মধুবালা পর্ব ২

মধুবালা পর্ব ২
ফারজানা আক্তার

মাথা নিচু করে ছোঁয়া হাস্যজ্জোল চেহারা করে বলে উঠে “শুভ্র ভাইয়াই তো আমায় বললো ওর সাথে ওর বন্ধুর বিয়েতে যেতে আর বালাগুলোও নিতে বলেছিলো। তাই তো আমি নিলাম।”

কথাটা বলেই ছোঁয়া হাত বাড়িয়ে আনজুমা খাতুনের হাতে বালা জোড়া দিয়ে একটু থেমে সবার হতবাক হয়ে থাকা মুখের দিকে তাকিয়ে আবারো বলে “আমি যদি এভাবে বলি কেউই বিশ্বাস করবেনা আমি জানি কারণ এটা সম্পূর্ণ মিথ্যা। সবাই খুব মন মেজাজ খারাপ করে বসে আছে দেখে একটু দুষ্টুমি করলাম ক্ষমা করুন বড় আব্বু।

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

আমি আসলে আমার বেস্টফ্রেন্ড সাহারার বিয়েতে গিয়েছিলাম। আম্মু আব্বুকে বলেই গিয়ছিলাম কিন্তু বালা জোড়ার কথা আব্বু আম্মু জানতোনা। সবাই জানে বালা গুলোর প্রতি ভীষণ আকর্ষণ আমার তাই এই সম্পর্কে আর কিছু বলতে চাইনা। সবাই মিলে যা শাস্তি দিবে মাথা পেতে নিবো আমি তবুও সুযোগ পেলে লকার খুলে বালা দুটো নিতে একটুও ভয় করবোনা। এই বালা গুলোর প্রতি ভীষণ দুর্বল আমি তা হয়তো এতোদিনে সবাই-ই বুঝে গেছে। শুভ্র ভাইয়া আবারো বলছি বিয়ে করে অর্ধাঙ্গিনী রুপে স্বীকার করে নাওনা আমায় প্লিজ।”

প্রায়ই অনেকক্ষণ সবাই চুপচাপ হয়ে ছোঁয়ার কথাগুলো হজম করছে। সবাই খুবই অবাক আজ। ছোঁয়া যে এতো পাগলামি করতে পারে সামান্য দুটো বালার জন্য তা কারোই জানা ছিলোনা। ছোঁয়ার মায়ের অবস্থা খুবই অস্থির। বুকটা দুরুদুরু করছে সেলিনা পারভীনের। কিন্তু ছোঁয়া কথাগুলো শেষ করে হাসিমুখ নিয়ে দিব্যি দাঁড়িয়ে আছে। মান্নান মির্জাও কিছুটা ঘামছে মেয়ের এমন পাগলামোতে।

হুট করে উপস্থিত সবাই হো হো করে হেঁসে উঠলো শুধু মুখ গম্ভীর করে রেখেছে আনজুমা খাতুন আর তার বড় ছেলে বেলাল মির্জা। শুভ্রও মুখ বেশ গম্ভীর করে রেখেছে। সবার মুখের হাসি মুহুর্তেই বিলীন হয়ে গেলো শুভ্রর কন্ঠস্বর কর্ণকুহর হতেই “তোর মতো মধুবালাকে বিয়ে করার কোনো শখ নেই আমার ছোঁয়া। বিশ্বাস কর বোন তোর এসব পাগলামি দেখতে দেখতে ভীষণ ক্লান্ত আমি আর বিরক্তও খুব। পড়ালেখায় মন দে আর হ্যাঁ দ্বিতীয় বার আর ভুলেও আমার হবু বউয়ের বালা জোড়ার দিকে নজর দিবিনা কখনো। মাথায় রাখিস কথাগুলো।”

এসব বলতে বলতেই সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠে গেলো শুভ্র। ছোঁয়া ঠাঁই দাঁড়িয়ে রয়েছে কিন্তু সবার মুখে বিষন্নতা ছেয়ে গেলেও ছোঁয়া স্বাভাবিক আছে কারণ ছোঁয়ার যে এখন অভ্যাস হয়ে গেছে তাই আর গায়ে মাখেনা কারো কটু কথা। বেলাল মির্জা তেঁ’তে কিছু বলতে যাবেন তখনই ছোঁয়া এক ছুটে ওর রুমে চলে যায়। এতে বেলাল মির্জা বেশ অপমানবোধ করেন। আনজুমা খাতুন বালা পেয়ে আর কথা না বাড়িয়ে নিজের রুমে চলে গেলেন ধীর পায়ে। বাড়ির ছোটদের সবার রুম দু’তলায় হলেও ছোঁয়ার রুম নিচে দেওয়া হয়েছে। এটা নিয়ে যদিও ছোঁয়ার মনে হাজারো প্রশ্ন তবুও সে কখনো মনখারাপ করেনি।
“এতো অপমান করে সবাই তোকে তবুও তুই এমন করিস কেনো? কেনো বারবার সবাইকে এভাবে সুযোগ দিস কথা শোনানোর?”

ছোঁয়া বিছানায় আধশোয়া হয়ে ফোন ঘাটছিলো। সেলিনা পারভীনের কথায় ফোন থেকে চোখ সরিয়ে মায়ের দিকে তাকিয়ে ফিক করে হেঁসে বলে “মা জানো তুমি আমার না সবার বকা শুনতে বেশ মজা লাগে।”
সেলিনা পারভীন একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলে “তুই আমাকে ছুঁয়ে ওয়াদা কর আর কখনো ওই বালা জোড়া ছুঁয়েও দেখবিনা তোর দাদির অনুমতি ছাড়া। ”

সেলিনা পারভীনের কান্না জড়িত কন্ঠ দূর্বল করে দিচ্ছে ছোঁয়াকে। ছোঁয়া সিদ্ধান্তহীনতায় ভোগছে। প্রায়ই অনেকক্ষণ সময় নিয়ে ছোঁয়া মাকে কথা দিয়ে দিলো কিন্তু সে বালা দু’টির লোভ কিছুতেই সামলাতে পারেনা। ছোট্ট থেকেই চুঁড়ি পাগলী ছোঁয়া। ছোঁয়ার হাজার ডিজাইনের চুঁড়ি থাকলেও বালা দু’টির ডিজাইন আকৃষ্ট করে ছোঁয়াকে বড্ড বেশি। হঠাৎ করেই মাকে জড়িয়ে ধরে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠে ছোঁয়া আর মনে মনে শপত করে একদিন দাদি নিজেই ওকে এই বালা জোড়া পরিয়ে দিবে। সেদিন ছোঁয়া মন খুলে হাঁসবে।

দুইদিন পর ছোঁয়া শুভ্রর রুমে এসে উঁকি দেয় কিন্তু দেখেনা কাউকে। ছোঁয়া কাউকে দেখতে না পেয়ে হাত থেকে শুভ্রর জ্যাকেট টা বিছানায় রেখে চলে যেতে নিলেই শুভ্রর কন্ঠস্বর ওকে থামিয়ে দেয়।
“একবার কাউকে কিছু দিলে সেটা ফেরত নেওয়া শুভ্র মির্জার ডিকশনারিতে নেই। নিয়ে যা জ্যাকেট টা তুই।”
“তাহলে বালা জোড়া কেনো নিয়ে নাও বারংবার ছিনিয়ে?”
“কারণ ওই বালা জোড়া তোকে দেওয়া হয়না বরং তুই চু’রি করে পালিয়ে যাস। চু’র’নি একটা।”
“তুমি আমায় চু’র’নি বলতে পারলে শুভ্র ভাইয়া?”

“আর এক সেকেন্ড যদি এখানে দাঁড়িয়ে থাকিস তবে এর চেয়েও বেশি কিছু বলে ফেলবো। যা এখান থেকে।”
ছোঁয়া আর কথা না বাড়িয়ে চলে গেলো জ্যাকেট টা নিয়ে। শুভ্র ওয়াশরুম থেকে বের হয়ে ছোঁয়াকে দেখে কেমন জানি কিছু একটা অনুভব করলো। যেনো নেশা করা ঘ্রাণ। শুভ্র কিছুতেই দূর্বল হতে চাইনা ছোঁয়ার প্রতি তাই ওকে দেখলেই রাগ দেখানোর চেষ্টা করে।

ছোঁয়া কলেজ যাওয়ার জন্য তৈরি হয়ে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজেকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখছে। কপালে ছোট্ট ছোট্ট কয়েকটা ব্রণের ভীড় জমেছে। নাকের উপর ব্লাকহ্যাডস। কিন্তু চেহারা টা তো মাশাআল্লাহ তবে কেনো শুভ্র ভাইয়া আমাকে পছন্দ করেনা? গায়ের রং টাও তো উজ্জ্বল শ্যামলা। শ্যামবতীও বলা যায়। ইস্ কত্ত কিউট আমি আর ওই শুভ্রর বাচ্চা কিনা আমাকেই ইগ্নোর করে।
“নিজের প্রশংসা নিজেকে করতে নেই মধুবালা, নজর লেগে যাবে।”

শুভ্রর ছোট বোন লিলির কথায় মুখ বাঁকিয়ে কাঁধে ব্যাগ ঝুলাতে ঝুলাতে ছোঁয়া বলে “চুপি চুপি কারো কথা শোনা কিন্তু ভালোনা। চল কলেজে যাবো। কয়েকদিন পর থেকে ফাইনাল পরিক্ষা। এখন কলেজ মিস করা মোটেও চলবেনা।
লিলি আর ছোঁয়া একই ক্লাসে পড়ে। এবার অনার্স ফাইনাল পরিক্ষা দিবে দুজন। লিলি পড়ালেখায় মোটামুটি ভালো হলেও ছোঁয়ার তেমন একটা টান নেই পড়াশোনার প্রতি তবুও লাক ভালো বলে প্রতিবার ভালো নাম্বারে পাশ করে যায় ছোঁয়া।

শুভ্র অফিসে যাওয়ার পথেই দুজনকে কলেজ ড্রপ করে দিয়ে যায়। শুভ্র মাস্টার্স শেষ করে একটা প্রাইভেট কোম্পানিতে জব করে। পরিবার অনেক বুঝিয়েও ওকে ফেমিলি বিজনেসে জয়েন করার জন্য রাজি করতে পারেনি। শুভ্র একমাত্র ছেলে বলে পরিবারের কেউ ওর সাথে তেমন একটা বারাবাড়ি করতে চাইনা তাই ও নিজের মতো চলতে পারে।
ছোঁয়া সবসময়ই শুভ্রর পাশের সিটে বসে। লিলি মিটি মিটি হাসে ছোঁয়ার শুভ্রর দিকে আনমনা হয়ে তাকানোটা কিন্তু ছোঁয়া কখনোই স্বীকার করেনা ও যে শুভ্রকে ভালোবাসে সেটা। ছোঁয়া নিজেও জানেনা বালার প্রেমে নয় শুধু মালিকের প্রেমেও সাঁতার কাটতেছে সে।

রাতে খাবার টেবিলে সবাই নিজের মতো খাওয়ায় ব্যস্ত কিন্তু মন খারাপ ছোঁয়ার। মাকে যে কথা দিয়েছে বালা জোড়ায় কখনো হাত লাগাবেনা সেটা চিন্তা করতে করতেই ছোঁয়া ক্লান্ত। ছোয়ার ছোট চাচি জায়েদা বেগম ওকে বলেন “কি হয়েছে ছোঁয়া। খাচ্ছিস না কেনো?”

ছোট চাচির প্রশ্নের জবাবে ছোঁয়া কি বলবে খুঁজে না পেয়ে বলে “চাচিম্মু একটু খাইয়ে দিবে আমায়?”
ছোঁয়ার এমন আদুরে আবদার কিছুতেই ফেলতে পারবেননা জায়েদা বেগম। এই ছোট্ট ছোট্ট আবদার গুলোর জন্যই তো জায়েদা বেগম ছোঁয়াকে একটু বেশি ভালোবাসেন। ছোঁয়া উনার কাছে থাকলে উনার মনেই হয়না যে উনি নিসন্তান।
এসব আদিখ্যেতা দেখে আনজুমা খাতুন নাক-মুখ কুঁচকে ফেলেন। সবার নজর এড়ালেও ছোঁয়ার নজর এড়ালোনা। ছোঁয়া একটা ছোট্ট শ্বাস নিয়ে সব ভুলে যায়। মুখে রাখে বিশ্ব যোদ্ধ জয়ের হাসি।

সকাল সকাল শুভ্র ঘুম থেকে জেগে আঁতকে উঠে হঠাৎ। ঘুম ভা’ঙ’তে’ই শুভ্র আয়নার সামনে গিয়ে নিজেকে পর্যবেক্ষণ করে খুব ভালো করে রোজ। আজকেও তার ব্যাতিক্রম হয়নি। আয়নার সামনে যেতেই শুভ্র হালকা চিৎকার দিয়ে দুই কদম পিঁছিয়ে যায়। শুভ্রর পুরো মুখ জুড়ে লাল লিপস্টিক লাগানো। কেমন এঁকেবেঁকে করে এঁকেছে কেউ বুঝাই যাচ্ছে। এমন মুহুর্তে শুভ্র কাউকে ডাক দিবে তাও পারছেনা কারণ ওর কথা শোনার আগেই সবাই অট্টহাসিতে লেগে যাবে। বেলাল মির্জা গম্ভীর হলেও পরিবারের বাকি সদস্য খুব চঞ্চল তা শুভ্রর জানা আছে বেশ ভালো করে।

মধুবালা পর্ব ১

মাথায় হাত দিয়ে শুভ্র বসে আছে খাটে। হঠাৎ মাথায় আসলো ছোঁয়ার খেয়াল। এই কাজ যে ছোঁয়া ছাড়া আর কারো করার সাহস হবেনা তা শুভ্র জানে। কিন্তু ছোঁয়া ওর রুমে প্রবেশ করলো কিভাবে? দরজা তো ভেতর থেকে লক করা।
“অপেক্ষা কর মধুবালা। আজ সকাল আমার জন্য যেমন অদ্ভুত তোর আগামী সকাল তার চেয়েও বেশি ভ’য়ং’ক’র হবে। ”

মধুবালা পর্ব ৩