মধুবালা গল্পের লিংক || ফারজানা আক্তার

মধুবালা পর্ব ১
ফারজানা আক্তার

পিরিয়ডের র’ক্তে মাখামাখি ছোঁয়ার সাদা পায়জামা। তলপেটে হালকা ব্যাথা এবং পায়জামা কিছুটা ভেজা অনুভব করতেই বিয়ে বাড়ির এক কোণে গিয়ে একটু সাইডে সবার আঁড়ালে দাঁড়িয়ে আছে ছোঁয়া যাতে কেউ এই অপ্রস্তুত অবস্থায় ওকে না দেখে। পুরো বিয়ে বাড়ি জমজমাট। কি করবে বুঝতে পারছেনা ছোঁয়া।

অন্যদিকে সব বন্ধু বান্ধব ছোঁয়াকে খুঁজতে খুঁজতে হয়রান। আজ ছোঁয়ার বেস্টফ্রেন্ড সাহারার বিয়ে। ছোঁয়া সব বন্ধুদের সাথেই ছিলো হঠাৎ এমন বিব্রতকর পরিস্থিতি অনুভব করে সবার আঁড়ালে লুকালো কারণ ছোঁয়া সাদা পায়জামা পরিধান করেছে এবং সে জানে সাদা পায়জামায় খুব স্পষ্ট ভাবে সব ফুটে উঠবে।

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

ছোঁয়া একবার ভাবলো ওর বান্ধবীদের কল করে ডাকবে কিন্তু আজ সবাই ফোন সাইলেন্ট করে রেখেছে যাতে তাদের আনন্দে কেউ ডিস্টার্ব করতে না পারে আর এই কারণেই ছোঁয়া চেয়েও কল দিতে পারছেনা। আর ওর বন্ধুরাও একই চিন্তা থেকে ওকে কল করেনি। প্রায়ই অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকার পর ছোঁয়া বেশ বিরক্ত হয়ে নিজের কপাল নিজেই থা’প্রা’চ্ছে। বিয়ে বাড়ির হৈ হুল্লোড় শুনে ছোঁয়া বুঝতে পারলো বরযাত্রি চলে এসেছে। রা’গে দুঃখে ছোঁয়া প্রায়ই কেঁদে ফেলে। ছোঁয়া আর না পেরে কল দেয় ওর সব বন্ধু বান্ধবীদের কিন্তু কল রিসিভ করেনি কেউ কারণ সবার ফোন সাইলেন্ট আর হাতে ফোন কেউ রাখেনি ছেলে ফ্রেন্ডদের ফোনও মেয়ে ফ্রেন্ড’দের ব্যাগে।

বিয়ে পরানোও শেষ। ছোঁয়া সব লক্ষ করছে আড়াল থেকে। বিয়ে বাড়িতে প্রচুর শব্দ থাকাই ওর গলার স্বর কারো কর্ণকুহরে পৌঁছায় না। এবার ছোঁয়া সত্যি সত্যিই কেঁদে দিলো। এতো কষ্ট করে বাসা থেকে বালা দুটো চু’রি করে এনেছে অথচ যে বিয়ের অনুষ্ঠানের জন্য এতো পরিশ্রম সেই বিয়েই কিনা সে এটেন্ড করতে পারলোনা। ছোঁয়ার পেটের ব্যাথাও তিব্র হচ্ছে।
“ছোঁয়া তুই এখানে?”

হঠাৎ পরিচিত কণ্ঠস্বর শুনে ছোঁয়া ভীষণ রকম ভয় পেয়ে যায়। এটা যে ওর জেটাতো ভাই শুভ্রর কন্ঠ। শুভ্র যদি ওর হাতে এই বালা দেখে তবে এখনই ছিঁনিয়ে নিয়ে নিবে। তাই ছোঁয়া হাত থেকে বালা গুলো খুলে ব্যাগে ভরে নিয়ে তারপর ধীরে ধীরে শুভ্রর দিকে তাকায়। শুভ্র কঠিন কন্ঠে বলে “বালা গুলো আগেই দেখেছি আমি, এতো ঢং করে লুকাতে হবেনা আর। আমার ভবিষ্যৎ বউয়ের বালা চু’রি করে পরতে তোর লজ্জা লাগেনা?” ছোঁয়া মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে আর ভাবছে শুভ্র এখানে কি করছে। আর মনে মনে বলে “হুহঁ তোমার ভবিষ্যত বউ তো আমিই হবো।” ছোঁয়ার ভাবনায় ছেদ পরে শুভ্রর চেঁচানিতে। শুভ্র চেঁচিয়ে বলে “এখানে কি করছিস তুই?”

“আমার বান্ধবী সাহারার বিয়ে আজ। তাই সব বন্ধুদের সাথে এসেছি।”
“তাহলে একা একা এই কোণায় এসে মুক্তির মতো দাঁড়িয়ে আছিস কেনো?”
“এমনি।”

আমতা আমতা করে বলে ছোঁয়া। ছোঁয়ার মুখ দেখে শুভ্রর মনে হচ্ছে ছোঁয়া কিছু একটা লুকাচ্ছে তাই শুভ্র চোখ রাঙ্গিয়ে বলে “দেখ ছোঁয়া এখানে বন্ধুর বিয়ের বরযাত্রি হয়ে এসেছি, আমি কোনো ঝামেলা করতে চাইনা তাই চুপচাপ বল কি হয়েছে। কি করছিস একা একা সবার আঁড়ালে?”

ছোঁয়া এবার চুপসে যায় একদম। কি বলবে বুঝতে পারছেনা। শুভ্রকে দেখলেই ছোঁয়ার হার্টবিট দ্বিগুণ বেড়ে যায়। ছোঁয়া আর কোনো পথ খোলা না পেয়ে শুভ্র কে বলে “ভাইয়া তোমার জ্যাকেট টা আমায় ধার দিবা আজকের জন্য? প্রমিজ করছি সুন্দর করে ধুইয়ে শুকিয়ে আয়রন করে ফেরত দিয়ে দিবো আবার।”
শুভ্র হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। আর বুঝার চেষ্টা করতেছে কি হয়েছে ছোঁয়ার। তারপর আর কিছু না ভেবেই শুভ্র নিজের জ্যাকেট টা খুলে ছোঁয়ার হাতে ধরিয়ে দিয়ে চলে যায় সেখান থেকে। শুভ্র হয়তো কিছুটা আঁচ করতে পেরেছে কিন্তু ছোঁয়ার অস্বস্তি হবে ভেবে ওকে কিছু বুঝতে না দিয়ে চলে যায় সেখান থেকে।

শুভ্র চলে গেলে ছোঁয়া জ্যাকেট টা কোমরে বেঁধে নেয় শক্ত করে তারপর খুব ধীর পায়ে হেঁটে গাড়ির কাছে যেতেই দেখে সব বন্ধুবান্ধব গাড়ির কাছে দাঁড়িয়ে ছোঁয়ার জন্য অপেক্ষা করছে। ছোঁয়াকে দেখতেই সবাই চেঁ’তে গিয়ে অনেক কথা শুনাই ওকে। ছোঁয়া কিছু না বলে মন খারাপ করে দাঁড়িয়ে সবার দেওয়া বকা গিলতেছে। তারপর এক বান্ধবী নিহা কে ইশারা করে বলে সমস্যার কথা, নিহা সব বুঝে বন্ধুদের বলে “সাহারার বিদায়ের সময় হয়ে এসেছে সবাই ওর কাছে যাও।”

সবাই চলে গেলেও মেয়ে বান্ধবীরা থেকে যায়। বান্ধবী রা সবাই আবারও বকে ওকে ওর সমস্যার কথা ওদের কাউকে না বলার জন্য। আর জ্যাকেটটা কোথায় পেয়েছে তাও জানতে চাই ওরা। ছোঁয়া একটু লজ্জা পেয়ে সবাইকে বলে সবটা। তারপর সবাই এই বিষয়টা নিয়ে অনেক হাসি তামাসাও করে। সবাই-ই জানে ছোঁয়া শুভ্রর বউ হতে চাই খুব করে আর কোন লোভে এতো বউ হওয়ার ইচ্ছে সেটাও জানে।
ছোঁয়া সবাইকে বিদায় দিয়ে একা বাসার দিকে রওনা দেয়। সাথে ড্রাইভার এনেছিলো বলে ছোঁয়াকে আর ড্রাইভ করতে হয়নি কষ্ট করে।

মির্জা বাড়ির আলিশান ড্রয়িংরুমে আজ সভা বসেছে। সবাই উপস্থিত আছে শুধু ছোঁয়া আর শুভ্র ছাড়া। বিকাল ৫টা। ছোঁয়ার জন্যই আজ সবাই একসাথে জড়ো হয়েছে। ছোঁয়ার বাবারা চার ভাই। শুভ্রর বাবা সবার বড়, ছোঁয়ার বাবা মেজু আর বাকি দু’জন তাদের ছোট। ছোঁয়ারা অনেক কাজিন হলেও চার ভাইয়ের মাঝে শুধু একটাই ছেলে সন্তান শুভ্র আর দুই ভাইয়ের সব মেয়ে।

ছোঁয়ার ছোট চাচার ঘরে কোনো সন্তান নেই। অনেক চেষ্টা করেও একটা সন্তান জন্ম দিতে পারেননি এই দম্পতি। ছোঁয়ার ছোট চাচি তাই ছোঁয়াকে নিজের মেয়ের মতো স্নেহ করেন। ছোঁয়াও ছোট চাচির সাথে বেশ ভাব জমায়। ছোঁয়ার দাদা গত হয়েছে অনেক বছর আগে, প্রায়ই ওর ছোট চাচার বিয়ের আগে কিন্তু ওর দাদি আনজুমা খাতুন এখনো জীবিত আছেন। আনজুমা খাতুন খুব ক্ষো’ভ নিয়ে বসে অপেক্ষা করছেন ছোঁয়ার জন্য।

পা টিপে টিপে ঘরের সদর দরজায় পা রাখতেই সবাইকে ড্রয়িংরুমের সোফায় জড়ো হয়ে বসে থাকতে দেখে ভয়ে শুকনো ঢুক গিললো ছোঁয়া। এই অবস্থায় সবার সামনে দিয়ে ঘরে ঢুকবে কিভাবে ভাবছে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে। তখনই ছোঁয়ার বড় আব্বু মোঃ বেলাল মির্জা ছোঁয়াকে দেখে রাগী কন্ঠে বলে উঠে “এইতো আসছে আমাদের মহারানী, আমার একমাত্র ছেলের বউ হওয়ার স্বপ্ন দেখা রাজকুমারী।”

বেলাল মির্জার কথায় সবাই সদর দরজায় দৃষ্টি দিতেই ছোঁয়াকে দেখতে পাই। ছোঁয়ার মা সেলিনা পারভীন মুখ শুকনো করে অপরাধীর মতো দাঁড়িয়ে আছেন সোফার পাশে। ছোঁয়ার পেঁছন পেঁছন শুভ্রও আসে। কারণ শুভ্র জানে আজকে আবারো বাড়িতে মহাকান্ড ঘটবে। শুভ্রর বাবা মোটেও পছন্দ করেনা ছোঁয়াকে যার কারণ ঘরের সব ছোট সদস্যদের অজানা কিন্তু বড় রা সবাই-ই জানে। ছোঁয়ার ভীষণ মন খারাপ হয় যখন বাড়ির অন্য ছোট সদস্যদের বেলাল মির্জা খুব আদর করেন তখন।
ছেলেকে দেখে বেলাল মির্জা আবারো বললেন “বাহ্ হবু বর বধুর দেখি একসাথেই প্রবেশ ঘটলো। তা একসাথে কোথায় যাওয়া হয়েছে মির্জা বাড়ির খানদানি বালা দুটো চু’রি করে?”

শুভ্র বাবার কথায় পাত্তা না দিয়ে ছোঁয়াকে বললো “রুমে যা তুই, ফ্রেশ হয়ে আয়। তারপর সবার সব প্রশ্নের উত্তর তুই নিজেই দিবি। এবার সত্যি সত্যি তোর একটা শাস্তি হওয়া খুব জরুরি। বারংবার তুই একই ভুল করিস। সামনে পরিক্ষা সেই খেয়াল তোর মোটেও নেই।”

ছোঁয়ার ভীষণ মন খারাপ হলো। বড় ভাইয়ের মতোই শাসন করে শুভ্র সবসময়ই ওকে। বুকের ভেতর একরাশ কষ্ট লুকিয়ে ছোঁয়া নিজের রুমের দিকে পা বাড়ালো। এতোদিনে ছোঁয়া বেশ বুঝতে পেরেছে এই ঘরের হাতে গোনা কয়েকজন লোক ছাড়া বাকি সবাই ওকে অপছন্দ করে। কিন্তু দিনশেষে ওর মায়ের একটু অতিরিক্ত আদরে সব মন খারাপ পালিয়ে যায় ছোঁয়ার।

ছোঁয়া ফ্রেশ হতে যেতেই শুভ্রর মা নাজমা বেগম ওকে জিজ্ঞেস “শুভ্র তোর জ্যাকেট ছোঁয়ার কোমরে কেনো?”
শুভ্র এবার বেশ বিরক্ত হলো মায়ের প্রতি। একটা মেয়ে হয়েও কিভাবে সবার সামনে ওর মা এমন প্রশ্ন করতে পারলো? যদিও শুভ্র জানে ওর মা ছোঁয়াকে মোটামুটি পছন্দ করে। বাড়ির মেয়েকে তো ফেলে দেওয়া যায়না সেই হিসেবে নাজমা বেগম ছোঁয়াকে সেই সমান ভালোবাসেন সবার মতোই। শুভ্র মায়ের প্রশ্নের কোনো উত্তর না দিয়ে দাদির পাশে গিয়ে সোফায় বসে পরে ধ’প করে। আনজুমা খাতুন নাক-মুখ কুঁচকে শুভ্রকে উদ্দেশ্য করে বলেন “ছোঁয়ার সাথে কোথায় গিয়েছিলি? বিয়ে টিয়ে করার পরিকল্পনা করতেছিস নাকি দাদু ভাই?”

শুভ্রর রাগে মাথা ফে’টে যাচ্ছে। সবাই সব না জেনেই এভাবে অহেতুক প্রশ্ন করে শুভ্রর রাগের মাত্রা আরো বাড়িয়ে দিচ্ছে। এমনিতেই ছোঁয়ার উপর খুব ক্ষেঁ’পে আছে ওর হবু বউয়ের জন্য রাখা খানদানি বালা চু’রি করার দায়ে শুভ্র।
এই বাড়িতে একমাত্র আনজুমা খাতুন আর বেলাল মির্জা ছোঁয়াকে সহ্য করতে পারেনা মোটেও কিন্তু বাকিরা সবাই ওর সাথে স্বাভাবিক আচরণ করে।

ছোঁয়া ফ্রেশ হয়ে এসে সবার সামনে এমনভাবে দাঁড়িয়েছে যে যেনো এই মুহুর্তে সে ১০/১২ টা খু’নে’র আ’সা’মি
এবার ছোঁয়ার দিকে প্রশ্ন ছুঁ’ড়ে মা’র’লো ওর বাবা মান্নান মির্জা।

“বারবার কেনো এভাবে আমার মানসম্মান নিয়ে টানাটানি করিস তুই ছোঁয়া? তুই কি বুঝিসনা এসব তোর জন্য নয়। এই খান্দানী বালা তে শুধু বাড়ির বউদের অধিকার থাকে। শুভ্র তোর জেটাতো ভাই। আর তোর বড় আব্বু কোনোদিন তোকে শুভ্রর বউয়ের স্থানে মেনে নিবেনা জানিস তুই তবুও সব জেনে এমন পাগলামি কেনো করিস তুই মা। আমি তো প্রমিস করেছি ঠিক এর মতোই আরেক জোড়া বালা তোকে আমি বানিয়ে দিবো, একটু সময় কি দেওয়া যায়না এই অযোগ্য বাপটাকে?”

ছোঁয়ার চক্ষু মাঝে জ্বলজ্বল করছে জল। ছোঁয়া যেনো মুখের ভাষা হারিয়ে ফেলেছে। অনেক ভেবেও ছোঁয়া কিছু উচ্চারণ করতে পারছেনা মুখ দিয়ে। একটু দূরে দাঁড়িয়ে অসহায় দৃষ্টিতে মেয়ের দিকে তাকিয়ে দাঁড়িয়ে আছে ছোঁয়ার মা সেলিনা পারভীন।

মধুবালা পর্ব ২