প্রণয়াসক্ত পূর্ণিমা পর্ব ৫

প্রণয়াসক্ত পূর্ণিমা পর্ব ৫
Writer Mahfuza Akter

অরুণী সৌহার্দ্যের দিকে তাকিয়ে অস্ফুটস্বরে বললো,
-“কীহ্? তুমি বিয়ে করেছো, সৌহার্দ্য? তুমি…তুমি বিয়ে করেছো?”

বলেই অরুণী হাসলো। চোখভর্তি পানি নিয়েই হাসলো সে। সেই হাসি দেখে চোখ বন্ধ করে ফেললো সৌহার্দ্য। অরুণী তার দ্বারা এতো কষ্ট পাবে, সে কখনো কল্পনাতেও ভাবেনি। অরুণী জড়ানো কন্ঠে বললো,
-“আমি ভাবতেই পারছি না, আমার সৌহার্দ্য এখন আর আমার নেই। বিশ্বাস-ই হচ্ছে না! আচ্ছা, তুমি আমার সাথে মিথ্যে বলছো না, তাই না? একবার বলবে যে, তুমি যা বলছো, তা মিথ্যে ছিল? শুধু একবার বলবে, প্লিজ?”

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

সৌহার্দ্য ঢোক গিললো। কান্নাগুলো গলায় আঁটকে আসছে তবুও। অরুণীর দিক থেকে দৃষ্টি সরিয়ে নিলো সে। অরুণী সেটা খেয়াল করলো। নিজের চোখ মুছে সৌহার্দ্যের সামনে গিয়ে দাঁড়ালো। নাক টেনে কান্না দমিয়ে বললো,

-“আমি তোমাকে অনেক ভালোবেসেছি, সৌহার্দ্য। যদিও ভালোবাসাটা আমার দিক থেকে প্রথম এসেছিল, তবে প্রেমটা কিন্তু দুজনের মধ্যেই ছিল। এই ছয় বছরে ‘বিয়ে’ শব্দটা যতবার শুনেছি, প্রতিবার তোমার পাশে নিজেকে কল্পনা করেছি আমি। আমার সেই কল্পনা আজ কাঁচের মতো ঝনঝন করে ভে*ঙে গেল। তুমি তোমার স্ত্রীকে মেনে নিয়েছো, তাই না?”
-“দেখো, অরুণী! তরীর সাথে আমার বিয়েটা অনাকাঙ্ক্ষিত ছিল, অরুণী।

টোটালি আনএক্সপেক্টেড! তরী শুধু কথা বলতে পারে না বলে ওর বিয়েটা ভে*ঙে গিয়েছিল। আমার এখনো মনে পড়ে, আশেপাশের লোকজন ওকে যা-নয়-তাই বলছি। মনে মনে ভাবছিলাম, কেউ কি নেই এই অসহায় মেয়েটাকে এই সমাজের কটুক্তির হাত থেকে রক্ষা করার মতো? আমার চোখের সামনে আজও ভাসে, বিয়ে ভে*ঙে গিয়েছে বলে তরীকে ওর সৎমা কীভাবে বিয়ের ভরা আসরে সবার সামনে চ*ড় মে*রে*ছি*ল!”

অরুণী সৌহার্দ্যের দিকে তাকিয়ে বললো,
-“আমি আর কিছু শুনতে চাই না, সৌহার্দ্য। তুমি ঠিকই বলেছো! আমরা একে অপরের প্রেমে পড়তে পারি, একজন আরেকজনকে ভালোবাসতে পারি। কিন্তু আমাদের মিলন সম্ভব নয়।”

অরুণী চলে গেল। সৌহার্দ্য ওকে আটকালো না। আটকানোর চেষ্টাও করলো না। ভাগ্য খুব যত্ন করে ওদের দুজনকে এক সুতোয় বেঁধেছিল। আর আজ ভাগ্য-ই নিজ দায়িত্বে একটানে সেই সুতো ছিঁ*ড়েও দিলো। কথায় বলে, জন্ম-মৃত্যু-বিয়ে, তিন বিধাতা নিয়ে! প্রচলিত এই কথাটার বাস্তব প্রয়োগও দেখে নিলো আজ তারা। তিনটি মানুষের সাথে যা ঘটলো, তা মোটেও ভালো কিছু ঘটেনি। কিন্তু এতে তাদের মধ্যে থেকে কাউকে দোষারোপ করাও যায় না। বাস্তবতা মাঝে মাঝে এমন অসঙ্গায়িত রূপ-ও দেখায়! অদ্ভুত বৈচিত্র্যময় সে রূপ!!

নিজের কেবিনে বসে বসে হাতের কলম ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে অনেক কিছু চিন্তা করছে প্রহর। মাথার ভেতর একটা ভাবনা আরেকটা ভাবনার সাথে সং*ঘ*র্ষ করছে বারবার। কী অদ্ভুত বিষয়! এই প্রথম এমন একটা অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হলো, যা ওকে বারবার দ্বিধান্বিত করছে।

-“স্যার, এই মাসে যে দুজন খু**ন হয়েছে, তারা দুজনেই সরকারী কর্মকর্তা। তাদের সকল ডিটেইলস এই ফাইলটাতে আছে।”
প্রহর চোখ তুলে তাকালো। ভ্রু কুঁচকে কিছুক্ষণ নিজের সেক্রেটারি রিয়াদের দিকে তাকিয়ে রইলো। তারপর বললো,
-“মধুর ব্যাপারে কোনো আপডেট আছে?”
-“ইয়েস স্যার। সেদিন মাধুর্য ম্যাম কখন কী করেছেন, সব ডেটা কালেক্ট করেছি। এইযে, এই ফাইলটা রেডি করেছি আজকে।”

প্রহর ফাইল দুটো হাতে নিলো। সবগুলো পৃষ্ঠা মনযোগ সহকারে দেখলো। হতাশার নিঃশ্বাস ফেলে বললো,
-“ফাইল দুটোতে সন্দেহজনক কিছু নেই, আর না আছে কোনো ক্লু।”
রিয়াদ প্রহরের দিকে তাকিয়ে অবাক কন্ঠে বললো,
-“কিন্তু স্যার, কেইস দুটো তো আলাদা। আপনি দুটোকে একসাথে মেলাতে চাইছেন কেন?”

-“রিয়াদ! খু*ন দুটোর সাথে মধুর ব্যাপারটার একটা সূক্ষ্ম সংযোগ আছে। আর এটা আমার ধারণা নয়, বরং আমি এ ব্যাপারে শতভাগ নিশ্চিত। কিন্তু আমি এটা বুঝতে পারছি না, মধুকে বারবার শুধু অ্যা*ট্যা*ক করা হচ্ছে। কিন্তু ওদের দুজনের মতো ওকে মে*রে ফেলার কোনো চেষ্টা করা হচ্ছে। সেদিন ওর স্কুটারে ধাক্কা দিয়ে ওকে মে*রে ফেলার কোনো উদ্দেশ্য ছিল না তাদের। আমাদের দ্রুত কিছু করতে হবে। আমি চাই না, মধুর কোনো ক্ষতি হোক।”

বলেই চেয়ারে হেলান দিয়ে চোখ বন্ধ করে রইলো প্রহর। বেশ কিছুক্ষণ কেটে গেল। মাথায় হঠাৎ একটা চিন্তা আসতেই ফট করে চোখ খুলে ফেললো সে। রিয়াদের হাত থেকে ফাইলটা নিয়ে আরেকবার দেখলো। চোখ ছোট ছোট করে কিছু একটা পর্যবেক্ষণ করে একটা ছবি দেখিয়ে বললো,

-“তরী! এই মেয়েটার ব্যাপারে সব ডিটেইলস আমার চাই। আজকের মধ্যে ওর সম্পর্কে এ টু জেড জেনে আমাকে জানাবে।”

অরুণী জানালার পাশে আনমনা হয়ে বসে আছে। হাতে একটা বই। অরুণীর বাবা আরমান সাহেব খাবার নিয়ে ঘরে প্রবেশ করে মেয়ের পাশে বসলেন। অরুণী বাবার উপস্থিতি বুঝতে পেরে বইয়ে মনযোগী হয়ে তাকালো।
আরমান সাহেব দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন,

-“বইটা উল্টো ধরে পড়া প্র্যাকটিস করছিস নাকি, অরুণী!”
অরুণী থতমত খেয়ে গেল। বাবার দিকে অবাক চোখে তাকালো।
-“যতই প্রিটেন্ড করিস না কেন যে, তুই বই পড়ছিস! এই বাবার কাছ থেকে লুকাতে পারবি না। আমি সেই ছোট থেকে আমি তোকে নিজ হাতে বড় করেছি। তোকে আমার থেকে ভালো আর কেউ চিনে না রে, মা!”

অরুণীর চোখে আবার পানি জমা হলো। কিন্তু বাবার সামনে সেটা প্রকাশ করার ইচ্ছে নেই। লুকিয়ে চোখের পানি মুছতেই আরমান সাহেব আবার বললেন,
-“সৌহার্দ্য বিয়ে করেছে, এটা আমিও শুনেছি। তুই ওর জন্য কষ্ট পাচ্ছিস? ও যখন তোকে ভুলে গিয়ে আরেকজনের সাথে সংসার করতে পারে, তাহলে তুই কেন ওর জন্য চোখের জল ফেলছিস?”
অরুণী ভা*ঙা কন্ঠে বললো,

-“আমার খুব কষ্ট হচ্ছে, বাবা। আমি সহ্য করতে পারছি না। সৌহার্দ্যকে দোষ দিতে পারছি না আমি। ও আমাকে সত্যি ভালোবাসতো। তবে ওকে কেন আজ দোষী মনে হচ্ছে? আমি পারবো না এভাবে বেঁচে থাকতে, বাবা! আমি পারবো না।”
বলতে বলতে অরুণী ওর বাবার বুকে মাথা রেখে কাঁদতে লাগল। আরমান সাহেব মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বললেন,

-“তোর যতই মনে হোক যে সৌহার্দ্য দোষী নয়! ওর দোষ অবশ্যই আছে। ও তোকে কষ্ট দিয়ে নিজে তো ঠিকই স্বাভাবিক আছে। ওর জীবনকে তো ও থামিয়ে রাখেনও! এদিকে তুই একা একা গু*ম*রে মরছিস!”
-“আমি কীভাবে স্বাভাবিক থাকবো, বাবা? আমার সাথে কেন এমনটা হলো?”

আরমান সাহেব মেয়েকে বুঝিয়ে অনেক কষ্টে খাবার খাওয়ালেন। অরুণীকে অনেক কষ্টে সামলে রেখেছেন তিনি। সৌহার্দ্যের প্রতি রাগ ছিল না তার। রাগ ছিল মূলত সৌহার্দ্যের বাবার ওপর। কিন্তু এখন দুজনের প্রতি-ই ক্ষো*ভ জমা হয়েছে তার মনে। মনে মনে প্রতিজ্ঞা করলেন,
-“তোদের বা*প-ছেলেকে দেখে নেব আমি!”

অনেকগুলো দিন কেটে গেছে। কিন্তু সময়ের সাথে সাথে পরিস্থিতির তেমন কোনো পরিবর্তন দেখা যায়নি।
আজ আকাশটা একটু মেঘলা। বাতাসের বেগ প্রতিদিনের চেয়ে একটু বেশি। দুপুরের দিকে বারান্দায় বসে বসে খোলা হাওয়ায় চুল শুকাচ্ছে আর বই পড়ছে তরী। উপন্যাসের পাতা উল্টাতে ভালোই লাগে তার! চরিত্রগুলোকে জী*ব*ন্ত মনে হয়।

তরীর পাশের বারান্দায় সৌহার্দ্য এসে দাঁড়ালো। দুজনের ঘর পাশাপাশি হওয়ায় বারান্দা দুটোও পাশাপাশি। এক বারান্দা থেকে আরেক বারান্দা স্পষ্ট দেখা যায়। সৌহার্দ্য আশে পাশে তেমন খেয়াল না করেই সি’গা’রে’ট জ্বা*লা*লো। এই অভ্যাসটা আগে থেকেই ছিল তার। কিন্তু ইদানীং এটার মাত্রাটা বেড়ে গেছে। আজকের অপারেশনটা আনসাকসেসফুল ছিল। রোগীটা মা*রা গেছে। রোগীর স্ত্রীর কান্নাটা এখনো চোখে ভাসছে তার।

এই রকম দৃশ্য ডাক্তারদের জন্য খুবই সাধারণ ব্যাপার হলেও আজকে ঘটনাটা মনে লেগেছে তার। সি’গারে’টে টান দিতে দিতে সৌহার্দ্য আজকে কথাগুলোই ভাবছিল।
অরুণীকে প্রায়ই দেখে সে। অরুণী যেই হসপিটালে ইন্টার্নশিপ করছে, সেখানে আজও গিয়েছিল সৌহার্দ্য। অরুণীর সাথে মুখোমুখি দেখা হলেও কথা বলা হয়নি। অরুনীও তার দিকে একবার তাকিয়ে দ্বিতীয় বার তাকানোর প্রয়োজন বোধ করেনি। আচ্ছা মেয়েটা কী তাকে ভুলে গেল?

প্রণয়াসক্ত পূর্ণিমা পর্ব ৪

ভাবনার মাঝেই সৌহার্দ্যের ফোন বেজে উঠল। ওর বাবার নাম্বার থেকে কল এসেছে। মিস্টার রায়হান এই অসময়ে ওকে কেন কল করবে? সৌহার্দ্য কল রিসিভ করতেই অপর পাশ থেকে অপরিচিত কন্ঠে কেউ বললো,
-“এই ফোনের মালিকের অ্যা*ক্সি*ডে*ন্ট হয়েছে। অবস্থা খুব খারাপ। মনে হয় বাঁচ*বে না!”

প্রণয়াসক্ত পূর্ণিমা পর্ব ৬