প্রমত্ত অঙ্গনা পর্ব ৩২

প্রমত্ত অঙ্গনা পর্ব ৩২
আরোহী নুর

ড্রয়িংরুমের সোফায় পায়ের উপর পা তুলে হাত ছড়িয়ে আয়েশ করে বসে আছে রিদিকা,মুখে তার প্রসারিত হাসি।
″আমার পথের সব কাঁটা দূর,এখন আদ্রিশ শুধু আমার,ওকে আমার কাছ থেকে এখন আর কেউ কেঁড়ে নিতে পারবে না,ও একান্তই আমার।

সব কটা পা*গ*ল ছিল,আমি থাকতে আমার আদ্রিশের উপর অধিকার জমাতে এসেছিল।আ*বা*লে*র দল।ওই ডাক্তারটাও পা*গ*ল,আমি না কী আমার শত্রুর সাথে ভাব করব।জানিনা কে এই ভাইরাস আমার শরীরে দিয়েছে কিন্তু যেই দিয়ে থাকুক না কেন আমার হাত থেকে বাঁচতে পারবে না।তৃতীয় ডোজ তো দিতে আসবেই,দেখি কেমনে দিয়ে যায়।রিদিকা এতো সহজে হার মানবার কেউ না।″

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

হাসপাতালে আঁখির কাজ শেষ হয়ে গেলেও আদৃতের কাজ এখনও বাকি,এদিকে বাড়িতে তাড়াতাড়ি যেতে হবে হঠাৎ করে ফোন আসলো মায়ের শরীর খারাপ করেছে অনেকটা।তাই হুটহাট বেড়িয়ে গেল আদৃতকে না বলেই,ফোনে মেসেজ করল।

″ডা.আদৃত, বাড়িতে মায়ের শরীর হঠাৎ অনেকটা খারাপ করেছে আমায় বেড়িয়ে যেতে হলো আর্জেন্টলি, আমি আর আপনাদের বাড়িতে থাকতে পারব না।হয়ত মামুনি রাগ করবে,উনাকে আমি ফোন করে বুঝিয়ে নিব আর কালকে সকালে পারলে একবার ওখানে আসব তারপর ওখান থেকেই আপনার সহিত হাসপাতাল আসব,তাছাড়া আপনার সাথে অনেক কথা আছে গুরুত্বপূর্ণ দেখা হলে বলব।″

আদৃত কাজ সেরে ফোন হাতে নিয়ে আঁখির ম্যাসেজটা দেখতে পেল,আঁখির জন্য বুকের ভিতরটা বড্ড খচখচ করছে তার,আশরাফ খানের আঁখির সাথে এমন ব্যবহার সে মেনে নিতে পারে নি,আঁখির মুখ আজ সারাদিনই বেশ মলিন ছিল,আজকে এতো ব্যস্ত ছিল যে আঁখির সাথে ভালো করে কথাও বলতে পারে নি আদৃত।

আশরাফ খানকে চাইলেও মুখের উপর জবাব দিতে পারত না আদৃত কারণ উনাকে যথেষ্ট সম্মান করে সে।কিন্তু বিষয়টা সয়েও যেতে পারছে না।তাই কিছুটা ভেবে আশরাফ খানের কেবিনের দিকে এগিয়ে গেল,আশরাফ আর আহিল দু’জনেই সেখানে বসে কিছু কাজ করছিলেন তখন,আহিলের মোটেও ভালো লাগে নি তার বাবার আঁখির সাথে এমন ব্যবহার,তবুও বাবার উপর কিছু বলল না।আশরাফ খানও মেয়ের সাথে এমন ব্যবহার করে এখন মনে মনে অনুতপ্ত হচ্ছেন।

″মে আই কাম ইন স্যার?″
″আদৃত মাই বয়,প্লিজ কাম এন্ড সিট। ″
আদৃত বসল,
″তা হটাৎ আমার কেবিনে আসলে,কোনো ইম্পর্ট্যান্ট কাজ?″

″স্যার এদিক ওদিকের কথা বলে আমি বর্তমানে আপনার সময় নষ্ট করতে চাইব না,সোজা কথায় বলতে চাই আপনার আজকে আঁখির সাথে করে যাওয়া ব্যবহারটা আমার ঠিক মনে হয় নি,আমরা সবাই জানি আঁখি নিজের দায়িত্ব নিয়ে কতটা সিরিয়াস,আজকে আপনি হুট করে মিটিং ডেকেছেন এতে তখন যেকোনো ডাক্তার নিজের কিছু প্রয়োজনে হাসপাতালের বাইরে থাকতেই পারত,এটা বড় কিছু ছিল না।″

″আমাকে আমার কাজ শিখাতে এসো না আদৃত।″
″না স্যার তা করার কথা আমি ভাবতেও পারি না,আপনি আমার গুরু।কিন্তু আমার যা সঠিক মনে হয়েছে সেটা বলেছি বাকিটা আপনি ভালো জানেন।হয়ত আঁখি একটা ভুল করে গেছে কিন্তু তার মাসুল যে তাকে জীবনভর দিতে হবে তেমন তো কিছু নয়,আঁখি আপনাদের ছাড়া কতটা পীড়ায় আছে তা জানলে হয়ত কখনই আঁখিকে দূরে ঠেলে দিতেন না।বাচ্চারা ভুল করতেই পারে স্যার তবে মা বাবা কি পারেন না বাচ্চাকে সে ভুল শোধরে নেওয়ার একটা সুযোগ দিতে।বিষয়টা ভেবে দেখলে খুশি হবো স্যার।আমার কথায় খারাপ লাগলে ক্ষমা করে দিবেন।চলি তাহলে।″

আদৃত উঠে চলে গেলে আহিল বলল।
″বাবা ভুল না হয় আঁখি করেছে তাই বলে কি ক্ষমা করা যায় না তাকে?″
আশরাফ খান কিছুই বললেন না আহিলের কথার উত্তরে,শুধুই নিরবতা পালন করে গেলেন।
বাড়িতে এসে মায়ের চেক আপ করল আঁখি,শরীর অত্যন্ত দূর্বল উনার,তাছাড়া অতিরিক্ত চিন্তায় শরীর আরও খারাপ করেছিল,আঁখি উনাকে ওষুধ খাইয়ে ঘুম পাড়িয়ে দিল।

রিদিকা আসলো আঁখির কক্ষে একটা মাথার ব্যাথার ওষুধ নিবে বলে হঠাৎ তার মাথা অত্যন্ত ধরেছে,আঁখি তাকে বসিয়ে রেখে পাশের ওয়্যারড্রোবের ড্রয়ার খুলে ওষুধের বাক্স বের করতে নিলে সেদিন এর আঁখির আনা অজ্ঞাত জনের কাঠিটাও সাথে বেড়িয়ে আসে,যা বেড়ুতেই ফ্লোরে পরে যায়,শুভ্রতার চোখ যায় সেদিকে।

″আরে আঁখি তুমিও একই কাঠি কিনেছ?।″
″একই কাঠি মানে আপু?আর কার কাছে দেখেছ কাঠিটা?″
″আরে রিদিকার কাছেও সেইম কাঠি আছে।″
″তুমি শিওর?এক দেখাতে কি করে চিনলে?″

″আরে চিনব না,এই কাঠি নিয়ে যা তা,সারাদিন এটাই পরে থাকত রিদিকা,অনেক পছন্দের ছিল ওঠা তার,সেদিন হঠাৎ খুঁজে পাচ্ছিল না বলে আমাকে না জানি কতো দোষারোপ করেছিল,কতো কথা শুনিয়েছিল,তারপর নিজেরই কক্ষের এক কোণে পরে থাকতে পায়।″
″সে কাঠিটাকে কি তুমি পাশ থেকে দেখেছ,মানে এমন কাঠি তো অনেকেই কিনতে পারে কিন্তু রিদিকার টা কি তুমি আলাদা ভাবে শনাক্ত করতে পারবে?

″হ্যাঁ, পারব,কারণ ওর কাঠিটা সেদিন খোঁজে পেলেও মাথার দিকটা অল্প ভাঙা পায়,হয়ত রিহানই খেলা করে ভেঙে দিয়েছিল।″
″দেখো তো এটা কি না?″
আঁখি শুভ্রতার সামনে নিয়ে কাঠিটা ধরলে এক মুহুর্তে চিনে ফেলে সে।
″হ্যাঁ এটাই তো,তুমি কি করে পেলে এটা!″
″এটা অনেক লম্বা গল্প আপু পরে বলব।″
মুখে রহস্যময়ী হাসি ফুটিয়ে বলল আঁখি।শুভ্রতা বুঝে উঠতে পারল না সে হাসির মানে।

আদৃত পাগলের মতো ডায়েরিটা খুঁজে যাচ্ছে।
″মা,মা,কোথায় তুমি?আমার ডায়েরি কোথায় গেছে?″
″আরে কি হয়েছে এতো চেঁচাচ্ছিস কেন?তোর জ্বালায় ঘরে থাকতে পারছি না?″
″আমার ডায়েরি কোথায়?″

″আমি জানি কী?না জানি বাবা কি হয় এসব লিখে!আগের যুগে লোক স্কুলের খাতা ছিড়ে চিঠি পাঠাত ভালোবাসার মানুষকে আর এখন ডায়েরিতে ভরে ভরে লিখে রেখে দিয়ে যে কি পায় পোলাপাইন!″
″মা তুমি বলবে কোথায় আমার ডায়েরি?″

″আমি জানি না রে বাবা,তা তোর জন্য এমন কিছু এনেছি যাকে দেখে তোর ডায়েরির ভুঁত মাথা থেকে নেমে যাবে।″
″আবার কোনো মেয়ের ছবি এনে থাকলে বলে দাও এখনই আমেরিকার টিকিট বুক করাব।″
″আরে একে রেখে কি কখনও আমেরিকা যেতে পারবি!এর জন্যই তো ছয় বছর বনবাস কাটলি,কি মনে করিস আমি কিছুু বুঝি না?″

আদৃতের সামনে আঁখির ছবি টাঙিয়ে বললেন শায়েলা মির্জা।অবাক হলো আদৃত।
″আঁখি।″
″হ্যাঁ আঁখি,মনে হয় তুই রাজি না,বাদ দে।চির কুমারই থাক তুই।″
মশকরা করে শায়েলা মির্জা চলে যেতে নিলে আদৃত উনাকে আটকালো।
″আরে আরে কোথায় যাচ্ছো মা,কে বলল আমি বিয়ে করব না!″
″মানে করবি?″
″ইয়ে মানে, হ্যাঁ।″

শায়েলা মির্জার ভ্রু উঁচানো কথার জবাবে আমতা করে মাথার পিছন দিক চুলকিয়ে সম্মতি জানাল আদৃত,শায়েলা মির্জা খুশিতে আত্নহারা।
″এই না হলে আমার ছেলে,দেখ তোর মা এখন তোর বিয়ে কীভাবে করায়।″
″কিন্তু মা এতে সমস্যা আছে,আমার মনে হয় না আঁখি মানবে বলে,কারণ ওর সদ্য ডিভোর্স হয়েছে।আমি চাই না এখন এসব নিয়ে ওর সাথে কিছু কথা বলা হোক,কিছুদিন যেতে দাও আমি নিজেই ওর সাথে কথা বলে নিব।″

″বুঝেছি,বাচ্চাদের মুখে বাবা ডাক শোনার জায়গায় দাদা ডাক শোনার ইচ্ছে হয়েছে তোর।″
″মানে!″
″মানে খুব সোজা,তোর হাতে ছেড়ে দিলে আরও একযুগ না পার করে দিবি আঁখিকে মনের কথা জানাতে,ছয় বছর আগে সঠিক সময়ে সঠিক সিদ্ধান্ত নিলে আজকে নাতি নাতনী আমার কোলে থাকত।তুই জায়গায় বসে থাক,তোর মা তোর বিয়ে আঁখির সাথে করিয়েই দম নিবে।″

আদ্রিশ কক্ষ ছেড়ে কোথাও বেরুবে তখনই রিদিকা কক্ষে প্রবেশ করে গেল,আদ্রিশ তাকে দেখে চমকে যায় অনেকটা।
″কি হয়েছে আদ্রিশ?″
″তোমার কি হয়েছে?কেমনটা দেখাচ্ছে তোমায়,কানের উপরের দিকে অনেকটা চুল উঠে এসেছে কি করে?″
আদ্রিশের কথায় রিদিকা ছোটে যায় আয়নার সামনে,দেখে ঠিকই তার একপাশের চুল অনেকটা উঠে এসেছে সে বুঝতেই পারে নি।

″কি হয়েছে রিদিকা?এমনটা হলো কেন?″
রিদিকা বুঝতে পারল বিষয়টা আদ্রিশের সামনে আসা থেকে ও আটকাতে পারবে না,তাই বলে দেওয়া উত্তম বলে মনে করল।সবকিছুই বলে দিল রিদিকা যা ওকে ডাক্তার বলেছেন।কথাগুলো শুনে আদ্রিশ একপ্রকার হেসেই দিল।″

″কি যে বলো রিদিকা,তোমাকে কেউ ভাইরাস কেন দিবে?তুমি কতো কিউট এন্ড সুইট,হয়ত ডাক্তার তোমার রোগের কোনো নাম খুঁজে না পেয়ে ভুলভাল কিছু বুঝিয়ে দিয়েছে তোমায়।তুমি চিন্তা করো না আমি তোমাকে অন্য বড় ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাব,সত্যিই তোমাকে এভাবে কেমন জানি লাগছে।তা আমি আজকে বাইরে যাচ্ছি, বন্ধুদের সাথে আড্ডা দিব মাইন্ডে ফ্রেসনেস চাই আমার।এমনিই আঁখিকে নিয়ে অনেক টেনশনে আছি,কাল সকাল অব্দি নতুন কাজের লোক এসে যাবে তুমি থাকো আমি চলি।″

কথাগুলো বলে আদ্রিশ চলে গেল।রিদিকা রাগে পাশের ড্রেসিংটেবিলে লাথি দিল সজোরে।
″আমি অসুস্থ জেনেও এভাবে চলে গেল আর ওই আঁখি অসুস্থ হলে তো ঘর মাথায় তুলে নিত,আঁখিকে নিয়ে এখনও ভাবছে।তুমি জানো না আদ্রিশ তুমি কতো বড় ভুল করে গেছ।তুমি আমাকে জীবনে জড়িয়েছ আর আমাকে নিয়েই থাকতে হবে সে আমি যেমনই হই না কেন।তুমি শুধুই আমার।আর আমার না হলে কারো না।
আই লাভ ইউ আদ্রিশ,আই লাভ ইউ।″

আদৃতের ডায়েরি পড়তে মত্ত হয়েছে আঁখি,ডায়েরির প্রতি পৃষ্ঠায় শোভা পেয়েছে আদৃতের আঁখির সাথে কাটানো সকল মুহুর্তে, তার বিহনে বিরহ তিথী কাটানো আখ্যান,লেখনীর মাধুর্যে ফুটে উঠেছে তা নিঁখুত ভাবে।আমেরিকা থাকাকালীন সময় থেকে নিয়ে দেশে ফিরে আঁখির সাথে কাটানো সকল ক্ষণ সেখানে আলাদা মানে ছেঁয়ে আছে।

″প্রিয়সী তোমার স্মৃতিতে কাটালাম আর এক দীর্ঘ রাত্রী,হয়ত শুয়ে আছে অন্যের বাহুতে,তবে তোমারই বিহনে বিরহ যন্ত্রণা যে সঙ্গ নিয়েছে এই অধমের।″
″আজ এ কি হল আমার!সেই পুরাতন অনুভুতি আঁকড়ে ধরলো আচমকা,
সুখপাখির সেই কান্নামিশ্রিত স্বর আবারও উতলা করল এ মন।″

″যদি পারতাম পাখি নিঃস্ব করে দিতাম সে জন,যে করেছে তোকে নীড়হারা,মিছে পীরিতে গলিয়েছে তোর মন,করেছে আমাকে কাঙাল।″
″আশ ফিরে পেলাম সুখ,তোকে পাব কোনো ক্ষণে,আবারও ফাঁসব তোর কথার জ্বালে,আড়ালে হাসব ইচ্ছে করেই তোর কাছে হার মেনে।″
দু’দিন আগের লিখা।

″ভালোবাসি সুখপাখি তোমায়,আজও মনের গহীন থেকে।ফিরে আসো না কো,কথা দিলাম নিরাশ করব না কবু।
ভালোবাসব মনের গহীন থেকে,আগলে রাখব প্রাণ দিয়ে…″
এমনই অজস্র লিখা আদৃতের ডায়েরি জুরে আঁখিকে নিয়ে।যা স্পষ্ট প্রমাণ করে আদৃত এখনও আঁখিকে ততটাই ভালোবাসে যতটা ঠিক ছয় বছর আগে বাসত।আর যাই হোক এই মানুষটা কখনও তাকে ঠকাতে পারে না,আদৃত যে শুধুই আঁখিকে ভালোবেসে গেছে।আঁখির মনে জন্মালো আবারও এক আশার আলো,জীবনে প্রথম ভালোবাসার প্রেমে যেন আজ আবার নতুন করে পরল।ডায়েরিটা পড়তে গিয়ে আঁখির চেহারাতে ঝলকালো সুখের হাসি।

প্রমত্ত অঙ্গনা পর্ব ৩১

রিদিকা বাড়ির দরজা জানালা সব কিছু শক্ত করে লাগিয়ে নিয়েছে,বাড়ির সকল দিক নিজে ভালো করে দেখে নিয়েছে।
″হুম,যেই আসুক,আসবে তো কখনও আমায় তৃতীয় ডোজ দিতে,তবে সে তো জানে না রিদিকা কি জিনিস,যাদের উপর সন্দেহ ছিল সবকটাকে তাড়িয়ে দিয়েছি,এবার দেখি আসে কে।″
রাত ২ টা,আদ্রিশের বাড়ির পিছন দিকে দাঁড়িয়ে আছে হুডিওয়ালা কেউ একজন।

প্রমত্ত অঙ্গনা পর্ব ৩৩