখপাখির মুখে ক্ষমা চাওয়া আমি কখনও মেনে নিব না।দেখো তোমার কান্নায় আজ আকাশটাও কান্না করে দিয়েছে,চলো না এই বেদনার জলে দু’জন সুখ মাখাই।আজ যে আমার এই নিরামিষ মনটাও উতলা সে বৃষ্টির জলে নেচে উঠতে চায় আঁখি তোমার সনে,ভিজবে কি আজ আমার সাথে?″

প্রমত্ত অঙ্গনা পর্ব ৩৪

″আঁখির চোখের জল মুছে তার দিকে হাত বাড়িয়ে প্রস্তাবটা দিল আদৃত।″

প্রমত্ত অঙ্গনা পর্ব ৩৬